প্রতিশোধের আগুনে
দীপালি ইন্ডিয়ান অয়েলের অফিস থেকে বেরোচ্ছিল, সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম গেছে, ক্লান্ত শরীরে সবেমাত্র তার স্কুটারে বসে বোতাম টিপে গাড়িটা চালু করেছে, অ্যাক্সেলেটর চেপে সামনে এগোতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে একটা মোটরবাইক প্রায় উল্কার গতিতে এসে ওকে বাঁদিক চেপে একটা সজোরে ধাক্কা দিয়েই বেরিয়ে গেল। দীপালি স্কুটার সমেত মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তার ধারের কাদায়, ওর চশমাটা ছিটকে গেল দূরে, হাতের ফাইলব্যাগটা থেকে কাগজপত্রগুলো বেরিয়ে গিয়ে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।
এতবড়ো একটা ইচ্ছাকৃত কাণ্ড ঘটে গেল, কিন্তু সেভাবে রাস্তার কেউ তেমন কৌতূহল দেখাল না বা ছুটেও এল না। অবশ্য আজকাল কেই বা সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসে! প্রত্যেকে নিজের জীবন, নিজের কাজ, নিজেকে নিয়েই বড় ব্যস্ত। শুধু দূর থেকে তাকাতে তাকাতেই দীপালির পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল তারা। দু-চারজন দাঁড়িয়ে ফিসফাস করল, কিন্তু এগিয়ে এল না।
শুধু ইন্ডিয়ান অয়েলের প্রধান গেটে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ড দুজন ছুটে এল এদিকে, তারা এক-দিনে বেশ চিনে গেছে দীপালিকে। তারাই ধরে ধরে তুলল।
একে ভাদ্র মাসের প্যাচপেচে গরম, তার ওপর খাঁ খাঁ রোদ। দীপালি কোনোমতে বুকে ভর দিয়ে উঠল, হাতড়ে হাতড়ে কাগজগুলো গোছাল, তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে বসল সামনের ফুটপাথের চওড়া জায়গাটায়। ছিটকে পড়লেও লাগেনি তেমন ওর, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটার সামনের দিকটা শুধু ছড়ে গেছে, আর কোমরের পেছনটাও ব্যথা করছে।
একটা সিকিউরিটি গার্ড ওর স্কুটারটাকে ধরে ধরে নিয়ে এল সামনে, আরো কিসব বলে যাচ্ছিল, গাড়িটার নম্বর দীপালি দেখতে পেয়েছে কিনা, আগে থেকে ওকে ফলো করছিল কিনা। দীপালির কানে কিছু ঢুকছিল না।
অপমানে ওর চোখে হঠাৎ জল এসে গেল হু-হু করে! নীল কালো হেলমেটের আড়ালে থাকলেও সঞ্জয়ের হাল্কা খয়েরি ফ্রেঞ্চকাট প্যাটার্নের দাড়ি চিনতে ওর ভুল হয়নি একটুও! এইরকমের দাড়ি রাখলে যে সঞ্জয়কে ভালো লাগে, সেটা একদিন দীপালিই বলেছিল ওকে। কোথায় সেটাও ওর পরিষ্কার মনে আছে, হানিমুনে শিলং গিয়ে, গলফ কোর্সের মাঠে দুজন পাশাপাশি বসে।
এতটা প্রতিহিংসা?
দাঁড়াও না, যত হিংসে করবি, তত জ্বলবি, তোর ওই পেট্রোল পাম্প আমিই একদিন কিনে নেব, মনে মনে কথাগুলো বলে দাঁতে দাঁত চিপল দীপালি।
মিনিট দশেক বসে থেকে ও উঠে দাঁড়াল। স্কুটারটার কিছু হয়নি তেমন, দু-এক জায়গায় রঙ চটে যাওয়া ছাড়া। তবে কাদায় পড়ে নোংরা হয়ে গেছে পুরো। ইচ্ছে করেই আর ইন্ডিয়ান অয়েলের অফিসের ভেতরে ও ঢুকল না, সামনের কর্পোরেশনের কল থেকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল, তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।
দু-চাকা চালানোর অভ্যেস অনেকদিন ছিল না দীপালির। মাঝে এই ক-বছর গাড়িতেই যাতায়াত করত তো! ওদের সাধের কেনা ছোট্ট হুন্ডাইটায়। তবে মাস সাতেক আগে যখন আবার দু-চাকা চালানো শুরু করেছিল তখন অসুবিধা হয়নি একটুও। বিয়ের আগে তো এই স্কুটার চালিয়েই অফিস থেকে বাজার, হিল্লিদিল্লি করে বেড়াত। মা আর মেয়ের সংসার, ও না করলে করার ছিলটাই বা কে! হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের ডালহৌসির সদর দপ্তরেই পোস্টিং ছিল ওর। তখন পাতি রিসেপশনিস্টের চাকরি। আর সেখানেই ওর দেখা হয়েছিল সঞ্জয়ের সঙ্গে।
একটা গর্ততে সামনের চাকাটা পড়তে পড়তেও শেষ মুহূর্তে কাটিয়ে নিল দীপালি। সঞ্জয় তখন ওর ডিলারশিপের লাইসেন্স বের করা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। দীপালিদের অফিসে দিনের পর দিন বলতে গেলে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত সঞ্জয়। একেই পেট্রোল পাম্পের ব্যবসা মানেই সেখানে লাখ লাখ টাকা ড্রয়ারের তলা দিয়ে পাস না করলে লাইসেন্স তো দূর, ভালো রেফারেন্স না থাকলে কর্তারা কথাই বলতে চাইতেন না, তার ওপর সঞ্জয়ের না ছিল সেই লেভেলের আর্থিক জোর, না ছিল জবরদস্ত কোনো চ্যানেল। পার্টির কোনো নেতার সাথেও তেমন দহরম-মহরম ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একটা ঠিকঠাক জমি আর মোটামুটি একটা পুঁজি। তা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা গেলেও শুরু করার জন্য যেসব সরকারি নিয়মের বেড়াজাল ডিঙোনো প্রয়োজন, সেগুলো টপকানো যায় না মোটেই।
কর্তারা ওকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতেন লবিতে, তখন গল্প হত দীপালির সঙ্গে। ইয়ং একটা ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, নিজের অজান্তেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল দীপালি। অফিসের বসেদের বলে কয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই সঞ্জয়ের ব্যবসা শুরু করার যাবতীয় কাগজপত্র বের করেছিল ও।
বছরখানেক বাদে ওরা যখন বিয়ে করে, তখন সঞ্জয়ের পেট্রোল পাম্প বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। সঞ্জয়ের বলা অবশ্য ভুল হল, দীপালি মনে মনে ভাবল, একে ওই চত্বরটার কাছেপিঠে অন্য কোনো পেট্রোল পাম্প নেই, সেখানে দীপালি একজন মেয়ে হয়ে পুরো পাম্পটার দেখভাল করত, এটাও অনেকের কাছে বেশ নতুনত্বের ব্যাপার ছিল, দীপালির প্রতিটা কাস্টমারের সাথে ভালো ব্যবহারও ছিল একটা প্লাস পয়েন্ট।
বরং সঞ্জয় পাম্পে থাকতোই না প্রায়। গভর্নমেন্টের দপ্তরে নিয়মমাফিক হফতা জমা দেওয়া, প্রতিদিনের পেমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে ডিমান্ড ড্রাফট করিয়ে কোম্পানিতে পাঠানো এসব অফিশিয়াল দিকগুলো দেখা ছিল ওর কাজ। আর পাম্পে পাঁচজন ছেলেকে নিয়ে রোজকার তেল এলে ট্যাংক খোলা, পলিউশন চেক, কাস্টমার সার্ভিস এসব সামলাত দীপালি।
বিয়ের পর দায়িত্ব আরো বেড়ে গিয়েছিল। সকাল সকাল বাড়ি থেকে স্নান-টান করে বেরিয়ে পড়ত ওরা দুজন, তারপর এ এদিকে ও ওদিকে। প্রথমে বারো হাজার লিটারের একটা ট্যাংক লিজ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল তেল কোম্পানির থেকেই, পরে ওরা নিজস্ব কুড়ি হাজার লিটারের ট্যাংকও কিনে ফেলেছিল একটা।
ভাবতে ভাবতে দীপালি হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায়, বাড়ির গলিতে কখন ঢুকে পড়েছে ও খেয়ালই করেনি।
গত কয়েকমাস ধরে এখানেই থাকে ও। মা চলে গেছে একবছর আগেই, আপাতত এই নিঃসঙ্গ জীবনে ওর কেউ নেই। বেশ হয়েছে কেউ নেই, দুজন পশুর মতো কামড়াকামড়ি করে একসাথে থাকার চেয়ে মানুষের মতো আলাদা থাকা অনেক বেশি সম্মানের, অনেক বেশি শান্তির। সুখ না থাকুক তাতে, স্বস্তি তো আছে! কিন্তু ওর ক্ষতি করার জন্য এমন উঠে পড়ে লেগেছে কেন সেটা ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।
কালীপুজো পর্যন্ত কি দীপালিকে বাঁচতে দেবে না সঞ্জয়? ব্যবসায়িক রেষারেষিতে এতটা হিংসা, এতটা ক্ষতি করা যায় একসময়ের ভালোবাসার মানুষের?
কি জানি! ক্লান্ত শরীরে বাথরুমে ঢুকে মাথার ওপর শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভাবল দীপালি, হয়ত সবটাই ছিল একতরফা! ব্যবসার প্রতি জন্মগত একটা প্রতিভা ছিল দীপালির। অভাবের সংসারে টুকটাক শাড়ির ব্যবসা, দৈনন্দিন জিনিষপত্র, কিংবা এল আই সি-র এজেন্সি, যখন যেটা করেছে, নিজের মিষ্টি ব্যবহারের জন্য সাফল্য পেয়েছে ঝটপট। সেইটাকে মূলধন করেই কি উঠতে চেয়েছিল সঞ্জয়? নাকি দীপালির পাক্কা বিজনেস বোঝা স্ট্র্যাটেজিকাল বুদ্ধিটাকে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল ও! কিন্তু তাই যদি হবে, তবে দিনের পর দিন খুঁটিনাটি কারণে সঞ্জয় অতটা হিংস্র হয়ে উঠতে থাকল কেন? তার পেছনে কি শুধুই মেল ইগো? নাকি অন্য কিছু?
দীপালি চোখ বন্ধ করে জলের স্বাদ নিতে নিতে ভাবল কি আর হবে এসব ভেবে! বিয়ের পর প্রথম বছর দুই বেশ ভালোই কেটেছিল, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেদের এই ব্যবসাটাকে চালিয়ে যখন দুজনে বাড়ি ফিরত, তখনো দুজনের হাসি অম্লানই থাকত। সঞ্জয় হাতে হাতে এগিয়ে দিতো, দীপালি রান্না করত। তারপর আস্তে আস্তে সমৃদ্ধি বাড়তে লাগল, সংসারে আসতে থাকল সাচ্ছন্দ্য। আর তার সাথে সাথেই সঞ্জয় কেমন যেন পালটে যেতে লাগলো। কারণে অকারণে জিনিসপত্র ভাঙচুর, চিৎকার চেঁচামেচি, শেষে দীপালির গায়ে হাত। আসল কারণটা অবশ্য ধীরে ধীরে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল দীপালি, নিজের ব্যবসা যদি সবাই অন্যের নামেই চিনতে থাকে, ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়তে থাকে শুধু তার ব্যবহারের জন্য, তবে ক-জন সইতে পারে? হোক সে সহধর্মিণী! লোকাল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এরকম পুরুষসর্বস্ব সেক্টরে দীপালির সাকসেসকে হাইলাইট করে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল, ছোটখাটো অন্ত্রেপ্রেন্যরশিপ ট্রেড ফেয়ারে দীপালির নামেই ইনভাইটেশান কার্ড আসতে থাকছিল বারবার, সঞ্জয় ওপর ওপর খুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন ক্রুদ্ধ সাপের মতো গর্জাচ্ছিল, যার প্রতিফলন হচ্ছিল ওর বন্ধ ঘরের মধ্যের ব্যবহারে, স্বামীত্ব ফলিয়ে দাবিয়ে রাখতে চাইছিল দীপালিকে।
সহ্য অনেক করেছিল দীপালি, অন্তত লক্ষবার বুঝিয়েছে ও সঞ্জয়কে, নরম গরম সবরকম ট্রিটমেন্টই করেছে, লাভ হয়নি কিছুই। সাময়িক শান্ত হয়েছে সঞ্জয়, তার কয়েকদিন পরেই যে কে সেই। তাও সহ্য করছিল দীপালি, যতটা না সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে, তার চেয়ে অনেকটাই বেশি পাম্পটার প্রতি মমত্ববোধে। কিন্তু শেষে সঞ্জয় যখন পাম্পে আসা কাস্টমার, অন্য সাবডিলার, এমনকি পাঁচটা কর্মচারীকে নিয়ে পর্যন্ত অযৌক্তিক নোংরা কথা বলতে শুরু করলো তখন দীপালি আর মানতে পারেনি।
আজ তাই দীপালি ভাবে, যে মানুষটা সম্পর্ক থাকার সময়েই এত অত্যাচার করেছে, সেই যদি দ্যাখে তার প্রাক্তন স্ত্রী এখন সবচেয়ে বড় রাইভ্যালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার কাছাকাছি জায়গায় পেট্রোল পাম্প বসিয়ে তার সব কাস্টমারদের সব টেনে নিয়ে ভাত মারার জোগাড় করতে লেগেছে, তখন সে তো তার এত বড় শত্রুকে যে কোনোমতে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করবেই!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দীপালি চিন্টুকে ফোন করল। যতই ওর ফাঁড়া যাক না কেন, আজ একটা বড় কাজ হয়েছে। লাইসেন্স আগের সপ্তাহতেই পেয়েছিল। কিছুটা ওর আগের অফিসের রেফারেন্সে আর অনেকটাই ওর সুখ্যাতির জেরে। ইন্ডিয়ান অয়েলের ইস্টার্ন জোনের জেনারেল ম্যানেজার মি. শ্রীবাস্তব তো আজ রীতিমতো একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেলেছিলেন দীপালিকে ডিলারশিপ দেওয়া উপলক্ষে। বারবার বলছিলেন ডিলারশিপ অনেক মহিলাকেই দিয়েছেন ওঁরা, কিন্তু সেগুলো সবই বকলমে তাঁদের স্বামীদেরই করায়ত্ত। সেই মহিলারা শুধু এই দিনটায় এসেছেন, স্বামীর শিখিয়ে দেওয়া পুতুলের মতো সই করেছেন, তারপর বাড়ি ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিজেদের কাজে। দীপালির মত সত্যি মালকিন তাঁরা কাউকে পাননি।
চিন্টু সব শুনেই বলল, ‘সে কি গো দিদি! থানায় যাবে তো?’
দীপালি বলল, ‘নাহ! ওসব আর করতে হবে না। তোকে এমনি জানালাম ঘটনাটা। সোমবার দিবাকর জয়েন করুক, কালীপূজোর দিন ট্যাঙ্কের উদবোধনটা ভালোয় ভালোয় মিটুক, এখন অনেক কাজ হাতে।’
চিন্টু বলল, ‘না না! একেই আমরা সবাই তোমার এখানে চলে এসেছি বলে সঞ্জয়দা পাগলের মতো করছে। ওদিকে হাটতলার মোড়ে মোটা টাকা অ্যাডভান্স করে দিয়েছে বিয়েবাড়ি হলের জন্য, সেটাতেও অনেকটা টাকা আটকে গেছে। তার ওপর ওই পাম্পের আসল মাথা দিবাকরদাও যে এই সপ্তাহটা করেই ছেড়ে দেবে, সেই খবরটা পেলে কি করবে ভাবতে পারছ? আমার তো মনে হয়, পুলিশে তোমার একটা সেফটির জন্য ডায়রি করে রাখা ভালো দিদি।’
দীপালি একটা নিশ্বাস ফেলল।
সত্যি! সঞ্জয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছিল। মায়ের এই একচিলতে বাড়িটুকু ছাড়া কিছুই ছিল না ওর। চুপচাপ চোখে শূন্যতা নিয়ে ভাবত কিভাবে চালাবে ও। সঞ্জয় যে আর ফিরে আসবে না, সেটা ও খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল। সম্পর্কটারও কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আর, একরাশ তিক্ততা ছাড়া।
প্রথমে ভেবেছিল ওর জীবন শেষ, জীবনের একটা বড় সময় ও যে জিনিসটার অধ্যবসায়ে কাটিয়েছে, সেটাই ওর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর তো কিছুই জানে না ও। কিন্তু সময় এমন একটা জিনিস, সময়ের সাথে সব দুঃখই ভুলিয়ে দেয়, সব জিনিসকেই অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখায়। দীপালি আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিল, ও যাতে পারদর্শী ছিল, সেটাকেই অস্ত্র করে ওকে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য।
এই বাড়িটা বন্ধক দিয়ে জমি কেনা, ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে আস্তে আস্তে এই ক-মাসে সত্যিই ওর স্বপ্নের পেট্রোল পাম্পকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে ও। সঞ্জয়ের থেকে বেশি দূরে নয়, এই মাইলখানেক। একই কোম্পানির ডিলারশিপ এত কাছাকাছি নেওয়া যায় না বলে বাধ্য হয়ে ওকে ইন্ডিয়ান অয়েল থেকে নিতে হল। এতদিন কোম্পানির কাছ থেকে লিজে ট্যাঙ্ক নিয়ে চালাচ্ছিল, তাতে লাভের টাকা খুব একটা থাকেই না প্রায়, অবশেষে ওর নিজের ট্যাঙ্ক কাজ করা শুরু করবে কালীপূজোর দিন থেকে।
চিন্টু ওপাশ থেকে ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল, ‘আসলে তোমার এই প্রতিশোধটা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না দিদি! দগ্ধে দগ্ধে মরবে দ্যাখো না! দিবাকরদা ছাড়লেই ও পুরো শেষ হয়ে যাবে।’
দীপালি হঠাৎ চমকে উঠল। সত্যিই কি ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে সঞ্জয়ের ক্ষতিই করতে চাইছে বেশি? নাকি সবাই সেটাই ভাবছে যে ও রিভেঞ্জ নিচ্ছে! কিন্তু ও তো নিজের মুক্তির জন্য লড়াই করছিল, সেটা কি ওর অবচেতনেই প্রতিশোধের পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
ওর চোখে বহুদিন বাদে জল এসে গেল হঠাৎ, কিন্তু ওদের পাঁচবছরের দাম্পত্য জীবন, সেই সময়টুকুর স্মৃতিটা তো মিথ্যে নয়! ওদের প্রথম ভালোবাসা, খুনসুটি, একটু একটু করে সাজিয়ে তোলা সংসার, সবই তো একেকটা ভালো স্মৃতি, হোক বা আজ তা মৃত। সেদিনগুলোর অনুভূতিতে তো কোনো ফাঁকি ছিল না। তবে ও কেন ক্ষতি করবে সঞ্জয়ের?
ফোনটা রেখে দীপালি ভাবল, সঞ্জয় কি তাহলে রিভেঞ্জের জন্যই এতকিছু করছে? এককালের ভালোবাসা ছাপিয়ে এখন প্রতিশোধস্পৃহাটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ওর কাছে? নাকি পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে এমন উল্টো পরাজয় মানতে পারছে না কিছুতেই।
ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে রইল দীপালি। তারপর বহু মাস পর সঞ্জয়ের ফোনে সমস্ত মান অভিমান রাগ মুছে ফেলে একটা মেসেজ করল, ‘আমাদের দুজনের প্রথম ভালোবাসা ওই পেট্রোল পাম্পটাই। তুমি আমাকে অধিকার না দাও, তবু ওটাই আমাদের সন্তান। ভালো করে মাথা ঠান্ডা রেখে তাকে বড় করো। আমিও একটা নতুন শুরু করেছি, শুভেচ্ছা পাঠিও। ভালো থেকো।’
সঞ্জয় একদিন নিশ্চয়ই ঠিকই বুঝবে!
মেসেজটা পাঠিয়ে একমুহূর্ত ইতস্তত করল দীপালি, তারপর ফোনটা নিয়ে ডায়াল করল দিবাকরকে, ‘দিদি বলছি দিবাকর। তুমি সঞ্জয়ের ওখানেই থাকো ভাই। ওর তোমাকে দরকার। বাকি তো সবাই এখন ওর ওখানে আনকোরা, তুমি চলে এলে বিপদে পড়বে।’
দিবাকর হঠাৎ এমন উল্টো সুর শুনে অবাক, এই দীপালিই দিনের পর দিন ওকে ফোন করে বুঝিয়েছে এই নতুন পাম্পে চলে আসার জন্য, আর এখন পুরো উল্টো কথা বলছে? সে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে জিগ্যেস করল, ‘কি বলছ দিদি! চিন্টু এই ফোন করেছিল, তোমায় নাকি সঞ্জয়দা ধাক্কা মেরেছে!’
দীপালি বলল, ‘ওসব ছাড়ো। তুমি ওর ওখানেই থাকো বুঝলে?’
দিবাকর অস্ফুটে বলল, ‘তুমি এখনো তার ভালো ভাবছ?’
দীপালি ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ভালো খারাপ কিছুই ভাবছি না। তবে ও খারাপ করেছে বলে আমিও ওর কোনো খারাপ করতে চাই না। চোখের বদলে চোখ নিতে হলে তো গোটা পৃথিবীটাই একদিন অন্ধ হয়ে যাবে।’
দীপালির মুখে হাসি ফুটে উঠল, ‘কিছুই ভুলিনি ভাই। ভালো খারাপ সবই মনে আছে। কেউ অন্যের ক্ষতি করে আনন্দ পায়, কেউ তাকে ক্ষমা করে। প্রথমটায় তৃপ্তি আছে জয়ের, কিন্তু আনন্দ নেই। আর দ্বিতীয়টাই আনন্দ আর শান্তি দুটোই!’