তিতলির বাবা-মা
তিতলি অধৈর্য হয়ে বারবার ওর সাধের রোলেক্স ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল। তিনটে বেজে দশ মিনিট, এখনো কোনো অ্যানাউন্সমেন্ট শো করছে না ডিজিটাল বোর্ডে, এদিকে আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে শিডিউলড টাইম পেরিয়ে যাওয়ার পরেও। এয়ারপোর্ট লবিতে বেশ ভিড়, অথচ গ্রাউন্ড ক্রু-রাও কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছেন না।
হলটা কি?
এইরকম তো হয় না!
এদিকে বাইরে না বেরলেও ও বেশ বুঝতে পারছে, তাপমাত্রা ধীরে ধীরে শূন্যের নীচে চলে যাচ্ছে। ইশ, ভেবেছিল বিকেল বিকেল বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে, এমনিতেই ঠাণ্ডার ধাত বাবার, কিন্তু সেই সন্ধে হয়ে যাবে পৌঁছতে পৌঁছতে। তার মধ্যে বরফ পড়তে শুরু করলে তো সোনায় সোহাগা!
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ও আর পারল না, ফোন লাগালো প্রতিমকে, ”কিগো, দেখা পেলে?”
ওপাশ থেকে প্রতিমের বিরক্তি মাখানো গলা শোনা গেল, ”আরে, লন্ডনে নাকি ব্লাস্ট হয়েছে, সব ফ্লাইট তাই ডিলে হয়েছে। তোমার কি খবর?”
তিতলি বেজার মুখে উত্তর দিল, ”এখানেও তাই। কিছুই বলছে না।”
অথচ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরেই ওরা দুজন যখন দু’দেশের দিকে রওনা দিয়েছিল, তখন মনে কত উত্তেজনা ছিল। প্ল্যানের পর প্ল্যান সাজিয়ে বেরিয়েছিল ওরা।
পাক্কা সাড়ে তিন বছর পর বাবাকে দেখবে তিতলি, আর মা-কে? চারবছর পর! মা-কে শেষ দেখা সেই বিয়ের পর প্রণাম করতে গিয়ে। মায়ের কাছে ছিল তখন ওরা দু-জন কয়েকদিন। মনটা কেমন খুশিতে ভরে ছিল সেই ক-টা দিন। তারপর তো ওরা দুজনেই চলে এল এই ছোট্ট দেশটায়। ফোন ছাড়া এখন আর কোনো যোগাযোগই নেই।
ইউরোপের অস্ট্রিয়া আর সুইজারল্যান্ড, এই বড় বড় দুটো দেশের মাঝে আল্পস পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একফালি চিজ স্যান্ডউইচের মতো এই বরফের দেশ লিকটেনস্টাইন। গোটা দেশটা মেরেকেটে ষাট বর্গমাইল মতো হবে, তার মধ্যে অর্ধেকই বরফে ঢাকা থাকে বারোমাস। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশ হাজারও লোক নেই এই দেশে। এই দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই, রূপকথার মতো রাজা-রাণী রয়েছে, নাম কা ওয়াস্তে রাজা নয়, তারাই সর্বেসর্বা দেশের।
বিয়ের পর প্রথম যখন তিতলি এসেছিল এখানে, দমবন্ধ হয়ে আসত, ভয়ও লাগত। হাওড়ার শিবপুরের জমজমাট এলাকার মেয়ে ও, সারাক্ষণ বাস-লরির কানফাটানো আওয়াজ শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে। সেখানে, হঠাৎ করে এইরকম কাকপক্ষীহীন প্রান্তরে এসে পড়লে কিরকম একটা লাগে না? প্রথম প্রথম ও ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাস্তার দিকে চেয়ে হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকত, পনেরো মিনিট অন্তর একজন পথচারীর দেখা মিলত বড়জোর। তাও হয়ত বরফ সরাতে বেরিয়েছে। পাহাড়ের উপরের দিকে তাকালে সেখানে দুর্গের মতো রাজপ্রাসাদ চোখে পড়ত, মনে হত ছোটবেলায় পড়া গ্রীম ব্রাদার্সের রূপকথার বাড়ি যেন বইয়ের মলাট ছেড়ে উঠে এসেছে সেখানে। ছুঁচলো চুড়োওয়ালা রাজবাড়িটাকে নিয়ে ও কল্পনায় কত কিই না ভাবত!
প্রতিম ওর হাঁ করে তাকিয়ে থাকা দেখে হাসত, বলত, ”একটু গুছিয়ে নি। তোমায় একদিন নিয়ে যাব তিতু, ওই রাজবাড়িতে। রাজামশাই আমায় খুব ভালোবাসেন।”
তা তো বাসবেনই, না হলে অমন দামি নেকলেস পাঠায় কেউ তিতলির জন্য? সঙ্গে আবার রোলেক্সের ঘড়ি!
প্রতিম এখানে রয়েছে প্রায় আটবছর। তার আগে অস্ট্রিয়াতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে এসেছিল ও। ওখানকার হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্সের বেশ দাম, পাশ করেই স্টুডেন্টরা সারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সব বড় বড় হোটেল চেনগুলোয় প্লেসমেন্ট পেয়ে যায়। প্রতিমও পেয়েছিল, কিন্তু চাকরি করার ইচ্ছে ওর ছিল না কোনোকালেই, বরং কিছুদিন এদিক-ওদিক টুকটাক কাজ করে সটান চলে এসেছিল এই ছোট্ট দেশের রাজধানী ভাদুজে, সবাইকে অবাক করে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁ খুলেছিল এখানে। ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল ঘরানার মুঘলাই রান্নাই ছিল এই কন্টিনেন্টাল খাবারের দেশে ওর নাম ছড়ানোর ইউ এস পি।
প্রতিমের স্ট্র্যাটেজিতে কোনো ভুল ছিল না। প্রথম প্রথম মাছি তাড়ালেও ওর প্রেজেন্টেশন, পেশাদারিত্ব, আর রান্নার গুণে এখন তার রেস্তোরাঁর নাম শুধু লিকটেনস্টাইনেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে পাশের দেশগুলোতেও। এখন সব মিলিয়ে ওর রেস্তোরাঁর সাতটা শাখা তিনটে দেশে, প্রতিম ছোটখাটো একজন উদ্যোগপতি এখানকার। এতকিছুর মাঝেও সে তার ছোট্টবেলার প্রেমকে ভুলে যায়নি মোটেই, তিতলিকে বিয়ে করে নিয়ে এসে সংসার পেতেছে এখানে। হাওড়ার কয়েকটা ছেলেকেও নিয়ে এসে রেস্তোরাঁর কাজে ঢুকিয়েছে সে।
ওর প্রধান পৃষ্ঠপোষক এখানকার রাজপরিবার। ছোটখাটো অকেশন হোক, বা কোনো বড় অনুষ্ঠান, রাজপ্রাসাদের ব্যাঙ্কোয়েট হলের একদিকে প্রতিমের ইন্ডিয়ান খাবার থাকবেই। রানির স্বয়ং তো ওই মশলাদার তন্দুরি চিকেন ভীষণ প্রিয়।
তিতলিও এখন ওদের রেস্তোরাঁ চেনের কো-পার্টনার। স্বামী-স্ত্রী মিলে সারাদিন ব্যস্ত থাকে নিজেদের হোটেলে, সময় কোথা থেকে কেটে যায়, টেরই পায় না। ওদের এই দেশের ভারি মজা, প্রায় সবাই সবাইকে চেনে, পুরো দেশটাই যেন একটা পরিবার।
তিতলি আরো একবার এনকোয়ারির কাছে গেল। ধুর, একে টেনশনে মরছে সে, তার ওপর এত দেরি কারুর ভালো লাগে? আচ্ছা, তার নিজেরই এইরকম হচ্ছে, তাহলে যারা গিনিপিগ হতে চলেছে তাদের ইনস্ট্যান্ট রিয়্যাকশন কি হবে?
তিতলির বাবা-মায়ের যখন ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, তখন তিতলি ক্লাস এইটে পড়ে। সারাদিন তুচ্ছ কারণে দুজনের খিটিমিটি লেগেই থাকতো। মা ছিল ভয়ানক গোছানো, আর বাবা তার ঠিক উলটো। স্নান করে এসে বাবা প্রত্যেকদিনের মতো ভিজে গামছাটা বিছানায় রেখে যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে দিত, আর সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করত মা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, দুজনেই ওদের হাওড়া লাইব্রেরিতে চাকরি করত, একই পোস্টে, একদম পাশাপাশি টেবিলে বসে। যখন ভালো সম্পর্ক থাকত, দিব্যি দুজনে একটা রিকশা করে পান চিবুতে চিবুতে রওনা দিত অফিস, আবার যখন ঝগড়া, তখন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই, আলাদা আলাদাভাবে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যেতো দুজনে, তারপর অচেনা কলিগের মতো পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরত দুই মক্কেলে।
তারপর কিছুদিন চলত ভাববাচ্যে কথোপকথন ও পারস্পরিক বক্রোক্তি।
সবাই ভাবত এভাবেই চলবে বুঝি বাকি জীবনটা ওদের, ঝগড়া, ভাব, আবার ঝগড়া, আবার ভাব। তিতলিরও আর কিছু মনে হত না। কিন্তু একদিন কি যে হল, দুম করে ঝোঁকের মাথায় সেই যে মা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে, আর ফিরে এল না। আগে কিছু হলে থামাত ঠাকুমা, কিন্তু ততদিনে ঠাকুমাও আর বেঁচে নেই।
তিতলি স্কুল থেকে ফেরার পথে লাইব্রেরি যেত, দেখত একইভাবে পাশাপাশি টেবিলে ভাবলেশহীন মুখে কাজ করে চলেছে দুজন।
ও ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে মা-কে বলত, ”ও মা, প্লিজ বাড়ি চলো, অনেক তো হল! বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে!”
”থাম তুই! কষ্ট হচ্ছে! কষ্ট হলে এতদিনে একবার ভুলটা স্বীকারও তো করতে পারত! সারাক্ষণ তো দেখছি, মজাতেই আছে! দিব্যি গল্পগুজব করছে, কাজ তো কিছুই নেই, তাস পেটাচ্ছে। সেদিন আমার টেবিল থেকে পেনটা পড়ে গেল, জানে আমার কোমরে ব্যথা, নিচু হতে কষ্ট হয়, তুলে দিতে পারত তো! দিল? দিল না। ওর মতো স্বার্থপর দুনিয়ায় নেই বুঝলি। আর তুই বলছিস কষ্ট হচ্ছে? ওইসব মানুষের জন্মে অনুতাপবোধ আসবে না!” ঝাঁঝিয়ে উঠত মা।
বাবা-মায়ের কোনো ডিভোর্সও হল না, আবার ঠিকঠাকও হল না কিছু। মা আর এল না ফিরে। পাশের পাড়াতেই মায়ের বাবার বাড়ি, সেখানেই থেকে গেল। বাবাকে বলতে গেলেই বাবা বলত, ”তোর মুখ চেয়ে আমি ছোট হয়েছিলাম তিতলি! অফিসে কিছু বলতে গেলে সিন ক্রিয়েট করতে পারে, তাই বাসে একদিন কথা বলতে গেছিলাম। এমন কটমট করে তাকাল যে আশপাশের লোকজনগুলো সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করল, আমি বুঝি ওকে বিরক্ত করছি! চিন্তা কর মাথা গরম হয় কিনা। ওর নিজের অহংকার নিয়ে ও থাক। ও ভেবেছে আমি বুঝি নিজে একা কিছু পারি না, তাই ওর উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে আমায়। সেই নিয়ে উঠতে বসতে শোনাত আমায়! কই, করছি না আমি সব নিজে? তোর টিফিন করে দেওয়া, রান্নাবান্না, সবই তো সামলাচ্ছি একা হাতে, তোর কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি?”
তিতলি আস্তে আস্তে হাল ছেড়ে দিয়েছে। দিন গেছে, মাস গেছে, বছর ঘুরেছে। তিতলি স্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পা রেখেছে। মা আর আসেনি।
এমনকি তিতলির বিয়ের সময়ও কেউ একচুলও নিজের ইগো ছেড়ে নড়ল না। বিয়ের আগে বাবাকে বললেই বলত, ”তুই জানিস না, এতদিন কিছু বলিনি, এখন মানাতে গেলেই বলবে, ওই তো বিয়ের জোগাড়, সব কাজকর্ম তো একা করতে পারবে না, ওমনি চলে এসেছে। তুই দ্যাখ না, আমি একাই একশো। তোর বাপ যদ্দিন আছে তোর কোনো চিন্তা নেই।”
তিতলি কিছুতেই বোঝাতে পারেনি, চিন্তাটা তার বিয়ের কাজকর্ম নিয়ে নয়, বাবা-মা দুজনকে পাশে পেয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করার একটা আলাদা আনন্দ!
আইডিয়াটা প্রতিমই দিয়েছিল মাসচারেক আগে। তিতলি প্রায়ই মনখারাপ করতো, ”আমি এতদূরে পড়ে আছি, বাবামা-ও রিটায়ার করে গেল, বাবা একলা, মা একলা, আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না। এই বুড়ো বয়সেও এত কিসের অভিমান ওদের?” ফুঁসে উঠেছিল ও।
প্রতিম তখন চরম ব্যস্ত। রাজার একমাত্র মেয়েজামাই আসবে সন্ধেবেলা ওদের রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে, মেনু ঠিক করা, ছেলেগুলোকে ম্যানার শেখানো, লাস্ট মিনিট সব দেখে নেওয়া, এর মাঝেই ও বলেছিল, ”খুব ইজি একটা প্রসেস আছে। দুজনকেই ডেকে নাও এখানে, আলাদা আলাদা ভাবে, এসে দুজন দুজনকে দেখে এখান থেকে তো আর পালাতে পারবে না, এ তো আর পাশের পাড়া নয়! থাকতেই হবে। আমরা দুজন চলে আসব কাজে, দুটো প্রোডাক্ট পাশাপাশি থাকতে থাকতে ঠিক হয়ে যাব, ইগো পালাবে পেছন দিয়ে।”
তিতলি কড়া চোখে তাকিয়েছিল প্রতিমের দিকে, ”এ আবার কি কথা? আমার বাবা-মা প্রোডাক্ট?”
”আরে!” প্রতিম তড়িঘড়ি সামলেছিল বউকে, ”আমরা সবাই একটা না একটা প্রোডাক্ট। তাই না? শুধু দেখো একসাথে থাকতে গিয়ে বাইপ্রোডাক্ট না হয়ে যায়! এতদিন পর, তখন আবার তার সিটিজেনশিপ নিয়ে ঝামেলায় পড়ব!”
তিতলি চোখ দিয়ে প্রায় ভস্ম করে দিয়েছিল প্রতিমকে, কিন্তু আইডিয়াটা তার মন্দ লাগেনি। সত্যিই তো দুজনকে নিয়ে চলে এলে তো আর কিছু করতে পারবে না। থাকতেই হবে।
সেইমত প্ল্যান করেছে দুজন এই কয়েকমাস ধরে। লিকটেনস্টাইনে কোনো এয়ারপোর্ট নেই, নয় অস্ট্রিয়া অথবা সুইজারল্যান্ড থেকে আসতে হয় এখানে। দুজনকে দু-ভাবে রাজি করিয়ে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়ে আজ প্রতিম চলে গেছে অস্ট্রিয়া এয়ারপোর্টে মা-কে রিসিভ করতে, আর তিতলি এসেছে সুইজারল্যান্ড এয়ারপোর্টে বাবার জন্য।
হাসিও পাচ্ছে, আবার এক্সাইটমেন্টও লাগছে বেশ। দুই বুড়োবুড়ি রিটায়ারের পর একা একা থাকে, গল্পের বই, টিভি এইসব নিয়ে সময় কাটায়। বন্ধুমহলে কত বলা হয়েছে সব মিটমাট করে নিতে, কিন্তু একজন যেমন বাঘা তেঁতুল, অন্যজন ঠিক সেইরকমই যেন বুনো ওল।
দূর থেকে বাবাকে দেখতে পেয়ে ও ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, ”কেমন আছো বাবা?”
বাবাকে বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছে, ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে বলল, ”উহ! মেয়ের দৌলতে আমার বিদেশ দেখা হয়ে গেল, কি ভাগ্যি রে! অবশ্য কোনোদিনও তো কারুর কোনো ক্ষতি করিনি, ভালো হবে নাই বা কেন আমার! তোর মায়ের মতো নাকি যে ছোট বাচ্চাকে ফেলে চলে যাব? ঠিক হয়েছে, সবার মুখে যেই শুনবে আমি তোর এখানে এসেছি, আফসোসে হাত কামড়াবে।”
তিতলি ঢোঁক গিলল, বাবারে, বাবা এসেই মায়ের এগেনস্টে তোপ দাগা শুরু করে দিয়েছে, তাহলে সামনাসামনি দেখলে কি করবে?
উফ, এদের এখনো এতো রাগ? ভয়ে ভয়ে ও একবার ফোনের দিকে তাকালো, প্রতিমের ছোট্ট মেসেজ, ”আমার সুন্দরী শাশুড়ি অ্যারাইভড। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পৌঁছচ্ছি বাড়ি।”
বাবার মালপত্র সব গাড়িতে তুলে দিয়ে ও গাড়িতে স্টার্ট দিল। তাই দেখে বাবা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল, ”তুই কি স্মার্ট হয়ে গেছিস তিতলি! গাড়িও চালাতে শিখে গেছিস?”
তিতলি হাসল, কিছু বলল না। এখানে এসে সত্যিই ও অনেক মডার্ন হয়ে উঠেছে। নিজের কাজ নিজেই করে নিতে পারে, তাছাড়া এখানে কোনো অলটারনেটিভও তো নেই! করতেই হবে।
ও বলল, ”আচ্ছা বাবা, এতদিন তো হল, তোমরা কেন ঠিক করে নিচ্ছ না বলো তো? আমার তো একটু স্বস্তি হয় তাহলে!”
বাবা পরমুহূর্তেই গম্ভীর, ”যেটা জানিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না। আমি তো রিটায়ার করেছি তোর মায়ের ছ-মাস আগে। ওর ফেয়ারওয়েলের দিন গেছিলাম, শম্ভু জোর করে নিয়ে গেল। তোর মায়ের বোধ হয় শরীরটা খারাপ হয়েছিল, অনুষ্ঠান শেষের দিকে মাথাটা ঘুরে গেছিল হঠাৎ, আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকলাম, সুস্থ হতে যেই গাড়ি ডেকে বলেছি বাড়ি চলো, ওমনি বলল, ‘আমার গাড়ি লাগবে না, রিকশাই যথেষ্ট’ বলেই একটা রিকশা নিয়ে গটগটিয়ে চলে গেল। এটা আমার অপমান নয়? এত গুমোর কিসের? এখন বুঝুক ঠ্যালা, আমি তো সঞ্জয়কে বলে এসেছি, কাগজ দিতে গিয়ে যেন বেশি বেশি করে বলে আসে আমি ইউরোপ এসেছি। শুনবে আর জ্বলবে, লুচির মতো ফুলবে!” বাবা বেশ তৃপ্তির সঙ্গে বক্তব্য শেষ করল।
তিতলি আর কথা বাড়াল না। এখন মনে হচ্ছে এত কাণ্ড না করে দুজনকে আলাদা নিয়ে এলেই ভালো হত। এদের ঠিক কোনোদিনও হবার নয়, মাঝখান থেকে আরো কিছুটা তিক্ততা হবে।
তবে যতটা ভয় তিতলি পেয়েছিল, সেইরকম কিছু হল না। প্রতিম মা-কে নিয়ে ওর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তিতলি দরজায় বেল টিপতেই মা হাসি হাসি মুখে দরজা খুলেই তিতলির পাশের মানুষটিকে দেখে থ হয়ে গেল।
বাবাও বেজায় চমকেছে। একটু তুতলে তিতলির দিকে তাকিয়ে চেঁচাল, ”একি! ও এখানে কেন? ওকে কে নিয়ে এল?”
পরিকল্পনামাফিক প্রতিম গম্ভীরভাবে বাবার পাশ থেকে লাগেজগুলো তুলে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ”এখানকার নিয়মকানুন ভীষণ কড়া বাবা, একটু চিৎকার করে কথা বললেই পাঁচ ইউরো করে ফাইন। তাই চেঁচামেচি একদম করবেন না বাবা। ভেতরে আসুন।”
তিতলি আড়চোখে দেখল, মা বাবার দিকে একঝলক টেরিয়ে দেখে চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরিয়ে চলে গেল বাথরুমে।
বাবা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল ডাইনিং-এ, তারপর বলল, ”এইরকম চক্রান্তের শিকার হতে চলেছি জানলে আমি কক্ষনো আসতাম না। তিতলি, তুই আমাকে রিটার্ন টিকিট কেটে দে।”
তিতলি হাঁ হাঁ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিম সেইরকমই নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ”রিটার্ন তো কাটাই আছে বাবা, ওটা আর আলাদা নয়, একসঙ্গে সুইজারল্যান্ড থেকে। পনেরো দিন বাদে।”
বাবা এবার গর্জে উঠল, ”পনেরো দিন? আমি কালকেই চলে যাব, তুমি টিকিট কেটে দাও আমাকে।”
তিতলি কাতরভাবে প্রতিমের দিকে তাকালো, কিন্তু এবারেও প্রতিমের বিশেষ হেলদোল নেই, ফোনের কি একটা অ্যাপ খুলে ফেলে বলল, ”আঠেরোশো ইউরো ছাড়ুন তাহলে!”
”মা-মানে!” বাবা একটু গুটিয়ে গেল, ”কত টাকা সেটা?”
প্রতিম নিজের মনে হিসেব করে বলল, ”খুব বেশি না, ওই এক লাখ তিরিশ হাজার মতো। এত জলদি টিকিট তো, তাই দাম একটু বেশি। আপনাদের রিটার্ন টিকিটটা তো অনেকদিন আগে অফারে কেটেছিলাম, তাই অত কম লেগেছিল। টাকাটা ট্রান্সফার করে দিন বাবা আমার অ্যাকাউন্টে, আমি এক্ষুনি কেটে দিচ্ছি, চাপের কিচ্ছু নেই। এখান থেকে আবুধাবি, সেখান থেকে কলকাতা। পরশুর মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাবেন।”
বাবা এবার মুষড়ে পড়ল বেশ।
কখন বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে মা এসে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি, টের পেল মায়ের তির্যক মন্তব্যে, ”এক লাখ তিরিশ! হাসালে বাবা প্রতিম! যে কোনোদিনও হাজার টাকা খরচের ভয়ে দিঘা নিয়ে গেল না, সে নাকি …! হেসে আর বাঁচি না!”
বাবা সঙ্গে সঙ্গে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিম আর কথা বাড়তে দিল না, ”চলুন মা, এখানে আজ খুব ঠাণ্ডা পড়বে, ফোরকাস্ট সেরকমই। স্নো ফল হবে। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নিয়ে শুয়ে পড়ুন। আপনারা দুজনেই টায়ার্ড আছেন।”
ওরা নিজেরাও টায়ার্ড ছিল, তবু উত্তেজনায় ভালো ঘুম হল না তিতলির। পরের দিন সকালে উঠেই ও উঁকি দিল পাশের দুটো ঘরে, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। অবাক হয়ে বাইরে এসে ও দেখল মা রান্নাঘরে কি সব খুটুরখুটুর করছে, আর বাবা বাইরের ঘরে বসে পা পর্যন্ত গামবুট পরছে।
ও কনফিউজড হয়ে গিয়ে বলল, ”কোথায় যাচ্ছ বাবা?”
বাবা গায়ে তিনটে জ্যাকেট চাপিয়েছে, মাথায় পড়েছে টুপি, জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলল, ”তোদের রেস্টুরেন্টে চলে যাব। ওখানেই বসে থাকব সারাদিন। আবার তোদের সাথে ফিরে আসব। বাড়িতে একা একা বসে কি করব! চিনিনা জানিনা, ঘুরতেও পারব না বিদেশবিভূঁইয়ে!”
প্রতিম কখন উঠে এসেছে তিতলি খেয়াল করেনি, ”একা একা কোথায় বাবা? মা-ও তো আছেন। দিব্যি খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ুন, এখানে একটা খুব সুন্দর ট্রাম সার্ভিস চলে, সারা শহর, রাজবাড়ি, আরো অনেক স্থাপত্য ঘুরিয়ে দেখায় তিন ঘণ্টায়, সঙ্গে সুন্দর করে ব্যাকগ্রাউন্ডটাও বুঝিয়ে দেয়। টিকিট কেটে এনেছি, দেখবেন দারুণ লাগবে। তারপর ছুটির দিন তো আমরা ঘুরিয়ে দেখাবোই।”
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল, ”তিতলি, লুচি আর ছোলার ডাল করছি। খেয়ে নিয়ে বেরোবি। আর বাবা প্রতিম, তুমি আমাকে একটু বুঝিয়ে দিও তো কিভাবে ওই ট্রাম ডিপোয় যাব। আমার কোনো অসুবিধে নেই। বুড়ো হয়ে গেছি নাকি যে বাড়ি বসে থাকব? ফোনে জিপিএস অন করব আর চলে যাব। ম্যাট্রিক্সের সিমও নিয়ে নিয়েছি এয়ারপোর্ট থেকে ওইজন্য। এডুকেটেড মানুষ, চিন্তার আবার কি আছে!” কথাকটা বলেই মা ঢুকে গেল রান্নাঘরে।
বাবা গজগজ করল, ”এহ! খুব শিক্ষার দেমাক! এদিকে লাইব্রেরি সায়েন্সের ফাইনাল ইয়ারেও আমার চেয়ে সাত নম্বর কম পেয়েছিল।” তারপরই জুলজুল করে তাকালো বাবা, ”ইয়ে, জিপিএস-টা কি রে? আমাকে একটু অন করে দে তো!” নিজের নোকিয়ার ঢাউস ফোনটা পকেট থেকে বের করে বাবা।
”ওটায় তো জিপিএস হবে না বাবা।” আমতা আমতা করল তিতলি, ”তুমি বরং মা-কে ফলো করে করে চলে যেয়ো। মা স্মার্ট আছে, ঠিক পৌঁছতে পারবে।”
বাবা গোমড়া মুখে বিড়বিড় করল, ”হু! ও যা হিংসুটে! ওকে ফলো করে যেতে গিয়ে দেখব পুলিশকে দেখে রিপোর্টই হয়তো করে দিয়েছে, এদেশের নিয়মকানুন এমনিই বলছিস কড়া।”
গোটা এক সপ্তাহ এইভাবে কেটে গেল। এই কয়েকটা দিন রোজই প্রতিম কিছু না কিছুর টিকিট কেটে এনে দিয়েছে, সেটা নিয়ে মা জিপিএস দেখে দেখে পৌঁছে গেছে, আর বাবামা-কে ফলো করে করে। তিতলি আর কিছু বলচ্ছিল না। বরং ওর বেশ ভালোই লাগছিল। মা আসার পর বেশ আরাম পাচ্ছে ও। এতদিন ঘরবার সামলাতে সামলাতে ও হাঁপিয়ে উঠত। এখন চোখের পলকও ফেলতে হয় না, টেবিলে দারুণ সব খাবার হাজির হয়ে যায়, জামাকাপড় ভাঁজ হয়ে সুন্দরভাবে ঢুকে যায় ওয়ার্ডরোবে, কোনোকিছু নিয়েই কোনো চিন্তা নেই!
লেপের তলায় গুটিসুটি হয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরে ও বলে, ”প্লিজ মা! তোমরা এখানেই থেকে যাও।”
মা পরক্ষণেই গম্ভীর, ”আমি থাকতে পারি, কিন্তু তোর বাবাকে আগে বিদায় কর। এত নোংরা কি বলব তোকে, ভেবেছিলাম এতগুলো বছর একা থেকে বোধ হয় পাল্টেছে। হা হতোস্মি! দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না, সেই মোজা পরেই রোজ বেরিয়ে পড়ছে, জানিস! আর কাল দেখি” রাগে মায়ের চোখ গোলগোল, ”আমার একটা তোয়ালে কেচে মেলেছিলাম ব্যালকনিতে, নোংরাটা ভেবেছে বুঝি আমি ঘুমিয়ে পরেছি, ওমা, সটান গেল, এদিক-ওদিক চেয়েই টুক করে সর্দি মুছে দিল আমার গামছাটায়! চিন্তা কর তুই। শুধু তাই নয়, বাথরুমে গিয়ে আমার দামি কেয়া শেঠের শ্যাম্পুটা মাথায় মেখেছে, যত না মেখেছে, তার চেয়ে ফেলেছে বেশি। রাগে আমার মনে হচ্ছিল ওই টাকে যেক-টা চুল আছে, সেগুলোও উড়িয়ে দিই!”
তিতলি আর কথা বাড়াল না, রণে ভঙ্গ দিয়ে দিল, ”ছাড়ো মা! তোমাদের একসাথে আনাই আমাদের ভুল হয়েছে। আসলে তোমরা নিজেরাই ঠিক করতে চাও না।”
”শোন, প্রতিমের মতো বর পেয়েছিস তো, তাই বুঝতে পারছিস না। এরকম বর জুটলে বুঝতে পারতিস জীবনটা কেমনভাবে ভাজাভাজা হয়। আবার তেজ আছে, কাল তোরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর জামাগুলো ওয়াশিং মেশিনে দেবো বলে ভিজিয়ে রেখেছিলাম, ও বাবা, বাবু এসে নিয়ে চলে গেল। কাজের বেলা নেই, তেজে আছে। হু!”
পনেরো দিন এভাবেই কাটল। মাঝে দুদিন ওরা চারজন বেরিয়েছিল, সুইজারল্যান্ডের মাউন্ট টিটলিস ঘুরিয়ে দিল বাবা-মাকে। এছাড়া একদিন চলে গেল লুসার্ন শহরে, সেখানে পাঁচতলা উঁচু একেকটা মলে খালি রাশি রাশি চকোলেট, বিশ্ববিখ্যাত সব চকোলেট বিক্রি হচ্ছে থরে থরে।
মা খুব খুশি, বেশ কিছু কেনাকাটা করল, ”পাড়ার বাচ্চাগুলোকে বলে এসেছি স্যুইস চকোলেট নিয়ে আসব জানিস!”
বাবা একটু মিইয়ে গিয়েছিল। তিতলি একবার বলল, ”বাবা তুমি কি চকোলেট কিনবে বলো? আমি কিনে দিচ্ছি।”
বাবা কিছু বলার আগেই মা ব্যঙ্গের স্বরে স্বগতোক্তি করল, ”চকোলেট খেতে গেলে মনে হয় দাঁতের প্রয়োজন হয়, আর বাঁধানো দাঁতে মনে হয় না এই চকোলেট খেয়ে কোনো তৃপ্তি পাওয়া যাবে!”
বাড়ি ফিরে চুপিচুপি তিতলির হাতে দুটো চকোলেট মিল্ক শেকের ক্যান ধরিয়ে দিল মা, ”এইটা গিয়ে দে, বলবি তুই কিনেছিস। আর বলবি যেন রাতে শোয়ার আগে দাঁতের পাটিদুটোকে খুলে ভালো করে মাজে, বুঝলি?”
যেদিন বাবা মা-কে ওরা এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে গেল, সেদিন তিতলির চোখে জল এসে গেল, বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ”আমার খুব চিন্তা হয় বাবা! তোমরা প্লিজ একসাথে থাকো।”
বাবা কোনো উত্তর দিল না।
মা-কেও ওই একই প্রশ্ন করতে মা মুখ টিপে বলল, ”তোদের ওই মানদা যে কি রান্না করে কে জানে! কি চেহারা হয়েছিল দেখেছিস? এই ক-দিনে তবু একটু ছিরি ফিরেছে! তুইও থাকিস না, কি ছাইপাঁশ খেয়ে বেড়ায় কে জানে!”
বাবা-মা চলে যাওয়ার প্রায় দিনসাতেক পর তিতলি ফোন করল বাবাকে, এমনিতে রোজই কথা হয়, কিন্তু কাজের চাপে কয়েক মিনিট। এই ছুটির দিনে বেশ জুত করে বসে কথা বলে ও। বাবাকে ফোন করার পরেই মা-কে করবে।
এবার আর শুধু ও নয়, প্রতিমও হাল ছেড়ে দিয়েছে, ”ধুর, এতকিছু করেও যখন ঠিক হল না, ও আর হওয়ার নয়, বুঝলে!”
বাবার ফোন প্রথমবার বেজে কেটে গেল। তারপর রিং হতেই একটা মহিলাকণ্ঠ পাওয়া গেল, তিতলি একটু ইতস্তত করে বলল, ”কে? মানদামাসি? বাবা কোথায় গো?”
মায়ের গম্ভীর গলা ভেসে এল, ”মায়ের গলাও আজকাল চিনতে পারছিস না বুঝি!”
তিতলি হকচকিয়ে গেল, অবাক হয়ে বলল, ”মা, তুমি বাবার ওখানে?”
মা একটু আমতা আমতা করল, ”ফ্লাইটে আসার সময় যা অবস্থা দেখলাম, একটু হেঁটেই হাঁপিয়ে যায়, প্রেশারের ওষুধগুলোও তো খায় না। একবার তো অক্সিজেন দিতে হল। তার ওপর যা খাচ্ছে, বদহজম। তাই, ভাবলাম মানদাকে ছাড়িয়ে দেওয়াই ভালো, বেকার টাকার শ্রাদ্ধ করে তো …!”
তিতলি আনন্দে চেঁচাচ্ছিল, ”আমি ভাবতেই পারছি না। অবশেষে তোমরা আবার এক হলে মা! আই লাভ ইউ মা, তোমরা দ্য বেস্ট! আমরা ক্রিসমাসেই যাচ্ছি। গিয়ে সব্বাই আনন্দ করব খুব।”
ওপাশ থেকে মায়ের খনখনে গলা ভেসে এল, ”থাম! এক হতে যাবো কোন দুঃখে? তাও আবার ওই নোংরার ডিপোর সঙ্গে? আলাদাই তো রয়েছি, ও পুবের ঘরে, আমি পশ্চিমের ঘরটায়!”