২. হোটেলের পথে চলতে চলতে

০৬.

হোটেলের পথে চলতে চলতে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আজ সকালে যা যা ঘটলো, আমাকে সব খুলে বল।

-মাদাম রেনাল্ডের কথাই মাথায় ঘুরছে। তার স্বামী যে ছেলেকে একটা রহস্যময় সমুদ্রযাত্রায় পাঠাচ্ছেন, মনে হচ্ছে এবিষয়টা তার অজানা ছিল না। খুনের কারণটাও সম্ভবতঃ তিনি জানেন–কিন্তু কি এক অজ্ঞাতকারণে গোপন করে যাচ্ছেন। বললাম আমি।

-তুমি ঠিকই অনুমান করেছে, মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল পোয়ারো, আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি মাদাম রেনাল্ড কিছু গোপন করতে চাইছেন। খুনের ব্যাপারে তার ওপরেই প্রথম সন্দেহ পড়েছিল আমার।

-তুমি ওঁকে সন্দেহ করেছিলে?

-হ্যাঁ, উইলের শর্ত একমাত্র তারই অনুকূল ছিল। এই কারণেই আমি তাঁর কব্জি পরীক্ষা করে দেখি। নিশ্চিত হই তিনি নিজেই দড়ি দিয়ে হাত বাঁধেননি।

তারপর তিনি মুখোশপরা লোকের যে কাহিনী শোনান, তা আমার পরিচিত। ওসব আগেই আমি শুনেছি কিংবা পড়েছি কোথাও।

সেই কব্জিঘড়ির কথাটা মনে কর, তিনি যা বললেন তা সত্যি ছিল না।

–তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না পোয়ারো। তুমি পরিষ্কার করে বলো।

–বেশ, তাহলে ভেঙ্গেই বলছি। খুনের ঘটনাটা কখন ঘটেছিল বলে তোমার মনে হয়?

-মাদাম রেনাল্ড তো বললেন, ঘড়িতে সেই সময় দুবার ঘণ্টা বেজেছিল–মানে রাত দুটো

-আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তার এই বক্তব্য সবাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি জানি তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। ঘটনা ঘটেছিল আরো দুঘণ্টা আগে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ঘড়িটার কাচ ভাঙ্গলেও বিকল হয়নি। নির্দিষ্ট কোনো কারণেই কেউ ঘড়ির কাঁটা দুটো স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মাদাম রেনাল্ড ব্যাপারটা জানতেন বলেই আমার বিশ্বাস।

-সেই কারণটা কি হতে পারে?

–তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছি। মারলিনভিল স্টেশন থেকে শেষ ট্রেনটা রাত বারোটা সতেরোয় ছেড়ে যায়–একথাই আমি ভাবছি।

–বুঝতে পারছি, বললাম আমি, তুমি বলতে চাইছ, সেই ট্রেনে কেউ চলে গেছে আর ঘড়ির দুঘণ্টা পরের সময়টাই তার অ্যালিবাই।

-তুমি ঠিক ধরেছ হেস্টিংস।

–তাহলে তো স্টেশনে খোঁজ নিলেই জানা যাবে দুজন বিদেশীকে কেউ ট্রেনে উঠতে দেখেছে কিনা।

পোয়ারো আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলতে লাগল, তোমাকে আগেও বলেছি এ অপরাধের পদ্ধতি আমার পরিচিত। এই ঘটনার সঙ্গে আগের একটি ঘটনার এমনই মিল যে আমার অনুমান দুটি ঘটনার পেছনে একই মস্তিষ্ক কাজ করেছে। অথবা এমন হতে পারে, অপরাধের পূর্ব স্মৃতি মনে জেগে ওঠায় খুনী দ্বিতীয় অপরাধটি করে বসে। অপরাধী কে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ–তবে ক্রমশ প্রকাশ্য।

–কিন্তু ডুবিনের সেই চিঠিটা–সঁসিয়ে রেনাল্ডের স্যান্টিয়াগোর জীবনের একটা গোপন তথ্যের পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায়।

মূল ঘটনা থেকে সন্দেহ সরিয়ে দেবার ওটা একটা কৌশলমাত্র। হেস্টিংস, আমি নিশ্চিত, মঁসিয়ে রেনাল্ডের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চিঠিটা লেখা হয়েছে স্যান্টিয়াগো থেকে নয়, ফ্রান্স থেকেই।

-তাহলে মৃতদেহের পাশ থেকে পাওয়া সেই দেশলাই কাঠি আর পোড়া সিগারেটের টুকরো–ওগুলো সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি?

–জিরয়েডের মতো গোয়েন্দাদের চোখে ফেলার জন্য ওগুলো ইচ্ছে করেই ফেলে রাখা হয়েছিল। আর মূর্খ জিরয়েড তা নিয়েই মেতে আছে।

–তাহলে মুখোশধারী লোকগুলো দৃশ্যপটে আসছে কেন?

 –ওরা অস্তিত্বহীন–কল্পনা মাত্র।

–তাহলে আসল ঘটনা কি ছিল?

–সেকথা বলতে পারেন একমাত্র মাদাম রেনাল্ড। অথচ, কোনো অবস্থাতেই ওই মহিলার মুখ থেকে একটি কথা বার করা যাবে না, আমি জানি। একটি অস্বাভাবিক চরিত্র মাদাম রেনাল্ড স্বামীর মৃতদেহ দেখার পর নির্ভেজাল শোক প্রকাশ করতে দেখেছি তাকে। আমি নিশ্চিত হয়েছি তিনি খুনী নন।

কিন্তু তবু কেন তিনি একের পর এক মিথ্যা বলেছেন তার ব্যাখ্যা এখনো আমার কাছে নেই। সেই কব্জিঘড়ির ব্যাপারে তিনি মিথ্যা বলেছেন, সেই মুখোশধারী লোকদুটির ব্যাপারে, দরজা খোলা অবস্থায় ছিল তার ব্যাপারে তিনি সত্য কথা বলেননি।

যাইহোক, হেস্টিংস, এখনো আমাদের অনেক কিছু জানার বাকি রয়ে গেছে।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা আমার মাথায় খেলে গেল। বললাম, পোয়ারো, আমার মনে হয়, মাদাম রেনাল্ড কাউকে আড়াল করতে চাইছেন।

–আমারও তাই ধারণা, বলল পোয়ারো, অথবা কাউকে যাচাই করার উদ্দেশ্যে তিনি মুখে চাবি আটকে রেখেছেন।

কথা বলতে বলতে আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম।

.

০৭.

–তা এই সুন্দরী তরুণীটির নাম কি? কৌতুকতরল কণ্ঠে প্রশ্ন করল পোয়ারো।

খাবার টেবিলে বসে আজ সকালের ঘটনাটা শোনার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া তার।

অদূরদর্শী কাজটার জন্য আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। পোয়ারো চিপটেন কাটতে ছাড়বে না তা-ও জানতাম। সৌভাগ্য যে অল্পেতেই রেহাই দিল এযাত্রা।

–তাহলে হোটেল ডি অ্যাঙ্গলেটরে সুন্দরীকে দেখতে তুমি যাচ্ছ?.

হোটেল ডি অ্যাঙ্গলেট নয়, ডু ফেরয়ে আছে ও।

–ওঃ হাঁ, আমিই গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

আহার পর্ব শেষ করে কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে পোয়ারো বলল, আমাকে এখুনি স্টেশনে ছুটতে হবে। প্যারিসের ট্রেন ছাড়বে দুটো পঁচিশে।

–তুমি এখন প্যারিস যাচ্ছ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি, কি ব্যাপার বলতো?

–মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনীর সন্ধানে। সবই তুমি জানতে পারবে, একটু ধৈর্য ধরো। কালই ফিরে আসছি। তুমি মঁসিয়ে রেনাল্ডের বাড়ির লোকজনের ওপর নজর রেখো।

–ওদের দুজনের কথা তুমি জানলে কি করে?

–দুয়ে দুয়ে চার হয়, এই হিসেবটা আমার জানা আছে বলে। তরুণ রেনাল্ডের মতো একজন যুবক মাদমোয়াজেল মাথার মতো সুন্দরীকে একজায়গায় রাখলে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কি দাঁড়াবে–প্রেম বিবাহ, তারপর কলহ। টাকা অথবা নারীঘটিত কোনো কারণে, ফলে ক্রোধ এবং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?

আমি মেয়েটির চোখে উদ্বেগের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। আর সেটাই আমাকে দিক নির্দেশ করেছে।

তার মানে তুমি বলতে চাও

 মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল পোয়ারো।

.

একা একা সমুদ্রতীরে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। তারপর একসময় হোটেল ডু ফেরয়ে এসে উপস্থিত হলাম। সিনডেরেলার পুরো নাম তো জানা নেই। কি নামে তাকে খোঁজ করব?

লাউঞ্জে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম যদি দেখা হয়ে যায়। পরে দরোয়ানের হাতে কিছু টিপস দিয়ে বললাম, একজন ইংরেজ মহিলা থাকেন, সুন্দরী যুবতী, তার নাম জানি না–তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।

লোকটি হেসে জানালো, ওইরকম কাউকে সে এখানে দেখেনি। আরো জানালো, বেঁটেখাটো চেহারার গোঁফওয়ালা, সবুজ চোখ এক ভদ্রলোকও ওই রকম বর্ণনার একটি মহিলার খোঁজ করতে এসেছিলেন।

সন্দেহ হল, আমাকে গোপন করে পোয়ারোই এসেছিল। সেই কারণেই আমাকে সে স্টেশনে তার সঙ্গী করতে চায়নি।

পোয়ারোর উদ্দেশ্যটা ঠিক বোধগম্য হল না। ওর সব কাজ আমি ধরতে পারি না।

–নিজেকে সে সবসময়ই রহস্যের মোড়কে গোপন রাখতে পছন্দ করে।

কিন্তু সিনডেরেলা কি আমাকে ভুল ঠিকানা দিল? নাকি হোটেলের নাম বলতে ভুল করেছে? অথবা সে আমার বন্ধুত্ব চাইছে না?

এমনি নানা কথা ভেবে মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল।

 হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে চললাম। ভিলার কাছাকাছি এসে পথের ধারে ঝোপের পাশে একটা বেঞ্চিতে বসলাম।

কিছুক্ষণ পরেই খুব কাছে ভিলা মারগুয়েরিটের বাগান থেকে পরিচিত নারীকণ্ঠ ভেসে এল। চিনতে পারলাম–মার্থা ডওব্রেয়ুইল।

একজন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পুরুষ সঙ্গীটি জ্যাক রেনাল্ড।

–তাহলে বলছ, আর কোনো বাধা নেই, বলল মার্থা।

–প্রিয়তমা, তুমি কি বুঝতে পারছ না? আমাদের মিলতে বাধা দেবার আর কেউ নেই।

–ওঃ জ্যাক–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে যে

পাতার আড়াল থেকে নজরে পড়ল–ওরা দুজন আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় পরস্পরকে নিরীক্ষণ করছে।

–আর কেন মিছে ভয় প্রিয়তমা?

–ভয় আমার তোমার জন্যে প্রিয়

থেমে থেমে আবেগজড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করল মার্থা।

আর কিছু শোনা সম্ভব হল না। একজোড়া পায়ের শব্দ কানে এলো। আমি সেখান থেকে সরে এলাম।

অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখা পেয়ে গেলাম জিরয়েডের।

–আপনি এখানে? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।

-আপনি যে কারণে, জিরয়েড বলল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। তা আপনার সেই প্রাচীন বন্ধুটি কোথায়? প্যারিসে খুনীর সন্ধানে নাকি? শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে বলল জিরয়েড।

কথা শেষ করে পেছন ফিরে চলে গেল সে। আমিও হাজারো জট মাথায় নিয়ে হোটলে ফিরে এলাম।

.

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলেই সাংঘাতিক খবরটা পেলাম। ভিলা জেনেভিয়েভে আর একটা খুন হয়েছে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে দুঃসংবাদটা।

ব্রেকফাস্ট শেষ করা হল না। তখনই ছুটতে হল ভিলার দিকে।

পোয়ারো এখানে নেই। এর মধ্যে কে খুন হয়ে গেল? আমাকে ও বলে গিয়েছিল ভিলার লোকজনের ওপর নজর রাখতে।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকেই চাকরবাকরদের জটলা চোখে পড়ল। ফাঙ্কেইসকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি শুনছি এসব?

-হ্যাঁ মঁসিয়ে। সাংঘাতিক ব্যাপার, ফ্রাঙ্কেইস হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগল, আর একজন খুন হয়েছে।

-কে খুন হলো?

–তা বলতে পারব না মঁসিয়ে। অজানা একজন লোককে শেডের মধ্যে পাওয়া গেছে। মঁসিয়ের মৃতদেহের মাত্র একশোগজ দূরে। বুকে ছুরি বিধিয়ে মারা হয়েছে।

.

০৮.

 দ্রুতপদক্ষেপে শেডে চলে এলাম। প্রবল উত্তেজনায় বুক কাঁপছে আমার।

পকেট টর্চ জ্বেলে মেঝের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলাম।

মঁসিয়ে জিরয়েড এককোণে টর্চের আলো ফেলল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সটান পড়ে আছে মৃতদেহ।

মাঝারি উচ্চতার মাঝবয়সী মানুষ, গায়ের রঙ ময়লা। পরনে নীল রঙের দামি কিন্তু পুরনো স্যুট। মুখে আতঙ্কের ছাপ।

বুকের ডানদিকে যে ছুরিটা বিদ্ধ হয়ে আছে–দেখে আগের দিনের খোয়া যাওয়া ছুরিটার কথা আমার মনে পড়ে গেল।

–উনি ফিরলেন?

ঠাট্টার সুরে জানতে চাইল জিরয়েড।

আমি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন খুন হল?

–ডাক্তারের অভিমত আমি জানি না। আমার বিশ্বাস অন্তত বারো ঘন্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। আপনি ছুরিটা কখন শেষ দেখেছিলেন?

গতকাল সকাল দশটা হবে।

–সকাল দশটা। তাহলে খুনটা খুব একটা পরে হয়নি।

–কিন্তু এই শেডের ভেতরে

–চমৎকার! মৃতদেহ তাহলে কি পর্যবেক্ষণ করলেন? এই আপনার গোয়েন্দাগিরি? পা-দুটো কেমন জড়ো করা দেখেছেন? হৃদপিণ্ডে ছুরিকাঘাত হলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে না। আর হাত দুটোও কেমন দুপাশে ছড়িয়ে আছে–এসব অস্বাভাবিক নয়? আর ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন

জিরয়েড শেডের কোণায় টর্চের আলো ফেলল। একরাশ ধুলো পড়ে আছে মেঝের ওপর। দেখেই বোঝা যায় লোকটাকে বাইরে থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।

ছুরিকাঘাতের পরে নিয়ে আসা হয়েছে–দুজন লোক—

হ্যাঁ, বলল জিরয়েড, একজন স্ত্রীলোক। পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও দু-একটা জুতোর ছাপ রয়ে গেছে।

মৃতদেহে বিদ্ধ ছুরির গা থেকে মেয়েদের একটা লম্বা চুল টেনে তুলে আবার বলল–এটাও সেকথা বলে।

মনে পড়ল, ঠিক এরকম একটা চুল পোয়ারো পড়ার ঘরের চেয়ারে পিঠ থেকে সংগ্রহ করেছিল।

লোকটার হাতের নখগুলোর দিকে তাকিয়ে কি মনে হয়? বলল জিরয়েড।

 স্বীকার করতে হল নজর আছে বটে তার। কেন না মৃতলোকটির হাতের নখগুলো ভাঙ্গা এবং বিবর্ণ চামড়াও রুক্ষ।

-ওই হাত কোনো ভদ্রলোকের হাত হতে পারে না, বলে চলল জিরয়েড, অথচ গায়ে দেখুন দামী সুট। বিসদৃশ নয়?

–খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। আমি বললাম।

–পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, লোকটা পরিচয় গোপন করে এসেছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য কি? এব্যাপারে এখনো কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে সে যে নিজের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আরো মজা হল, এবারেও খুনী আগের মতই হাতে গ্লাভস পরে কোনো রকম ক্লু না রেখেই কাজ সমাধা করেছে।

–দুটি খুন একই ব্যক্তির বলে আপনি সন্দেহ করছেন? জানতে চাইলাম আমি।

–আমার ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমরা এবার মারকয়ডের সঙ্গে দেখা করব। বলতে বলতেই দরজার সামনে ডি. ভিলা মারকয়ডকে দেখা গেল। জিরয়েড তাকে বলল, মাদাম রেনাল্ডকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। একটু পরেই সে মাদামকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো।

টর্চের আলো ধরে মৃতদেহের কাছাকাছি নিয়ে এলো জিরয়েড তাকে।

-এই যে দেখুন মাদাম, লোকটাকে চিনতে পারছেন আপনি?

মৃতদেহ দেখে কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেল না মাদাম রেনাল্ডের মুখে। নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, এই লোককে জীবনে কখনো দেখিনি–বহিরাগত।

–সে-রাতে যে দুজন লোক আপনাকে আক্রমণ করেছিল, এই লোকটি কি তাদের মধ্যে ছিল? ভালো করে দেখে বলুন।

-না, মঁসিয়ে, আমি নিশ্চিত, এই লোক তাদের মধ্যে ছিল না।

–বেশ, ধন্যবাদ, মাদাম।

মাদাম রেনাল্ডের পর জ্যাক রেনাল্ডকে ডেকে দেখানো হল। সে-ও মৃতদেহ সনাক্ত করতে পারল না।

মাদাম ডওব্রেইল এলেন তার পরে। তিনি তো রেগে খাপ্পা।

–এসব কি ছেলেখেলা হচ্ছে মঁসিয়ে। খুনের ঘটনার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

–ধৈর্য হারাবেন না মাদাম, কর্কশ শোনাল জিরয়েডে স্বর, তদন্তে আমি যা জেনেছি…তা হলো দুটো খুনই আপনি করেছেন।

–আপনি আমাকে অপমান করছেন, চিৎকার করে উঠলেন ডওব্রেয়ুইল, এ অত্যন্ত অন্যায়।

 ছুরির হাতল থেকে কালো লম্বা চুলটা এবারে টেনে তুলল জিরয়েড।

-এটা নিশ্চয়ই চিনতে ভুল করবেন না। মাদাম, সুযোগ পেলে এটা আপনার কিনা আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারব।

–এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি কোনো অপরাধের বিষয়েই কিছু জানি না। তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল।

–অপরাধের বিষয়ে আপনাকে এখনো কেউ অভিযুক্ত করেনি মাদাম। আপনি এবারে শান্ত হয়ে আমার কথার জবাব দিন। মৃত লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখুন তো তাকে চিনতে পারেন কি না?

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকালেন ডওব্রেয়ুইল। জিরয়েডের দিকে চোখ তুলে সহজকণ্ঠে বললেন, না, একে কখনো দেখিনি।

যথেষ্ট ধন্যবাদ।

মাদাম ডওব্রেয়ুইল দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।

 আমাকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে জিরয়েড বলে উঠল, আপাততঃ মহিলাকে গ্রেপ্তার না করে নজরে রাখাই আমার ইচ্ছা। লোকটাকে কি মনে হয় আপনার, স্প্যানিশ?

–না, ফরাসি বলেই মনে হচ্ছে। জবাব দিলাম আমি।

এই সময় বাইরে অনেক মানুষের গলা পাওয়া গেল। একে একে ঘরে ঢুকলেন ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেট, তার কেরানী এবং কমিশনার মঁসিয়ে রেক্স।

-আমরা কেসের গভীরে যেতে পারিনি মঁসিয়ে জিরয়েড, তা না হলে দ্বিতীয় খুনের আভাস পাওয়া যেত। লোকটিকে সনাক্ত করা গেছে? বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

–কেউ চিনতে পারেনি, জিরয়েড বলল, আপনারা একবার দেখুন।

সকলে ঘরের কোণে গিয়ে মৃতদেহের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন।

গতকালের চুরি যাওয়া ছুরিটাই লোকটির বুকে বিদ্ধ করা হয়েছে। খুনী কোনো হাতের ছাপ রেখে যায়নি, বলল জিরয়েড, খুবই রহস্যময় কেস

ডাঃ ডুরান্ড মৃতদেহ পরীক্ষা করতে থাকেন। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। ডাঃ সরে এসে জানালেন, আমি নিশ্চিত, লোকটি কম করেও আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে মারা গেছে।

জিরয়েডের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমরা সকলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে রইলাম।

.

০৯.

 আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধ হতবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ডাক্তারের কথায় গোটা ব্যাপারটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল।

ছুরিটা চুরি গেছে চব্বিশ ঘণ্টা আগে, তাহলে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে সেই ছুরি লোকটির বুকে বিদ্ধ হয় কি করে? বিস্ময়কর এই ব্যাপারটা যখন সকলকে চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলেছে, সেই সময় পোয়ারোর তারবার্তা হোটেলের লোক আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল।

পোয়ারো জানিয়েছে বারোটা আঠাশে মারলিনভিল স্টেশনে পৌঁছচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি স্টেশনের দিকে রওনা হলাম।

স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল ট্রেন লেটে আসছে। খানিকটা সময় হাতে পেয়ে স্টেশনের কয়েকজন পোর্টারের সঙ্গে কথা বললাম। দুর্ঘটনার রাত্রে শেষ ট্রেনে স্টেশন ছাড়তে কোনো যাত্রীকে তারা দেখেছে কিনা জানতে চাইলাম।

পোর্টারদের প্রধান জানাল, সে-রাতে শেষ ট্রেনে জনাকুড়ি যাত্রী মারলিনভিল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল। তাদের মধ্যে দুজন বিদেশীও ছিল।

খবরটা পেয়েও ঠিক স্বস্তি পেলাম না। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তরুণ মঁসিয়ে রেনাল্ড সে-রাতে ট্রেন ধরতে পেরেছিলেন তো?

–সেকি বলছেন সিয়ে? সেই দিনই মাত্র আধঘন্টা আগে তিনি পৌঁছেছেন, তারপর আর শেষ ট্রেন ধরা যায় কখনো?

-ওহো, দুর্ঘটনার রাত্রেই তাহলে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় পৌঁছেছিলেন?

–হ্যাঁ, মঁসিয়ে। অন্য পথের শেষ ট্রেনটা পৌঁছেছিল এগারোটা চল্লিশে।

এই সংবাদে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। দুর্ঘটনার রাতে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় ছিল, সেই কারণেই তাকে নিয়ে মার্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

কিন্তু জ্যাক একথা স্বীকার না করে চেরবুর্গে থাকার কথা আমাদের বলেছিল কেন? কিন্তু এই খুনের ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে, এমন কথাও ভাবা যাচ্ছে না।

মার্থা জ্যাকের জন্য উদ্বিগ্ন, কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে কিনা পোয়ারোকে ডেকে ও জানতে চেয়েছিল…তার মানে বোঝা যাচ্ছে, সব ঘটনার কথাই মার্থা জানে। তা না হলে এমন উদ্বিগ্ন কেন হবে?

একটু পরেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। চিন্তাভারাক্রান্ত মাথা নিয়েই পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানালাম।

ট্রেন থেকে নেমে আমার প্রশ্ন করার আগেই পোয়ারো বলল, আমার অভিযান সম্পূর্ণ সফল হেস্টিংস।

–নিঃসন্দেহে আনন্দ সংবাদ। এদিককার খবর যে

আমাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, কি জিরয়েড কাউকে গ্রেপ্তার করেছে? লোকটা যে একটা গণ্ডমূর্খ আমি প্রমাণ করে ছাড়ব।

-শোন পোয়ারো, খুব খারাপ খবর। ভিলায় আর একটা খুন হয়েছে। আমাদের সেখানে যেতে হবে।

পোয়ারোর চোখ নিষ্প্রভ হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলে পড়ল। বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

–আর একটা খুন, বিড়বিড় করে বলল পোয়ারো, আমার সব ধারণাই কি তবে ভুল হল…হ্যাঁ, অসম্ভব নয় যদি…আচ্ছা হেস্টিংস, নিহত লোকটি কি মাঝবয়সী? তালাবন্ধ শেডের ভেতরেই মৃতদেহটা পাওয়া গেছে?

আরো হতে পারে…আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে খুনটা হয়ে থাকতে পারে…তাকেও ছুরিবিদ্ধ করা হয়েছে…অবশ্য পিঠে না-ও হতে পারে…

আমি থ হয়ে পোয়ারোর অত্যদ্ভুত কথা শুনে গেলাম।

-তুমি তো দেখছি হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেলে। নিশ্চয় আগে কিছু শুনে থাকবে। অবাক হয়ে বললাম আমি।

-না, বন্ধু, সে সুযোগ আমার ছিল না। সদ্য ট্রেন থেকে নেমেছি। সংবাদটা শুনে তাই প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

–তাহলে এতসব জানলে কি করে তুমি?

এবারে মদগর্বী পোয়ারো স্বরূপে ফিরে গেল। বলল, মস্তিষ্কের সেই ধূসর কোষগুলোর ক্রিয়া বন্ধু, আর কিছু না। দ্বিতীয় খুনের সম্ভাবনা তারাই আমাকে জানিয়েছিল। তাহলে চল আর দেরি করে কাজ নেই।

.

ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে যেতে যেতে দ্বিতীয় খুনের ঘটনার কথা পোয়ারোকে জানালাম। সব শুনে সে বলল, কিন্তু বলছ একই ছুরি দিয়ে দুটো খুন হয়েছে?

-হ্যাঁ। ব্যাপারটা রহস্যময়। বললাম আমি।

–কিছুই রহস্যময় নয় ভায়া। দুটো ছুরি থাকা অসম্ভব নয়। জ্যাক রেনাল্ড ছুরিগুলো তৈরি করিয়ে একটা হয়তো নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছিল।

–কিন্তু সেকথা তো আগে বোঝা যায়নি।

–সবই কি আর বোঝা যায়, উপলব্ধি করে নিতে হয়।

.

শেডে ঢুকে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে পোয়ারোর সর্বপ্রথম নজরে পড়ল পোশাকের দিকে।

-একি, কোট ট্রাউজার-সবই দেখছি বাগানের মালির ব্যবহার করা—

ঠিকই ধরেছেন।

পাশ থেকে জিরয়েড বলে উঠল।

 মৃতদেহের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে পর্যবেক্ষণ করল পোয়ারো।

-নখগুলো লক্ষ্য করেছেন। বলল পোয়ারো।

–হ্যাঁ। চোখে পড়েছে সবই। বলল জিরয়েড।

–ডাঃ ডুরান্ড। কঠিন মুখে ডাকল পোয়ারো।

 সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলেন ডাক্তার।

-মৃতব্যক্তির মুখে গাঁজলা লক্ষ্য করেছেন?

ডাক্তার স্বীকার করলেন তিনি লক্ষ্য করেননি।

–তাহলে এবারে দেখে কি মনে হচ্ছে? উঁহুমৃত্যু ছুরির আঘাতে হয়নি। পোশাকেও রক্তের দাগ নেই

ছুরির ফলাটাও সামান্য বেঁধানো—

হ্যাঁ, মঁসিয়ে খুবই অস্বাভাবিক।

-না, মঁসিয়ে ডুরান্ড, অস্বাভাবিক মোটেও নয়। লোকটিকে মৃত্যুর পরে ছুরি মারা হয়েছে

–আমার সঙ্গে নিশ্চয় আপনি একমত হবেন?

–হ্যাঁ, মঁসিয়ে আমি একমত।

-মৃত্যুর পরে ছুরি বেঁধানো–এ তো অদ্ভুত ব্যাপার, বলে উঠলেন মঁসিয়ে হয়টেট, এমন ঘটনা তো আগে শোনা যায়নি।

–খুবই ঠান্ডা মাথার কাজ বোঝা যাচ্ছে। পুলিসকে বিভ্রান্ত করার পরিকল্পনা।

–তাহলে এই লোকটা খুন হল কি করে? চিন্তিতভাবে জানতে চাইলেন কমিশনার।

-খুন নয় মঁসিয়ে। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে বলব, লোকটা মৃগীরোগে মারা গেছে।

সকলের মুখেই বিস্ময়সূচক শব্দ ধ্বনিত হল। ডাঃ ডুরান্ড এগিয়ে গিয়ে আবার মৃতদেহ পরীক্ষা করেন।

পরে সরে এসে পোয়ারোকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, আপনার অনুমানই ঠিক সঁসিয়ে পোয়ারো। ছুরিকাঘাতের কথাটা মাথায় ছিল বলে মৃত্যুর অন্য লক্ষণগুলো আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি।

পোয়ারো সগর্বে মাথা উঁচিয়ে উপস্থিত সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। তার চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ সকলেরই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।

জিরয়েড এগিয়ে এলো। সংযত কণ্ঠে বলল, আর একটা বিষয় মঁসিয়ে, এই কাল লম্বা চুলটা ছুরির বাঁটে পাওয়া গেছে–কোনো মহিলার চুল।

-ওহ, মহিলার চুল, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল পোয়ারো-ভাবনার বিষয়ই বটে।

আর কোনো কথা না বলে শেড থেকে বেরিয়ে এলো পোয়ারো। হোটেলের দিকে রওনা হলাম আমরা।

-বুঝলে হেস্টিংস, জিরয়েড লোকটা মহা তাঁদড়। একটি মহিলার চুল তুলে ধরে আমাকে ভুল পথে নিয়ে যাবার তাল করছিল।

.

মধ্যাহ্ন ভোজের পরে দুজনে বসার ঘরে আরাম করে বসেছি। হোটেলে ফিরে আসার পর থেকে নিজের মনেই ডুবে আছে পোয়ারো। অথচ ওর প্যারিস ভ্রমণের খবর শোনার জন্য আমি ছটফট করছিলাম। এবারে সে প্রসঙ্গ না তুলে আর পারা গেল না।

পোয়ারো নড়েচড়ে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল।

–আমার হঠাৎ করে প্যারিসে চলে যাওয়াটা তোমার কাছে রহস্যময় হয়ে আছে বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে কিছু বলার উপায়ও ছিল না।

প্যারিস কেন গিয়েছিলাম জান? এই যে–এটার জন্য

পকেট থেকে একটা ছোট খাম বার করে আনল পোয়ারো। খামের মুখ খুলে ভেতর থেকে খবর কাগজের রঙচটা একটা কাটিং বার করে আমার হাতে তুলে দিল।

কাটিং-এ একটি মহিলার মুখের ছবি ছাপা ছিল। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, একি, এতো মাদাম ডওব্রেয়ুইল।

মৃদু হেসে মাথা নাড়ল পোয়ারো।

বেরোণ্ডি কেসের কথা আমার মুখে হয়তো শুনে থাকবে। ইনিই হলেন সেই কুখ্যাত মাদাম বেরোণ্ডি। সেই দিনগুলোতে এই ছবির মহিলা এই নামেই পরিচিত ছিলেন। এই কেসের সুবাদে বেরোণ্ডি কেস এখন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে গেল।

এরপর বেরোণ্ডি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শোনা গেল পোয়ারোর কাছ থেকে।

বেরোণ্ডি কেস

 বছর কুড়ি আগে লায়ন্স থেকে মঁসিয়ে বেরোণ্ডি তার সুন্দরী স্ত্রী এবং ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে প্যারিসে এসেছিলেন। ছোট একটি মদ তৈরির প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তার রোজগার যা ছিল তাতে আধুনিক ফ্যাসানের বিলাসী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারছিল পরিবারটি।

মঁসিয়ে বেরোণ্ডির সুন্দরী স্ত্রী অল্পসময়ের মধ্যেই সমাজের উঁচু হলে রোমান্সের ক্ষেত্রে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল।

ইতিমধ্যে তার জন্মকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর কিছু গুজবও ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, একজন রাশিয়ান গ্র্যান্ড ডিউকের অবৈধ কন্যা মাদাম বেরোণ্ডি।

অনেকে এমনও অনুমান করল, কোনো অস্ট্রিয়ান আর্ক-ডিউক তার জন্মদাতা-বাবা–মায়ের অবৈধ মিলনে তার জন্ম।

অসাধারণ রূপ-লাবণ্য, লাস্য এবং জন্ম ইতিহাসের রহস্য সব মিলিয়ে এক তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন তিনি।

এক তরুণ উকিল জর্জের্স কনিউ জেনির প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল। মাঝবয়সী স্বামীর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেই জেনিও প্রেমের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছিল।

প্যারিসে মাস তিনেক সময়ের মধ্যে জনৈক আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপও রীতিমত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে বেরোণ্ডি পরিবারের সঙ্গে।

এমনি যখন অবস্থা, সেই সময় একদিন মাদাম বেরোণ্ডি তার বন্ধুমহলে বলাবলি শুরু করলেন, তিনি স্বামীর জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ তাঁর স্বামীর হেফাজতে কতকগুলি গোপন রাজনৈতিক কাগজপত্র সে দেখেছে। সেসব নথিতে প্যারিসের কিছু উগ্রপন্থী সদস্যের নাম সে চিনতে পেরেছে। এই নামগুলোই তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। যে কোনো সময় যা কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা।

দিন কয়েক পরেই মাদাম বেরোণ্ডির আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণ হয়ে যায়।

সেদিন পরিবারের রাঁধুনী সকালে বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়ে বিস্মিত হয়ে যায়। সাধারণতঃ মাদাম বেরোণ্ডিই তাকে দরজা খুলে দেন। সেদিন দরজা ছিল ভোলা। তাছাড়া শোবার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দও তার কানে আসছিল।

অশুভ কিছুর আশঙ্কা করে সে শোবার ঘরে ছুটে যায়। দেখতে পায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদাম বেরোণ্ডি ঘরের মেঝেয় পড়ে গোঙাচ্ছেন। অর্ধ-অচেতন অবস্থা তার।

বিছানার ওপর বুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় মঁসিয়ে বেরোণ্ডির রক্তাপ্লুত দেহ পড়েছিল।

মাদাম বেরোণ্ডি যে ঘটনা ব্যক্ত করেছিল তা হল, মাঝরাতে নিঃশ্বাসের কষ্ট হতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখতে পায়, কালো মুখোশপরা দুজন লোক তার মুখ চেপে ধরে দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলছে। সে যাতে চিৎকার করতে না পারে সেজন্য তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়।

মুখে মুখোশ আঁটা থাকা সত্ত্বেও মাদাম বেরোণ্ডি বুঝতে পারে, আততায়ী দুজন রাশিয়ান। তারা তার স্বামীর কাছে গোপন নথিপত্র দাবি করে। তিনি তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে একজন তার বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দেয়।

তার পকেট থেকে চাবি বার করে নিয়ে তারা আলমারি খোলে। সব কাগজপত্র ওখানেই রাখা ছিল। সমস্ত কুড়িয়ে নিয়ে তারা চলে যায়।

বেরোণ্ডি পরিবারের ওপর আঘাতের এই ঘটনা সেই সময় খুবই আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু পুলিস অনেক অনুসন্ধান করেন মুখোশধারী লোকগুলোর কোনো সন্ধান করতে পারেনি।

জনসাধারণ যখন এই ঘটনা প্রায় ভুলতে বসেছে সেই সময় হঠাৎ একদিন স্বামীকে হত্যা করার অপরাধে মাদাম বেরোণ্ডিকে গ্রেপ্তার করল পুলিস।

যথারীতি মামলা আদালতে উঠল। তখনই রহস্যময়ী জেনি বেরোণ্ডির জীবনকাহিনী জনসাধারণ জানতে পারে। জনৈক ফল ব্যবসায়ীকে জেরা করে জানা যায় লায়ন্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম।

স্বামীকে হত্যা করার উদ্দেশ্য জানা গেল মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে জেরা করে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করতে বাধ্য হল, সে জেনিকে ভালোবাসত।

কিন্তু তাকে বিয়ে করার বাধা স্বরূপ ছিল তার মাঝবয়সী স্বামী মঁসিয়ে বেরোণ্ডি। জেনি তার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে ভেবেছিল ট্রাপ।

জেরার জবাবে জেনিও স্বীকার করেছিল, বিত্তবান আমেরিকানকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

বিচার চলাকালে জেনি আদালতকে তার বানানো কাহিনী শুনিয়ে গেল। সে কাহিনী সম্পূর্ণ অবাস্তব হলেও অধিকাংশ লোকই তা বিশ্বাস করল। যদিও শেষ পর্যন্ত আদালত মাদাম বেরোণ্ডিকেই অভিযুক্ত করল। আদালতের রায় ছিল, মুখোশধারী দুজন রাশিয়ানই তার স্বামীকে খুন করেছিল। এই হত্যার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল মাদাম বেরোণ্ডিও তার প্রেমিক জর্জেস কনিউ।

কনিউকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি হল, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্যারিসে সরকারি উকিলের নামে ডাকে একটি চিঠি এলো। চিঠি লিখেছিল জর্জেস কনিউ–কিন্তু তাতে তার কোনো ঠিকানা দেওয়া ছিল না।

কনিউ তার চিঠিতে স্বীকার করল, সে মাদাম বেরোণ্ডিকে ভালোবাসতো। তার পরামর্শ মতোই সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডিকে হত্যা করেছিল।

মাদাম বেরোণ্ডি তাকে বুঝিয়েছিল, স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতনে সে অতিষ্ঠ। তার কবল থেকে মুক্ত হতে পারলে কনিউকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব হবে।

কনিউ পরে জানতে পেরেছিল, তাকে বিয়ে করার জন্য নয়, বিত্তবান আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে বিয়ে করার মতলবেই কনিউকে দিয়ে সে তার স্বামীকে হত্যা করিয়েছিল। জেনি আসলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

এই চিঠির জবাবে মাদাম বেরোণ্ডি আদালতে তার নির্দোষিতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে স্পষ্টই স্বীকার করল, যদিও আদালত দুই রাশিয়ানকে তার স্বামীর হত্যাকারী বলে রায় দিয়েছে, আসলে রাশিয়ানদের কাহিনী ছিল তার মনগড়া। জর্জেস কনিউ পাছে তার স্বামীর মতো তাকেও হত্যা করে সেই ভয়ে সে আগে আদালতে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি। তবে স্বামীকে হত্যা করার জন্য তার প্ররোচনার কথা জর্জেস তার চিঠিতে যা উল্লেখ করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এরকম কোনো বোঝাঁপড়া জর্জেসের সঙ্গে তার হয়নি।

যে তার প্রিয় স্বামীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, তাকে বিয়ে করার কথা সে কখনোই ভাবতে পারে না।

মাদাম বেরোণ্ডি কান্নাজুড়ানো গলায় এমন আবগেপূর্ণ ভঙ্গীতে তার কাহিনী ব্যক্ত করেছিল যে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও জুরিরা তা মেনে নিয়েছিল।

গভীর আবেগের সঙ্গে সে আরো বলে যে স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে আদালতে প্রথমে জর্জেসের নাম না করার জন্য সে তার অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছে।

তবে সে তার স্বামীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাকে খুন করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সে আদালতে সত্য গোপন করার জন্য অপরাধী সত্য কথা; স্বামীর খুনের জন্য সে কখনোই দায়ী নয়।

শেষ পর্যন্ত জুরিদের রায়ে মাদাম বেরোণ্ডি এই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

জর্জেন্স কনিউকে গত কুড়ি বছরেও পুলিস আর বার করতে পারেনি। মাদাম বেরোণ্ডিও যে তার মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে যায় সেখবরও কেউ জানে না।

.

পোয়ারোর মুখে পুরনো বেরোণ্ডি মামলা শোনার পর বর্তমান কেসটা যেন অনেক স্বচ্ছ হয়ে এলো আমার কাছে। আমি অনেক কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছি।

 পোয়ারো বলল, এবার তাহলে বল তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ।

-মাদাম ডওব্রেয়ুইলই হল সেই মহিলা জেন বেরোণ্ডি, যে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করছে। বললাম আমি।

-তাহলে তুমি বলতে চাইছ, মাদাম বেরোণ্ডিই তার স্বামীকে খুন করেছিল? আদালত তাকে ভুল করেই নির্দোষ ঘোষণা করেছিল?

-আমার মত তাই। কেন, তুমি তা মনে কর না?

–আমিও অবশ্য তোমার সঙ্গে একমত। তবে আইনের চুলচেরা হিসেবে ফেলতে গেলে মাদাম বেরোণ্ডিকে নির্দোষই বলা যায়।

–সেই অপরাধের ক্ষেত্রে হলেও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্ততঃ নয়।

–অর্থাৎ মাদাম ডওব্রেযুইলই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করেছে। কিন্তু এই খুনের মোটিভ কি? এই ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকেই তার লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই। আগের কেসের ক্ষেত্রে যেমন ছিল, বিত্তবান প্রেমিক তাকে বিয়ে করার জন্য তার স্বামীর মৃত্যুর অপেক্ষা করেছিল।

-খুনের মোটিভ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু কি হতে পারে না? বললাম আমি।

–হতে পারে। যেমন, গভীর আসক্তি বা ঈর্ষা। তাছাড়া মানসিক ভারসাম্য হারালেও খুনী এধরনের অপরাধ করতে পারে। অবশ্য মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে বলা যায় সম্পূর্ণ সুস্থ মহিলা।

–গভীর আসক্তি থেকেও এই অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। যদি ধরে নেওয়া যায় মাদাম ডওব্রেয়ুইল ছিলেন মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতা, সেক্ষেত্রে তার প্রতি আকর্ষণ কমে আসছে অনুভব করলে প্রবল ঈর্ষা বা ক্রোধবশতঃ সঁসিয়ে রেনাল্ডকে সে খুন করতে পারে না?

হাসল পোয়ারো। বলল, মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে নিয়ে অনেক ভেবেছ তুমি বন্ধু, কিন্তু তার সম্পর্কে আমি বলব, তোমার ধারণা ভুল।

আগের কেসে তার ধীরস্থির বুদ্ধির পরিকল্পনার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। চমৎকার একজন অভিনেত্রীও সে। বিত্তবান আমেরিকানকে পাওয়ার জন্য সে স্বামীর খুনী সেই যুবকটির সঙ্গে নিজেকে জড়ায়নি।

নিজের লাভের কথা মাথায় রেখেই তাকে অপরাধ করতে দেখি আমরা। তাছাড়া, কবর খোঁড়া পুরুষের কাজ, তার পক্ষে তা সম্ভব নয়।

মাদাম রেনাল্ড আর মাদাম বেরোণ্ডি তথা ডওব্রেয়ুইলের জীবনধারা আপাত দৃষ্টিতে একই মনে হলেও এক্ষেত্রে দুজনের ভূমিকা ভিন্ন।

মাদাম ডওব্রেয়ুইল আগে যে কাহিনী শুনিয়েছিল সে কাহিনীরই যদি পুনরাবৃত্তি ঘটত, তাহলে মামলা অত্যন্ত সরল হয়ে যেত। এক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে মাদাম রেনাল্ডের কার্যকলাপে।

তাহলে কি তুমি বলবে মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতার সঙ্গে দৌড়ে তিনিও ছিলেন একজন প্রতিযোগিনী?

-তা আমি মনে করি না। বললাম আমি; তাকে আমি এমন দক্ষ অভিনেত্রী বলে মনে করি না।

হেস্টিংস, তুমি এখানে যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। অপরাধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের স্থান নেই, মনে রেখো। একজন অপরাধীর একজন দক্ষ অভিনেত্রী হতে বাধা নেই। কিন্তু তা অপরিহার্যও নয়।

স্বামীর মনোযোগ বা ভালোবাসা পাবার ক্ষেত্রে মাদাম রেনাল্ড প্রতিযোগিনী ছিলেন আমি মনে করি না। কারণগুলো তোমাকে আগেই বলেছি। সেই ছোট্ট ধূসর কোষগুলো নাড়াচাড়া করলে তুমি অনেক তথ্য পেয়ে যাবে।

–পোয়ারো, তুমি আর কি জেনেছ?

–যা যা জানবার জন্য মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে ডেকে এনেছিলেন, সবই আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি।

খুনীকে তুমি জেনেছ?

–হ্যাঁ, একজন খুনীকে আমি জেনেছি। কিন্তু এখানে দুটো খুন। দ্বিতীয় খুনের ব্যাপারে আমি এখনো নিশ্চিত নই।

–কিন্তু তুমি বলেছিলে শেডের লোকটার মৃত্যু স্বাভাবিক।

–তুমি এখনো বুঝতে পারনি দেখছি, হেসে বলল পোয়ারো, খুন না করেও খুনের অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়, দুটি মৃতদেহ দুটি অপরাধের কথাই বলে।

কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার। বিহ্বল ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পোয়ারো।

–হ্যাঁ, ওই তো জ্যাক রেনাল্ড আসছেন। তাকে আমার বলা ছিল। বলল পোয়ারো।

–আশ্চর্য ঘটনা জানো, বললাম আমি, জ্যাক রেনাল্ড, ঘটনার দিন রাত্রে মারলিনভিলেতেই ছিলেন।

–আমি জানি। মাথা নেড়ে বলল পোয়ারো।

বুঝতে পারলাম, আমার আগেই পোয়ারো স্টেশনে খবর নিয়েছে। জিরয়েডও ব্যাপার জেনে থাকতে পারে।

এই সময় জ্যাক রেনাল্ড ঘরে প্রবেশ করল। সম্ভাষণ জানিয়ে পোয়ারো তাকে বসতে বলল।

–ভিলার পরিবেশ খুবই বিশৃঙ্খল হয়ে আছে বলে আপনাকে কষ্ট দিতে হল। তাছাড়া আমার আবিষ্কারের খবর আমি জিরয়েডের জানার বাইরেই রাখার পক্ষপাতি। আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন। বলল পোয়ারো।

–জিরয়েড লোকটিকে আমারও পছন্দ নয় মঁসিয়ে। খুবই সহানুভূতিহীন। বলল জ্যাক।

–আমাকে একটা সাহায্যের জন্য আপনাকে অনুরোধ করব মঁসিয়ে। পরবর্তী স্টেশনই হল আবালা, এখুনি একবার সেখানে গিয়ে ক্লোকরুমে খবর নিয়ে জেনে আসতে হবে ঘটনার দিন রাত্রে দুজন বিদেশী কোনো ব্যাগ জমা রেখেছিল কিনা। দয়া করে এই উপকারটুকু আপনি করুন।

নিশ্চয়ই করব, মঁসিয়ে, আমি এখুনি যাচ্ছি।

–মিনিট পনেরোর মধ্যেই ট্রেন পেয়ে যাবেন।

জিরয়েড আপনার গতিবিধি জানতে না পারলেই ভালো।

–খুব ভালো কথা। আমি তাহলে যাচ্ছি—

জ্যাক রেনাল্ড উঠে দাঁড়ালে, পোয়ারো তাকে বসতে ইঙ্গিত করল।

–এক মিনিট মঁসিয়ে রেনাল্ড, দুর্ঘটনার রাত্রে আপনি যে মারলিনভিলে উপস্থিত ছিলেন, আজ সকালে মঁসিয়ে হয়টেটকে তা না জানিয়ে ভুল করেছেন।

–কিন্তু আমি তো চেরবুর্গেই ছিলাম মঁসিয়ে পোয়ারো। সামান্য ইতস্ততঃ করে বলল সে।

স্টেশনের লোকেরা তাহলে আমাকে ভুল সংবাদ দিয়ে থাকবে। তারা বলেছে, সেদিন রাতে এগারোটা চল্লিশে আপনি পৌঁছেছেন।

–সে-রাতে যদি ফিরেও থাকি, তাতে কি?

–ফিরে আসার কারণটা জানাবেন?

–এর মধ্যে লুকোছাপার কিছু নেই। আমার প্রেমিকা মাদমোয়াজেল ডওব্রেয়ুইলকে আশ্বস্ত করা দরকার মনে হয়েছিল, কোনো না কবে ফিরতে পারব তা আমার জানা ছিল না।

-তারপরই ফিরে এসে ট্রেন ধরেছিলেন আপনি?

–না, শেষ ট্রেন ধরার সময় ছিল না। আমি হেঁটে সেন্ট বিউভেসে গিয়ে গ্যারেজ থেকে একটা গাড়ি নিয়ে চেরবুর্গে চলে যাই।

–বুঝতে পেরেছি, আচ্ছা আপনি রওনা হয়ে যান।

জ্যাক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পোয়ারো লাফিয়ে উঠে বলল, চল হেস্টিংস, ভিলা জেনেভিয়েভে এখুনি যেতে হবে।

–একারণেই তুমি তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিলে?

 আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনসূচক হাসি হাসল পোয়ারো।

.

১০.

 ভিলায় প্রবেশ না করে পোয়ারো সরাসরি শেডের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। আগের দিন ভিলা জেনেভিয়েভ এবং ভিলা মারগুয়েরিটের মধ্যবর্তী জায়গায় যে বেঞ্চিতে বসে জ্যাক রেনাল্ড ও মার্থাকে ঝোপের আড়ালে কথা বলতে দেখেছিলাম, সেখানে উপস্থিত হল।

-এখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে হেস্টিংস, বেঞ্চিতে বসে বলল পোয়ারো, মার্থাকে বাগানে দেখা পেয়ে যেতে পারি। আলোচনার দরকার

বলতে বলতেই দেখা গেল মাদমোয়াজেল মার্থা এদিকেই এগিয়ে আসছে। পোয়ারোর ডাক শুনে এগিয়ে এসে ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল।

-আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই মাদমোয়াজেল। বলল পোয়ারো।

নিশ্চয়ই, মঁসিয়ে পোয়ারো।

সহজভাবে কথাটা বললেও তার চোখে প্রচ্ছন্ন উদ্বেগের ছায়া আমার চোখ এড়াল না।

–সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আপনি জানতে চেয়েছিলেন খুনের ব্যাপারে আমরা কাউকে সন্দেহ করি কিনা।

-হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন সন্দেহভাজন লোক দুজন—

কিন্তু এখন বলতে হলে আমি বলব দুজন নয়, একজন।

–কে-কে সে? সাগ্রহে জানতে চাইল মার্থা।

–মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ড।

–অসম্ভব। জেদের স্বরে বলে উঠল মার্থা, জ্যাককে কেউ সন্দেহ করতে পারে না।

–কিন্তু জিরয়েড তাই করে।

মার্থার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুষ্ক স্বরে সে বলল, জিরয়েড লোকটি অতি নিষ্ঠুর।

বলতে বলতে তার চেহারা পাল্টে গেল। যেন মুহূর্তের মধ্যেই জিরয়েডকে আক্রমণ করার সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে।

গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটিকে নিরীক্ষণ করল পোয়ারো। বলল, ঘটনার রাত্রে জ্যাক এখানেই ছিল, আপনি জানেন?

–হ্যাঁ, মৃদুকণ্ঠে বলল মার্থা, সে আমাকে বলেছে।

–আজ সকালে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এ কথাটা স্বীকার না করা ঠিক কাজ হয়নি।

 –গোপন না করে উপায় ছিল না। জিরয়েড় তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করত।

–কিন্তু এই ঘটনা তার বিরুদ্ধেই যাবে। আপনি নিশ্চয় তা বুঝতে পারছেন?

-সবরকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো মনোবল আমার আছে মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি জানি জ্যাক নির্দোষ। তাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হবে না।

হঠাৎ অন্তরঙ্গ সুরে সামান্য ঝুঁকে পোয়ারো বলে উঠল, মাদমোয়াজেল, একটা কথা আপনাকে আমি বলি, আপনি যা গোপন করতে চাইছেন, আমাকে তা খুলে জানালে আপনার অহিত কিছু হবে না।

অবাক চোখে পোয়ারোকে লক্ষ্য করল মেয়েটি।

–হ্যাঁ, বলার আছে মঁসিয়ে, কিন্তু আপনার কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে।

–তবু আপনি আমাদের বলুন।

–দ্বিতীয় মৃতদেহটা সনাক্ত করার জন্য জিরয়েড আমাকে শেডে ডেকেছিলেন। আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু শেড় থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমার মনে পড়েছে ঘটনাটা। মঁসিয়ে রেনাল্ড যেদিন খুন হন সেদিন সকালে আমি বাগানে বেড়াবার সময় দুজন লোকের ঝগড়ার শব্দ শুনতে পাই। ঝোপের আড়াল থেকে আমার চোখে পড়ে মঁসিয়ে রেনাল্ড দাঁড়িয়ে আছেন আর অপর লোকটি ক্রুদ্ধস্বরে কথা বলছে। সে টাকা চাইছিল। কিন্তু তার পোশাক ভালো ছিল না। প্রবল রাগে ভীষণ হয়ে উঠেছিল সে।

-তারপর?

–ঠিক সেই সময়ই বাড়ির ভেতরে মা আমাকে ডাকতে থাকেন। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যাই আমি। কিন্তু মঁসিয়ে, আমি নিশ্চিত, সেই লোকটিরই মৃতদেহ আমি শেডের ভেতরে দেখেছিলাম।

–কিন্তু একথা তো আপনি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাননি মাদমোয়াজেল?

–সেই মুহূর্তে আমি সন্দেহ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কেননা, শেডের মৃতদেহের গায়ে ছিল দামি পোশাক। দুজনের মুখ একরকম হলেও শেডের লোকটিকে আমার অভিজাত কেউ বলেই মনে হয়েছিল।

এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে মায়ের ডাক শুনে, আমি যাচ্ছি মঁসিয়ে বলে বাড়ির দিকে ছুটল মার্থা।

আমরা অতঃপর ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে চলতে লাগলাম।

 চলতে চলতে পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি যা বলল তা সত্যি বলে তুমি মনে করছ?

–আমার বিশ্বাস সে তার প্রেমিককে আড়াল করার উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা গল্প শোনায়নি। আরও একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। জ্যাক বলেছিল, মার্থা ডওব্রেযুইলকে আশ্বস্ত করবার জন্যই দুর্ঘটনার রাত্রে ফিরে এসেছিল। কথাটা যাচাই করার জন্যই তাকে সতর্ক করে দেবার সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত সত্যটা আমি মেয়েটির কাছে জেনে নিলাম।

আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা কেবল বলল, সে আমাকে বলেছে, অর্থাৎ সে-রাতে জ্যাক এখানে ছিল একথা তার কাছে শুনেছে। হেস্টিংস, একটা ব্যাপার এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি, দুর্ঘটনার রাতে জ্যাক ফিরে এসে কি করেছিল, কার সঙ্গে দেখা করেছিল–এসব কিছুই আমি জানি না।

–কিন্তু জ্যাক তার বাবাকে খুন করেছে বলে আমার মনে হয় না।

আবার তুমি বাস্তব ছেড়ে ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ছ হেস্টিংস। ছেলে বাপকে খুন করেছে। একথা তোমার বিশ্বাস করতে বাধছে, কিন্তু আমি দেখেছি জীবনবীমার মোটা টাকা পাওয়ার লোভে মা তার ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে খুন করেছে। এমন ঘটনার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে, বল?

–কিন্তু জ্যাকের কিসের লোভ ছিল?

 –সে জানত, বাবার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির অর্ধেক সে পাবে।

–তাহলে শেডের ভেতরে মৃত অবস্থায় যে লোকটিকে পাওয়া গেল সে কে?

–জ্যাকের হিসেব বলবে, লোকটা জ্যাকের সহযোগী ছিল।

–তা যদি হয়, ছুরির হাতলে মেয়েদের চুল পাওয়া যাবে কেন?

 স্বভাবসুলভ অধৈর্যের সঙ্গে পোয়ারো বলে উঠল, সেটা আদৌ কোনো স্ত্রীলোকের চুল নাও হতে পারে। আজকাল অনেক যুবককেই মেয়েদের মতো চুল রাখতে দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে চুলটা কোনো মহিলারই। সে কে আমি জানি না।

পোয়ারোর বক্তব্যের উদ্দেশ্য আমি ধরতে পারছিলাম না। সে চেষ্টা না করে আমি অগত্যা জানতে চাইলাম, এখন আমরা চলেছি কেন?

–যে জন্য মঁসিয়ে জ্যাককে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তার ঘরটা খুঁজে দেখতে চাই।

.

অভ্যস্ত দ্রুততার সঙ্গেই পোয়ারো জ্যাক রেনাল্ডের ঘরের আলমারি, ড্রয়ার, কাগজপত্র সমস্ত কিছু আঁতিপাতি করে খুঁজল। যখন হাল ছেড়ে দিয়ে জায়গামতো সব রাখতে যাচ্ছে, তখনই একতাড়া কাগজের তলা থেকে বার করে আনল এটা ফটোগ্রাফ। সঙ্গে সঙ্গে সেটা পকেটে চালান করল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখতে পেলাম জিরয়েডের গাড়ি ভিলার সামনে এসে থামল। গাড়িতে বসে আছে জ্যাক রেনাল্ড।

দ্রুতপায়ে দুজনে নিচে এলাম।

–শুভ অপরাহু মঁসিয়ে জিরয়েড, স্বাভাবিক স্বরে বলল পোয়ারো, ব্যাপার কি?

চকিতে জ্যাক রেনাল্ডকে দেখে নিয়ে জিরয়েড বলল, ইনি জাল ছিঁড়ে পালাবার মতলব করেছিলেন। কিন্তু আমার শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারেননি। মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ডকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জ্যাক রেনাল্ডের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পোয়ারো সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

এব্যাপারে আপনার বক্তব্য –

কিছুই নয়।

দৃঢ়স্বরে বলল জ্যাক। সে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল পোয়ারার দিকে।