২. ইনসপেক্টর নীল সার্জেন্ট

দ্বিতীয় পর্ব

ইউট্টি লজে পৌঁছেই ইনসপেক্টর নীল সার্জেন্ট হেঁকে বললেন, মিস মারপলকে বল, আমি এখনই তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

একটু পরেই মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।

–বেশিক্ষণ বসতে হয়নি তো ইনসপেক্টর। আমি মিসেস ক্রাম্পের সঙ্গে রান্নাঘরে কথা । বলছিলাম। আপনাদের পক্ষে কাজ করা সহজ, সরাসরি আসল বক্তব্যে পৌঁছতে পারেন। আমি কথায় কথায় কাজ উদ্ধার করতে পছন্দ করি।

–আপনি নিশ্চয় গ্ল্যাডিস মার্টিনকে নিয়েই কথা বলছিলেন?

-হ্যাঁ। দেখলাম মিসেস ক্রাম্প মেয়েটার সম্পর্কে অনেক কথাই জানে। মানে আমি বলছি গ্ল্যাডিসের নানা ভাবনাচিন্তার কথা।

–ওতে কোন সাহায্য হয়েছে? নীল বললেন।

–হ্যাঁ। অনেক কাজ হয়েছে।

–শুনুন মিস মারপল, আপনাকে একটা জরুরী কথা বলব বলে খোঁজ করছিলাম।

–বলুন ইনসপেক্টর।

–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনার বেশ খ্যাতি আছে–

-ওসব নিশ্চয় স্যর হেনরি ক্লিদারিং-এর কাজ। আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু উনি। বললেন মিস মারপল।

–যাই হোক, দেখুন আপনার আর আমার দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ আলাদা। আমার মত হলো আসল ঘটনাটাকে বাস্তব দৃষ্টিতে দেখা।

–আপনার কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলুন। বললেন মিস মারপল।

–মিঃ ফর্টেস্কুর খুনের পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে অনেকেই লাভবান হচ্ছে, বিশেষ করে একজনের কথাই বলব।

দ্বিতীয় যে খুনটা হল, দেখা যাচ্ছে তাতেও একই লোক লাভবান হচ্ছে। তৃতীয় খুনটাকে বলতে পারেন নিরাপত্তার জন্য খুন।

কিন্তু ইনসপেক্টর, আপনি কোন খুনকে তৃতীয় বলছেন? তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন মিস মারপল।

-আপনার ইঙ্গিত ঠিক। আমি সেই ছড়ার কথাই ভাবছিলাম। রাজা তার কোষাগারে রানী তার পার্লারে আর পরিচারিকা কাপড় শুকোতে দিচ্ছে–পরপর।

-হ্যাঁ, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। গ্ল্যাডিস মিসেস ফর্টেস্কুর আগেই খুন হয়েছেন।

ঘটনা এরকমই। যদিও গ্ল্যাডিসের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক রাতে। তার মৃত্যুর সঠিক সময় জানা সম্ভব হয়নি। অবশ্য আমার ধারণা সে বিকেল পাঁচটা নাগাদ খুন হয়েছে।

তা না হলে দ্বিতীয় ট্রেটা সে নিশ্চয়ই ড্রইংরুমে নিতে যেত।

–হ্যাঁ, এতে কোন ভুল নেই। বললেন ইনসপেক্টর নীল, প্রথমে সে চায়ের ট্রেটা নিয়ে যায়। দ্বিতীয়বারে খাবারের ট্রেটা নিয়ে হলঘরে আসতেই কিছু একটা ঘটে যায়। হয় সে কিছু দেখে থাকবে নয়তো শুনে থাকতে পারে।

এমন হওয়াও অসম্ভব নয়, সেই সময়েই মিসেস ফর্টেস্কুর ঘর ছেড়ে নেমে আসছিলেন। অথবা মিসেস ইলেইনের ছেলে বন্ধু জেরাল্ট রাইটও হতে পারে।

যেই হোক, গ্ল্যাডিসকে ইশারায় বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তাকে মরতে হয় শেষ পর্যন্ত।

-আপনার অনুমান যথার্থ ইনসপেক্টর। গ্ল্যাডিস বাগানে কাপড় তুলতে গিয়েছিল, আমি তা মনে করি না। ওরকম সন্ধ্যার সময়ে কেউ কাপড় শুকোতে দিতে যায় না। গোটা বাপারটাই একটা ধোঁকা। আসলে ওই ছড়ার সঙ্গে সঙ্গতি রাখারই অপচেষ্টা বলতে পারেন। তারপর ওই নাকে ক্লিপ আটকে দেয়া–সবই।

–পাগলামি ছাড়া কিছু নয় ওসব। আর এখানেই আপনার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। আপনার ওই ছেলেভুলানো ছড়ার ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না।

-কিন্তু ওটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ঘটনাগুলো, মিলে যাচ্ছে।

–তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু ছড়ায় রয়েছে, পরিচারিকা তৃতীয় খুন। বাস্তবে আমরা দেখছি খুন হচ্ছেন রানী অর্থাৎ অ্যাডেল ফর্টেস্কু। তার আগেই অর্থাৎ পাঁচটা পঁচিশ থেকে ছটার মধ্যে, আমার বিশ্বাস গ্ল্যাডিস তার আগেই মারা গিয়েছিল। ছড়ার কথার সঙ্গে সংগতি তো রইল না মিস মারপল?

–আমার মনে হচ্ছে আপনি অসংগতিটা আরোপ করবার চেষ্টা করছেন। বললেন মিস মারপল।

ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন। মিস মারপলের কথাটা কানে তুললেন না। ঘর ছেড়ে যাবার আগে স্বগতোক্তির মতো বললেন, একজনই মাত্র হতে পারে।

.

মেরী ডাভ ছোট্ট একটা ঘরে থাকেন। নিজের ঘরে বসে তিনি পরিবারের হিসেবের খাতায় চোখ বোলাচ্ছিলেন।

এমনি সময় দরজায় টোকা দিয়ে ইনসপেক্টর নীল ঘরে ঢুকলেন।

 চোখ তুলে নিস্পৃহ চোখে তাকালেন মিস ডাভ।

–সামনের চেয়ারটায় বসুন ইনসপেক্টর। এই মাসের হিসেবটা একটু দেখে নিচ্ছি।

ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ারে বসলেন নীল। তিনি মিস ডাভের ভাবভঙ্গির সঙ্গে মনে মনে মানসিক হাসপাতালে দেখা মিসেস ম্যাকেঞ্জির ভাবভঙ্গির মিল খুঁজবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হতাশ হলেন।

একটু পরেই হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখলেন মিস ডাভ।

-এবারে বলুন, ইনসপেক্টর।

-এই তদন্তে একটা ব্যাপারের ব্যাখ্যা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে কিছু রাই পাওয়া গিয়েছিল, তার কথাই বলছি আমি যদি

ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত, বললেন মিস ডাভ, কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা আমারও জানা নেই।

–আরো একটা ব্যাপার। গত গ্রীষ্মে মিঃ ফর্টেস্কুর টেবিলের ওপরে চারটে কালোপাখি পাওয়া গিয়েছিল। আর পাইয়ের পাত্রেও মাংসের বদলে পাওয়া গিয়েছিল কালোপাখি।

–হ্যাঁ, আমি জানি।

–দুটো ঘটনার সময়েই আপনি এখানে ছিলেন?

–হ্যাঁ, ছিলাম। খুবই বিশ্রী কাজ ছিল এগুলো। তবে উদ্দেশ্যহীন কাজ বলেই ভেবেছিলাম।

-উদ্দেশ্যহীন হয়তো বলা যাবে না। বললেন নীল, ব্ল্যাকবার্ড খনির বিষয়ে আপনার কিছু জানা আছে মিস ডাভ?

-ওরকম নামের কোন খনির কথা শুনেছি বলে মনে হয় না।

 –আপনি মেরী ডাভ। তার চোখে ভয়ের আভাস দেখতে পেলেন নীল।

 –এ কিরকম অদ্ভুত প্রশ্ন, ইনসপেক্টর? আপনি কি আমার আসল নামে সন্দেহ করছেন?

–ঠিক তাই। আমি বলতে চাইছি, আপনার নাম রুবি ম্যাকেঞ্জি।

মেরী ডাভ কোন প্রতিবাদ করলেন না। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

নীল লক্ষ করলেন, মেরী ডাভের দৃষ্টি ভাবলেশহীন।

-তাহলে, আমি কি বলব আশা করছেন?

দয়া করে বলুন, আপনার নাম কি রুবি ম্যাকেঞ্জি?

–আমার নাম মেরী ডাভ।

 –এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারবেন?

–কি দেখতে চান আপনি? আমার জন্মের প্রমাণপত্র?

-সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। কেন না আপনার কাছে কোন মেরী ডাভের বার্থ সার্টিফিকেট থাকতে পারে। আপনার কোন বান্ধবী হয়তো, এখন মৃত।

–তাহলে তো অনেক সম্ভাবনাই এরকম আপনি পেতে পারেন। ওহ, খুবই দেখছি আতান্তরে পড়ে গেছেন আপনি ইনসপেক্টর।

–পাইউড স্যানাটোরিয়ামের নাম শুনেছেন? আপনাকে সম্ভবত সেখানে সনাক্ত করা যেতে পারে, বললেন, নীল।

–ওই স্যানাটোরিয়ামটা কোথায় আছে?

 –সেকথা আপার অজানা নয় নিশ্চয়ই, মিস ডাভ।

–ওই নাম জীবনে এই প্রথম আপনার মুখ থেকে শুনতে পেলাম। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

–তাহলে আপনি রুবি ম্যাকেঞ্জি নন, একথা অস্বীকার করছেন?

–কি বলব ইনসপেক্টর। আমি মেরী ডাভ নই কোন রুবি ম্যাকেঞ্জি একথা যদি আপনি জেনে থাকেন তাহলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনারই।

ইনসপেক্টর নীলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন মেরী ডাভ।

–আমি রুবি ম্যাকেঞ্জি কিনা, ইনসপেক্টর, আপনি নিশ্চয়ই প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে পারেন।

ইনসপেক্টর নীল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতেই সার্জেন্ট হে এগিয়ে এলো তার দিকে।

–স্যর, মিস মারপল আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।

–পরে দেখা যাবে। ব্যস্তভাবে বললেন নীল, সব কাজ ফেলে রেখে তুমি আগে মেরী ডাভ তার সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, যাচাই করে দেখো। তার আগের চাকরি ইত্যাদি সবকিছু খুব জরুরী।

–ঠিক আছে স্যর। এখুনি করছি।

নীল লাইব্রেরী ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

 হাতের ব্যস্ত সেলাইয়ের কাঁটার দিকে তাকিয়ে মিস মারপল লাইব্রেরীতে বসে মিসেস পার্সিলের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছিলেন।

দরজার সামনে পৌঁছে নীল শুনতে পেলেন, মিস মারপল বলছেন, আমার মনে হয়েছিল, নার্সিং-এর কাজটা আপনি খুবই পছন্দ করেন। ওটা সত্যিই মহৎ কাজ।

নীল নিঃশব্দে আড়াল নিলেন। কিন্তু তাঁর মনে হল, মিস মারপলের চোখকে তিনি ফাঁকি দিতে পারেন নি।

ঘরের ভেতরে তখন মিস মারপল বলছেন, আপনাদের আলাপ পরিচয়ও বোধ হয় এই সেবার কাজের মাধ্যমেই হয়েছিল?

-হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেভাবেই শুরু হয়েছিল। আমি এখানে পার্সিভালের সেবার জন্য এসেছিলাম।

–চাকরবাকরদের কথায় অবশ্য কান দেওয়া ঠিক নয়। শুনেছি, আপনার আগে একজন নার্স ছিলেন, তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অযত্ন করার জন্য, তাই কি?

অযত্ন ঠিক নয়। বললেন জেনিফার, ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার বদলি হিসেবে আমি এসেছিলাম।

তখনই আপনাদের রোমান্স শুরু হয়? দারুণ ব্যাপার।

-হ্যাঁ। কিন্তু কি জানেন, মাঝে মাঝে কেমন মনে হয়, আবার যদি ওয়ার্ডে ফিরে যেতে পারতাম।

-হ্যাঁ আপনার মন আমি বুঝতে পারি। কাজটা খুবই প্রিয় ছিল আপনার।

–আগে অতটা মনে হত না। কিন্তু… এমন একঘেয়ে জীবন… কোন কিছু করার নেই…ভ্যালও তার ব্যবসা নিয়েই ডুবে থাকে–

–পুরুষরা আজকাল এরকমই হয়েছে। বললেন মিস মারপল।

–কিন্তু ওরা বোঝে না যে এতে স্ত্রীর জীবন কতটা শূন্য একঘেয়ে হয়ে যায়। হয়তো এটা আমার কাজেরই সাজা। তখন মনে হয়, কাজটা করা আমার উচিত হয়নি।

-কোন কাজটার কথা আপনি বলছেন?

–ভ্যালকে বিয়ে করার কথা বলছি।…না মিস মারপল, একটু ইতস্তত করলেন জেনিফার, এসব কথা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না।

মাথা নাড়লেন মিস মারপল। প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যই যেন তিনি এরপর প্যারীতে নতুন চালু হওয়া মেয়েদের পোশাকের প্রসঙ্গ তুললেন।

.

স্টাডিরুমে মিস মারপল আর ইনসপেক্টর নীল কথা বলছেন।

-আমার যেটুকু যাচাই করার বাকি ছিল তা সম্পূর্ণ হয়েছে ইনসপেক্টর। এখন আমি নিশ্চিত। বললেন মিস মারপল।

-কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন? মিষ্টি হেসে বললেন নীল।

–আমি নিশ্চিত জেনেছি, কে মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে খুন করেছে। আপনার কাছ থেকে মারমালেডের ব্যাপারটা শোনার পরেই সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। কে, কিভাবে খুনটা করেছে, কোন কিছুই আর আমার কাছে অস্পষ্ট থাকে না।

ইনসপেক্টর নীল কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তার মনোভাব বুঝতে পেরে মিস মারপল বললেন, আমার অসুবিধা হল, মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে বোঝাতে পারি না।

–আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না মিস মারপল। বললেন নীল।

–তাহলে সব খুলেই বলছি। অবশ্য আপনার সময় থাকলে।

একটু থামলেন মিস মারপল। একটু নড়েচড়ে বসলেন, পরে বলতে শুরু করলেন।

–আমি বাড়ির সকলের সঙ্গেই কথা বলেছি। একদিকে ওই বৃদ্ধা মিস র‍্যামসবটম থেকে ক্রাম্প ও মিসেস ক্রাম্পকেউই বাদ যায়নি। ক্রাম্পকে আমার মিথ্যাবাদী বলেই মনে হল। সে যাই হোক–এখন সেই টেলিফোনের ব্যাপার থেকে নাইলনের মোজা কোন বিষয়ই আমার অজানা নেই।

নীল মিস মারপলের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালেন। তার মনে হল, বৃদ্ধা হয়তো নতুন অজানা কোন তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেই কথার অবতারণা করার জন্যই হয়তো নানা গোলমেলে প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন।

তবু তিনি অধৈর্য হলেন না। তিনি মিস মারপলের সব কথা শুনবার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলেন।

সব কথাই বলুন আপনি। বললেন নীল, তবে আসল কথাটা দিয়েই শুরু করুন।

–সেই করছি। বললেন মিস মারপল। আসল কথাটা হল গ্ল্যাডিসকে নিয়ে। আপনি তো জানেন, আমি এখানে এসেছিলাম গ্ল্যাডিসের জন্যই। আপনিই দয়া করে তার জিনিসপত্র দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাতেই আমি ওই টেলিফোনের কথা, নাইলনের মোজা ইত্যাদির বিষয় জানতে পারি। আর এই সূত্রেই মিঃ ফর্টেস্কু আর ট্যাকসিনের বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। 

মারমালেডে কে ট্যাকসিন মিশিয়েছিল এবিষয়ে আপনি কি কোন থিয়োরীর কথা বলছেন?

-না ইনসপেক্টর, এটা কোন থিয়োরী নয়। আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি ওসব।

একটু থেমে মিস মারপল ফের বললেন, কাজটা করেছিল গ্ল্যাডিসই।

 কিছুই যেন বোধগম্য হচ্ছে না এভাবে তাকিয়েছিলেন নীল। তার চোখ পিটপিট করছিল।

–আপনি তাহলে বলছেন, গ্ল্যাডিসই মিঃ ফর্টেস্কুকে মারার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মারমালেডে বিষ মিশিয়েছিল? বললেন নীল, এ অসম্ভব মিস মারপল। আপনার একথা মেনে নিতে পারছি না, আমি দুঃখিত।

-না, ইনসপেক্টর, মারমালেডে বিষটা মিশিয়েছিল গ্ল্যাডিসই, কিন্তু মিঃ ফর্টেস্কুকে মারা তার উদ্দেশ্য ছিল না। আপনিই বলেছিলেন, জেরার সময় সে খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। উল্টোপাল্টা কথা বলেছিল। ওকে অপরাধী বলেই আপনার মনে হয়েছিল।

-হ্যাঁ, তবে খুনের অপরাধ নয়। বললেন নীল।

-সেকথা ঠিক আসলে কাউকে খুন করা ওর উদ্দেশ্য ছিল না। তবে বিষটা ও মিশিয়েছিল। আমার সন্দেহ, সে জানত না ওই জিনিসটা বিষ।

–বিষটাকে তাহলে কী মনে করেছিল গ্ল্যাডিস। অবিশ্বাসের সুর প্রকাশ পেল নীলের কথায়।

হ্যাঁ, ইনসপেক্টর ওই জিনিসটাকে সে বিষ বলে জানত না। ও জানত ওটা সত্য উদ্রেকের ওষুধ।

মেয়েদের একটা বিচিত্র অভ্যাস হল তারা কাগজ থেকে নানা টুকরো খবর কেটে রেখে দেয়। বিশেষ করে প্রিয় পুরুষকে বশীভূত করার কোন জিনিস বা পদ্ধতির প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ যুগ যুগ ধরে একই রকম।

ডাইনীতন্ত্র, কবচ মাদুলি ইত্যাদি তাদের সহজে আকৃষ্ট করে। আজকাল তো বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান বলেও চালানোর চেষ্টা দেখা যায়।

এটা সত্যি যে মন্ত্রবলে কিছু করা কিংবা যাদুলাঠির কথা কেউ বিশ্বাস করবে না–যাদুলাঠির ছোঁয়ায় কাউকে ব্যাঙ করে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু কাগজে যদি ছাপা হয়, বিশেষ কোন ইনজেকশন শরীরে নিলে, আপনার মধ্যে ব্যাঙের হাবভাব ফুটে উঠবে, তাহলে কেউ অবিশ্বাস করবে না।

সত্য উদ্রেককারী এমনি কোন ওষুধের কথা যদি কাগজে ছাপা হয় আর গ্ল্যাডিসের মতো মেয়েদের চোখে যদি তা পড়ে, তারা সহজেই বিশ্বাস করে নেবে।

–এরকম কোন ওষুধের কথা তাকে কি কেউ বলেছিল?

–হ্যাঁ। অ্যালবার্ট ইভান্স। মিস মারপল বললেন, নামটা অবশ্য ভুয়ো। তবে ওই নামেই সে একটা হলিডে ক্যাম্পে গত গ্রীষ্মকালে গ্ল্যাডিসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এবং উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই তার খুব প্রশংসা করে আর ভালবাসার অভিনয় করে।

আমার বিশ্বাস সেই সময়েই সে তার ওপরে খুব অবিচার হয়েছে এমন কোন ঘটনার কথা গ্ল্যাডিসকে জানায়। সেই সূত্রেই রেক্স ফর্টেস্কুর প্রসঙ্গ উঠেছিল। সম্ভবত অ্যালবার্ট জানিয়েছিল এমন কিছু ওষুধের কথা যা প্রয়োগ করলে রেক্স ফর্টেস্তু নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করবে আর ক্ষতিপূরণ করবে।

এসব অবশ্য আমার জানার কথা নয় ইনসপেক্টর নীল, তবে এরকম যে হয়েছিল তাতে আমি নিশ্চিত।

অ্যালবার্ট ইভান্স ভালবাসার অভিনয় করে সহজেই গ্ল্যাডিসের মন জয় করতে সক্ষম হয়। মেয়েটা পুরুষের ভালবাসা লাভের জন্য বড়ই লালায়িত ছিল।

যাইহোক, অ্যালবার্টই উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গ্ল্যাডিসকে এখানে কাজ করতে পাঠায়। সহজে আজকাল কাজের লোক মেলে না। তাই কাজটা পেতে তার দেরি হয়নি।

এরপর অ্যালবার্ট আর গ্ল্যাডিস সাক্ষাতের জন্য একটা দিন স্থির করে। আপনি গ্ল্যাডিসের ঘরে কয়েকটা ছবির পোস্টকার্ড পেয়েছিলেন, নিশ্চয় আপনার মনে আছে। তার একটাতে লেখা ছিল। আমাদের দেখা করার তারিখ মনে রেখো।

একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ওরা দুজনে কাজে নেমেছিল। তাই পরস্পরের সাক্ষাতের ওই দিনটা দুজনের কাছেই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল।

অ্যালবার্ট সেই সত্য উদ্রেককারী বিশেষ ওষুধটা গ্ল্যাডিসকে দিয়েছিল? ওই বিশেষ দিনেই সেটা মারমালেডে মিশিয়ে দেবার কথা ছিল যাতে ওই দিনই মিঃ ফর্টেঙ্কু প্রাতরাশে সেটা খেতে পারেন। অ্যালবার্ট এই কথাও বলেছিল গ্ল্যাডিস যেন কিছু রাই মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে রেখে দেয়।

অ্যালবার্ট কিভাবে কি বুঝিয়েছিল গ্ল্যাডিসকে আমি সেসব জানি না। তবে, গ্ল্যাডিসকে আমি যতটা জানি, সহজেই সে সবকিছু বিশ্বাস করে নিয়েছিল। ওর মত একটি অবাঞ্ছিত মেয়েকে সুপুরুষ কোন তরুণ যা বলবে তাই বিশ্বাস করে নেওয়া তার পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব ছিল না।

ইনসপেক্টর হাঁ করে যেন গিলছিলেন মিস মারপলের কথাগুলো। তিনি সম্মোহিতের মতোই বলে উঠলেন, তারপর? বলতে থাকুন।

–ব্যাপারটা ছিল এই রকম, ওইদিন অ্যালবার্ট মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর সঙ্গে অফিসে দেখা করতে যাবে। ইতিমধ্যে প্রাতরাশের সঙ্গে খাওয়া সত্য উদ্রেকের ওষুধ কাজ করতে শুরু করবে আর মিঃ ফর্টেষ্ণু সব স্বীকার করবেন।

মিস মারপল কথা শেষ করলেন দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে। পরে বললেন, ইনসপেক্টর নীল, একবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণুর মৃত্যুর খবর পাবার পর গ্ল্যাডিসের মনোভাব কি রকম হওয়া সম্ভব।

–কিন্তু মিস মারপল, ঘটনা যদি এরকমই হতো, তাহলে আমার জেরার মুখে গ্ল্যাডিস কথাটা প্রকাশ না করে পারত না।

-তাহলে আপনি মনে করবার চেষ্টা করুন, তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন মিস মারপল, আপনি যখন তাকে জেরা শুরু করেন, তখন প্রথমেই সে আপনাকে কি বলেছিল?

–সে বলেছিল, আমি এ কাজ করিনি। নীল বললেন।

-ঠিক তাই, গর্বিত স্বরে বললেন মিস মারপল, আপনার জানার কথা নয় ইনসপেক্টর, ঠিক ওরকম কথাই ও বলতে অভ্যস্ত ছিল। কোন গহনা কিংবা বাসন ভেঙ্গে ফেললেও, গ্ল্যাডিস সব সময় বলত, আমি একাজ করিনি মিস মারপল। কি করে হল ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমার বিশ্বাস ওর মতো মেয়েরা এরকম বলতেই অভ্যস্ত। কোন দোষ ঘটে গেলে, ওদের সবার আগে চিন্তা হয় কি করে দায় এড়িয়ে যাওয়া যায়। এটাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

কোন দুর্বল মনের তরুণী যখন কাউকে খুন করতে না চাইলেও তার খুনের কারণ হয়ে পড়ে তখন সে কথাটা স্বীকার করে নেবে, এরকমটা নিশ্চয়ই আপনি ভাববেন না। এরকম হলে তা খুবই অস্বাভাবিক বলতে হবে।

ইনসপেক্টর নীলের মনে পড়ল গ্ল্যাডিসের কথাগুলো। মেয়েটা খুবই নার্ভাস ছিল। অস্থিরভাবে বারবারই এককথা উচ্চারণ করছিল, আর এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছিল। এসবের যে কোন গূঢ় কারণ থাকতে পারে তা তার তখন মনে হয়নি। এখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারছিলেন।

–সবকিছু অস্বীকার করবে স্বভাবতঃই এই সিদ্ধান্ত করে নিয়েছিল গ্ল্যাডিস। তারপর কি করে কি হলো এসব হয়তো ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিল। ভেবেছিল হয়তো অ্যালবার্ট জানত না ওষুধটা কতটা কড়া। কিংবা নিজে বেশি মাত্রায় দিয়ে ফেলেছে এরকমও ভেবে থাকতে পারে।

অ্যালবার্ট যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তা অনুমান করেছিল গ্ল্যাডিস। সে তা করেও ছিল অবশ্য। আমার ধারণা অ্যালবার্ট টেলিফোন করেছিল তাকে।

সেদিন বাড়িতে অনেক টেলিফোন এসেছিল। যখনই মিসেস ক্রাম্প বা ক্রাম্প রিসিভার তুলেছে অমনি লাইন কেটে যায়।

এরকমই হয়তো অ্যালবার্ট করতো, যতক্ষণ না গ্ল্যাডিস ফোন ধরত। অ্যালবার্ট তাকে ওইদিন গ্ল্যাডিসকে তার সঙ্গে দেখা করার কথাই বলতো।

আমার এই অনুমানের একটা সমর্থন পাওয়া যায় মিসেস ক্রাম্পের কথায়। তিনি বলেছেন, ওইদিন ও সবচেয়ে ভাল নাইলনের মোজা আর জুতো পরেছিল। সে কারো সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল।

গ্ল্যাডিস জানত অ্যালবার্ট ইউট্রিলজেই আসছিল। এই কারণেই খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল গ্ল্যাডিস। অন্যদিনের চাইতে অনেক দেরিতে চা এনেছিল।

আমার ধারণা দ্বিতীয় ট্রেটা নিয়ে ও যখন হলঘরে যায় তখনই পাশের দরজা দিয়ে অ্যালবার্টকে দেখতে পায়।

অ্যালবার্ট হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছিল। ট্রে নামিয়ে রেখে গ্ল্যাডিস তার সঙ্গে দেখা করতে চলে যায়।

এরপরই ওকে গলা টিপে হত্যা করে? বললেন নীল।

–অ্যালবার্ট কোন ঝুঁকি রাখতে চায়নি। সে এক মিনিটের মধ্যেই কাজ সেরেছিল। বোকা মেয়েটাকে শয়তান খুনীর হাতে মরতে হল। সে ওর নাকে একটা ক্লিপ এঁটে দেয়। এই কাজটা খুনী করেছিল ছড়ার কথার সঙ্গে ব্যাপারটাকে খাপ খাওয়ানোর জন্য। সবই ছিল যথারীতি-রাই, কাতলোপাখি, কোষাগার, রুটি আর মধু। আর পাখির নাক ঠোকরানোর ব্যাপারটাকে বোঝাতে চেয়েছিল ক্লিপ আটকে।

-তার মানে বলতে চাইছেন, নিজেকে উম্মাদ প্রতিপন্ন করে শাস্তি এড়াবার ফন্দি এঁটেছিল খুনী? বললেন নীল।

শাস্তি সে এড়াতে পারবে না ইনসপেক্টর। কারণ হল, সে মোটেও উম্মাদ নয়, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।

নীল এবারে নড়েচড়ে বসলেন। পরে বলতে লাগলেন।

-আপনি যা পেশ করলেন, এটাকে একটা থিওরীই বলা চলে মিস মারপল। হয়তো আপনি বলবেন, থিওরী নয় আপনি এসব জানেন। আপনি বলতে চাইছেন, অ্যালবার্ট নামে একটা লোক উদ্দেশ্য মূলক ভাবে খুনগুলো করে। নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে হলিডে হোমে গ্ল্যাডিসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল।

সেই পুরনো ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারে প্রতিশোধ নেবার জন্যই অ্যালবার্ট ইভান্স এই সব করেছিল, এই যদি আপনার বলার উদ্দেশ্য হয় তাহলে মেনে নিতে হয় মিসেস ম্যাকেঞ্জির ছেলে ডন ম্যাকেঞ্জি যুদ্ধে মারা যায়নি।

জীবিত থেকে সেই এই সমস্ত করেছে।

ইনসপেক্টর নীল অবাক হয়ে দেখলেন, মিস মারপল তার কথা অস্বীকার করে সজোরে মাথা ঝাঁকালেন।

-না, ইনসপেক্টর না, ওরকম কিছুই আমি বলছি না। কালোপাখির ব্যাপারটা কেউ একজন জানতো, যেগুলো লাইব্রেরীতে আর পাইয়ের মধ্যে রাখা হয়েছিল। সেই এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়েছিল।

কালোপাখিগুলো যে রেখেছিল সে নিশ্চয় ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা জানত। প্রতিশোধ নেবার কথাটাও তার মাথায় ছিল।

তবে মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে খুন করা তার ইচ্ছা ছিল না। সে চেয়েছিল ভয় ধরিয়ে দিয়ে মিঃ ফর্টেস্কুকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে প্রতিশোধ নিতে।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি আপনাকে বলেছিলেন বাচ্চাদের তিনি প্রতিশোধ নেবার জন্য তৈরি করে তুলেছিলেন। কিন্তু ইনসপেক্টর, আমি বিশ্বাস করি না একাজ করা সম্ভব। বাচ্চাদের এভাবে তৈরি করা যায় না।

কেন না, অপরিণত বুদ্ধি হলেও বাচ্চাদের একধরনের বুদ্ধিবিবেচনা থাকে। তারা বড়জোর এটুকু করতে পারে, বাবার মৃত্যুর যে কারণ হয়েছে, যাতে সে মানসিক কষ্ট পায়। এই ক্ষেত্রে এরকমই কিছু হয়েছিল আর খুনী সেটা কাজে লাগায়। তাই বলছি কালোপাখির ব্যাপারটা পুরোপুরি ধাপ্পা।

–তাহলে একজন খুনীকে আলাদাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বললেন নীল, আপনি এবারে খুনীর সম্পর্কে বলুন, লোকটি কে?

-খুনী। মৃদু হাসলেন মিস মারপল, খুনী সম্পর্কে আমার বিবরণ শুনলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন লোকটি কে। অন্তত খুনগুলো করার মতো মানসিক গঠন কার থাকতে পারে তা আপনি বুঝতে পারবেন।

লোকটি মোটেই উম্মাদ নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ, আর দারুণ বুদ্ধিমান। তবে একেবারেই বিবেকহীন। আরো বলি, সে এই খুনগুলো করেছে, স্রেফ টাকার জন্য।

পার্সিভাল ফর্টেস্কুর কথা বলছেন? মনের সায় পাচ্ছিলেন না, তবুও নামটা উচ্চারণ করলেন নীল।

–ওহ, না ইনসপেক্টর, পার্সিভাল নয়। সে হলো ল্যান্সলট ফর্টে।

–এ একেবারেই অসম্ভব।

মিস মারপলের দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নীল।

মিস মারপল যে রকম মানুষের চরিত্র এঁকেছেন, তাতে নীল অবাক হননি। খুনীর সাদৃশ্য ল্যান্সের সঙ্গে প্রায় হুবহু এক। কিন্তু সুযোগ আর সম্ভাবনার কথা ভেবেই তিনি কথাটা বলেছেন।

মিস মারপল বুঝতে পারলেন, ইনসপেক্টর নীলের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকাতে হলে তাকে ধাপে ধাপে পরিষ্কার করে সব বোঝাতে হবে। তিনি তাই ধীর শান্ত স্বরে তার ব্যাখ্যা শুরু করলেন।

-ল্যান্স বরাবরই ছিল নির্দয় প্রকৃতির। অতি বদ তার চরিত্র। অথচ সুপুরুষ চেহারার জন্য সে ছিল আকর্ষণীয়, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে।

ল্যান্সের মানসিক গঠন এমনই ছিল যে সে চিরদিন ঝুঁকি নেবার জন্যই তৈরি ছিল। সে নানা ঝুঁকি নিয়েছে আর বাহ্যিক আকর্ষণের জন্যই লোকে তার কথা বিশ্বাস করেছে।

গত গ্রীষ্মকালে সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তবে সে যে তার বাবার চিঠি পেয়ে দেখা করতে এসেছিল, অথবা তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। এমন কোন প্রমাণও নিশ্চয়ই আপনি পাননি।

-না, মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু ল্যান্সকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ পাইনি। বললেন নীল, একটা চিঠি আমি পেয়েছি ল্যান্সের লেখা।

তবে সেটা একটা কারচুপিও হতে পারে। এখানে এসে পৌঁছনোর পর বাবার কাগজপত্রের মধ্যে ওটা গুঁজে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।

–চমৎকার। তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাজ। বললেন মিস মারপল, যাইহোক, বাবার সঙ্গে একটা মিটমাট কবে নেবার জন্যই সম্ভবত সে এখানে এসেছিল। কিন্তু তার বাবা রাজি হননি।

ল্যান্সের অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করুন। সে বিয়ে করেছিল। আর তার সৎ উপার্জনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বেঁচে ছিল কোন রকমে।

কিন্তু তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। প্যাট মেয়েটি সত্যিই ভাল। তাকে ভালবাসতো ল্যান্স। সেজন্যই সে চাইছিল একটা সম্মানজনক জীবন।

ল্যান্স যখন ইউট্রিলজে আসে তখনই সম্ভবত কালো পাখির ব্যাপারটা শুনেছিল। অ্যাডেল অথবা তার বাবা বলে থাকবে।

তখনই তার মনে পড়ে যায় ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা। সে ধরে নেয় ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ে নিশ্চয়ই ছদ্মপরিচয়ে ওদের বাড়িতে আছে।

ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে সে খুনের পরিকল্পনা নেয় যাতে ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ের কাঁধেই দোষটা চাপানো যায়।

ল্যান্স বাবার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিল, কিছু আদায় করা সম্ভব হবে না। তাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের পরিকল্পনা নিতে হয়।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর শরীর যে ভাল যাচ্ছে না তা ল্যান্স জানতো। তাই সে দেরি করার পক্ষপাতি ছিল না। কেননা ইতিমধ্যে তিনি মারা গেলে তার ভবিষ্যৎ একেবারেই তলিয়ে যাবে।

-হ্যাঁ, ল্যান্স তার বাবার শরীরের অবস্থার কথা জানতো। বললেন নীল।

–আমার ব্যাখ্যা তো তাহলে মিলেই গেল। বললেন মিস মারপল। যাই হোক, দৈবাৎই বলতে হবে কালোপাখির ছড়ার দিকে ল্যান্সের আগ্রহ জেগেছিল। তার বাবার নাম রেক্স ফর্টেস্কু। রেক্স শব্দটা আর পাই ও ডেস্কের ওপরে কালোপাখির উপস্থিতিই সম্ভবত তার এই আগ্রহ জাগার মূলে কাজ করেছিল।

আসলে তার পরিকল্পনাটাকে যতটা সম্ভব জটিল করে তুলতে চেয়েছিল সে। তার প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ব্ল্যাকবার্ড মাইনের ঘটনাটাকে অর্থাৎ মিসেস ম্যাকেঞ্জির প্রতিশোধ নেবার হুমকির সঙ্গে ঘটনাটাকে জড়ানো।

ছড়ার সঙ্গে সংগতি রেখেই তাই সে অ্যাডেলকে খুন করে। যাতে ব্যবসা থেকে এক লক্ষ পাউণ্ড বেরিয়ে যায়।

কিন্তু ছড়ার সঙ্গে মেলাবার জন্য আর একটা চরিত্রও দরকার হয়ে পড়েছিল। একজন পরিচারিকা যে বাগানে কাপড় মেলতে ব্যস্ত থাকবে। একটা ধাঁধার মতো করেই ছকটাকে সে তৈরি করেছিল। তার নিরীহ সহযোগীর মুখ বন্ধ করে দেবার মত চমৎকার অ্যালিবাইও সে ছকে রেখেছিল।

বিকেলে চা পর্বের আগেই সে বাড়িতে হাজির হয়। সেই সময়েই গ্ল্যাডিস দ্বিতীয় ট্রে নিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল।

বাগানের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে সে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় আর হাতছানি দিয়ে গ্ল্যাডিসকে ডাকে।

গ্ল্যাডিস এগিয়ে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে শ্বাসরোধ করে। তারপর দেহটা বাগানের পেছনে যেখানে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয় সেখানে বয়ে নিয়ে যায়। এই কাজে সে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি সময় ব্যয় করেনি।

এরপর আর কোন বাধা থাকে না। সে সদর দরজায় এসে ঘণ্টা বাজায়। বাড়িতে ঢোকার পর সে সকলের সঙ্গে চায়ে যোগ দেয়। চা পানের পর মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ওপরে চলে যায়।

ল্যান্স যখন নেমে আসে, অ্যাডেল তখনো ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছিলেন। সে তার পাশে বসে কথা বলতে থাকে এবং সুযোগ মতো চায়ে সায়ানাইড মিশিয়ে দেয়।

আমার ধারণা চিনি নেবার অছিলাতেই সাদা গুঁড়োর সায়ানাইড সে অ্যাডেলের কাপেই ফেলে দেয়। হেসে বলে, যাঃ ভুল করে তোমার কাপে আরো চিনি দিয়ে ফেললাম।

অ্যাডেল নিশ্চয়ই বলে, এজন্য সে কিছু মনে করেনি। এই চিনি মেশানোর ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলেও খুব ঝুঁকির সন্দেহ নেই। দুঃসাহসী ল্যান্স ঝুঁকির কাজই বরাবর করেছে।

–আপনার ব্যাখ্যা অসম্ভব নয় মিস মারপল, বললেন নীল, বাস্তবে এরকমটা সম্ভবপর। কিন্তু, একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। তিন তিনটে খুনের ঘটনা ঘটিয়ে সে কি পেতে চেয়েছিল।

নিজের প্রাপ্য যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য ব্যবসায় বিপর্যয় ঠেকাবার প্রয়োজন ছিল, তার জন্য রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যু না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাকি দুটি মৃত্যু থেকে তো তার প্রাপ্য কিছু বেশি হবার ব্যাপার ছিল না।

–আপনার সঙ্গে আমি একমত ইনসপেক্টর, বললেন মিস মারপল, আর ঠিক এই কারণেই ব্ল্যাকবার্ড খনির দিকে চোখ ফেলতে হয়। আমার ধারণা, ওই খনির ব্যাপারটা সত্যিই ভুয়ো ছিল না। ল্যান্স সেটা জানতো।

ইনসপেক্টর নীল, স্মৃতি হাতড়ে নানা টুকরো কথা মনে আনবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আজ লণ্ডনের অফিসে পার্সিভালকে বলা ল্যান্সের কথাগুলো তার মনে পড়ল। ঝুঁকির লগ্নীর সঙ্গে অলাভজনক সোনার খনি ব্ল্যাকবার্ড নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল সে।

খনিটার ব্যাপারে এমন ভুল করা মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর পক্ষে কতটা সম্ভব তা ভাববার চেষ্টা করলেন নীল।

যদি ধরে নেওয়া যায় খনিটা অলাভজনকই ছিল, কিন্তু বর্তমানে এর উন্নতি ঘটেছে।

তাহলে খনিটা কোথায়? ল্যান্স বলেছে পশ্চিম আফ্রিকায়। অথচ মিস র‍্যামসবটমই সম্ভবত বলেছিলেন সেটা পূর্ব আফ্রিকাতে।

ল্যান্সের তাহলে এরকম ভুল বলার উদ্দেশ্য কি হতে পারে? তবে এমনও হতে পারে বৃদ্ধা র‍্যামসবটমের স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। আবার নাও হতে পারে।

ল্যান্স এসেছে পূর্ব আফ্রিকা থেকে। আর যদি খনিটা পূর্ব আফ্রিকাতেই হয়ে থাকে, তাহলে খনি সম্পর্কে নতুন খবর শোনা তার পক্ষে সম্ভব।

নানা কথা চিন্তা করতে করতে আচমকা নীলের মনে পড়ে গেল–আজই ট্রেনে বেডন হীথ ফেরার সময় খবরের কাগজে একটা সংবাদ তার নজরে পড়েছে। টাইম পত্রিকায় খবরের হেডিংটা ছিল এরকম : টাঙ্গানাইকায় ইউরেনিয়ামের স্তর আবিষ্কার।

নীল ভাবলেন, যদি ওই ইউরেনিয়াম ব্ল্যাকবার্ড খনির এলাকায় হয়ে থাকে, তাহলে সমস্ত ব্যাখ্যাই সুন্দরভাবে মিলে যায়।

ওই খনির ভেতরে ইউরেনিয়ামের স্তর রয়েছে ল্যান্স হয়তো সেখানে এই খবর শুনেছিল। আর এই কারণেই সে এতকালের অলাভজনক ঝুঁকিকর খনি নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ল্যান্স জেনে গিয়েছিল ওখানে ইউরেনিয়ামের স্তরে তার জন্য বিশাল সৌভাগ্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু…

নীল মিস মারপলের দিকে তাকালেন। বললেন, কিন্তু এসব কি করে প্রমাণ করা যাবে বলে ভাবছেন আপনি?

-আপনি নিশ্চিত প্রমাণ করতে পারবেন আমার বিশ্বাস। গোড়া থেকেই লক্ষ করেছি, আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। খুনী কে যখন আপনি জানতে পেরেছেন, দরকারী সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতেও আপনার অসুবিধা হবে না।

যেমন ধরুণ, ওই হলিডে ক্যাম্পের ঘটনা। সেখানে তার ছবি দেখে সকলেই তাকে সনাক্ত করতে পারবে। অ্যালবার্ট ইভান্স নামে একসপ্তাহ সেখানে কাটিয়েছিল সে। কিন্তু ওই নাম নেবার কি দরকার হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। বলতে পারেন, এখানেও সে একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছিল।

ইনসপেক্টর নীল মাথা ঝাঁকালেন। পরে বললেন, কিন্তু মিস মারপল, এসব কিছুই তো কল্পনা নির্ভর।

-হলেও আমি নিশ্চিত এরকম চরিত্র আপনি আগেও দেখেছেন।

 –হ্যাঁ। দেখেছি। মৃদু হাসলেন নীল।

-বেচারী প্যাটকে দেখেই ল্যান্সের দিকে নজর পড়েছিল আমার। বড় দুর্ভাগা মেয়ে–সবসময় বদ লোককেই ও বিয়ে করেছে।

-কিন্তু রুবি ম্যাকেঞ্জির ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয় এখনো।

–কারণ আপনি বরাবর ভুল মানুষকেই ভেবেছেন। মিসেস পার্সির সঙ্গে গিয়ে কথা বলুন, তাহলেই আপনার ধন্দ ঘুচবে।

.

ইনসপেক্টর নীল জেনিফার ফর্টেস্কুর ঘরে এলেন।

মিসেস ফর্টেস্কু, বিয়ের আগে আপনার নাম কি ছিল, জানতে পারি?

–ওহ।

প্রশ্ন শুনে বেশ চমকে গেলেন জেনিফার। তার চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল।

–সত্য কথাটা ভোলাখুলি বলাই ভাল মাদাম। আমার মনে হয় বিয়ের আগে আপনার নাম ছিল রুবি ম্যাকেঞ্জি; তাই না?

–আমি–মানে–এতে ক্ষতি কি হল?

–না, ক্ষতি বা দোষের কিছু নয়। বললেন নীল, কদিন আগে পাইউড স্যানেটোরিয়ামে আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

-মায়ের সঙ্গে এখন আর দেখা করতে যাই না। মা আমার ওপর রাগ করে আছেন। নিশ্চয়ই জানেন, মা বাবাকে খুব ভালবাসতেন।

–আর তাই তিনি আপনাকে স্বামীর হত্যার প্রতিশোধ নেবার মতো করে তৈরি করেছিলেন?

–হ্যাঁ, বললেন জেনিফার ফর্টেস্কু, ছেলেবেলা থেকেই তিনি বাইবেল স্পর্শ করিয়ে আমাদের শপথ করাতেন–যেন আমরা ভুলে না যাই তাকে একদিন খুন করতে হবে। বড় হয়ে যখন হাসপাতালের কাজ করতে যাই, তখন বুঝতে পেরেছিলাম, মার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না।

–তার পরেও, আপনার মনে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা ছিল?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, সেটা ছিল। আমি জানতাম মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন। তিনি গুলি করে বা ছুরি মেরে বাবাকে হত্যা করেননি। কিন্তু তার জন্যই বাবাকে মরতে হয়েছিল। দুটো ব্যাপারই এক, তাই নয়?

-হ্যাঁ, নৈতিক দিক থেকে এক।

–আমি তাই ঠিক করেছিলাম, তাকে কিছু শিক্ষা দেব। বললেন জেনিফার, সেই উদ্দেশ্যেই আমি এখানে তার ছেলের দেখাশোনার কাজটা নিয়েছিলাম। আমার আসার আগে আমার এক বান্ধবীই কাজটা করছিল। কিন্তু ইনসপেক্টর, সত্য কথা বলতে ঠিক কি ভাবে কি করব তা আমি কিছুই জানতাম না।

মিঃ ফর্টেস্কুকে খুন করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কেবল এটুকুই মাথায় ছিল তাঁর ছেলের সেবাযত্নে ত্রুটি রাখব, তাইতেই সে মারা যাবে। কিন্তু আমি তা পারি নি। কোন নার্সই সম্ভবত এমন কাজ করতে পারে না।

আমি রীতিমত পরিশ্রম করে ভ্যালকে সুস্থ করে তুলি। এর মধ্য দিয়েই সে আমাকে ভাল বাসতে শুরু করে। পরে বিয়ের কথা বলে।

আমি তখন ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি। ভ্যালকে বিয়ে করেই আমি প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবি।

অর্থাৎ ভ্যালকে বিয়ে করে তার বাবার সব টাকাকড়ির মালিক হব আমি। এভাবেই বাবাকে ঠকিয়ে তিনি যে টাকা আত্মসাৎ করেন তা আমার হাতে আসবে। এই কাজটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়েছিল।

হ্যাঁ, আপনার মনোভাব অযৌক্তিক ছিল না। বললেন নীল, আপনিই মনে হয় পাইয়ের মধ্যে আর টেবিলে কালোপাখি রেখেছিলেন?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর নীল, বললেন জেনিফার, কাজটা খুবই বোকার মতো হয়ে গিয়েছিল। তবে যেভাবে মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু অহঙ্কার করে তার কীর্তিকাহিনী শোনাতেন, কি ভাবে আইন মেনেই মানুষকে একের পর এক বোকা বানিয়ে ঠকিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছিল তাকে বেশ ভয় দেখিয়ে দিতে হবে।

আর সেই কালোপাখির ঘটনার পরে তিনি বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন। মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

একটু থামলেন জেনিফার। শান্ত চোখে তাকালেন নীলের দিকে।

–এটুকুই কেবল, ইনসপেক্টর, এর বেশি আমি কিছুই করিনি। কাউকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, নিশ্চয়ই আপনি তা বুঝতে পারবেন।

-তা হয়তো পারি, হাসলেন নীল, তবে একটা কথা, আপনি কি ইদানীং মিস ডাভকে কোন টাকা দিয়েছিলেন।

জেনিফার রীতিমত চমকে উঠলেন। ভীত স্বরে বলে উঠলেন, আপনি কি করে জানলেন একথা?

–আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয় মাদাম। বললেন নীল।

–আপনি তাকে রুবি ম্যাকেঞ্জি বলে ভাবছেন, একদিন সে এসে আমাকে একথা জানায়। সে বলে, ওকে যদি পাঁচশো পাউণ্ড দিই তাহলে সে আপনার কাছে রুবি ম্যাকেঞ্জি হয়েই থাকবে। আরও বলে, আমিই রুবি ম্যাকেঞ্জি একথা আপনি জানতে পারলে মিঃ ফর্টেঙ্কু ও তাঁর স্ত্রীকে খুনের অপরাধে আমাকেই অভিযুক্ত করা হবে।

ভ্যালকে এসবকথা জানাতে পারিনি, আমার কথাটাও জানত না। তাই অনেক কষ্ট করে আমাকে টাকাটা জোগাড় করতে হয়েছিল।

আমার বিয়ের বাগদানের হীরের আংটি আর মিঃ ফর্টেল্ক দিয়েছিলেন একটা নেকলেস–এই দুটো জিনিস বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।

–দুঃখ করবেন না মাদাম, সহানুভূতির সঙ্গে বললেন নীল, টাকাটা মনে হয় আদায় করে দিতে কষ্ট হবে না।

.

পরদিন মিস মেরী ডাভের সঙ্গে দেখা করলেন ইনসপেক্টর নীল।

–মিস ডাভ, আবার একবার আপনার কাছে আসতে হল।

একই রকম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নীলের দিকে তাকালেন তিনি।

-বলুন, ইনসপেক্টর।

-ভাবছি, মিসেস পার্সিভালের নামে আপনি পাঁচশো পাউণ্ডের একটা চেক লিখে দেবেন কিনা?

মুহূর্তে মেরী ডাভের মুখের চেহারা পাল্টে গেল। নীলের মনে হল, তার মুখের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে।

–ওই বোকা স্ত্রীলোকটা দেখছি সবই আপনাকে বলে দিয়েছে।

 ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন মেরী ডাভ।

-হ্যাঁ, তা বলেছেন। আপনার জানা নেই বোধহয় মিস ডাভ, ব্ল্যাকমেল গুরুতর অপরাধ।

–এটা ব্ল্যাকমেল নয় ইনসপেক্টর। তার কিছু কাজ আমি করে দিয়েছিলাম। ওটা তারই পারিশ্রমিক।

–সেরকমই না হয় আমি ভাবব, আপনি চেকটা দিয়ে দিলেন।

মেরী ডাভ আর কথা বাড়ালেন না। চেকবইটা এনে নীরবে মাথা গুঁজে একটা চেক লিখলেন।

–মনে হয় আপনি অন্য কাজ খুঁজছেন?

–হ্যাঁ। এই কাজটা ঠিক মনঃপুত হয়নি।

–তাই দেখছি। বললেন নীল। সব কিছুই আপনাকে বেশ অসুবিধায় ফেলে দিয়েছে।

আমাদেরও হয়তো যে কোন মুহূর্তে আপনার অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হতে পারে।

–কিছুই পাবেন না ইনসপেক্টর, আমার অতীত সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ।

 আবার শান্ত নির্লিপ্তভাব ফিরে এলো ডাভের কণ্ঠে।

–তেমন হলে তো সত্যিই সুখের ব্যাপার। তবে একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত যে গত তিন বছর যে সব জায়গায় আপনি কাজ করেছেন আপনি কাজ ছেড়ে চলে আসার তিন মাসের মধ্যেই সেখানে ডাকাতি হয়। এটাকে আশ্চর্য সমাপতনই বলা যায়, কি বলেন?

–এরকম তো ঘটতেই পারে ইনসপেক্টর।

-তা পারে অবশ্যই, বললেন নীল, তবে প্রতিক্ষেত্রেই এরকম হওয়াটা কি ঠিক মিস ডাভ? আমার মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও আমাদের আবার দেখা হয়ে যেতে পারে।

–কিছু মনে করবেন না ইনসপেক্টর, আমাদের দেখা না হয় সেটাই আশা করি।

.

-ওর বউটার জন্যই দুঃখ হয়। বললেন মিস র‍্যামসবটম। ছেলেটা সব সময়ই অন্যরকম ছিল। অবাক হয়ে ভেবেছি আমার বোন এলভিরার ছেলে কেন এরকম হল। অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম কিন্তু স্নেহের বশে কিছু বলতে পারতাম না।

কিন্তু খারাপ কাজ সবসময়ই খারাপ। সেজন্য শাস্তি হওয়া উচিত। এটাই চিরন্তন রীতি। আপনার মাধ্যমেই এখানে হয়তো সেকাজটা হবার ছিল। আমি অখুশি নই মিস মারপল। আশাকরি পুলিস ইনসপেক্টরকে সব জানিয়ে দিয়েছেন?

–হ্যাঁ। তিনি নিজেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। বললেন মিস মারপল।

–তিনি এসব কিছু প্রমাণ করতে পারবেন?

–আমি নিশ্চিত তিনি পারবেন? একটু সময় হয়তো লাগতে পারে।

সুটকেস গোছগাছ করে মিস মারপল আগেই ক্রাম্পের হাতে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মিস র‍্যামসবটমকে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এবারে তিনি নিচে নেমে এলেন।

প্যাট ফর্টেস্কু তাকে বিদায় জানাবার জন্য হলঘরে অপেক্ষা করছিলেন।

–আপনি আমাদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার অভাব বেশ বোধ করব।

–কাজের জন্য এসেছিলাম, সেটা শেষ হল, এবারে তো যেতেই হবে। দুঃখ রইল কাজটা তেমন সুখকর হল না। তবে মন্দ কাজের জয় তো হয় না।

প্যাট কথাটা বুঝতে না পেরে বিস্মিতভাবে তাকালেন।

–আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-তা আমি জানি। একদিন হয়তো পারবেন। তবে যাবার আগে একটা পরামর্শ দিয়ে যাই, যদি কোথাও কোন গোলমাল হয়, আপনি বিপর্যস্ত বোধ করেন, তাহলে আপনার ছেলেবেলার সেই আয়ারল্যাণ্ডেই ফিরে যাবেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেদনাকাতর চোখে প্যাটের দিকে তাকালেন মিস মারপল।

–এখানে আর আমাদের থাকবার ইচ্ছা নেই, বলল প্যাট, ল্যান্স বলেছে, সব মিটে গেলে পূর্ব আফ্রিকাতেই আমরা চলে যাব। সেখানেই আনন্দে থাকব।

–ঈশ্বর আপনাকে আশীর্বাদ করুন। ভাল মন্দ মিশিয়েই জীবন, মানুষকে সব কিছুই সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।

প্যাটের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মিস মারপল। বাইরে তার জন্য ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল।

.

সেদিনই সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলেন মিস মারপল।

ঘরের কাজ করে দেয় যে মেয়েটি, বিটি, মিস মারপলের নামে আসা চিঠিপত্র তার টেবিলে গুছিয়ে রেখেছিল। কুশল বার্তা নেবার পর চিঠিগুলো নিয়ে বসলেন তিনি।

একটা চিঠির ওপরে আঁকাবাঁকা অক্ষরে ছেলেমানুষী লেখার ঠিকানা দেখে সেটা তুলে নিলেন তিনি। খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে আনলেন।

.

প্রিম মাদাম,

কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না, তাই আপনাকে লিখছি। আমাকে মাপ করবেন।

ওরা বলেছে খুন–কিন্তু শপথ করে বলছি আমি এমন খারাপ কাজ করিনি। কখনো করতে পারি না। আর আমি জানি, একাজ অ্যালবার্টও করেনি। আমি জানি।

গত গ্রীষ্মকালে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। আমরা বিয়ে করব ঠিক ছিল, কিন্তু সব গোলমাল করে দিচ্ছিলেন যিনি মারা গেলেন, সেই মিঃ ফর্টেষ্ণু। তিনি অ্যালবার্টের সব পাওনা মেটাননি; ওকে ঠকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি সবই অস্বীকার করছিলেন।

অ্যালবার্ট গরীব, তার কথায় কেউ কান দিচ্ছিল না। লোকেরা বড়লোক মিঃ ফর্টেস্কুর কথাই বিশ্বাস করেছে।

অ্যালবার্টের এক বন্ধু একজায়গায় কাজ করত, সেখানে নতুন একরকম ওষুধ তৈরি হয়। খবরের কাগজেও ওষুধটার কথা বেরিয়েছে, নিশ্চয় আপনি পড়েছেন। ওটা সত্যের ওষুধ, খেলে ইচ্ছে না থাকলেও মানুষ সত্যকথা বলে ফেলে।

মিঃ ফর্টেস্কুর অফিসে অ্যালবার্ট দেখা করতে যাচ্ছিল ৫ই নভেম্বর। আমাকে বলেছিল ওষুধটা মিঃ ফর্টেস্কুর খাবারে মিশিয়ে দিতে। তাহলে ওষুধটা ঠিক সময়ে কাজ করবে আর মিঃ ফর্টেঙ্কু সব স্বীকার করে অ্যালবার্টের পাওনা মিটিয়ে দেবেন।

মাদাম, আমি খুশি হয়ে ওষুধটা তার মারমালেডে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই তিনি মারা যান। আমার মনে হয় ওষুধটা খুবই কড়া ছিল, অ্যালবার্ট নিশ্চয়ই এটা জানত না। জানা থাকলে একাজ ও আমাকে করতে বলতো না। অ্যালবার্ট জানত না, ওর দোষ নেই।

মাদাম, পুলিসকে আমি বলতে পারিনি। আমার ভয় হয়েছিল, তারা অ্যালবার্টকেই দোষী করত। কিন্তু আমি জানি সে একাজ করেনি। এখন সারা বাড়িতে পুলিস, আমি কি করব বুঝতে পারছি না। কি বলা উচিত তা-ও বুঝতে পারছি না। ওদের দেখলেই আমার বড় ভয় করে, কেমন সব প্রশ্ন করে ওরা। মাদাম, অ্যালবার্টের কাছ থেকে খবর পাইনি। আপনাকে কি করে বলব বুঝতে পারছি না, তবু আপনি যদি একবার আসতেন, আমার বিশ্বাস, ওরা আপনার কথা ঠিক শুনবে। আমি আর অ্যালবার্ট কোন দোষ করিনি। আপনি নিশ্চয় সাহায্য করবেন। আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। —স্নেহের
গ্ল্যাডিস মার্টিন

পুনঃ-আমার আর অ্যালবার্টের একটা ছবি পাঠালাম। হলিডে ক্যাম্পে একজন তুলেছিল, সেই আমাকে দেয়। অ্যালবার্ট ছবি ভোলা পছন্দ করে না, তাই ওকে ছবিটার কথা বলিনি। দেখলেই বুঝবেন ও কি চমৎকার ছেলে।

চিঠি পড়া শেষ করে ছবিটা তুলে নিলেন মিস মারপল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চেপে ধরলেন।

ছবিতে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। মিস মারপলের চোখ যে ছবিটার ওপর নিবদ্ধ হল, তার মুখে হাসি, সে মুখ ল্যান্স ফর্টেস্কুর।

হৃদয়হীন এক খুনীর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে বুকে চাপ সৃষ্টি হলেও দেখা গেল বেদনার অশ্রু ভরে তুলেছে মিস মারপলের দুই চোখ।