২. আমাদের বিয়ে

দ্বিতীয় পর্ব

০১.

নীরস, বৈচিত্র্যহীন ভাবেই অবশেষে আমাদের বিয়ে হল। এব্যাপারে গ্রেটা ইলিয়াকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।

অত্যন্ত সাবধানে সে ইলিয়ার গতিবিধি সকলের চোখের আড়াল করে রেখেছে।

আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আমাদের বিয়েকে কেন্দ্র করে ইলিয়ার আত্মীয়-পরিজন মহলে বেশ বড় ধরনের গণ্ডগোল দেখা দিতে পারে। সে কথা একদিন ইলিয়াকে বলেও ফেললাম।

ইলিয়া একটুও বিচলিত হল না। বলল, সবই দু-চারদিন। একটু হয়তো বকাঝকা করবে, খারাপ ব্যবহারও করতে পারে, তারপর সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

যথাকালে দেখা গেল ইলিয়ার কথাই সত্যি হল। এবং অদ্ভুত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সে সমস্ত কিছু সামাল দিল।

বিয়ের পরে আমরা মধুচন্দ্রিমায় বেরুলাম। প্রথমে গেলাম গ্রীসে, সেখান থেকে ফ্লোরেন্সে, তারপর ভেনিসের লিভোয় গিয়ে কিছুদিন থাকলাম। সেখান থেকে উপস্থিত হলাম ফ্রান্সের বিভিয়েরা। স্যানটনিক্সের সঙ্গেও দেখা করলাম। আমাদের দুজনকে তিনি আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন।

পরে আমাকে বললেন, তোমাদের জন্য একটা বাড়ির প্ল্যান আমি ইতিমধ্যেই তৈরি করে রেখেছি। নিশ্চয়ই তোমার মিসেসের কাছে সব কথা শুনেছো। তোমাদের বিয়ের আগেই তোমার সুন্দরী তরুণী স্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করে তোমাদের দুজনের জন্য একটা স্বপ্নপুরী তৈরি করবার আদেশ করেছিলেন।

ইলিয়া সলজ্জ প্রতিবাদের সুরে বলল, না না, আদেশ বলবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম।

স্যানটনিক্স বললেন, তোমরা যে জিপসি একর কিনে নিয়েছ, দিনকতক আগে আমি সেই জায়গাটা ঘুরে দেখে এসেছি। দেখলাম জায়গাটা পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়ে গেছে।

এরপর বাড়ির নক্সাটা স্যানটনিক্স আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। জলরঙের একটা ছবিও করা ছিল পর বাড়িতে এসেছি।

ইলিয়া সব দেখেশুনে উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠল, আমার স্বপ্নের বাড়িটিই যেন আমি দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।

স্যানটনিক্স জানালেন খুব শিগগিরই লণ্ডনে এসে তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন।

স্যানটনিক্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এথেন্সে ফিরে এলাম।

ওখান থেকে ইলিয়া কয়েকটা জরুরী চিঠি লিখল। একটা লিখল তার সম্মাকে। আর দুটো ফ্র্যাঙ্ককাকা ও অ্যান্ড্রুকাকার কাছে।

তার এই অ্যান্ড্রকাকার সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, ইনি তার নিজের কাকা নন, আত্মীয়ের মধ্যেও পড়েন না। আসলে ইনি হচ্ছেন তার আইনসঙ্গত অভিভাবক। বাবাই সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। ভদ্রলোক একজন আইনজীবী।

এখান থেকে আমিও আমার মাকে একটা চিঠি লিখলাম। অবশ্য সত্যিকথা বলতে ইলিয়াই আমাকে লিখতে বাধ্য করল।

আমি মাকে লিখলাম

মা,
মনে কেমন একটা সঙ্কোচ ছিল, তাই তোমাকে আগে লেখার সাহস পাইনি। তিন সপ্তাহ আগে আমি বিয়ে করেছি। ব্যাপারটা হঠাই হয়ে গেল। এই মেয়েটির কথাই তোমাকে বলেছিলাম। আমার স্ত্রী বেশ সুন্দরী এবং অগাধ সম্পত্তির অধিকারী। সেইজন্য মাঝে মাঝে বড় অস্বস্তি বোধ হয়।

ভাবছি ফিরে গিয়ে, কাছাকাছি কোথাও একটা বাড়ি তৈরি করব। এখন আমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভালোবাসা নিও।–স্নেহের মাইক

লণ্ডনে হোটেল ক্ল্যারিজে আগে থেকেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে রাখা ছিল। লণ্ডনে ফিরে এখানে এসেই উঠলাম আমরা।

স্যানটনিক্সের সঙ্গে কথা বলে নতুন বাড়ির কাজ শুরু করার সব ব্যবস্থাই করে আসা হয়েছিল। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত বাড়ির কাজ শেষ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই আমরা স্থির করলাম, হোটেল থেকে একবারে নতুন বাড়িতেই গিয়ে উঠব আমরা।

.

০২.

 একসময় নতুন নির্মীয়মাণ বাড়ির কাজ শেষ হল। স্যানটনিক্সের টেলিগ্রাম পেয়ে আমরা একদিন দেখতে রওনা হলাম।

বেলা শেষ হবার মুখে আমরা জিপসি একরে এসে পৌঁছলাম। স্যানটনিক্স এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সদ্য সমাপ্ত হয়েছে বাড়ির কাজ। বাড়ির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম।

এই তো আমার সেই মনের মত বাড়ি, আবাল্য যার স্বপ্ন দেখে এসেছি। এতদিনে তা বাস্তব হয়ে ধরা দিল।

স্যানটনিক্স প্রশ্ন করলেন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে?

অভিভূত স্বরে কেবল বলতে পারলাম, এর তুলনা নেই।

–এটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। অবশ্য এর জন্য তোমাদের অর্থও যোগান দিতে হয়েছে অপরিমিত।

সেইদিনই আমি চিরচরিত প্রথা মেনে সস্ত্রীক গৃহপ্রবেশ করলাম।

বাড়িতে প্রবেশ করে স্যানটনিক্স আমাকে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলি মাইক, স্ত্রীর। প্রতি সর্বদা নজর রাখবে। কখনো স্ত্রীর কোন বিপদ হতে দেবে না।

ইলিয়া বলল, হঠাৎ আপনি আমার বিপদ-আপদের কথা বলছেন কেন?

-কারণ পৃথিবীতে ভাল মানুষ যেমন আছে তেমনি অনেক জঘন্য প্রকৃতির কুৎসিত লোকও ঘুরে বেড়ায়। বাড়িটা তৈরি করতে করতে আমি বুঝতে পেরেছি তোমার চারদিকে জঘন্য প্রকৃতির কিছু লোক সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দু-একজনকে আমি এই জিপসি একরেই দেখা পেয়েছি।

তারা এখানে এসে বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াত। নোংরা ধেড়ে ইঁদুর যা করে তেমনি নাক দিয়ে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করত। সেকারণেই আমার মনে হয়েছে তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত।

এরপরেই প্রসঙ্গ পাল্টে তিনি বললেন, এবারে এসো, সমস্ত বাড়িটা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই।

গোটা বাড়ি আমরা ঘুরে দেখলাম। কয়েকটা ঘর সম্পূর্ণ খালি রয়েছে। বাকি ঘরগুলো উপযুক্ত ও সৌখিন আসবাবপত্র ও ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। দরজা জানলাতেও বেশ মানানসই পর্দা ঝোলানো হয়েছে।

ইলিয়া বলল, বাড়িটার একটা মনের মত নামকরণ করা বাকি রয়ে গেল।

 স্যানটনিক্স বললেন, স্থানীয় লোকেরা তো এই এলাকাটাকে জিপসি একর বলে, তাই না?

আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, নামটা আমার একদম পছন্দ না।

স্যানটনিক্স বললেন, তোমার পছন্দ না হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু এলাকাটাকে ওই নামেই ডাকবে।

বাড়ি দেখা শেষ হলে আমরা বৈঠকখানায় এসে বসলাম। গৃহস্থলীর কাজকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় দাসদাসী আগামীকাল এসে পৌঁছবে। আমরা সঙ্গে করেই নৈশ আহারের ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলাম।

তিনটে সুদৃশ্য ডিশে তিনজনের খাবার সাজিয়ে দিল ইলিয়া। খাবারের মধ্যে ছিল, ফরাসী রুটি, গলদা চিংড়ির কারি আর নুন মাখানো শুয়োরের মাংস। প্রচুর পরিমাণে পানীয়ও ছিল সঙ্গে।

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ের গল্পও চলতে লাগল।

ঠিক সেই সময়েই আচম্বিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। বাইরে থেকে একটুকরো পাথর কাচের জানলা ভেদ করে আমাদের খাবার টেবিলে এসে পড়ল।

পাথর লেগে একটা গ্লাস ভেঙ্গে গেল। একটুকরো কাচ ছিটকে ইলিয়ার কপালে এসে লাগল।

এই অভাবিত ঘটনায় আমরা হকচকিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেললাম। ছিটকিনি খুলে জানলা দিয়ে বাইরের চত্বরে গিয়ে পড়লাম। স্যানটনিক্সও আমার অনুসরণ করলেন। আশপাশে খুঁজে কাউকেই পাওয়া গেল না। আমরা উত্তেজিতভাবে ঘরে ফিরে এলাম।

কাচের টুকরো লেগে ইলিয়ার কপাল সামান্য কেটে গিয়েছিল। সামান্য রক্তপাত হয়েছে। কাগজের ন্যাপকিন দিয়ে সযত্নে তা মুছে দিলাম।

ইলিয়া বলল, এমন একটা কাজ কে করতে যাবে? কি উদ্দেশ্যেই বা করবে?

পরিবেশটা হাল্কা করবার জন্য আমি বললাম, বদমাইশ ছেলেছোকরাদের কাণ্ড ছাড়া আর কি হবে। মজা করার জন্যই ওরা এরকম উপদ্রব করে থাকে।

কিন্তু ব্যাপারটা আমি অত সহজ করে নিতে পারছি না। খুবই ভীতিপ্রদ ঠেকছে।

আমি বললাম, স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমরা এখনো কিছুই জানি না। কাল সকালে অনুসন্ধান করে দেখা যাবে।

ইলিয়া স্যানটনিক্সের উদ্দেশ্যে বলল, আমরা বড়লোক, অনেক পয়সা খরচ করে বাড়ি করেছি, এরকম ক্ষোভ থেকেই কি কেউ এমন কাণ্ডটা করল? নাকি অন্য কোন কারণ? মিঃ স্যানটনিক্স, জিপসিদের অভিশাপের গল্পটা তো আপনিও শুনেছেন। এখানে যারা বাস করতে আসবে তারাই নাকি সেই অভিশাপের শিকার হবে। তাহলে কি এসব সত্যি?

ইলিয়া যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে স্যানটনিক্স বললেন, আমার মনে হয়, এসব কোন কারণ নয়–

–তাহলে কি কেউ আমাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে? আমাদের দুজনের স্বপ্ন দিয়ে গড়া এই বাড়ি থেকে?

আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, আমাদের এখান থেকে কেউ উৎখাত করতে পারবে না। আমি সবরকমের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। তোমার কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।

ইলিয়া পুনরায় স্যানটনিক্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে তো বাড়ির কাজের সময় বেশ কয়েকদিন থাকত হয়েছিল। তখন কি কোনভাবে বাড়ি তৈরির কাজে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল?

–বাধা সৃষ্টি হবার মত কিছু ঘটেনি। স্যানটনিক্স বললেন, অতবড় একটা বাড়ি তৈরি হল, সামান্য দু-একটা ঘটনা ঘটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাজের সময় মই থেকে পড়ে গিয়ে একজন মজুর চোট পেয়েছিল। আর একজন মজুরের হাত ফস্কে একটা পাথরের বোঝা তার পায়ের ওপর পড়েছিল।

একজনের পায়ের আঙুলে পেরেক ফুটে বিষিয়ে উঠেছিল–এগুলো উল্লেখ করবার মত মারাত্মক কিছু ঘটনা নয়।

–আর কিছু ঘটেনি?

–না ইলিয়া, আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি। বললেন স্যানাটনিক্স।

–আমার কেবলই সেই জিপসি বুড়ির কথা মনে পড়ছে। প্রথম দিনেই দেখা হতে সে আমাদের এখানে আসতে নিষেধ করেছিল। কী সাংঘাতিক ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। ইলিয়া বলল।

–ওই ছিটেল বুড়ির কথা বাদ দাও। বললাম আমি।

-আমরা যেখানে বাড়ি তৈরি করেছি, বিশেষ করে এই জায়গাটা সম্পর্কে বুড়ি লী আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। আমরা এখানেই থাকব। কারুর সাধ্য হবে না আমাদের এখান থেকে উৎখাত করে।

বেশ রাগত ভঙ্গিতেই ইলিয়া কথাগুলো বলল।

আমিও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললাম, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, সে সুযোগ কেউ পাবে না।

সেদিন এভাবেই আমরা অদৃশ্য নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম।

.

০৩.

 জিপসি একরের নতুন বাড়িতে এভাবেই আমাদের দুজনের জীবন শুরু হয়েছিল।

বাড়িটার একটা জুতসই নাম খুঁজে পাবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম দুজনে।

ইলিয়া মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিল। পরদিন ইলিয়া আমাকে বলল, জায়গাটার নামবদলের চেষ্টা করব না আমরা। জিপসি একর নামই রাখব। সম্পত্তিটা এখন আমাদের। জিপসিরা কবে কি বলেছে না বলেছে তাতে আমাদের কি এসে যায়।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য সেদিন আমরা হেঁটে গ্রামের দিকে রওনা হলাম। জিপসি বুড়ির ঝুপড়ির কাছে এসে দেখা গেল তার দরজায় তালা ঝুলছে।

একজন প্রৌঢ়াকে পথে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করতে জানাল, অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে। বুড়ি তো মাঝেমাঝেই দু-চার দিনের জন্য এমনি বেপাত্তা হয়ে যায়। জিপসিদের স্বভাবই ওরকম। একজায়গায় বেশিদিন থাকতে পারে না।

বৃদ্ধা জানতে চাইল, পাহাড়ের উঁচুতে নতুন বাড়িটা আপনারাই তো তৈরি করেছেন?

আমি সায় দিয়ে বললাম, সবে গতরাত্রে আমরা এখানে এসে পৌঁচেছি।

–আপনাদের ওই জায়গাটা খুবই সুন্দর। ওই বাড়িটাও সুন্দর। জিপসি একরের চেহারাটাই পাল্টে গেছে। তবে চারপাশটা খুবই নির্জন। অনেকেই আবার অমন গাছপালা ঘেরা জায়গায় বেশিদিন থাকতে চায় না।

জায়গাটাকে লোকে এত ভয় পায় কেন? ইলিয়া জানতে চাইল।

-তাহলে গল্পটা আপনাদের কানেও পৌঁচেছে। আগে ওখানে যে বাড়িটা ছিল তার নাম ছিল টাওয়ার।

ইলিয়া বলল, আমরা ঠিক করেছি বাড়িটার নাম রাখব জিপসির বাগান।

আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, বাঃ, এই তো সুন্দর নাম পেয়ে গেছ।

–হ্যাঁ, এইমাত্র মাথায় এল।

 সেদিন গ্রামের আরো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।

এরপর জিপসি একরকে ঘিরে আমাদের নানা ধরনের পরিকল্পনা চলতে লাগল।

ইতিমধ্যে গ্রেটা এসে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেল। বাড়িটার আসবাবপত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। রবিবার বিকেলেই ও চলে গেল।

এই দুদিন ইলিয়া গ্রেটাকে নিয়েই মেতে ছিল। কাছে থাকায় বুঝতে পারলাম, গ্রেটা তার কত প্রিয়। এই অন্তরঙ্গতা আমার অপছন্দ হলেও নিজেকে মার্জিত হাসি ও ব্যবহার দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলাম।

সপ্তাহ খানেকের মধ্যে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আমাদের কিছুটা আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। অনেকটাই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলাম আমরা।

একদিন বিকেলে মেজর ফিলপট এলেন। ইলিয়াকে ইতিপূর্বেই ফিলপটের পরিচয় জানিয়েছিলাম। স্থানীয় বাসিন্দারা মেজরকে ঈশ্বরের মত ভক্তিশ্রদ্ধা করে।

ভদ্রলোকের বেশ অমায়িক চেহারা। পোশাকআশাকও অতি সাধারণ। মাথার চুলের বেশিটাই সাদা, বয়স ষাটের কাছাকাছি।

বৈঠকখানা ঘরে এসে নিজেই চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর বেশ অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা শুরু করলেন।

নানান প্রসঙ্গ নিয়েই আমাদের আলোচনা হতে লাগল। কথায় কথায় ইলিয়া একসময় বলল, জিপসিদের অভিশাপের গল্প শুনিয়ে বুড়ি লী তো আমাদের রীতিমত ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। মনে হয় ছিটগ্রস্ত।

বুড়ি এন্থার এমনিতে বিশেষ উৎপাত করে না। আমিই ওকে কুঁড়েটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। যুবক-যুবতীদের দেখতে পেলে পয়সার লোভে তাদের ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে খুশি করবার চেষ্টা করে।

–কিন্তু আমাদের তো আশাভরসার কোন কথাই শোনাল না। নানানভাবেই সাংঘাতিক ভয় ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। ও তো আমাদের এখানে আসতেই নিষেধ করছিল।

মেজর ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অবাক লাগছে। তরুণ-তরুণীদের মনজোগানো কথাবার্তাই তো বুড়ির মুখে সবসময় শোনা যেত। কিন্তু কখনো ওর মুখ থেকে কোন অমঙ্গলের আশঙ্কার কথা তো শোনা যায়নি।

খানিক বিরতির পর মৃদু হেসে মেজর পুনরায় বললেন, আমার ছেলেবেলায় এ অঞ্চলে অনেক জিপসির আস্তানা ছিল। চুরিটুরির অভিযোগ শোনা যেত ওদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এদের আমার খুব ভাল লাগত।

একবার আমার এক ভাই গ্রামের পুকুরে ডুবে মরতে বসেছিল। বুড়ি লী তাকে বাঁচিয়েছিল। এই কারণেই আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ।

এইসময় অসতর্কভাবে ধাক্কা লেগে আচমকা সুদৃশ্য ছাইদানি মেঝেয় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙ্গা টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো করলাম।

ইলিয়া বলল, আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি বুড়ি লী আসলে খুবই নিরীহ আর শান্ত প্রকৃতির। ওকে ভয় পাবার কিছু নেই।

মেজর ভ্রূকুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন, ও কি আপনাকে কোন ভয়ের কথা বলেছিল?

আমি বললাম, বুড়ি সেদিন এমনভাবে শাসিয়েছিল যে ভয় পাওয়াটা ইলিয়ার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।

–বুড়ি লী–শাসিয়েছিল? অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন মেজর।

 বললাম, তার কথাগুলো সেরকমই ছিল। তার পর আমরা যেদিন প্রথম এলাম এখানে, সেদিনই এমন একটা অভাবিত ঘটনা ঘটল যা খুবই ভীতিপ্রদ।

আমি মেজরকে জানালার শার্সি ভাঙার ঘটনাটা খুলে বললাম।

মেজর বললেন, বদমাস ছেলেছোকরাদের কাণ্ড। ব্যাপারটা দেখতে হবে। সত্যিই এটা খুব দুঃখের ব্যাপার। প্রথম দিনেই–

তবে তার চাইতেও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে মাত্র দিনদুয়েক আগে, ইলিয়া বলল।

এই ঘটনাটাও মেজরকে খুলে বললাম। দিনদুয়েক আগে সকালে বেড়িয়ে ফেরার সময় দেখি একটা ছুরিবিদ্ধ মরা পাখি আমাদের দরজার সামনে পড়ে আছে। ছুরির ডগায় গাঁথা একটুকরো কাগজে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ছিল–নিজেদের মঙ্গল চাও তো জিপসি একর ছেড়ে অবিলম্বে চলে যাও।

মেজর ফিলপট রীতিমত রেগে গেলেন ঘটনাটা শুনে। বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড, এতো রীতিমত শাসানো। কোন ছিঁচকে বদমায়েশের কাণ্ড বলে তো মনে হচ্ছে না।

–পুলিসকে তোমরা এঘটনা জানিয়েছিলে?

ইলিয়া বলল, আমরা নতুন এসেছি, প্রথমেই এতদূর যেতে চাইনি। তাতে অপরাধী রেগে গিয়ে হয়তো সাংঘাতিক কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে।

–ব্যাপারটার পেছনে দুরভিসন্ধি রয়েছে। কারুর মনে বিদ্বেষভাব থাকলে এরকম ভাবে শাসানো সম্ভব। কিন্তু কিন্তু তোমরা তো এখানে নতুন এসেছ–স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাল করে আলাপ-পরিচয়ই তো হয়নি।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। বিদ্বেষের প্রশ্ন আসবে কেন?

–বেশ, আমি নিজেই ব্যাপারটার খোঁজখবর করব।

তারপর আরও দু-চারটে কথা বলে মেজর বিদায় নিলেন। যাবার আগে আশপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, তোমাদের বাড়িটা সত্যিই সুন্দর। ঘরগুলো বেশ বড় বড়-হাওয়া-বাতাস খেলবার উপযুক্ত।

আজকাল তো সব পায়রার খোপের মত ঘর তৈরি হচ্ছে। এটাই নাকি ফ্যাসান। আমার দুচক্ষের বিষ। তোমাদের বাড়িটা খুব উঁদে স্থপতি তৈরি করেছেন নিশ্চয়?

আমি তাকে স্যানটনিক্সের বিষয়ে বলেছিলাম। শুনে মাথা নেড়ে বললেন, স্যানটনিক্স সম্পর্কে একটা আলোচনা তিনি হাউস অ্যাণ্ড গার্ডেন নামক পত্রিকায় দেখেছেন।

বাড়ি ছাড়বার আগে তিনি আমাদের একদিন তার বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।

নিজের গাড়ি চেপেই এসেছিলেন মেজর ফিলপট। একটা স্প্যানিয়েল কুকুর দেখলাম রয়েছে গাড়ির মধ্যে। গাড়িটা অবশ্য পুরনো।

মেজরের আন্তরিক ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। খুব সহজেই তিনি আপন করে নিতে জানেন। ইলিয়াকে খুবই স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তবে আমার সম্পর্কে তার মনোভাবটা বোঝা গেল না। যাই হোক ভদ্রলোক যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তা বোঝা গেল স্পষ্ট।

ফিরে এসে দেখি, ইলিয়া ভাঙ্গা অ্যাশট্রের টুকরোগুলো পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখে বলল, মেজর খুব সজ্জন ব্যক্তি।

.

পরের সপ্তাহেই মেজরের বাড়িতে আমাদের লাঞ্চের নিমন্ত্রণ হল। আমাদের সম্মানে আরও কয়েকজন সম্ভ্রান্ত প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মেজর সকলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

স্থানীয় ডাক্তার বৃদ্ধ শ বেশ সাদাসিদে ধরনের মানুষ। জরুরী একটা কল ছিল বলে সেদিন তিনি লাঞ্চ শেষ হবার আগেই বিদায় নিয়ে নিলেন।

স্থানীয় পল্লীযাজকও উপস্থিত ছিলেন। মাঝবয়সী এক মহিলাও ছিলেন। জানা গেল তার কুকুরের ব্যবসা।

ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল নামে এক সুন্দরী তরুণীও সেদিনের ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন। ইলিয়ার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল তার। ক্লডিয়ার ঘোড়ায় চড়ার শখ। যতক্ষণ ওখানে ছিলাম ইলিয়া তার সঙ্গে ঘোড়া নিয়েই কথা বলে গেল।

মিসেস ফিলপট আমার সম্পর্কে জানতেই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। আমি কি কাজ করি, কোন কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব কথাই তিনি জানতে চাইছিলেন।

এসব বিষয়ে সেই কুকুর-পালিকা মহিলারও দেখলাম সমান উৎসাহ। ভদ্রমহিলার নামটা এখন আর মনে করতে পারছি না।

লাঞ্চের পরে আমি আর ইলিয়া মেজরের বাড়ির বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। সেইসময় ক্লডিয়া এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। কথায় কথায় জানা গেল সে আমাদের মিঃ স্যানটনিক্সের বোন।

ক্লডিয়া বলল, তিনি আমার পিসতুতো দাদা। তবে দেখাসাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। আপনাদের বাড়িটা তৈরি হবার সময়।

ইলিয়া স্যানটনিক্সের গুণগ্রাহী। কিন্তু দেখা গেল ক্লডিয়া তার দাদার কাজ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী নয়। তার নাকি পুরনো ধাঁচের ঘরবাড়িই পছন্দ।

ইলিয়া বলল, একদিন আমাদের আধুনিক ফ্যাশানের বাড়িটা দেখে আসবেন। আপনার নিমন্ত্রণ রইল।

স্থানীয় গলফ ক্লাবে ইলিয়াকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নিল ক্লডিয়া। বলল, আগে একটা ঘোড়া কিনে নাও।

মেজর তার আস্তাবলটা আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন। ক্লডিয়া সম্পর্কে তিনি জানালেন, মেয়েটা খুবই সাহসী। একপাল কুকুর নিয়ে একাই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু জীবনটাকে কাজে লাগাতে পারল না।

এক আমেরিকান ভদ্রলোককে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। এখন সে নিজের পদবীই ব্যবহার করে। আর বিয়েথা করবে না ঠিক করেছে।

খুব আনন্দের মধ্যেই কাটল সময়টা। একসময় বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম আমরা।

.

০৪.

 বিশ্ব সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা নির্জন জিপসি একরে এসে ঘরসংসার পেতেছিলাম। দুজনে এখানে একান্তে নিশ্চিন্তে বসবাস করব এই ছিল আশা। কিন্তু অজ্ঞাতবাসের সুখ আমাদের সইল না।

ইলিয়ার সৎমা কোরা দেখা দিলেন মূর্তিমান অভিশাপের মত। একের পর এক চিঠি, শেষের দিকে ঘন ঘন তার পাঠিয়ে উত্যক্ত করতে লাগলেন।

ইলিয়ার নতুন বাড়ি নাকি তার খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি ঠিক করেছেন, ইংলণ্ডেই এরকম একটা বাড়ি করবেন। ইলিয়া যেন জমি বেচাকেনার দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

একদিন সশরীরে আবির্ভাব ঘটল তার। আমাদের এখানে থেকেই জিপসি একরের আশপাশে পছন্দমত জায়গায় খোঁজ করে বেড়াতে লাগলেন।

শেষ পর্যন্ত কিংসটন বিশপ থেকে মাইল পনেরো দূরে একটা জায়গা তার পছন্দ হল। যথারীতি এর পরে নতুন জায়গায় বাড়ি তৈরির প্ল্যান ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

এরকম একটা ব্যাপার আমাদের মোটেই ভাল লাগবার কথা নয়। কিন্তু আমাদের আপত্তি জানাবারও কোন উপায় ছিল না।

কয়েকদিন পরে কয়েকটা জরুরী তার এল ইলিয়ার নামে। জানা গেল তার ফ্র্যাঙ্ক পিসে প্রতারণার ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে জেলে যেতে বসেছেন। তার সঙ্কট মোচনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

এই সঙ্গে আরও একটা ঝামেলার সংবাদও এসে পৌঁছল। ইলিয়ার ব্যবসা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এইসমস্ত বৈষয়িক ঝামেলা আমার মাথায় ঢুকত না। তাই আমি নাক গলাবারও চেষ্টা করলাম না।

এই সব ঝুটঝামেলার মীমাংসার জন্য ইলিয়াকে ঘন ঘন কিছুদিন ইংলণ্ড যাতায়াত করতে হল।

এরমধ্যেই একটা ব্যাপার আমরা আবিষ্কার করলাম। যে সম্পত্তিটা আমরা কিনেছিলাম সেটা ছাড়াও আশপাশের কিছু জমি ও গোটা পাহাড়ের অনেকখানিই আমাদের সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বনজঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলটা আমরা ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম।

পায়ে চলার কোন পথ এদিকে ছিল না। ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে নিতে হচ্ছিল আমাদের নিজেদেরই।

বনবাদাড় ঘুরে বেড়াবার সময় একজায়গায় একটা পায়েচলা পথের চিহ্ন খুঁজে পেলাম একদিন। বোঝা যাচ্ছিল দীর্ঘ দিন এই পথ ব্যবহার হয়নি। বহু পরিশ্রম স্বীকার করে পথটার শেষ আমরা খুঁজে বের করলাম। নানা আকার আকৃতির পাথরের চাঙড়ের মাঝখানে ভাঙাচোরা একটা ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে পথটা।

ঘন জঙ্গলের ভেতরে লোকজনের সংস্পর্শের বাইরে এমন একটা ঘর আবিষ্কার করতে পেরে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম আমরা। যেন একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া গেল।

দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ঘরটা আমরা লোকজন ডেকে সারাই করিয়ে নিলাম। আশপাশটাও ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে নেওয়া হল।

দিন কয়েকের মধ্যেই নতুন জানালা দরজা লাগিয়ে ঘরটাকে বসবাসযোগ্য করে নেওয়া হল। মাঝে মাঝে এখানে এসে যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায় সেইজন্য আসবাবপত্রও নিয়ে আসা হল।

তবে যাতায়াতের পথটা ইচ্ছে করেই পরিষ্কার করালাম না। আমার মনে হল জায়গাটাকে লোকজনের দৃষ্টির আড়ালে রাখাই ভাল।

সেই সঙ্গে আমি ইলিয়াকে সতর্ক করে দিতেও ভুললাম না। বললাম, তোমার সৎমা কোরাকে কিন্তু ভুলেও এই ঘরের সন্ধান দিও না।

কোরা সেই সময়ে দিনকয়েকের জন্য আমাদের এখানেই অবস্থান করছিলেন। সেই কারণেই ইলিয়াকে বিশেষ করে সতর্ক করার প্রয়োজন ছিল।

কোরা চলে যাবার পর একদিন বিকেলে আমাদের সেই গোপন আস্তানা থেকে ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটল। পাথরে পা হড়কে পড়ে গিয়ে ইলিয়ার একটা পা বেশ জখম হল।

পাঁজাকোলা করে তাকে নিয়ে আসতে হল। ডাঃ শকে খবর দেওয়া হল। তিনি এসে পরীক্ষা করে জানালেন, হাড় ভাঙেনি, তবে আঘাতটা গুরুতর। অন্তত সপ্তাহ খানেক বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।

ইলিয়াকে সেবাশুশ্রূষার ব্যাপারে খুবই আতান্তরে পড়ে গেলাম। দাস-দাসীদের দিয়ে সে কাজটা হওয়া সম্ভব ছিল না।

ইলিয়া গ্রেটাকে দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে তার করেছিল। সংবাদ পাওয়া মাত্র গ্রেটা এসে হাজির হল এবং বাড়ির কাজকর্মের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ইলিয়াও যেন প্রাণ ফিরে পেল।

ইতিমধ্যে দাসদাসীরা ঝামেলা পাকিয়ে বসল। এমন নির্জন জায়গায় তারা থাকতে রাজি হল না। এমন একটা কাণ্ডের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, কোরা এসেই ওদের বিগড়ে দিয়ে গেছে।

গ্রেটা কিন্তু তোয়াক্কাই করল না। তড়িঘড়ি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সে একদিনের মধ্যেই আর একপ্রস্থ দাসদাসীর ব্যবস্থা করে ফেলল।

গ্রেটার সেবাযত্নে ও তত্ত্বাবধানে ইলিয়া শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠল। তার পরেও কিন্তু গ্রেটা রয়ে গেল।

অবশ্য ইলিয়া আমাকে আড়ালে জানিয়েছিল। গ্রেটা যদি কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকে, কেমন হয়?

আমি সহাস্যে জানিয়েছিলাম, তাহলে তো ভালই হয়। তোমার বন্ধু যতদিন খুশি থাকুন ।

গ্রেটা থেকে গেল এবং ঘরগৃহস্থালীর সমস্ত কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে নিজের হাতে নিয়ে নিল। তার নির্দেশেই এখানকার সব কাজ হতে লাগল।

 একদিন লাঞ্চের পরে ইলিয়া বসার ঘরে সোফায় শুয়ে একটা ফ্যাশনের ম্যাগাজিন দেখছিল। বাইরের বারান্দায় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আমি আর গ্রেটা গল্প করছিলাম। এই সময় একটা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ উপস্থিত হল।

সেই থেকে কথাকাটাকাটির সূত্রপাত। কেউ কারুর গোঁ ছাড়ছিলাম না। ফলে উত্তপ্ত কথাবার্তা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে গেল। তীব্র ঝঝের সঙ্গে দুজনেই দুজনকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিলাম।

গ্রেটা যে ক্ষমতাপ্রিয়, ইলিয়াকে সুকৌশলে নিজের কজায় পুরে ফেলেছে এসব কথাও যথেষ্ট তিক্ততার সঙ্গে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

সেদিনই প্রথম দেখলাম, সুন্দরী গ্রেটা রেগে গেল কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত অসুস্থ শরীরে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এসে ইলিয়া আমাদের সামাল দিল।

ইলিয়া কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সোফায় নিয়ে ওকে বসিয়া দেবার পরে বলল, মাইক, তুমি যে মনে মনে গ্রেটাকে এমন ঘৃণা কর আমি ধারণা করতে পারিনি।

ইলিয়াকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। বললাম, রেগে গেলে আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। মুখ দিয়ে কি বেরয় তা আমি নিজেও জানি না। এ নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি গ্রেটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।

শেষ পর্যন্ত গ্রেটার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করেছিলাম। অনেক সাধ্যসাধনার পর গ্রেটা আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হল।

ডাঃ শ এসে জানিয়ে দিয়ে গেলেন ইলিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করতে পারে। তবে উঁচুনিচু পথে হাঁটাচলা করার সময় আহত গোড়ালিটা পুরু কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিতে হবে।

কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে আমি ডানতে চাইলাম, ইলিয়ার শরীর বা হার্ট সম্পূর্ণ সুস্থ কিনা।

আমার এই প্রশ্নটা করার কারণ হল, একদিন গ্রেটা আমাকে জানিয়েছিল, ইলিয়া ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

 ডাঃ শ ইলিয়াকে পরীক্ষা করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে জানালেন, শরীরে কোনদিক থেকেই ইলিয়ার দুর্বলতার কোন চিহ্ন নেই। সে সম্পূর্ণভাবেই সুস্থ।

আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ইলিয়াও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, গ্রেটা আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে অযথাই উদ্বিগ্ন হয়।

স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে ক্রমশই ইলিয়ার বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। বিশেষ করে ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল এখন প্রতিদিনই আমাদের এখানে আসে। ইতিমধ্যে ইলিয়া একটা ঘোড়া কিনেছে। দুজনে মিলে মাঝে মাঝে ঘোড়া চড়ে ঘুরে বেড়ায়।

ঘোড়ায় চড়ার ব্যাপারে আমি ততটা উৎসাহী নই। যদিও আয়ার্ল্যাণ্ডের এক আস্তাবলে কিছুদিন কাজ করেছি আমি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ঘোড়া চড়াটা শিখে নিলে মন্দ হয় না।

ইলিয়া ছোটবেলা থেকেই ঘোড়া চড়ায় অভ্যস্ত। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে বিশেষ আনন্দ পায় ও। গ্রেটাও তাকে এব্যাপারে উৎসাহ যোগায়।

ক্লডিয়ার পরামর্শেই একটা বাদামি রঙের ঘোড়া কিনেছিল ইলিয়া। তার পর থেকে হপ্তায় দু-তিন দিন সে সকালে উঠে ঘোড়া নিয়ে বেরুত।

ঘরগেরস্থালীর কেনাকাটার প্রয়োজন থাকলে গ্রেটা নিজেই গাড়ি নিয়ে মার্কেট কডওয়েল চলে যেত। একদিন দুপুরের খাওয়ার টেবিলে বসে ও বলল, আজ সকালে এক ডাইনীর মত দেখতে বুড়ি আমার পথ আগলে ছিল। ক্রমাগত হর্ন শুনেও রাস্তার মাঝখান থেকে সরছিল না। ফেরার পথেও বুড়ি একই কাণ্ড করল।

আমরা বুঝতে পারলাম জিপসি বুড়ি লীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। ইলিয়া তার পরিচয় জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, বুড়ি তোকে কিছু বলেছিল?

গ্রেটা বলল, কুৎসিত বুড়িটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল।

–কি বলছিল বুড়ি। সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

–বুড়ি বলছিল, আমরা নাকি জিপসিদের এলাকা জোর করে দখল করে রেখেছি। এখান থেকে চলে না গেলে আমাদের মঙ্গল হবে না।

এখানে নাকি অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপ আছে–এখানে বাড়ি তৈরি করে আমরা সেই অভিশাপ কুড়িয়েছি। আমাদের সর্বনাশ হবে। 

গ্রেটা সেদিন আরও অনেক কথা বলেছিল। ইলিয়া পরে আমাকে আড়ালে বলেছিল, ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল ঠেকছে না মাইক।

আমি বললাম, গ্রেটা তো বানিয়ে কিছু বলবার মেয়ে নয়। ও যা বলল, তা তো ভীতিপ্রদ।

হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথায় এল। ইলিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, পাহাড়ী পথে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াবার সময় ইতিমধ্যে জিপসি বুড়ির সঙ্গে তোমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?

ইলিয়া কেমন দ্বিধা করল জবাব দিতে। বুঝতে পেরে বললাম, মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

-হ্যাঁ। জঙ্গলের আড়ালে-আবডালে বুড়িকে দু-একবার আমার চোখে পড়েছে। জঙ্গলের গাছপালার আড়াল থেকে কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু চিনতে পারি না কে।

একদিন বেশ বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ইলিয়া ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরে এল। মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাত পা কাঁপছে থরথর করে।

উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ ইলিয়া?

–জান, মাইক, আজ বুড়ি ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘোড়া থামালাম। বুড়ি তখন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের দিকে তুলে কি সব বকবক করতে লাগল।

মনে হয় অভিশাপ দিচ্ছিল। আমার খুব রাগ হয়ে গেল। বললাম, তুমি কেন আমাদের ভয় দেখাচ্ছ? এ জমি তোমাদের নয়, আমরা কিনে নিয়েছি। বরাবর এখানে বাস করব, সেজন্য বাড়ি তৈরি করেছি। 

বুড়ি তেজের সঙ্গে বলল, এ জমি কখনো তোমাদের নয়। এ জমি জিপসিদের। তোমাকে আগেও আমি সাবধান করেছি, আজ শেষবারের মত সাবধান করে দিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার বাঁ কাঁধের পেছনে মৃত্যু থাবা বাড়িয়েছে।

আর দেরি নেই। তুমি যে ঘোড়াটার ওপরে চড়ে আছ, তার একটা পা সাদা। এটা কিসের লক্ষণ জান? মৃত্যু। মৃত্যু। এত সাধ করে জিপসিদের জমিতে যে বাড়ি বানিয়েছ, সেই বাড়িও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

কথাগুলো বলতে বলতে ইলিয়া ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। বারবার তার ঠোঁট শুকিয়ে আসতে লাগল।

গ্রেটাও বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল। আমিও আর হেসে উড়িয়ে দিতে পারলাম না।

-বুড়ি দেখছি, খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এর একটা সুরাহা করা এখুনি দরকার।

বলে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বুড়ি লীর সঙ্গে আগে কথা বলব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ঝুপড়িতে তাকে পাওয়া গেল না। সরাসরি চলে এলাম থানায়।

থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সার্জেন্ট কীন-এর সঙ্গে ইতিপূর্বে আমার পরিচয় হয়েছিল। বেশ বুদ্ধিমান ও বিবেচক ব্যক্তি। আমার সবকথা তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।

তারপর জানালেন, বুড়ি লীকে নিয়ে আগে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এখন দেখছি, ওকে ডেকে একটু শাসিয়ে দেবার দরকার হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মিঃ রজার, বুড়ি আর এমন ব্যবহার করতে সাহস পাবে না।

সার্জেন্ট কীনকে ধন্যবাদ জানিয়ে যখন উঠে আসছি তখন তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব মিঃ রজার। আচ্ছা আপনার বা আপনার স্ত্রীর ওপর কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে, এমন ঘটনা কি কিছু ঘটেছে?

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছেন কেন?

–আমার কাছে একটা খবর আছে, আজকাল বুড়ি বেশ পয়সা-কড়ি খরচ করতে পারছে। কি করে এসব ও করছে, তার কোন হদিশ পাইনি।

ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকছে।

–আমার ধারণা, আপনাদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে চায় এমন কোন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বুড়িকে টাকা জোগাচ্ছে। এই রকম একটা ব্যাপার বেশ কয়েকবছর আগে এখানে ঘটেছিল। এক ব্যক্তি টাকা দিয়ে বুড়িকে হাত করেছিল, উদ্দেশ্য ছিল এক প্রতিবেশীকে উৎখাত করা। গ্রামের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজনের মধ্যে বুড়ির উদ্ভট এবং ভয়-দেখানো কথাবার্তা সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। আর বুড়ির মত দরিদ্র লোকজনকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সহজেই বশ করা যায়।

আমি বললাম, আমরা তো এই অঞ্চলে নবাগত। এখনো সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় পর্যন্ত হয়নি।

–ঠিক আছে, আমি দেখছি ব্যাপারটা।

সার্জেন্টের কথায় বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। খুব বিরক্তও লাগছিল। শান্তিভঙ্গের এমন অনাহূত কাণ্ড কেন ঘটছে বুঝতে পারছিলাম না।

গেট দিয়ে ঢুকতেই গীটারের শব্দ কানে এলো। ইলিয়া তার স্প্যানিশ গীটারটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে গীটার বাজিয়ে গুনগুন সুরে গান করতে ভালবাসে ও। গীটারের সঙ্গে সেই গান শুনতেও বেশ ভাল লাগে। ভাবলাম কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করব, এই সময় হাজির হয়ে ওকে বাধা দেব না।

এমন সময় ব্যাপারটা চোখে পড়ল আমার। দেখলাম, কে একজন বাইরে দাঁড়িয়ে বৈঠকখানা ঘরে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে।

কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম। আগন্তুক পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। চিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। স্বয়ং মিঃ স্যানটনিক্স।

ওঃ, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মশায়। অনেকদিন আপনার কোন খবর পাইনি। এখানে কবে এলেন?

স্যানটনিক্স আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। হাত ধরে টেনে নিঃশব্দে জানলা থেকে দূরে সরিয়ে আনলেন আমাকে।

চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, তুমি মেয়েটাকে এখানে ঢুকতে দিলে কেন? ও কি বরাবরের মতই এখানে এসে উঠেছে?

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কার কথা বলছেন?

–আমি জানতাম এরকম ঘটনাই একদিন ঘটবে। আমি গ্রেটা মেয়েটার কথা বলছি। তুমি জান, ও কি সাংঘাতিক প্রকৃতির মেয়ে?

আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মিঃ স্যানটনিক্সের মুখের দিকে।

–নিশ্চয় ও বিনা নিমন্ত্রণেই এখানে এসে গেড়ে বসেছে? তুমি কিন্তু সহজে ওকে এখান থেকে নাড়াতে পারবে না।

কোনরকমে বলার চেষ্টা করলাম, ইলিয়া হঠাৎ পা মচকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার সেবাশুশ্রূষার জন্যই দিনকয়েকের জন্য গ্রেটা এখানে এসেছে। ইলিযা এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে, মনে হয় খুব শিগগিরই গ্রেটা নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাবে।

-তুমি দেখছি তাহলে কিছুই জান না। ওর উদ্দেশ্য যেনতেন প্রকারে এখানে থাকা। বাড়িটা তৈরি হবার সময়েও বারকয়েক এখানে এসেছিল বলে আমি জানি।

–ইলিয়ার ইচ্ছা, ওর বান্ধবী ওর সঙ্গে এখানেই থাকে।

–মেয়েটা তো শুনেছি, বেশ কিছুদিন থেকেই ইলিয়ার কাছে রয়েছে। ইলিয়ার মত অমন সরলমতি মেয়েকে ধুরন্ধর মেয়েটা খুব সহজেই কজা করে নিয়েছে।

কথাটা আমারও অজানা নয়। ইলিয়ার অভিভাবক মিঃ লিপিনকটও গ্রেটা সম্পর্কে একবার ঠিক এরকম মন্তব্যই করেছিলেন।

স্যানটনিক্স ফের বললেন, তোমারও কি ইচ্ছা মেয়েটা বরাবরের মত এখানে থেকে যাক?

আমি বিরক্তির সুরে বললাম, আমি তাকে জোর করে বার করে দিতে পারি না। গ্রেটা আমার স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার এক্ষেত্রে কি বলার থাকতে পারে?

স্যানটনিক্স অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও বুঝবার চেষ্টা করছিলাম, তার এমন অদ্ভুত কথার কারণটা কি।

আচমকা তিনি বলে উঠলেন, তুমি বুঝতে পারছ না মাইক, খুব বিপজ্জনক পথে পা বাড়িয়ে চলেছ। বলতে বাধ্য হচ্ছি, গ্রেটাকে নিয়েও তোমার সম্পর্কে আমার সন্দেহ জাগে। কিন্তু মেয়েটার মনোবল তুমি জান না।

এবারে আমি স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ না করে পারলাম না। ঝঝের সঙ্গেই বললাম, কীসব আবোলতাবোল বকে চলেছেন আপনি?

–দেখ মাইক, আমি অনেকক্ষণ ধরে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে দুজনকে লক্ষ্য করছি। দুজনের ঘনিষ্ঠতা খুবই গাঢ়। এদের মধ্যে তোমাকে একজন বহিরাগত ছাড়া অন্যকিছু মনে হয় না। তুমি কি তা বুঝতে পারছ না?

–এসব কথা আপনি ভাবছেন কি করে? আমি ইলিয়ার স্বামী। এর মধ্যে বহিরাগতের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?

–আমার বক্তব্য তুমি কোনদিনই বুঝতে পারবে না। যা দেখছি, তুমি তোমার নিজের সম্পর্কেই ঠিক ঠিক ওয়াকিবহাল নও।

এবারে আমি রূঢ় স্বরে বললাম, দেখুন মিঃ স্যানটনিক্স, এটা ঠিক যে আপনি একজন প্রথমশ্রেণীর স্থপতি, কিন্তু তাই বলে–

তাতে কি কোন সন্দেহ আছে। এই বাড়িটা আমার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। প্রাণমন ঢেলে এটা তৈরি করেছি আমি। তুমি আর ইলিয়া দুজনে মিলে এই বাড়িতে সুখে শান্তিতে বসবার করবে এটাই আমি চাই।

আমাকে বলাও হয়েছিল সেরকম। আমার অনুরোধ, তোমাদের মধ্যে তৃতীয় কারুর প্রবেশ ঘটতে দিও না। পরিণতি শুভ হবে না। আমি বলছি, খুব বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে ওই মেয়েটাকে তুমি বিদেয় কর।

দেখুন, গ্রেটাকে আমি নিজেও পছন্দ করি না। কিন্তু সেকথা ইলিয়াকে বোঝানোর উপায় নেই। তবুও, দিনকতক আগেই তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেছে। কিন্তু তবু এ বাড়ি থেকে তাকে তাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

এর পর খানিক বিরতি দিয়ে আমি পরে বললাম, এখন বুঝতে পারছি, যারা এই জিপসি একর জায়গাটাকে অভিশপ্ত বলে থাকে, তারা খুব একটা মিথ্যা বলে না। এদিকে ঘরে এই অবস্থা, ওদিকে এক জিপসি বুড়ি সেই প্রথম দিন থেকে আমাদের পেছনে লেগে রয়েছে। কেবলই ভয় দেখায়।

যেন এখান থেকে আমাদের তাড়াতে পারলে বাঁচে। আচমকা বনবাদাড় থেকে সামনে হাজির হয়, বিড়বিড় করে অভিশাপ দেয়।

বলে এখান থেকে চলে না গেলে আমাদের সর্বনাশ হবে। জায়গাটাকে বরাবর পবিত্র এবং সুন্দর রাখা প্রয়োজন।

শেষ বাক্যটা কানে যেতে আমি নিজেও চমকে উঠলাম। কথাটা যেন অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, যেন আমাকে দিয়ে কেউ বলিয়ে নিল বোধ হল।

স্যানটনিক্স ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। সেই রকমই রাখা উচিত। বিশেষত একটা অশুভশক্তির প্রভাব যখন রয়েছে।

–এসব অভিশাপের কথা নিশ্চয় আপনি বিশ্বাস করেন না।

-দেখ মাইক, দুনিয়ার কতটুকু তুমি জান বা দেখেছ? তোমাদের কাছে অদ্ভুত এমন অনেক কিছু আমি বিশ্বাস করি।

এই জাতীয় অশুভশক্তি সম্পর্কেও আমার অভিজ্ঞতা কিছু কম নেই। আমি নিজেও যে খানিকটা অশুভশক্তির অধিকারী, তা কি তোমার মনে হয় না?

আমি বরাবরই আমার মধ্যে অশুভশক্তির অস্তিত্ব অনুভব করি। সেকারণেই কোন অশুভশক্তির কাছাকাছি হলে আমি তা অনুভব করতে পারি। তবে তার উৎসটা সবসময় বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না।

একটু থেমে আমার মুখের ওপর সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, তুমি জান না, এই বাড়িটা তৈরি করার সময় আমি বরাবর সতর্ক ছিলাম, কোন অশুভশক্তি যেন একে স্পর্শ করতে না পারে। আমার কাছে এর গুরুত্ব কতখানি, আশাকরি এবারে তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?

কথা বলতে বলতে সহসা স্যানটনিক্সের মুখের চেহারা অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে বকবক না করে চল ভেতরে যাওয়া যাক। ইলিয়ার কাছে গিয়ে বসা যাক।

সেই সন্ধ্যাতেই স্যানটনিক্সের এক নতুন রূপ আমি আবিষ্কার করেছিলাম। তিনি যে কি সাংঘাতিক চরিত্রের মানুষ সে বিষয়ে আগে আমার কোন ধারণা ছিল না।

তাকে আন্তরিকভাবেই ইলিয়া অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তিনিও বেশ খোশমেজাজে আমাদের সঙ্গে গল্প করলেন। রীতিমত সম্মোহিতের মত গ্রেটার রূপের প্রশংসা করলেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। লক্ষ করলাম গ্রেটাকে যে কোন উপায়ে খুশি করার জন্যই তিনি ব্যস্ত। সারাক্ষণ তার আচারআচরণ লক্ষ্য করে উদ্দেশ্যটা আঁচ করবার চেষ্টা করলাম।

স্বাভাবিক সৌজন্য বশতঃই ইলিয়া স্যানটনিক্সকে দুচারদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানাল। তিনি জানালেন, মাত্র একবেলার জন্যই এখানে এসেছেন। আগামীকাল সকালেই চলে যাবেন।

.

০৫.

 পরদিন বিকেলে এক অভাবিত ঘটনা ঘটল। বনপথ ধরে বাড়ির দিকে ফিরে আসছিলাম। পাইনগাছের তলায় তলায় অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে আসছিল। সহসা চোখে পড়ল, অন্ধকারে গাছতলায় এক দীর্ঘকায় নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।

অনুমান করলাম, জিপসি বুড়ি ছাড়া কেউ নয়। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দুকথা শুনিয়ে দেবার জন্য দু-পা এগিয়ে গেলাম।

কিন্তু সহসাই স্তম্ভিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমাকে। দেখি স্থির, নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আমার মা।

–হায় ভগবান, প্রবল বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে? তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? তা বাড়িতে গেলে না কেন?

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মা আমার সামনে দাঁড়ালেন।

বললেন, তোমার কুশল জানতেই এসেছি আমি। ওই প্রাসাদবাড়িটা কি তোমরা নিজেদের জন্য তৈরি করেছ?

-হ্যাঁ। তোমাকে তো কতবার আসবার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তুমি কোন সাড়াই দিলে না।

কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বললাম। বিয়ের পর একটা দায়সারা গোছের চিঠির পর মাকে আমি কোন চিঠিই আর লিখিনি।

আমি ভালকরেই জানতাম, মা কোনদিনই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। আর মায়ের আসাটাও আমার অভিপ্রেত ছিল না।

মা বলল, বাড়িটা সত্যিই সুন্দর।

–তুমি নিশ্চয় ভাবছ, আমার মত ছেলের পক্ষে খুবই জমকালো হয়ে গেছে।

–বাছা, এটা সত্যি যে, তুমি যে বাড়িতে ও পরিবেশে মানুষ হয়েছ সেই তুলনায় বাড়িটা জমকালোই বটে। সকলকে সবক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্য ও পরিবেশের কথা মনে রেখে চলা উচিত।

মা, বরাবর দেখেছি, তুমি আমার সবকিছুতেই ভ্রু কোঁচকাও। আমি একই গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকব চিরকাল তাই কি তুমি চাও? যাকগে ওসব কথা, এখন চল বাড়ির সঙ্গে, তোমার পুত্রবধূকেও দেখবে।

–তোমার স্ত্রীর সঙ্গে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে।

আমি বিস্মিত হলাম মায়ের কথা শুনে। বললাম, তোমার সঙ্গে আবার তার পরিচয় হল কবে?

-তোমাকে তোমার স্ত্রী দেখছি কিছুই বলেনি। সে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য লণ্ডনে গিয়েছিল।

মাকে আমি জানি, ছলচাতুরি, মিথ্যা কখনো প্রশ্রয় দেয় না। তবু অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, লণ্ডনে গিয়ে ইলিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করেছে?

-হ্যাঁ, সপ্তাহ কয়েক আগে হঠাৎ একদিন উপস্থিত হয়েছিল আমার বাসায়। আমি মাইকের মা জানতে পেরে নিজের পরিচয় দিল। বলল, তোমার আপত্তির ফলেই আগে আসতে পারেনি। সেদিনও তোমাকে না জানিয়েই চলে এসেছিল।

তোমার আপত্তি সম্পর্কে মেয়েটি বলল, সে ধনী পরিবারের মেয়ে, অগাধ বিত্তের অধিকারী, সে কারণে তুমি নাকি তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে চাওনি।

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, মাইক তোমাকে ঠিক কথা বলেনি। মাইকের দোষগুলো আমি জানি বলেই সে আমার কাছে আসতে লজ্জা পায়।

আমি ক্ষুণ্নস্বরে বললাম, তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, একথা আমাকে ইলিয়ার বলা উচিত ছিল। কথাটা কি উদ্দেশ্যে গোপন করল, বুঝতে পারছি না।

-উদ্দেশ্য আর কি থাকবে। তোমার অমতে কাজটা করেছে বলে হয়তো পরে বিব্রত বোধ করেছিল।

কথা বলতে বলতে মাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গোটা বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাকে দেখালাম। লক্ষ্য করলাম মায়ের ভ্র আগাগোড়া কুঞ্চিত হয়ে রইল।

ইলিয়া আর গ্রেটা বৈঠকখনা ঘরে বসেছিল। তাদের দুজনের ওপর দৃষ্টি পড়তেই মা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে

ইলিয়া মাকে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত আনন্দ প্রকাশ করে ব্যস্ত হয়ে উঠে এল। মায়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে নিল।

–মিসেস রজার, কি সৌভাগ্য, আমি তো ভাবতেই পারিনি।

ইলিয়া গ্রেটাকে ডেকে বলল, ইনি মাইকের মা, আমাদের মাননীয়া অতিথি। আমাদের সংসার স্বচক্ষে দেখতে এসেছেন।

পরে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ হচ্ছে গ্রেটা অ্যাণ্ডারসন, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মা গ্রেটার দিকে তাকাল। মুহূর্তে তার মুখভাব কঠিন হয়ে গেল।–এ যে দেখছি…এ যে দেখছি…বলতে বলতে মা থেমে গেল।

ইলিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি দেখছেন–

-না, বলছিলাম, সব কিছুই বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছ তোমরা। সবকিছুই বেশ পরিপাটি, মানানসই।

ইলিয়া গ্রেটাকে মায়ের জন্য চা করতে পাঠিয়েছিল। মা সোফায় এসে বসল।

 ইলিয়া মুখোমুখি বসে মাকে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, আপনার সঙ্গে মালপত্র কোথায়?

মা বললেন, না বাছা, ওসব কিছু আনিনি। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই উঠব। নইলে লণ্ডনের ট্রেন পাব না। তোমাদের কেবল একবার নিজের চোখে দেখতে এলাম।

গ্রেটা চা নিয়ে এসে পৌঁছবার আগেই মা তার সঙ্গে ইলিয়ার দেখা করার প্রসঙ্গ তুলে বললেন, যে কর্তব্যের খাতিরেই কাজটা সে করেছে। এজন্য আমি যেন ওকে কিছু না বলি।

পরে ইলিয়ার-প্রশংসা করে বললেন, এমন সুন্দরী গুণবতী মেয়েকে বিয়ে করা খুবই ভাগ্যের কথা। আমার পুত্রবধূটি প্রকৃতই ভাল মেয়ে।

ইতিমধ্যে গ্রেটা চা নিয়ে এলো। চা খাওয়া শেষ হলে মা আর বসতে চাইলেন না। ইলিয়াও আর বেশি অনুরোধ করল না।

মাকে এগিয়ে দেবার জন্য আমি আর ইলিয়া গেট পর্যন্ত এলাম। বিদায় নেবার আগে মা জানতে চাইল, তোমাদের সঙ্গে যে মেয়েটিকে দেখলাম, সে কে?

গ্রেটার সঙ্গে সম্পর্কের কথা ইলিয়া খুলে জানাল। বলল, ও তিনবছর থেকে এখানে আছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সবরকম ভাবেই ও আমাকে সাহায্য করে।

আরো দু-একটি কথা মা ওর সম্পর্কে জেনে নিলেন। পরে বললেন, দেখ বাছা, বিবাহিত নারীপুরুষের মাঝে, অন্য কারুর উপস্থিতিটা ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়। বিশেষ করে তোমরা সদ্য বিবাহিত।

মায়ের কথাটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ইলিয়ার এন্ডুকাকা অর্থাৎ মিঃ লিপিনকটের কথা। কথায় কথায় তিনিও একদিন গ্রেটার প্রতি তাঁর বিরাগের মনোভাব আমাকে জানিয়েছিলেন। গ্রেটা নাকি ইলিয়ার ওপর খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে।

প্রথম দেখার পরে মা-ও সেই একই কথা জানিয়ে গেল। ইলিয়া এ প্রসঙ্গে মাকে কিছু অবশ্য বলল না।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম।

.

পরদিন সকাল থেকেই মনটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল। আজ অবশ্য মেজর ফিলপটের সঙ্গে একটা নিলামে যাওয়ার কথা আছে।

জায়গাটা মাইল পনেরো দূরে। কিছু সৌখিন সামগ্রী নিলাম হবে। মেজরেরও এসব বিষয়ে বেশ সখ আছে।

আজকাল ঘোড়ায় চড়াটা ওর নেশার মত হয়ে গেছে। প্রায়ই সকালে বেরিয়ে যায়। ক্লডিয়াও কোন কোন দিন সঙ্গে থাকে। আজও সে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

গ্রেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তাহলে বাড়িতেই আছ তো?

-না একটু বেরুতে হবে। কিছু কেনাকাটার জন্য লণ্ডন যেতে হবে। মার্কেট কডওয়েল স্টেশন থেকে ক্লডিয়াও আমার সঙ্গে যাবে।

ইলিয়াকে বললাম, গ্রেটা যখন লণ্ডনে যাচ্ছে, তুমি তাহলে বার্টিংটনের হোটেলে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে যোগ দিতে পার।

নিলাম শেষ হবার পরে একটা নাগাদ আমি এবং মেজর ওখানে উপস্থিত হব। মোটর নিয়ে সেখানে যেতে তোমার কোন অসুবিধা হবে না।

ইলিয়া সম্মতি জানিয়ে বলল, বেশ তাই হবে। আমি একটা নাগাদ পৌঁছে যাব।

আমি প্রাতঃরাশ সারলাম। এক পেয়ালা কফি আর এক গেলাস কমলার রস পান করে ইলিয়া ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গেল।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে কিছুটা এগিয়েই পাহাড়ের মাঝ বরাবর বিস্তীর্ণ সমতলভূমি। সেই প্রান্তরেই ইলিয়া খুশিমত ঘোড়া নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।

রোদ চড়বার আগেই বাড়ি ঘিরে আসে।

ইলিয়ার জন্য ছোট গাড়িটা রেখে বড় ক্রাইসলারটা নিয়ে আমি একটু পরেই বার্টিংটন ম্যানরের দিকে রওনা হলাম।

ফিলপট আমার আগেই নিলামঘরে উপস্থিত হয়েছিলেন। নিলাম শুরু হবার কয়েক মিনিট আগেই আমি তার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলাম।

স্থানীয় কিছু লোকজন ছাড়া লণ্ডন থেকেও অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গিনীরাও সঙ্গে ছিলেন।

মেজর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন?

বললাম, নিলামের ব্যাপারে ওর বিশেষ আগ্রহ নেই। তবে, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে যোগ দেবে।

প্যাপিয়ে মাশে অর্থাৎ কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি আসবাব আজকাল বিশেষ দেখা যায় না। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা একটা লেখার টেবিল আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।

ওটা ছিল নিলামের তালিকার বিয়াল্লিশতম দ্রব্য। সেটার যখন ডাক উঠল আমি এগিয়ে গিয়ে দাম দিলাম।

লণ্ডন থেকে আগত দুই ব্যবসায়ীরও এই বস্তুটির বিষয়ে আগ্রহ ছিল। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাক চলল। শেষ পর্যন্ত বেশ চড়া দামই আমাকে জিনিসটার জন্য গুণে দিতে হল। সেই সঙ্গে বৈঠকখানা ঘরের জন্য একটা আরামকেদারাও কিনলাম।

জিনিসগুলোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা জর্জ হোটেলে হাজির হলাম। ইতিমধ্যে আরো অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছেন। হোটেলকর্মীরা রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে।

ভেতরে ইলিয়ার খোঁজ করলাম। ও এখনো এসে পৌঁছয়নি। অবশ্য ঘড়িতে সবে বেলা একটা হয়েছে।

হোটেলের বারে গিয়ে আমরা দু পাত্র পানীয়ের অর্ডার দিলাম। ইলিয়ার জন্য এখানেই অপেক্ষা করা যাক।

চারপাশের প্রায় সব টেবিলেই লোক। হঠাৎ জানালার পাশে বসা এক ব্যক্তিকে দেখে চেনা মনে হল। খুবই পরিচিত মুখ। কিন্তু এই মুহূর্তে সঠিক পরিচয় মনে করতে পারলাম না।

আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মেজরকে বললাম, মনে হয় কোন কারণে আটকে পড়েছে। নইলে এত দেরি হবার কথা নয়। গাড়ির কলকজাও বিগড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। বরং চলুন আমরা লাঞ্চটা সেরে নিই।

মেজর বিশেষ আপত্তি করলেন না। আমরা নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দিলাম।

মেজর বললেন, এই লাঞ্চের ব্যাপারটা ইলিয়া ভুলে যায়নি তো। একটা টেলিফোন বরং করে দেখতে পার।

–ঠিক মনে করেছেন। তাহলে অন্তত মানসিক উদ্বেগটা কমবে।

আমি উঠে কাউন্টারের ফোনটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফোনটা ধরল আমাদের পরিচারিকা মিসেস কার্সন। সে জানাল, মিসেস রজার তো এখনো বাড়ি ফেরেননি।

–সেকি, ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে

–হ্যাঁ, সকালবেলা বেরিয়ে যাবার পরে এখনো বাড়িতে ফিরে আসেননি। আমাদের কিছু বলেও যাননি।

খুবই দুর্ভাবনায় পড়ে গেলাম। মিসেস কার্সনকে জর্জ হোটেলের ফোন নম্বরটা জানিয়ে বললাম, ইলিয়ার কোন খবর পেলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করে।

টেবিলে ফিরে এলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়েই মেজরের চোখেও উদ্বেগের ছায়া পড়ল। আমি বিব্রতকণ্ঠে জানালাম, সেই যে সকালে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে, তার পর এখনও পর্যন্ত বাড়ি ফেরেনি। অন্যদিন তো দেড় দু ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসে।

মেজর আমাকে ভরসা দিয়ে বললেন, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, কোন কারণে কোথাও হয়তো আটকে গিয়ে থাকবে। পাহাড়ি পথে ঘোড়াটা পায়ে চোট পেয়ে থাকলে বেচারীর ভোগান্তির একশেষ হচ্ছে।

 হোটেলের বিল মিটিয়ে চিন্তিতভাবে আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই রাস্তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ি স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল।

চালকের আসনে বসে থাকা লোকটির দিকে চোখ পড়ল। এই ভদ্রলোকই হোটেলে জানালার ধারে বসেছিল।

এবারে মনে পড়ে গেল–স্টানফোর্ড লয়েড। ইলিয়ার সম্পত্তির লগ্নিসম্পর্কিত দায়দায়িত্ব তারই ওপর। এখানে ভদ্রলোকের আসার কি কারণ ঘটল মাথায় এলো না।

গাড়িতে বসে থাকা যে মহিলাকের পলকে জন্য নজরে পড়ল, তাকে ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল বলেই আমার মনে হল।

কিন্তু ক্লডিয়ার তো গ্রেটার সঙ্গে লণ্ডনে যাবার কথা। সবকিছু যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল।

আর অপেক্ষা করা বৃথা মনে হল। মেজরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে পথের লোকজনের কাছে ইলিয়ার খোঁজখবর নিতে লাগলাম। কিন্তু কেউই কোন সন্ধান দিতে পারল না।

জিপসি একরের কাছাকাছি এসে ক্ষেতে কাজ করা একটি লোকের কাছ থেকে জানা গেল, ঘণ্টা দুয়েক আগে সে সওয়ারবিহীন একটা ঘোড়াকে পাহাড়ী পথ ধরে ওপরে যেতে দেখেছে।

এরপর আর কোথাও দেরি না করে বাড়িতে ফিরে এলাম। সহিসকে ডেকে ঘোড়া নিয়ে ইলিয়ার খোঁজে পাঠিয়ে দিলাম।

মেজর ফিলপট তার বাড়িতে ফোন করে একজনকে ইলিয়ার খোঁজ নিতে বলেছিলেন। তারপর, ইলিয়া ঘোড়া নিয়ে যে পথে যাতায়াত করে মেজরকে নিয়ে সেই পথ ধরে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হলাম।

বনটা শেষ হলেই বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। বনের ভেতর থেকে কয়েকটা সরু পায়েচলা পথ প্রান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।

এমনি একটা পথের প্রান্তে আসতেই চোখে পড়ল, হাত-পা গুজড়ে পড়ে আছে ইলিয়া। দুহাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠলাম।

ফিলপট হাঁটু গেড়ে বসে ঝুঁকে দেখলেন। পরে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, এখুনি একজন ডাক্তার প্রয়োজন। আমার মনে হচ্ছে–

–ইলিয়া কি মারা গেছে! ভগ্নকণ্ঠে জানতে চাইলাম আমি।

–হ্যাঁ, বিষণ্ণ গম্ভীর কণ্ঠ মেজরের, আমার তাই বিশ্বাস।

 –হায়, ভগবান। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–এ কি করে সম্ভব। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। মেজর এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ইতিমধ্যে আমাদের সহিস সেখানে এসে পৌঁছেছিল। মেজর তাকে পাঠিয়ে দিলেন ডাঃ শকে ডেকে আনার জন্য।

.

০৬.

 কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাঃ শ তার পুরনো ল্যাণ্ডওভারটা নিয়ে এসে পৌঁছলেন। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি সোজা ইলিয়ার নিথর দেহটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েক মুহূর্ত পরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস রজার মারা গেছে ঘন্টা তিনেক আগেই। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল কিভাবে?

ডাক্তার শ’কে জানালাম, সকালেই ও ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি।

ডাঃ শ বলল, কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে যাবার সময় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তো মনে করতে পারছি না। আমি অনেকবার তাকে ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় দেখেছি। খুবই অভ্যস্ত বলে মনে হয়েছে।

আমি বললাম, ঘোড়ায় চড়ার ব্যাপারে ওর দক্ষতা ছিল অসাধারণ।

-তাহলে স্নায়ুর কোন প্রতিক্রিয়াঘটিত ব্যাপার হতে পারে। অথবা ঘোড়াটা কোন কারণে হয়তো চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল।

ইলিয়ার নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে ডাঃ শ বললেন, শরীরে কোন চোট পেয়েছেন বলে বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে না। ভেতরের ব্যাপার বলেই সন্দেহ হচ্ছে। যাই হোক, এখন আমাদের কিছু করার নেই। করোনারের বিচারের সময় পুলিসের রিপোর্ট থেকেই মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।

আমি অসহায় বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ডাক্তারের দিকে। তিনি বললেন, আপনি বরং বাড়ি ফিরে গিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করুন।

ইতিমধ্যে কি করে যে খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল কে জানে। কয়েকজন স্থানীয় গ্রামবাসী এসে সেখানে জড়ো হয়েছিল। তারা নানা কথা বলাবলি করছিল।

একজন বৃদ্ধ চাষীকে বলতে শোনা গেল, আমার সামনে দিয়েই ভদ্রমহিলাকে ঘোড়ায় চেপে যেতে দেখেছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ঘোড়াটাকে একা জোরে জোরে পা ফেলে নেমে আসতে চোখে পড়েছিল।

ডাঃ শ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভদ্রমহিলার পাশাপাশি কি আর কাউকে যেতে দেখেছিলেন?

–এই হতভাগ্য মহিলা ছাড়া আশপাশে আর কাউকে চোখে পড়েনি। বনের পথ ধরে তিনি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

–সেই জিপসি বুড়ির কাজ নয় তো। একটি মেয়ে এই সময় বলে উঠল।

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জিপসি বুড়ি? কখন দেখেছ তাকে?

মেয়েটি জানাল, বুড়ির সঙ্গে গ্রামের পথে দেখা হয়েছিল আমার। বেলা তখন আন্দাজ দশটা হবে। আমি নিজ কানে শুনেছিলাম বুড়ি একবার ভদ্রমহিলাকে প্রাণে মারা পড়বে বলে ভয় দেখিয়েছিল।

-তবে কি জিপসির অভিশাপ? আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলাম আমি, জিপসি একরই আমাদের এমন সর্বনাশ করল?