৩. লরেন্স রেডিং পৌঁছানোর পর

১১.

লরেন্স রেডিং পৌঁছানোর পর আমার ডাক পড়ল। পড়ার ঘরে এসে লরেন্সকে দেখে কেমন উদভ্রান্তের মত মনে হল। আমাকে দেখে ম্লান মুখে হাসল।

চীফ কনস্টেবল মিঃ মেলচেট লরেন্সকে বলল, কয়েকটা প্রশ্ন করব বলেই তোমাকে এখানে আনানো হয়েছে।

আচ্ছা, তুমি কি জান যে আরও একজন মিঃ প্রথেরোকে খুন করেছে বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে?

–আরো একজন, বিস্মিত হল লরেন্স, কে কে সে?

–মিসেস প্রথেরো।

–অসম্ভব। এটা একেবারেই অসম্ভব। অ্যানা এটা করতেই পারে না।

–আমরাও অবশ্য তার কথা বিশ্বাস করি না, বললেন মিঃ মেলচেট, অবশ্য তোমার কথাগুলোও আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি।

খুনের যে সময়টার কথা তুমি বলেছ, ডাঃ হেডক বলেছেন, তা হতে পারে না। তিনি জোর দিয়েই বলেছেন।

–ডাঃ হেডক সেরকম বলেছেন নাকি?

-হ্যাঁ। ডাক্তারের কথা আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। এখন আমরা আশা করব, সত্যি কথাটা বলে তোমরা আমাদের সাহায্য করবে।

লরেন্স মাথা নত করে চিন্তা করতে লাগল। বার কয়েক ইতস্তত করে পরে বলল, মিসেস প্রথেরোর ব্যাপারে আমাকে মিথ্যা কথা বলছেন না তো? আপনি কি সত্যি ওকে সন্দেহ করেন?

–না, মোটেই না।

-আমি একটা আস্ত বোকা, লরেন্স বলে উঠল, আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে সে এটা করেছে।

–কি হয়েছিল, তুমি আমাদের খুলে বল।

 –বেশি কিছু বলার নেই। সেই বিকেলে আমি মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করি।

–ওই ব্যাপারটা আমরা জানি। তোমাদের দুজনের সম্পর্কের কথাটা অনেকেই জানতো।

–হয়তো। লরেন্স আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি সবকথাই খুলে বলছি।

একটু থেমে সে ফের বলতে শুরু করল, বিকেলে সওয়া ছটার সময় আমি স্টুডিও ঘরে মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করি।

আমি এখান থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই কথাটা তাকে জানাই। ও স্বীকার করে, সাময়িকভাবে আমার সরে থাকাই ভাল।

–তারপর? আমি বললাম।

–আমরা স্টুডিও ছেড়ে বেরিয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ স্টোনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

এরপর ডাঃ স্টোনের সঙ্গে আমি ব্লু-বার-এ গেলাম। মদ খেলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাবার কথাই মনে হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু পরে ভাবলাম, এখানে এসেছি যখন একবার ভিকার-এর সঙ্গে দেখা করে যাই।

ওই অবধি বলে লরেন্স চোখ বুঝল। মনে মনে পরের ঘটনাগুলো সম্ভবতঃ সাজিয়ে নিল।

লরেন্স ফের বলতে শুরু করল, ভিকারেজে দরজার কাছেই ঝি-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শুনলাম ভিকার নেই, তবে ফিরে আসবেন শিগগিরই।

আরো শুনলাম, মিঃ প্রথেরো ভিকারের জন্য পড়ার ঘরে অপেক্ষা করছেন। আমিও অপেক্ষা করব ভেবে পড়ার ঘরে চলে এলাম।

-তারপর? মিঃ মেলচেট উদগ্রীব হলেন।

–দেখলাম মিঃ প্রথেরো লেখার টেবিলে বসে আছেন। আমি এগিয়ে গেলাম, তাকে ছুঁলাম, বুঝতে পারলাম দেহে প্রাণ নেই।

নিচের দিকে চোখ পড়তে মেঝেয় চেয়ারের একপাশে পিস্তলটা চোখে পড়ল। সেটা তুলে হাতে নিয়েই বুঝতে পারলাম, আমার পিস্তল।

–এরপর তুমি কি করলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–এখানে ওই অবস্থায় আমার পিস্তলটা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এসে গেল, নিশ্চয়ই মিসেস প্রথেরো কোন সময়ে আমার পিস্তলটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল, অতিষ্ট হয়ে উঠলে সেটা নিজের ওপরই ব্যবহার করবে। আমার ধারণা হল, আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ও এখানেই এসেছিল। তারপর…উঃ। আমি আর ভাবতে পারছি না মিঃ ক্লেমেন্ট।

বলতে বলতে অসহিষ্ণুভাবে মাথা চেপে ধরল লরেন্স।

স্বাভাবিক। সহানুভূতির সুরে বললাম আমি।

–তারপর তুমি কি করলে? মিঃ মেলচেট জানতে চাইলেন।

–আমি তৎক্ষণাৎ পিস্তলটা পকেটে পুরে ফেললাম। ঘর থেকে বেরিয়ে গেটের মুখে আসতেই মিঃ ক্লেমেন্টের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন প্রথেরোর সঙ্গে তার দেখা করবার কথা আছে।

আমার তখন মানসিক অবস্থা এমন যে কি করছি কি বলছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

আমার আচরণের অস্বাভাবিকতা দেখে যে ভিকার আশ্চর্য হয়েছে তা বুঝতে পেরেছিলাম।

আমি সেখানে আর দাঁড়াতে পারিনি। ছুটে রাস্তায় এসে উদভ্রান্তের মত রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার তখন কেবলই মনে হচ্ছে, অ্যানা যদি এটা করেই থাকে, তাহলে তার জন্য পরোক্ষ ভাবে আমিই দায়ী। শেষে মরীয়া হয়ে পুলিসের কাছে গিয়েছি।

লরেন্সের কথা শেষ হলেও অনেকক্ষণ আমরা কেউই কোন কথা বলতে পারলাম না। তারপর একসময় মিঃ মেলচেট নীরবতা ভঙ্গ করলেন।

বললেন, আচ্ছা রেডিং একটা কথা, টেবিলের ওপরে মৃতদেহের আড়ালে পড়ে থাকা কোন চিরকুট কি তোমার চোখে পড়েছিল?

–না, তেমন কিছু দেখতে পাইনি।

–কোন কারণে ঘড়িটায় কি হাত দিয়েছিলে?

-না, সেটা ধরবার কোন কারণই ঘটেনি। তবে চোখে পড়েছিল টেবিলের ওপর উল্টে পড়ে আছে।

মিঃ মেলচেট একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, এবারে মনে করতে পারছ কিনা দেখতে, পিস্তলটা তুমি শেষ কবে দেখেছিলে?

লরেন্স একটু চিন্তা করল। এরপর বলল, এটা ঠিকভাবে বলা শক্ত।

–বেশ, ওটা সাধারণত তুমি কোথায় রাখতে?

-বুককেসের ওপরের তাকেই সাধারণত রাখতাম। তবে খুব যত্নে যে থাকত তা নয়। পিস্তলটার ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না কোন কালেই।

-তাহলে তো দেখছি তোমার বসার ঘরে যে কেউই সেটা দেখতে পেত?

–হ্যাঁ। তা সম্ভব ছিল।

–তাহলে শেষ ওটা কবে দেখেছ, সঠিক বলতে পারছ না?

জবাবে মাথা নাড়ল লরেন্স। পরে কি চিন্তা করে বলল, যতদূর মনে করতে পারছি, গত পরশু পর্যন্ত পিস্তলটা ওই তাকের ওপরেই দেখেছি। ব্যাপারটা মনে আছে এই জন্য যে ওটা সরিয়ে সেদিন একটা পাইপ বার করেছিলাম।

–আর একটা কথা, সম্প্রতি তোমার বাড়িতে কে কে গেছে?

–অনেকেই তো যাচ্ছে আসছে, কার কথা বলব! তবে গত পরশু আমি একটা টি-পার্টি দিয়েছিলাম। সেদিন অনেকেই আমার ওখানে গিয়েছিল।

–বাইরে বেরিয়ে যাবার সময় কি তুমি দরজায় চাবি লাগিয়ে যাও?

–একদম না। দরকারই হয় না। চুরি হবার মত কোন জিনিসই তো আমার ঘরে নেই। তাছাড়া এখানে কেউ তেমন করেও না।

-তোমার ঘরদোর দেখাশোনা করে কে?

-মিসেস আর্চার নামে বৃদ্ধা এক মহিলা। সে পিস্তলের ব্যাপার কিছু বলতে পারবে না। তবে ইচ্ছে করলেই যে-কেউ আমার ঘর থেকে পিস্তলটা সরিয়ে ফেলতে পারে।

ঠিক এমনি সময়ে মিসেস প্রথেরোকে নিয়ে ডাঃ হেডক উপস্থিত হলেন। লরেন্স আর মিসেস প্রথেরো পরস্পরকে দেখে বিস্মিত হলেন।

মিসেস প্রথেরো মিঃ মেলচেটকে জিজ্ঞেস করলেন, একটু আগে ডাঃ হেডকের কাছ থেকে যা শুনলাম তা কি সত্যি?

মেলচেট বললেন, হ্যাঁ, মিসেস প্রথেরো। রেডিং এখন সন্দেহমুক্ত। এখন আমরা আপনার কথা শুনতে চাই।

মিসেস প্রথেরো আমার মুখের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, হা সবই বলছি খুলে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা লরেন্স রেডিং-এর সঙ্গে তার স্টুডিও ঘরে আমার দেখা করার কথা ছিল।

সওয়া ছটা নাগাদ আমি আর আমার স্বামী গাড়ি করে গ্রামে যাই। আমার কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল।

আমরা যখন পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিই সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন যে ভিকারের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। শুনে আমার একটু অস্বস্তি হয়েছিল। আমাকেও তো লরেন্সের স্টুডিওতে যেতে হবে। ভিকারেজে স্বামীর উপস্থিতিতে আমাকে যেতে হবে, এটাই ছিল অস্বস্তির কারণ।

-তারপর?

–আমার স্বামী সম্ভবত বেশিক্ষণ ভিকারেজে ছিলেন না। যাই হোক, আমি পেছনের রাস্তাটা দিয়ে বাগানে ঢুকেছিলাম। ভেবেছিলাম, তাহলে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।

কিন্তু আমাকে দেখতে পেয়ে মিস মারপল ডাকল। বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে হল।

মিস মারপলের সঙ্গে কথা বলে ভিকারেজ পার হয়ে পেছনদিক দিয়ে ঘুরে ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম।

ভেতরে কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। তখন গুঁড়ি মেরে উঁকি মারলাম। কিন্তু দেখলাম, ঘর ফাঁকা–কেউ নেই।

এরপর আমি স্টুডিও ঘরে চলে এলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লরেন্স এসে হাজির হল।

–পড়ার ঘরটাতে আপনি কাউকেই বসে থাকতে দেখেননি?

–না। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছিলাম, সেখানে আমার স্বামী ছিলেন না।

 চীফ কনস্টেবল মিঃ মেলচেট নীরবে কি ভাবলেন। পরে বললেন। কিছু মনে করবেন না মিসেস প্রথেরো, আপনি কি ভাবে কি করেছিলেন, দয়া করে একবার আমাদের দেখাবেন?

–বাধা কি আছে। বেশ, দেখাচ্ছি। মিসেস প্রথেরো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

ইনসপেক্টর স্লাক এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। সেটা দিয়ে বেরিয়ে মিসেস প্রথেরো ঘরে পেছনের জানালার দিকে গেলেন।

ইনসপেক্টর লেখার টেবিলে গিয়ে বসার জন্য আমাকে ইশারা করলেন।

আমার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তবু ধীরে ধীরে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম।

একমিনিট পরেই কানে এলো একজোড়া পায়ের শব্দ। কিছুক্ষণ থেমে রইল। তারপরেই শব্দটা আবার ফিরে গেল।

ইনসপেক্টর স্লাকের নির্দেশে লেখার টেবিল থেকে আমি আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস প্রথেরো ঘরে ফিরে এলেন।

-ঠিক এভাবেই আপনি এসেছিলেন? মিঃ মেলচেট জিজ্ঞেস করলেন।

–হ্যাঁ, অবিকল এইভাবে।

–আচ্ছা এবারে বলুনতো, আপনি যখন জানালা দিয়ে তাকালেন, তখন ভিকার কোথায় ছিলেন?

–ভিকার? মাপ করবেন, আমি ভিকারকে দেখতেই পাইনি।

ইনসপেক্টর গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, বুঝতে পারা গেল। এই জন্যেই আপনি সেদিন আপনার স্বামীকে ঘরে দেখতে পাননি। সেদিন মিঃ প্রথেরো লেখার টেবিলে ছিলেন।

–ও ওখানে…। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন মিসেস প্রথেরো।

–হ্যাঁ, মিসেস প্রথেরো, আপনি যখন জানালা দিয়ে তাকান সেই সময় মিঃ প্রথেরো ওখানেই বসেছিলেন। যাই হোক, ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। আচ্ছা, রেডিং-এর যে একটা পিস্তল আছে আপনি কি জানতেন?

-হ্যাঁ। একবার আমাকে বলেছিল।

–সেটা কোথায় থাকতো তা কি আপনি জানতেন?

–তা ঠিক জানতাম না। তবে ওর ঘরে বুক কেসের ওপর সেটা চোখে পড়েছে।

পিস্তলটা শেষ করে আপনার চোখে পড়েছে, মনে করতে পারেন?

–সম্ভবতঃ হপ্তা তিনেক আগে। সেদিন আমি আর আমার স্বামী ওখানে চায়ের নিমন্ত্রণে। গিয়েছিলাম।

-তারপর আর ওখানে যাননি?

–না। সাধারণতঃ আমি লরেন্সের বাড়িতে যাই না।

–তাহলে আপনাদের দেখা হত কোথায়?

–ওল্ডহলেই ও আসত। লেটিসের একটা ছবি আঁকায় হাত দিয়েছিল। এছাড়া বনের মধ্যে প্রায়ই দেখা হত আমাদের।

মেলচেট এবারে বললেন, না, আমার আর কিছু জানার নেই। আপনি এখন যেতে পারেন। আমাদের সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ।

ডাঃ হেডক মিসেস প্রথেরোকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। লরেন্স রেডিং-ও তাদের সঙ্গে গেল।

মিঃ মেলচেট বললেন, ওই চিরকূটটাই মনে হচ্ছে আমাদের পথ দেখাবে। লক্ষ্য করে দেখুন, চিঠির কথাগুলো অন্য কালিতে লেখা। আর মাথায় যে সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে সেই লেখাটার কালি অন্যরকম। চিরকূটে কোন আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল?

ইনসপেক্টর স্লাক বললেন, ওতে কোন আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে এমন আশা করা বৃথা। তবে পিস্তলে লরেন্স রেডিং-এর আঙুলের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। তবে সবচেয়ে রহস্যজনক আমার মনে হচ্ছে গুলির শব্দটা। যদি গুলির শব্দ হয়েই থাকে তাহলে তা কারোর না কারোর কানে আসবেই।

কর্নেল মেলচেট বললেন, মিস মারপল শব্দটা শুনেছেন বলে স্বীকার করেছেন।

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ঘটনাটা ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। সমস্ত ঘটনাগুলোর পেছনেই এমন একটা প্রেক্ষাপট লুকিয়ে আছে। আমার ধারণা, আমরা এখনো পর্যন্ত তার নাগাল ধরতে পারিনি।

আমাদের চোখের সামনের জিনিসগুলো যেমন ঘড়ি, চিরকূট, পিস্তল, এসবগুলোর অন্য কোন অর্থ থাকা অসম্ভব নয়।

-তাহলে এখন তুমি কি করতে চাইছ? জানতে চাইলেন ইনসপেক্টর।চল একবার মিসেস প্রাইস রিডলের সঙ্গে দেখা করে আসি।

ইনসপেক্টর আপত্তি করলেন না। আমাকেও তারা সঙ্গে নিয়ে চললেন।

.

১২.

 মিসেস প্রাইস রিডলে বাড়িতে ছিলেন না। চাকর বলল পুলিস স্টেশনে গেছেন। আমরাও পা বাড়ালাম সেদিকে।

পুলিস স্টেশনেই তার সঙ্গে দেখা হল। তিনি বেশ উত্তেজিত অবস্থাতেই ছিলেন। তার কাছ থেকে জানা গেল কেমন একটা বিকৃত অদ্ভুত স্বরে কে তাকে টেলিফোনে শাসিয়েছে।

কথাগুলো তাকে কি বলা হয়েছিল জানতে চাইলে মিসেস রিডলে বললেন, কথাগুলো মনে করতেও আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে। বলল, তুমি একটা পরনিন্দুক নচ্ছার মেয়েছেলে। এবারে তুমি বড় বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ভুলে যেও না তোমার পেছনে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড লেগেছে। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে যাও, নইলে মহা বিপদে পড়বে। মিঃ মেলচেট এসব কি কোন কথা হলো? সে কি ভয় ধরানো গলার স্বর!

-তারপর?

–আমি যেই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে কথা বলছো, অমনি বলল, একজন প্রতিশোধ গ্রহণকারী। তারপরই শুনলাম ফোনটা নামিয়ে রাখল।

একমুহূর্ত বিরতির পরে মিসেস রিডলে ফের বললেন, ফোনটা পেয়ে এমনই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি যে বনের দিক থেকে একটা গুলির আওয়াজের মত শব্দ কানে আসতেই ভীষণভাবে চমকে উঠেছিলাম।

ইনসপেক্টর স্লাক সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন-বন থেকে গুলির শব্দ?

-হ্যাঁ। বেশ জোরেই হয়েছিল শব্দটা মনে হল। অবশ্য তখন আমার মানসিক অবস্থাও খুব উত্তেজিত ছিল। তার জন্যও খুব জোরে বলে মনে হতে পারে।

মিঃ মেলচেট বলল, ঠিক আছে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।

 আমি বললাম, এমনও হতে পারে, কেউ আপনার সঙ্গে রসিকতা করেছে।

 মিসেস রিডলে কুঞ্চিত করে প্রথমে আমার দিকে তাকালেন। পরে মিঃ মেলচেটকে বললেন-সম্প্রতি গ্রামটায় অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। অদ্ভুতভাবে মারা গেলেন কর্নেল প্রথেরো। এরপর কার পালা কে জানে হয়তো আমারই হবে।

মিসেস রিডলে বিদায় নিলেন। ইনসপেক্টর স্লাক চিন্তিতভাবে বললেন, গুলির একটা শব্দ যে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মোট তিনজন শব্দটা শুনেছে বোঝা যাচ্ছে। শব্দটার উৎস এবার অনুসন্ধান করতে হবে।

তাছাড়া টেলিফোনের ব্যাপারটাও এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল।

পরে আবার বললেন, এরকম একটা চোরা টেলিফোন খুনের ঘটনার দিন ভিকারকে অকুস্থল থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।

মেলচেট মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ইনসপেক্টর বললেন, খুনের দিন ওই সময়টায় অর্থাৎ ছটা থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত কে কোথায় ছিল সেটাও অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। আচ্ছা ভিকার, ফোনটা কখন এসেছিল?

আমি বললাম, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হবে।

-কণ্ঠস্বরটা, নারী না পুরুষের?

–নারীকণ্ঠ বলেই মনে হয়েছে আমার। মিসেস অ্যাবোট বলেই ধারণা হল।

ফোন পেয়েই আপনি বেরিয়ে পড়লেন, না কিছুটা সময় নিয়েছিলেন?

সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি। তবে বাইসাইকেল নিইনি।

–মিসেস অ্যাবোটের বাড়ি কতদূর?

–মাইল দুই হবে।

-ওদিকে যাবার সবচেয়ে সংক্ষেপ রাস্তাটা মনে হয় ওল্ডহল বনের মধ্য দিয়ে, আপনি সেই পথেই গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।

–না, সংক্ষিপ্ত হলেও ওটা চলাচলের উপযুক্ত নয়। আমি মাঠের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা রাস্তাটা ধরে গিয়েছি। ফিরেছিও ওই পথে।

–এই রাস্তাটাই তো ভিকারেজের উল্টো দিক থেকে এসেছে?

–হ্যাঁ।

–আপনার স্ত্রী তখন কোথায় ছিলেন?

–তিনি সকালেই লণ্ডনে গিয়েছিলেন। ফিরেছেন ছটা পঞ্চাশের ট্রেনে।

–ঠিক আছে। ইনসপেক্টর কি যেন চিন্তা করলেন, পরে বললেন, এখন আমি পর পর কয়েকটা কাজ সারব। মেয়েটাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য একবার ভিকারেজে যেতে হবে।

সেখান থেকে যাব ওল্ডহল। তারপর যাব মিসেস লেসট্রেঞ্জের কাছে। খুনের আগের দিন এই মহিলা মিঃ প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। একটু খোঁজ খবর নিতে হবে।

ইতিমধ্যে লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছিল। বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।

.

১৩.

 বাড়ির পথে দেখা হয়ে গেল ডাঃ হেডকের সঙ্গে। তিনি গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁকে বেশ চিন্তিত বলে মনে হল। বললেন, আমার বাড়ি চলুন। অগত্যা উঠতে হল তার গাড়িতে। ডাঃ হেডকের বাড়িতে এসে সার্জারি ঘরে বসলাম। আমরা যে গুলি করার সঠিক সময়টা জানতে পেরেছি তা তাকে জানালাম।

কথায় কথায় ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সহকারী পাদ্রী হস বেশ কিছুদিন থেকে এনকেফেলাইটিস লেথার্জিতে ভুগছে। ব্যাপারটা আমি জানতাম না। তাই ঠিক করলাম সময় করে তাকে একবার দেখতে যেতে হবে।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমি বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

ঘরে গ্রীসলভা আর ডেনিস গল্প করছিল। ওরা সব ঘটনা জানতে চাইল। আমি সংক্ষেপে সবই বললাম।

একটু পরেই মেরী এসে একটা চিরকূট হাতে দিয়ে জানাল ক্লেমেট, হস দেখা করতে এসেছে। বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। এটা পাঠিয়ে দিল আপনাকে।

চিরকূটের লেখাটা পড়লাম–

প্রিয় মিঃ ক্লেমেট,

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যদি একবার আমার ওখানে আস তাহলে বাধিত হব। ভীষণ বিপদে পড়েছি। তোমার পরামর্শ দরকার।
বিনীত
এসটেটল লেসট্রেঞ্জ

 একটু পরেই হসের কাছে এলাম। তার চোখ মুখে একটা ভীত সন্ত্রস্ত ভাব দেখে চমকে উঠলাম। হাতদুটোও কেমন কাঁপছিল। মনে হল অসুস্থ। ব্যস্ত হয়ে বললাম, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ? তাহলে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নাও।

হস আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, দরকার হবে না। আমি খুব ভালই আছি। শরীরের যা অবস্থা হয়েছে, কোনদিনই আর ভাল হয়ে উঠব বলে বিশ্বাস হয় না। এই অবস্থাতেই জীবন টেনে নিতে হবে।

একটু থেমে দম নিয়ে সে ফের বলতে লাগল, গ্রামে বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে গেল। এজন্য খুব মানসিক চাপ পড়ছে। তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

-চাপ পড়াই স্বাভাবিক। বললাম আমি।

–ওরা কি মিঃ রেডিংকে গ্রেপ্তার করেনি?

–না। তার জবানবন্দি পুলিস মেনে নিতে পারেনি।

 –তাহলে পুলিস বুঝতে পেরেছে মিঃ রেডিং সম্পূর্ণ নির্দোষ?

–হ্যাঁ সম্পূর্ণভাবে।

–তাহলে পুলিস কি অন্য কাউকে সন্দেহ করছে?

হস-এর কৌতূহল আমার মাত্রাতিরিক্ত মনে হল। কাজেই আমাকে সংযত হতে হল। বললাম, তা বলতে পারব না। তবে ইনসপেক্টর অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

হস নিজে থেকেই বলে চলল, এরকম একটা কাজ যে কে করল বুঝতে পারছি না। তবে মিঃ প্রথেরোর ব্যবহার তো মোটেই ভাল ছিল না। নিজেই লোককে শত্রু বানিয়ে ফেলত।

হতে পারে। বললাম আমি।

–কেন মিঃ ক্লেমেট, তোমার মনে নেই, আগের দিন সকালেই তো তোমাকে বলেছিল, আর্চার নামে লোকটা তাকে হুমকি দিয়েছে।

আমার মনে পড়ল কথাটা। মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

–আমি সেই সময় কাছেই ছিলাম। তুমি পুলিসকে কি আর্চারের কথাটা বলেছিলে? মানে ওই হুমকি দেবার ব্যাপারটা।

-না, বলিনি।

–তাহলে এবার পুলিসকে জানাও।

 বললাম, তুমিও তো কথাগুলো শুনেছিলে, পুলিসকে বলা উচিত মনে হলে তুমি নিজেই তো সে কাজটা করতে পার।

একথা বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। হসকে বিদায় জানিয়ে মিসেস লেসট্রেঞ্জের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

আমার অপেক্ষাই করছিলেন ভদ্রমহিলা। চিঠি পেয়েই চলে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, কথাটা ভেবেছিলাম পরে বলব। কিন্তু সেটা ঠিক হত না।

–বেশ তো। আপনাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারলে খুশি হব।

–খুব একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি মিঃ ক্লেমেট। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে আপনি সৎ পরামর্শ দিন।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিসেস লেসট্রেঞ্জের মুখের দিকে তাকালাম।

 ঠিক এই সময়েই বাড়ির ঝি এসে খবর দিল একজন পুলিস ইনসপেক্টর কি জরুরী প্রয়োজনে দেখা করতে এসেছেন। শুনে মিসেস লেসট্রেঞ্জ চোখ বুজলেন। মনে হল কয়েকবার সেঁক গিললেন। পরে ঝিকে বললেন, ওকে নিয়ে এসো।

–আপনিও বসুন মিঃ ক্লেমেট। বললেন আমাকে। একটু পরেই ইনসপেক্টর স্লাক ঘরে ঢুকে সুপ্রভাত জানালেন। আমার দিকেও তাকালেন। কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার উপস্থিতি তার অভিপ্রেত নয়।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিসেস লেসট্রেঞ্জ বললেন, ইনসপেক্টর, মিঃ ক্লেমেট এখানে থাকলে আপনার কোন অসুবিধা হবে না আশাকরি।

-না, তেমন অসুবিধা নেই। তবে না থাকলেই ভাল হত।

ইনসপেক্টরের এই কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে মিসেস লেসট্রেঞ্জ বললেন, বলুন, আপনাকে আমি কি ভাবে সাহায্য করতে পারি।

–মিঃ প্রথেরোর খুনের তদন্তের দায়িত্ব আমার ওপরেই রয়েছে। সেই কারণেই নিয়ম অনুসারে কিছু কাজ আমাকে করতে হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা ছটা থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত কে কোথায় ছিল, সে ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে হচ্ছে।

মিসেস লেসট্রেঞ্জ বললেন, তার মানে আপনার জিজ্ঞাস্য হল, গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমি কোথায় ছিলাম, তাই তো?

–হ্যাঁ তাই।

–সেই সময়টা আমি বাড়িতেই ছিলাম।

–ওহ, আপনার বাড়ির ঝিটাও নিশ্চয় সেই সময় বাড়িতেই ছিল?

–না গতকাল বিকেলে ও বাড়ি ছিল না।

–আচ্ছা।

মিসেস লেসট্রেঞ্জ বললেন, কাজেই বুঝতেই পারছেন, আমার কথাটাকেই সত্যি বলে। আপনাকে ধরে নিতে হবে।

ইনসপেক্টর স্লাক নড়েচড়ে বসে বললেন, তাহলে ধরুন কোন মহিলা, মানে মিস হার্টনেলের কথাই বলছি, তিনি যদি ছটার সময় এসে বেল বাজিয়ে কোন সাড়া না পেয়ে ফিরে গিয়ে থাকেন, আপনি কি তার ভুল বলবেন?

–বুঝতে পেরেছি, মাথা নেড়ে বললেন মিসেস লেসট্রেঞ্জ, ওই মহিলা বড়ই বিরক্তিকর। তিনি যাবার আগে অনেকবার বেল বাজিয়েছিলেন, আমি সাড়া দিইনি।

–কিন্তু কেউ যদি বলে ওই সময়টায় আপনাকে বাইরে দেখেছে?

কারুরই তা দেখা সম্ভব নয়, কেননা আমি বাড়িতেই ছিলাম। বেশ জোর দিয়েই মিসেস. লেসট্রেঞ্জ বললেন।

–তাহলে শুনুন মিসেস, মিঃ প্রথেরো খুন হবার আগের দিন রাত্রে আপনি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, একথাও কি মিথ্যা বলতে চান?

-না। আমি সত্যিই গিয়েছিলাম।

–কি প্রয়োজনে গিয়েছিলেন, তা কি দয়া করে বলবেন?

-সেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার ইনসপেক্টর, তা বলা সম্ভব না।

–কিন্তু এই ব্যক্তিগত বিষয়টিকেই যে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।

–আমি নিরুপায়। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, খুনের ঘটনার সঙ্গে এই বিষয়ের কোন যোগ নেই।

–সেটা আপনার পক্ষে বিচার করা শক্ত মিসেস লেসট্রেঞ্জ।

-বললাম তো ইনসপেক্টর, আমি নিরুপায়। দয়া করে একই কথা পুনরাবৃত্তি করতে আমাকে বলবেন না।

ইনসপেক্টরের চোখ চকচক করে উঠল। তিনি বেশ ক্রুদ্ধস্বরেই এবারে বললেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাই যে কোন প্রকারেই হোক আমি বিষয়টা পরিষ্কার করতে চাই–তা আমাকে করতে হবে।

মিসেস লেসট্রেঞ্জ, আপনি নিজেই নিজেকে বিপদে জড়িয়ে ফেলছেন।

 মিসেস লেসট্রেঞ্জ একথার কোনই উত্তর করলেন না। তিনি নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলেন।

-আপনি কি কর্নেল প্রথেরোর পূর্বপরিচিত? ইনসপেক্টর এবারে তাঁর জেরার ধরন পাল্টালেন।

-হ্যাঁ। তবে অনেক বছর তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ছিল না।

–তাহলে তো আপনি মিসেস প্রথেরোকে চিনতেন বোঝা যাচ্ছে।

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা, মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার?

-না। আমি কেবল মিঃ প্রথেরোর সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলাম, অন্য কারোর সঙ্গে নয়।

–ওই বাড়িতে গেলেন অথচ মিঃ প্রথেরোর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন না কেন?

–সেটা আমার নিজের ব্যাপার ইনসপেক্টর।

–তাহলে এর বেশি আপনি কিছু বলবেন না? ইনসপেক্টরকে হতাশ শোনাল। –না।

–বেশ, আমি উঠছি। যাবার আগে আবারো বলে যাছি মিসেস লেসট্রেঞ্জ, ইচ্ছে করেই আপনি নিজেকে বিপন্ন করে তুলছেন।

একথার অর্থ অবশ্য এই নয় যে আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি, তবে এটুকু জানিয়ে যাচ্ছি, খুব শিগগিরই আমরা প্রকৃত সত্য জানতে পেরে যাব।

ইনসপেক্টর চলে যাবার পরে আমিও উঠলাম। পথে দরজার সামনেই দেখা হয়ে গেল ডাঃ হেডকের সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইনসপেক্টর স্লাককে বেরতে দেখলাম, তিনি কি মিসেস লেসট্রেঞ্জকে জেরা করতে এসেছিলেন?

আমি ঘাড় নেড়ে সায় জানিয়ে গ্রামের পথে দ্রুত এগিয়ে চললাম।

 ইনসপেক্টর কোন উদ্দেশ্যেই সম্ভবত ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তাঁকে ধরে ফেললাম।

আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ ক্লেমেট, ওই মহিলাটি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?

বললাম, না, ইন্সপেক্টর।

-উনি কেন এখানে থাকতে এসেছেন, এ সম্পর্কে আপনাকে কিছুই বলেননি?

এবারেও আমাকে একই উত্তর দিতে হল।

-মহিলা খুবই প্যাঁচালো। ব্ল্যাকমেলের আভাস পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।

আমি কোন উত্তর করলাম না। হাঁটতে হাঁটতে শুনে যেতে লাগলাম ইনসপেক্টরের কথা।

–আপনি কি সেরকমই ভাবছেন?

তা না হলে বলুন, কেনই বা একজন অমন সুসজ্জিত মহিলা এখানে থাকতে আসবেন আর কেনই বা তিনি মিস বা মিসেস প্রথেরোকে এড়িয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন?

একটু থেমে আবার বললেন ইনসপেক্টর, সবটাই একসূত্রে বাঁধা। ব্ল্যাকমেল ভাবতে অসুবিধা কি? আর সেই জন্যই মিসেস লেসট্রেঞ্জের পক্ষে স্বীকার করার এত অসুবিধা।

কথা শেষ করে নীরবেই কয়েক কদম চললেন। পরে বললেন, ওল্ডহলের চাকরটার সঙ্গে কথা বললে হয়তো কিছু জানা যাবে। ওদের দুজনের কথাবার্তা তার পক্ষে শোনা অসম্ভব নয়। যদিও সে জোর দিয়েই একবার বলেছে যে ওদের কোন কথাবার্তা শোনেনি।

তবে সে জানিয়েছে মিসেস লেসট্রেঞ্জকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিয়েছিল বলে নাকি মিঃ প্রথেরো তার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিলেন। এব্যাপারে চাকরটাও খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

–তাহলে তো আপনি অনেকদূরই এগিয়ে গেছেন দেখছি।

ইনসপেক্টর বললেন, লোকটাকে দিয়েই কাজ উদ্ধার হবে বলে মনে হচ্ছে। কেন না তারও ব্যক্তিগত রাগ রয়ে গেছে মনিবের ওপর। যাইহোক, ওই বাড়ির গাড়ির চালকের সঙ্গেও একবার কথা বলতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই আমরা ওল্ডহলে এসে পৌঁছলাম।

গাড়ি চালকের ছোকরা বয়েস। ইনসপেক্টরকে দেখে ঘাবড়ে গেল। কথা জড়িয়ে যেতে লাগল মুখে।

ইনসপেক্টর স্লাক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল তুমি তোমার মালিককে গাড়ি চালিয়ে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলে?

–হ্যাঁ, স্যার।

–তখন কটা হবে?

সাড়ে পাঁচটা, মনে আছে।

–মিসেস প্রথেরেও সঙ্গে গিয়েছিলেন?

 –হ্যাঁ, স্যার।

রাস্তার মাঝখানে কোথাও গাড়ি থামিয়েছিলে?

–না স্যার।

–গ্রামে পৌঁছবার পরে কি করলে?

-কর্নেল গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। আমাকে জানালেন গাড়ির আর দরকার নেই। মিসেস প্রথেরো কিছু কেনা কাটা করলেন। সেসব গাড়িতে রেখে আমাকে চলে আসতে বললেন।

মিসেস প্রথেরোকে গ্রামেই ছেড়ে দিয়েছিলে?

–হ্যাঁ স্যার।

 –তখন কটা হবে?

সময়টা-সওয়া ছটা মত হবে।

–তাকে কোথায় ছেড়েছিলে?

–চার্চে।

মিসেস প্রথেরো কোথায় যাবেন সে সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেছিলেন?

–না স্যার, সে সব কিছু বলেননি।

এমন সময় লেটিস এসে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি বার করতে, সে একটু বেরুবে।

ইনসপেক্টর লেটিসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল। কয়েকটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।

লেটিস বিরক্ত হল তা স্পষ্টতই বোঝা গেল। বলল, আমি কোন কাজেরই সময়ের হিসেব রাখি না।

–তবুও আমার ধারণা গতকাল লাঞ্চের পরেই তুমি বেরিয়ে গিয়েছিলে?

লেটিস ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

–কোথায় তুমি গিয়েছিলে জানাতে আপত্তি আছে?

–মোটেই না। টেনিস খেলতে গিয়েছিলাম।

–সঙ্গে আর কে ছিল?

–হার্টলি লেপিয়ারস। বেলহামে ম্যাচ ছিল।

–কখন ফিরেছিলে?

–সময় জানি না। সময়-টময়ের হিসেব রাখা আমার পোষায় না।

–আমার মনে হয় তুমি প্রায় সাড়ে সাতটার সময় ফিরেছিলে।

–হ্যাঁ, তাই হবে।

লেটিসকে বিদায় দিয়ে ইনসপেক্টর জানালেন, এবারে ঝি-টার সঙ্গে কথা বলবেন।

আমি মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করব বলে চাকরকে দিয়ে ভেতরে খবর পাঠালাম। চাকর ফিরে এসে জানাল, তিনি আমাকে বৈঠকখানা ঘরে বসতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

একটু পরেই নিচে নেমে এলেন মিসেস প্রথেরো। বসতে বসতে বললেন, আবার কিছু হয়েছে নাকি?

আমি মাথা নাড়লাম। বললেন, ডাক্তার খুবই চমৎকার মানুষ। আমার প্রতি অত্যন্ত সদয়। আচ্ছা মিঃ ক্লেমেট, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। গুলির শব্দটা আমার কানে এলো না কেন?

–শব্দটা হয়তো পরে হয়ে থাকবে।

–কিন্তু চিরকূটটায় যে সময় লেখা ছিল ছটা কুড়ি।

আমি বললাম, সম্ভবত ওটা খুনীর হাতের লেখা।

 মিসেস প্রথেরোর মুখ কেমন বিবর্ণ দেখালো। বললেন, কি সাংঘাতিক।

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে আমি বিদায় নিলাম। ওল্ডহল থেকে বেরিয়ে আমি একটা অব্যবহৃত পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম।

এদিকে জঙ্গল বেশ ঘন। কিছুটা যেতেই হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন আসছে। একটু পরেই লরেন্স রেডিংকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। হাতে একটা বড় পাথরের টুকরো।

আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লরেন্স পাথরটা তুলে ধরে বলল, এটা একটা উপহার মিঃ ক্লেমেট; কোন ক্ল নয়।

জিজ্ঞেস করলাম কার জন্য উপহার?

–মিস মারপলের জন্য। কথা বলার আগে এটা দিয়ে তাকে খুশি করব। তার জাপানী বাগানের জন্য এটা খুব পছন্দ হবে, কি বলেন?

আমি হেসে বললাম, তা হবে।

–আমার ধারণা, গতকাল সন্ধ্যাবেলা কিছু যদি কেউ দেখে থাকে তবে সে মিস মারপল। অন্তত তার কাছ থেকে ক্লু উদ্ধার হতে পারে। সেসব হয়তো উনি পুলিসকে বলা প্রয়োজন মনে করেননি।

-হ্যাঁ, তা অসম্ভব নয়। আমি বললাম।

–মিঃ ক্লেমেট, এই ঘটনাটার শেষ অবধি আমি দেখতে চাই, অন্তত অ্যানার কথা ভেবে এই কাজটা আমি করব। ইনসপেক্টর স্লাকের ওপর আমার বিশেষ ভরসা নেই।

-তার মানে, তুমিও এখন গোয়েন্দাগিরি শুরু করবে?

একটু হাসল লরেন্স। তারপর বলল, আপনি এ সময়ে এই জঙ্গলে কেন?

একটু থেমে পরে বলল, আমি জানি আপনি কিসের সন্ধান করছেন, ওই একই উদ্দেশ্য আমারও। খুনীকে আমার পড়ার ঘরে ঢুকতে হলে প্রথম রাস্তা হল পেছনের রাস্তা দিয়ে গেট পেরিয়ে। দ্বিতীয় রাস্তাটা হল সদর দরজা। তৃতীয় কোন রাস্তা আছে কিনা সেই সন্ধানই আমি এখন করছি।

ভিকারেজের দেয়ালের পাশের ঝোঁপগুলো দেখলেই বোঝা যাবে খুনী দেয়াল টপকে ছিল কিনা।

বললাম, ওটা আমিও চিন্তা করেছি।

-ওদিকটা দেখার আগে মিস মারপলের কাছে যাচ্ছি। তাকে জিগ্যেস করে দেখি গতকাল সন্ধ্যার সময় পেছনের রাস্তা দিয়ে উনি কাউকে যেতে দেখেছেন কিনা। বিশেষ করে আমি আর মিসেস প্রথেরো যখন স্টুডিও ঘরে ছিলাম।

দুজনে মিলে মিস মারপলের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

বাগানেই তিনি কাজ করছিলেন। আমাদের দেখতে পেয়ে ডাকলেন। লরেন্স তাকে পাথরের টুকরোটা দিল। খুবই খুশি হলেন তিনি।

দু-চার কথার পর লরেন্স জানতে চাইল কাল মিস মারপল পেছনের রাস্তা দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেখেছেন কিনা।

মিস মারপল বললেন, না তো, কাউকে চোখে পড়েনি।

–কিংবা ওই সময় বনের রাস্তায় কাউকে যেতে দেখেছেন?

-তা দেখেছি। অনেকেই তো যাতায়াত করেছে। ডঃ স্টোন যেখানে খননের কাজটা করছেন, বনের পথেই সেখানে যাওয়া সবচেয়ে সহজ রাস্তা। ডঃ স্টোন আর মিস ম্লাককে যেতে দেখেছি। পরে ডঃ যখন ফিরে আসছিলেন তখনই তো মিসেস প্রথেরো আর আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

–আচ্ছা, মিস মারপল, আমি বললাম, যে গুলির শব্দটা আপনি শুনেছিলেন, তাহলে মিসেস প্রথেরো আর লরেন্সও নিশ্চয় সেটা শুনে থাকবে?

লরেন্স আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকালো। পরে বলল, হ্যাঁ কয়েকটা শব্দ শুনেছি।

মিস মারপল বললেন, আমি মাত্র একটা শব্দই শুনেছি। ইনসপেক্টর স্নাকও এই কথা জানতে চেয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ছে লরেন্স আর মিসেস প্রথেরো স্টুডিও ছেড়ে চলে যাবার পরেই শব্দটা শুনতে পেয়েছিলাম।

লরেন্স বলল, শব্দটা এমন কিছু কানে পড়বার মত ছিল না। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, আমরা যখন স্টুডিওতে তখনই শব্দটা হয়েছিল। তবে অ্যানাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব।

কথাটা শুনে মিস মারপল আমার মুখের দিকে তাকালেন।

লরেন্স বলে চলেছে, একটা বিষয় কিন্তু আমার কাছে খুবই রহস্যজনক ঠেকছে। বুধবার রাতে মিঃ প্রথেরোর ডিনারের পর মিসেস লেসট্রেঞ্জ কেন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। মিঃ প্রথেরো কিন্তু এই ব্যাপারটা বাড়িতে তার স্ত্রী কিংবা অন্য কাউকে বলেননি।

মিস মারপল বললেন, এই কথাটা মিঃ ক্লেমেট জানলেও জানতে পারে।

কথা শুনে আমার সন্দেহ হল, সেদিন সন্ধ্যাবেলা যে মিসেস লেসট্রেঞ্জের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তা মিস মারপলের নজর এড়ায়নি।

মিস মারপল এরপর জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে ইনসপেক্টর স্লাক এখন কি ভাবছে?

আমি বললাম, ভদ্রলোক এখন ওল্ডহলের চাকরটাকে নিয়ে পড়েছেন। তবে মনে হচ্ছে লাভ কিছু হবে না।

মিস মারপল বললেন, আমার ধারণা ওদের দুজনের কথাবার্তা তৃতীয় কেউ শুনে থাকবে। অর্থাৎ ওরকমটা কেউ সর্বদাই করে থাকে। লরেন্স কিছু বলতে পারছেন না?

 লরেন্স বলল, মিসেস প্রথেরো কিছুই জানে না, আমি ভাল করেই জানি।

-না না, আমি ঝি-চাকরগুলোর কথাই বলছি। ওরা পুলিসের কাছে মুখ খুলতে চায় না। আমার মনে হয়, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো।

–বলছেন? তাহলে আজ সন্ধ্যাবেলাতেই একবার চেষ্টা করব।

এরপর মিস মারপলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লরেন্স আর আমি ফের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলাম।

জঙ্গলের পথ ধরে কিছুদূর যাবার পর এক জায়গায় এলোমেলো ঝোপঝাড় দেখে মনে হল, তখন থেকেই কেউ রাস্তা ছেড়ে নেমেছে।

লরেন্স বলল, একটু আগে এই চিহ্নটা দেখেই আমি বনের ভেতরে ঢুকেছিলাম। কিন্তু ভেতরে ঢোকা হয়নি।

ঝোপঝাড় সরিয়ে সেদিক দিয়ে আমরা খানিকটা এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই, কেউ যে এ পথে গেছে তার চিহ্ন স্পষ্ট।

ঝোপঝাড়ের দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থাটা ভিকারেজের দেয়ালের কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয়েছে।

দেয়ালটা বেশ উঁচু, মাথায় ভাঙা বোতলের টুকরো বসানো রয়েছে। চেষ্টা করলে দড়ির মই দিয়ে দেওয়াল টপকানো অসম্ভব হবে না।

আমরা দেয়ালটার কাছাকাছি হতেই একটা শব্দ কানে এল। সামনের দিকে তাকালাম। তখনই চোখ পড়ল ইনসপেক্টর স্লাকের ওপরে। কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাদের দেখে বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এদিকে কি করছেন? আমি তাকে আমাদের উদ্যমের কথাটা জানালাম শুনে তিনি বললেন, যেই খুন করে থাকুক না কেন, এই পথ দিয়ে সে আসেনি। আমিও দেখেছি, সে রকম কোন চিহ্ন দেয়ালের কোন পাশে নেই। খুনী এসেছে সদর দরজা দিয়েই।

আমি বললাম, সেটা অসম্ভব ইনসপেক্টর।

-অসম্ভব কেন? সদর গেট তো সবসময়ই ভোলা থাকে আপনার। যে কেউই ইচ্ছে করলে ভেতরে ঢুকতে পারে।

রান্না ঘর থেকে তাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া অনেকেই জানতো আপনারা কেউ বাড়িতে নেই।

ভিকারেজের গেটের উল্টোদিকের রাস্তাটা ধরে এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ইচ্ছেমত বেরিয়ে ভিকারেজে ঢোকা যায়। খুনী সেই কাজটাই করেছে।

–দেয়াল টপকেও তো ঢোকা সম্ভব। একটা দড়ির মই হলেই যথেষ্ট। বলল লরেন্স।

-না, সেটা ঝুঁকির হয়ে যেত। দেওয়াল টপকালে মিসেস প্রাইস রিডলের বাড়ির ওপরতলা থেকে চোখে পড়ে যাওয়া সম্ভব।

.

১৪.

 ইনসপেক্টর স্লাক এলেন পরদিন সকালেই। জানালেন, দুটো চোরা ফোনেরই খোঁজ পেয়ে গেছি মিঃ ক্লেমেট।

আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, আমার পাওয়া ফোনটার কথা।

ইনসপেক্টর বললেন, আপনি যে ফোনটা পেয়েছিলেন সেটা করা হয়েছিল ওল্ডহলের নর্থলজ থেকে। এখন ওটা ফাঁকা। পুরনো বাসিন্দারা চলে গেছে। নতুন বাসিন্দা এখনো এসে পৌঁছয়নি। লজের একটা জানালা খোলা ছিল। তবে সেখানে কোন রকম আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।

–দ্বিতীয় ফোনটা–মিসেস প্রাইস রেডলি

–ইনসপেক্টর রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেটা করা হয়েছিল লরেন্স রেডিং-এর বাড়ি থেকে।

–সেকি। ভারি অদ্ভুত কাণ্ড!

–হ্যাঁ, অদ্ভুতই বটে। রেডিং সেই সময় বাড়ি ছিল না। ডঃ স্টোনের সঙ্গে যখন সে ব্লুবারে যায় সেই সময়েই, ছটা তিরিশ নাগাদ, ফোনটা ওর ঘর থেকে করা হয়েছিল। রেডিং-এর ঘর ফাঁকা, এটা কোন লোক জানতো। তার ওপরে বাইরে যাবার সময় দরজায় তালা দেবার অভ্যাস তার ছিল না। সেই সুযোগেই কাণ্ডটা হয়েছে।

–ঠিকই বলছেন। আমি চিন্তিতভাবে বললাম।

–একই দিনে দুটো ফোন–অদৃশ্য একটা যোগাযোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না কি? আমার দৃঢ় ধারণা দুটো ফোন একই লোক করেছে।

–কিন্তু উদ্দেশ্য কি?

–সেটাই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। আচ্ছা, মিঃ প্রথেরো খুনের আগের সময়টায় মিসেস লেসট্রেঞ্জ কি করছিল, কখনো ভেবে দেখেছেন?

মিসেস লেসট্রেঞ্জ!

হ্যাঁ, আমার ধারণা ওই ভদ্রমহিলা মিঃ প্রথেরোকে ব্ল্যাকমেল করত।

আমি হেসে বললাম, মনে হচ্ছে এটা ঠিক ভাবনা নয়। কেননা যে হাঁস সোনার ডিম প্রসব করে, কোন বুদ্ধিমান সেটাকে মেরে ফেলতে চাইবে না।

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ইনসপেক্টর স্লাক বললেন, এমন তো হতে পারে, অতীতে মহিলা ব্ল্যাকমেল করতেন, মাঝখানে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। তারপর মিঃ প্রথেরোর খোঁজ। পেয়ে এখানে চলে এসেছেন। এবং যথারীতি ব্ল্যাকমেল শুরু করেন।

–বেশ, বলে যান। বললাম আমি, তারপর কি হল?

-ততদিনে দিনকাল আর আগের মত ছিল না। নতুন করে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করতে মিঃ প্রথেরো হয়তো সাফ-সুফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি পুলিসের সাহায্য নেবেন। সুতরাং নিজেকে বাঁচাবার সহজ পথটাই মহিলাকে বেছে নিতে হয়েছিল।

ইনসপেক্টরের যুক্তিগুলো খুবই জোলো মনে হল আমার। তাছাড়া মিসেস লেসট্রেঞ্জকে যেমন দেখেছি, তার সঙ্গে ইনসপেক্টরের কথাগুলো মেলাতে পারলাম না।

আরও দু-চার কথার পরে ইনসপেক্টর চলে গেলেন।

কি মনে হলো, ঘর থেকে বেরিয়ে লরেন্সের বাড়ির দিকে এগুলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এসে ও আমাকে ডেকে ঘরে নিয়ে গেল।

–তুমি কি ওল্ডহলে ঝিটার সঙ্গে কথা বলেছিলে? আমি জানতে চাইলাম।

–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। মুখ খোলাতে অনেক কষ্ট হয়েছে।

–কিছু জানতে পেরেছ?

-বলছি আপনাকে। মিঃ প্রথেরো আর মিসেস লেসট্রেঞ্জ যখন ঘরে বসে কথা বলছিলেন, সেই সময় ওই বাড়ির রাঁধুনী তার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ফিরছিল। সেই সময় মিঃ প্রথেরোকে বেশ চড়া গলায় কথা বলতে শুনতে পায়।

ঝি আমাকে রাঁধুনীর কাছে নিয়ে যায়। রাঁধুনী বলল, মনিব খুব চড়া গলায় কথা বলছিলেন। মহিলাকে বলছেন, তাছাড়া তোমাকে তো আমি বারবারই বারণ করেছি। মহিলাটি কি বললেন বোঝা গেল না। তবে মনে হল মনিবকে দিয়ে তিনি কিছু করাতে চাইছিলেন। মনিব রাজি হচ্ছিলেন না।

পরে বলতে শুনলাম, তুমি এখানে এসে খুব অন্যায় করেছ। তারপর কয়েকটা কথা কি বললেন বুঝতে পারিনি, পরে কানে এলো, তুমি ওর দেখা পাবে না। আমি নিষেধ করেছি। শুনে আমার মনে হল মহিলাটি মিস প্রথেরোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু মনিব রাজি হচ্ছেন না।

রাঁধুনি পরে বলল, সে মিঃ প্রথেরোকে একবার বলতে শুনেছে, আমি এ বিশ্বাস করি না।–ডঃ হেডক যাই বলুন না কেন।

মিসেস লেসট্রেঞ্জ সম্ভবত উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে তিনি নাকি বলেছেন, আমি কিছুতেই ভুলতে পারব না। মনে রেখো। কাল তোমাকে ঠিক মরতে হবে–মরতে হবে। এরপরই তিনি চলে যান।

লরেন্স থামল। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই নিশ্চুপ বসে রইলাম। আমি ভাবলাম, এটা বোঝা যাচ্ছে যে দুজনের সম্পর্কটা কোন ভাবেই মধুর নয়।

আর তাদের সাক্ষাৎকারের বিষয়টা এমনই নিষিদ্ধ যে মিঃ প্রথেরো সেটা মিসেস প্রথেরোকে জানতে দিতে চাননি। ডাক্তার হেডক যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল তাও বোঝা যাচ্ছে। তবে মিসেস লেসট্রেঞ্জ যে খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা কিছুতেই ভাবতে পারছি না।

বাড়িতে ফিরেই দেখি তুলকালাম কাণ্ড! গ্রীসলডা, ডেনিস, মেরী তিনজনই একজায়গায়। সবারই মুখ থমথমে।

জানা গেল, লেটিস এসেছিল। সে নাকি একটা কানের দুল খুঁজে পাচ্ছে না। এখানেও খুঁজেছে, সকলকে জিজ্ঞেস করেছে। মেরীকে নাকি অহেতুক চোটপাট করেছে। তাতেই মেরীর গোসা হয়েছে, বাইরের লোক কেন তার ওপর চোখ রাঙাবে।

যথারীতি আমাকে মেরীর মান ভাঙাতে কিছু কথা বলতে হল। ডেনিস বলল, লেটিস বড় অন্যমনস্ক মেয়ে কাকা। কোথায় কখন কি রাখে তা নিজেই জানে না। সবাইকে উদ্ৰব্যস্ত করে মারে। আমি নিশ্চিত, ও এখানে কোন কানের দুল ফেলে যায়নি। বৃহস্পতিবার সেটা পরে ও খেলতে গিয়েছিল দেখেছিলাম।

-ওখানেই হারিয়েছে। আমি বললাম।

এরপর পড়ার ঘরে চলে এলাম। এখানে কি কিছু ফেলে গেল লেটিস? চারদিকটা তাকিয়ে দেখলাম।

লেখার টেবিলটার দিকে তাকালাম। ওটার ওপরেই কয়েকদিন আগে মিঃ প্রথেরো গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়েছিল।

টেবিলটার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনার সময়েই হঠাৎ তলার দিকে মেঝেয় চোখ আটকে গেল। ছোট মত কি একটা চকচক করছে। সরে গিয়ে নিচু হয়ে সেটা তুলে নিলাম।

.

১৫.

 পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলেই মিসেস প্রথেরোর একটা চিঠি পেলাম। লিখেছে গ্রীসলডাকে। ওর চিঠিটা আমিও পড়লাম।

প্রিয় গ্রীসলডা,
তুমি আর ভিকার যদি আজ মধ্যাহ্নভোজটা এখানে সারো তাহলে খুব খুশি হব। আমার এখানে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছে। সে কারণেই ভিকারের পরামর্শ দরকার। আমি কাউকেই এসব বলিনি। তোমরাও এখন এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলল না।
তোমার স্নেহের অ্যানা প্রথেরো

চিঠিটা পড়া শেষ করে আমি চিন্তিতভাবে তাকে বললাম, কি এমন ঘটতে পারে নতুন করে বুঝতে তো পারছি না।

গ্রীসলডা বলল, আমিও তো তাই ভাবছি। বেচারীর জন্য বড় কষ্ট হয়। খুনের ব্যাপারটা কিছু কি এগুলো?

-মনে হয় আমরা ঘটনার শেষ প্রান্তে এসে এখনো পৌঁছতে পারিনি। ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে সবকিছু।

–তুমি একথা বলছো কাউকে এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে?

-না, তা নয়। এমন জটিল আবর্ত যে সেগুলো ভেদ করতে না পারলে এ কেসের সমাধান সম্ভব নয়। যাই হোক, চল ওল্ডহল থেকে তাহলে ঘুরে আসা যাক।

–হ্যাঁ যাব। তুমি আর কোথাও বেরিয়ো না।

.

খাওয়া দাওয়ার পর বৈঠকখানায় বসে কফি খেতে খেতে মিসেস প্রথেরো বলল, মিঃ ক্লেমেট, আপনাকে আমি গুটিকতক কথা বলতে চাই। ওপরে বসার ঘরে যাই চলুন।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে ছাদে চলে এলাম। সেখানে মই-এর মত একটা সিঁড়ি ওপরতলায় উঠে গেছে। আমরা সেটা বেয়ে উঠে গেলাম। একটা ময়লা চিলেকোঠার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

মিসেস প্রথেরো ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। ভেতরটা আবছা অন্ধকার। চারপাশে নানান বাতিল অদ্ভুত জিনিস জড়ো করা।

মিসেস প্রথেরো বললেন, এখানে নিয়ে এলাম বলে নিশ্চয়ই বিস্মিত হচ্ছেন। খুলে বলছি শুনুন। কাল শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতেই মনে হল কেউ বাইরে চলাফেরা করছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

এরপর শব্দটা কিসের দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারলাম, ওপরের ওই ঘরটা থেকে শব্দটা আসছে। আমি নিঃশব্দে সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়ালাম।

শব্দটা আবার উঠতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কে?

সঙ্গে সঙ্গে শব্দ থেমে গেল। সাড়াও পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে হল, হয়তো আমারই ভুল। মনের অবস্থা তো ঠিক নেই। কি শুনতে কি শুনেছি। আমি ফিরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তারপর?

–আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই ঘরে চলে এলাম। আর এটা দেখতে পেলাম। কথাটা বলে মিসেস প্রথেরো উবু হয়ে দেয়ালে উল্টো করে ঠেস দেওয়া একটা ছবি ঘুরিয়ে ধরল।

দেখলাম একটা তৈলচিত্র। কিন্তু ছবির অবস্থা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। সূক্ষ্ম কিছু দিয়ে এমন ভাবে ছবির ওপরটা ফালা ফালা করে আঁচড়ে দেওয়া হয়েছে যে ছবিটা কার তা চেনা যাচ্ছে না।

–এই অদ্ভুত ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল। এটা আঁচড়ানোর শব্দই আমি পেয়েছিলাম। ব্যাপারটা কিছু ধরতে পারছেন?

আমি বললাম, দেখে মনে হচ্ছে কেউ মনের ঝাল মিটিয়েছে। এভাবে ফালাফালা করার মধ্যে একটা আক্রোশ ফুটে উঠছে।

–এটা আমিও ভেবেছি।

 –প্রতিকৃতিটা কিসের তা বুঝতে পারছেন? জিজ্ঞেস করলাম।

–এটাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। বিয়ে হয়ে আমার এখানে আসার আগে থেকেই এ ঘরে জিনিসপত্রগুলো ছিল। কিন্তু কোনদিন ঘরে ঢুকে এসব দেখার ইচ্ছে হয়নি।

.

আমি চিত্রটা খুঁটিয়ে দেখে বুঝবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। বললাম, এমনভাবে আঁচড় কাটা হয়েছে যে কিছুই উদ্ধার করা যাচ্ছে না।

–এই ব্যাপারটাতে আমি খুবই ভীত হয়ে পড়েছি। কি করব বুঝতে পারছি না।

 ছবিটা আর দেখার কিছু ছিল না। আমরা দুজনে নিচে বসার ঘরে চলে এলাম।

সোফায় বসতে বসতে মিসেস প্রথেরো বললেন, কি বলেন, পুলিসে খবর দেব?

আমি চিন্তিত ভাবে বললাম, ব্যাপারটার সঙ্গে খুনের ঘটনার কোন যোগসূত্র আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। না ভেবে কিছু করাটা কি ঠিক হবে?

–তা অবশ্য ঠিক।

–আপনি কি ভাবছেন?

-দেখুন, আর মাস ছয়েক আমি এখানে থাকব। দুর্ঘটনাটা না ঘটলে অবশ্য আরও আগেই চলে যেতাম। এখন গেলে লোকে অন্যরকম কথা রটনা করবে। ছমাস কাটার পরে আমি লরেন্সকে বিয়ে করছি।

কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও বলে চলল, আপনি তো বুঝতে পারছেন, আসল খুনী যতক্ষণ ধরা না পড়ছে ততক্ষণ লোকে ভাববে লরেন্সই খুনটা করেছে। বিশেষ করে আমাকে যখন ও বিয়ে করবে।

–কিন্তু পুলিস তো জানিয়েছে, লরেন্স সন্দেহমুক্ত। এতে এটা পরিষ্কার যে লরেন্স খুন করেনি।

মিসেস প্রথেরো বললেন, কিন্তু লোকে এসব বুঝবে না। আমি সে জন্যেই এখানে থেকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে চাই। মিস ক্র্যামকে আমার এখানে ছুটি কাটিয়ে যেতে এজন্যই নিয়ে এলাম।

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ওই মহিলাকে ওর সঙ্গে জড়িত মনে করছেন?

-না সেরকম ভাবছি না। তবে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে কিছু জানে। কাছে থেকে একটু বুঝতে চাইছি।

আমি বললাম, একটা ব্যাপার খুবই লক্ষণীয় মনে হচ্ছে, মিস ক্র্যাম যেদিন আপনার এখানে এলো, সেদিন রাতেই ওই ছবিটার ওপর আক্রমণ হল। তাই না?

-না, ওই এটা করেছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। কেন করবে? না, একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

–অসম্ভব তো অনেককিছুই মিসেস। আপনার এটাও কি অসম্ভব নয়?

–আমি তা জানি, ভিকার। আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারি। সবসময় সবকথা বলে উঠতে পারি না।

কথার মাঝখানেই আমি একসময় পকেটে হাত দিয়ে ছোট্ট কানের দুলটা বার করে আনলাম। হাতের তেলোতে নিয়ে মিসেস প্রথেরোর সামনে ধরে বললাম, দেখুন তো, এটা আপনার কিনা?

একপলক দুলটার দিকে তাকিয়ে মিসেস প্রথেরো মাথা নাড়লেন। পরে বললেন, ওটা কোথায় পেয়েছেন?

ওর সেকথার জবাব না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওটা এখন দিন কয়েক আমার কাছে থাকলে আপনার আপত্তি নেই তো?

–না, থাক না।

মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে কথা শেষ করে আমি লেটিসের ঘরে গেলাম। ওকেও একই ভাবে দুলটা দেখালাম। বললাম, চিনতে পারছো? এটা আমার পড়ার ঘরে ফেলে রেখে এসেছিলে কেন?

প্রথমে ও অস্বীকার করল। পীড়াপীড়ি করলে স্বীকার করল যে সে ইচ্ছে করেই করেছে। অ্যানা প্রথেরো যাতে খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এই উদ্দেশ্যেই করেছিল।

বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল লেটিস।

গ্রীসলডাকে একাই ভিকারেজে পাঠিয়ে দিলাম। আমি একবার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে আজ আবার জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম।

সেদিনের পথ ধরে এগিয়ে চলতে চলতে বুঝতে পারলাম আমার আর লরেন্সের পরে আরো কেউ জঙ্গলে ঢুকেছিল। নতুন কিছু ঝোপঝাড় ভেঙ্গে দুমড়ে আছে দেখা গেল।

আরো খানিকটা পথ ধরে এগুলাম। হঠাৎ মাটির দিকে চোখ পড়তে উবু হয়ে বসলাম। দু হাত দিয়ে ঘাস-পাতা সরাতেই একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়ল। জিনিসটা হাতে তুলে নিলাম। তারপর ভিকারেজে ফিরে এলাম।

.

 ভিকারেজে এসে দেখি হস আমার অপেক্ষায় বসে আছে। ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ওর খুব কৌতূহল দেখলাম। সেসব জানার জন্যই বসে আছে।

তার অহেতুক কৌতূহল আমাকে বিরক্ত করে তুলল। দু-চার কথার পরে তাকে বিদেয় করলাম।

হল ঘরের টেবিলে দেখলাম গোটা চারেক চিঠি পড়ে আছে। প্রথম তিনটে লিখেছেন, মিসেস প্রাইস রিডলে, মিসেস ওয়েদারবাই আর মিস হার্টনেল। তিনজনই অনুরোধ করে লিখেছে, আমি গেলে কিছু জরুরী কথা জানাবে।

চতুর্থ চিঠিটা গ্রীসলডার নামে। সেটা আমি ওকে দিয়ে দিলাম।