দৈনন্দিন নগরে ও বন্দরের ভিড়ে যত মুখ
দেখি, ছুঁই যত হাত, রংছুট জীবনের যত
টুকরো ছবি তুলে নিয়ে মনে রোজ ফিরে আসি ঘরে,
বু্দ্বুদের মতো সবি একদিন হারায় সুদূরে,
মিলায় কৌতুকী ধূপে। সবি মুছে যায়? তবু কিছু
সুবর্ণ ঘটনা
জমা থাকে জাদুকর সময়ের আশ্চর্য থলিতে।
বিস্ময়ের স্তব্ধ তটে দাঁড়িয়ে দু’জনে
মুখোমুখি পদ্মার স্টিমারে,
উন্মীলিত চোখের আকাশে
বিদ্যুতের মতো উঠল জ্বলে প্রিয়-সম্ভাষের শিখা।
ডেকের রেলিং ধরে সে-ও পদ্মাপারের সুদূরে
এক ফোঁটা কাজল গাঁয়ের দিকে, ধু-ধু শূন্য চরে
চেয়ে ছিল অপলক চোখে;
জেলেদের সরু ডিঙি চলে গেল ঢেউয়ের আড়ালে।
পদ্মায় সন্ধ্যার ছায়া। দূরযাত্রী পাখিকণ্ঠে সাড়া
দিগন্তের অদৃশ্য নূপুরে,
এখানের একদিন ছিল নাকি রৌদ্র-ছায়া-আঁকা
কোনো গ্রাম,-কোমন শিশিরে আর ঘাসে পরিপাটি,
হয়তো মুখর হ’ত মানুষের উজ্জ্বল উৎসবে সেই গ্রাম
এখন যেখানে শুধু জলের ধূসর মরুভূমি।
মদির চুলের গাঢ় তিমির-সৌরভে
সহস্র রজনীগন্ধা হৃদয়ের উষ্ণ অন্ধকারে
উঠল ফুটি থরে-থরে, তখন হঠাৎ যদি নিতাম মুঠোয়
তুলে তার দুটি হাত, স্নিগ্ধ গালে উঠত জেগে লজ্জার আশ্চর্য রামধনু
আর যা হ’ত (বলা নয়) ভাবা যায় শুধু।
দূরন্ত পদ্মার
অজানা যাত্রীর সাথে সে-ও নেমে গেল
একফোঁটা গাঁয়ের স্টেশনে,
জলে তার পূর্ণ ছায়া, বাতাসে রুমাল, মেঘে-মেঘে ঝাপসা চোখ,
প্রৌঢ় পিতা বিব্রত শরীরে
জড়িয়ে পুরোনো শাল নামলেন ধূসর ডাঙায়
পিছনে আড়ষ্ট গিন্নি, শিশুপুত্র। কন্যা অষ্টাদশী।
সারেঙের তীব্র বাঁশি, নিচে ফের চাকার তলায়
উচ্ছল, ফেনিল জল-দূরে নীল কুয়াশায় সুখী পরিবার।
পেরিয়ে বাঁশের সাঁকো, মাঠ। মধ্যযুগী
অশ্বত্থের নিচে হেঁটে যেতে
হয়তো পড়বে চোখে পথের কিনারে
পাড়াগাঁর কোনো
দুরন্ত ছেলের কিছু ফেলে-যাওয়া ম্লান বুনো ফল,
কড়ি আর রাঙা নুড়ি ছেঁড়াখোঁড়া খেলার সংসার।
কার কথা ভেবে-ভেবে সেই মেয়ে পৌঁছে যাবে শেষে
তার সাতপুরুষের দেশের ভিটায়? কত সুবর্ণ ঘটনা
জমা থাকে জাদুকর সময়ের আশ্চর্য থলিতে।
সগর-শিয়রে রোজ সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের ছবি
রং ঢালে, প্রজ্বলিত হয় দিনলিপি।
কে যেন ফুঁ দিয়ে
বারবার খুলে দেয় রহস্যের থলি;
ঝরায় বর্ষার জল প্রথামতো আষাঢ়, শ্রাবণে,
পথ চলি আশার উল্লাসে!
সব কলরব, সব গুঞ্জন ছাপিয়ে
মাঝে-মাঝে তাকে মনে পড়ার মতন
সমুজ্জ্বল বেদনায় হৃদয়কে ছিঁড়ে
জেগে ওঠে দূরন্ত পদ্মার সেই সফেন কল্লোল।