(অগ্রজ জনাব আজিজুর রাহমান চৌধুরীকে)
আমার প্রথম ভাই কান্তিমান, স্কুল-ছুট, সতত বালক
(এমনকি মধ্যবয়সেও)
নবাববাড়ীর নওশা, আলাভোলা, প্রখর, যৌবনে
ছিলেন উড়নচণ্ডী। পরিণীতা, পুত্র রইল পড়ে
এবং হলেন তিনি দেশান্তরী, ঘুরে বেড়ালেন
সার্কাস পার্টির সঙ্গে। সাত ঘাটে আঁজলা ভরিয়ে,
ভিজিয়ে পায়ের পাতা একদিন শেষে
ঘরের উধাও ছেলে ফিরে এলো ঘরে। তারপর
কাটে তাঁর অনুজ্জ্বল বৈচিত্র্যরহিত দিনগুলি
সংসারের ভাঙ্গা
খাঁচায় এবং অকস্মাৎ
কোনো মধ্যরাতে খাঁচার ভিতর থেকে
অস্থির অচিন পাখি উড়ে গেল অনন্তের দিকে।
আমার দ্বিতীয় ভাই, আবাল্যে তুখোড় ডানপিটে,
দীর্ঘকায়, সুদর্শন, পৌরুষে ভাস্বর।
ভ্রমণবিলাসী তিনি কলেজ পালিয়ে মেহগনি বাক্স ভেঙে
ঘুরেছেন দাক্ষিণাত্যে মন্দিরে মন্দিরে, অজন্তার
বিখ্যাত গুহায় আর দিলেন কাটিয়ে
দিল্লিতে ভক্তিতে মজে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে
দু’তিন বছর। গত বিশ্বযুদ্ধে পাঠাতেন তারবার্তা
ব্রিটিশ জাহাজ থেকে, মনে পড়ে। হঠাৎ খেয়ালে
জাহাজের খোল ছেড়ে সেই যে এলেন
নিজের ডাঙায় ফিরে, তাকে আর ভোলাতে পারেনি
সমদ্রের গান; এমনকি যে ইহুদি রমণী বিদেশে
ছিলেন দয়িতা, তার ঘাগড়ার রেশমি টান, চোখের কুহক
ফেরাতে পারেনি তাঁকে ভবঘুরে জীবনের বাঁকে
বাঁকে, অনন্তর সমুদ্রের ঢেউ নয়, কোনো রমণীয় শরীরের
চড়াই-উতরাই নয়, তরুণ ঘোড়ার
পেশি-তরঙ্গের প্রতি
কী দুর্মর আকর্ষণ তাঁর। রেসের মরীচিকায়, তাসের আড্ডায়
রেখেছেন জীবন বন্ধক।
এখন যখন তিনি আরমানীটোলার পথ দিয়ে
হেঁটে যান ক্লান্ত, রুগ্ন, ভীষণ একাকী,
যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো,
তখন মুখাবয়বে তাঁর ছয় দশকের আর্তি,
বহ্নুদ্যৎসব, হাহাকার,
প্রমাদ, চিৎকার জেগে থাকে অবেলায়।
আমার তৃতীয় ভাই ছিলেন মাঝারি গড়নের,
ইস্পাতি শরীর তার ঝলসাত মাঠের রোদ্দুরে গোল্লাছুট
কাবাডি খেলায়,
ক্রোধের ভিমরুল তাঁকে কামড়ালে, কালো কপালের
কাটা দাগ আরও চিকচিকে আর গাঢ় হয়ে যেত।
কখনো কখনো তিনি নাকীসুরে খুব দুলে দুলে
গাইতেন ফিল্মি গান এবং বন-বাদাড়ে একা-একা
কাটত সময় আর বলতেন তাঁর
চোখ ভেসে ওঠে কত
সুন্দর আজীব গাছপালা, জীব-জানোয়ার কিমাকার আর
অতল পাতাল।
যখন এ. আর. পি.-তে লেখালেন নাম,
উর্দি-পরা তাঁকে
দিব্যি বীর-বীর লেগেছিল। ছিলেন অকৃতদার আর
অকস্মাৎ এ কি বজ্রপাত
আমাদের ঘরে-
আমার তৃতীয় ভাই ক্রূর পিত্তশূলে হলেন অকালমৃত
প্রেমিকার চুম্বনবিহীন,
সন্তানের আলিঙ্গনহীন।
আমার চতুর্থ ভাই পিতার মিনিয়েচর, তেজী
একরোখা, স্পষ্টভাষা! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ডে
সর্বদা নিবদ্ধ দৃষ্টি তার, উপার্জনে নিয়ত সংগ্রামশীল,
সামাজিক নিমন্ত্রণে অকুণ্ঠ, উদার;
ভোজনবিলাসী, নীড়প্রিয়
বাবুই পাখির মতো গোছায় সংসার প্রতিদিন।
পুরানো প্রথাম প্রতি নতজানু; এই শতকের
রোদে পিঠ দিয়ে ভালোবাসে মধ্যযুগী মায়াবী আঁধার।
নিত্য সুরে-সাদেকের আলো-আঁধারিতে
করে পাঠ কলমা দরুদ।
আমার পঞ্চম ভাই সুকান্ত, সৌজন্যময় আর
রুচিবান এবং সবার প্রীতিসাধনে তৎপর
সর্বক্ষণ, পরমতসহিষ্ণু অথচ সুতাকিক।
গোঁড়ামির প্রতি সায় নেই তার, গ্রন্থপ্রিয় মন
করে বিচরণ মুক্তবুদ্ধির মিনারে, উপরন্তু,
সংগীত-নির্ঝরে স্নাত নিয়মিত, আদালতে
সাজিয়ে কথার পিঠে চোস্ত কথা কুড়ায় বাহবা,
দীপ্ত অধ্যাপকও বটে। বস্তুত সে স্নিগ্ধ বুদ্ধিজীবী।
আমার কনিষ্ঠ ভাই চটপটে, বেপরোয়া, বড় ঝলমলে;
নিখুঁত টাইয়ের নট, গায়ে হাল-ফ্যাশনের নানা
পোশাক-আশাক।
আকৈশোর অভিযানে মাতাল। তাই সে
প্রায়শ জমায় পাড়ি দূর দেশে, যেন
কোনো নামহীন দ্বীপ থেকে
আনবে নির্যাস ছেঁকে রহস্যের কিংবা অতল পাতাল থেকে
মণিরত্ন, যেন নিমেষেই নেমে যাবে তুড়ি মেরে
দুর্গম খনিতে একা। নৈরাশ্যের থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে জোরে
‘যে যাই বলুক আমি বাণিজ্যেতে যাবোই’ বলে সে
আমার কনিষ্ঠ ভাই ভাসিয়েছে সমদ্রে জাহাজ।
কখনো-কখনো ভাবি আমার ভ্রাতৃ-সংঘের কতটুকু আছে
নিহিত আমার মধ্যে? কার চোখ, কার মুখভঙ্গি
হুবহু প্রতিফলিত আমার সত্তায়?
কার কোন আচরণ করি ব্যবহার মুদ্রাদোষের মতন
আমিও অজান্তে মাঝে মাঝে?
আর মাঝে-মধ্যে আমাদের
বংশের প্রাচীন
নামহীন কত পুরুষের অজ্ঞাত জীবনী
মন্ত্রের মতন গুঞ্জরিত হতে চায়
আমার নিজস্ব অবচেতনের রহস্য-শোষক তন্দ্রাচ্ছন্ন স্তরে স্তরে।