স্বাতন্ত্র

স্বাতন্ত্র

সাপে-মানুষে যে পার্থক্য, তাকেও পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য বলা চলে। কিন্তু তাতে কারো গৌরব নেই, কেননা তা প্রাকৃতিক কিংবা সৃষ্টির নিয়মেই পাওয়া। জন্মসূত্রে যা মেলে, তা-ই স্বভাব। স্বভাবের বিভিন্নতা সৃষ্টি-বৈচিত্র্যেরই নির্দেশক। আর রূপগত ও গুণজাত অনৈক্য স্বাতন্ত্র-জ্ঞাপক নয়, বিধাতার বিচিত্র বিলাস-বিধানের পরিচায়ক।

মানুষের সম্পর্কে স্বাতন্ত্র-এর রয়েছে বিশিষ্ট্য অভিধা। স্বাতন্ত্র্য উৎকর্ষসূচক, বিশেষ ব্যঞ্জনা ঋদ্ধ শব্দ। মানুষের স্বাতন্ত্র্য অর্জিত গুণ। তা একান্তভাবে ব্যক্তিক চর্যায় ও চর্চায় লভ্য। এটি ব্যক্তিবিশেষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি ও মনন-সঞ্জাত। অতএব স্বাতন্ত্র্য কখনো সমাজ কিংবা জাতিগত হতে পারে না। একের উপলব্ধ সত্য অপরের অনুকৃতিজাত আচরণের তথ্যে পরিণত হলে তা প্রাণহীন মারাত্মক আধির রূপ নেয়। কেননা তখন তা অশিক্ষিত, অপরিশ্রুত এবং অনুপলব্ধ যান্ত্রিক অনুশীলন ছাড়া কিছুই নয়। যন্ত্র হচ্ছে একটি অবয়ব যা সুপ্ত শক্তির আধার। যন্ত্রীর অভিপ্রায়ই যন্ত্রকে চালিত করে। ফল হয় অভিপ্রায়-অনুগ। অভিপ্রায় যেখানে অস্পষ্ট; অস্থির, ফল সেখানে লক্ষ্য-নির্দিষ্ট হতে পারে না; আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো রূপ নেই, তেমনি অভিপ্রায়-নিরপেক্ষ কোনো যন্ত্র নেই।

সচেতন মনের স্বতস্ফূর্ত অভিপ্রায়ে আর বন্ধ্যামনে আরোপিত অভিপ্রায়ে তফাৎ দুস্তর। ঘরে সংসারে লোকে সুনিশ্চিত অভিপ্রায়ে ব্যবহার করে আগুন। সে আগুন অবোধ শিশুর কর্তৃত্বে গেলে ঘটায় অনর্থ।

সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্র প্রভৃতি যা-কিছু মনুষ্যকল্যাণে রচিত, তা হচ্ছে পরিচর্যা-পুষ্ট, পরিত রুচি, প্রজ্ঞা-ঋদ্ধ শ্রেষ্ঠ মানুষের মনন-মনীষার প্রসূন। নির্ঘ নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত জীবন-প্রতিবেশ রচনার জন্যে যা পরিকল্পিত, বন্ধ্যা মনের অনুকৃত অভিপ্রায় সংযোগে তা-ই হয়েছে সঙ্কট-শঙ্কার আধার। সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের নামে যত পীড়ন, যত রক্তপাত ও জীবন নাশ হয়েছে, তেমনটি মহামারী ভূমিকম্প-অগ্ন্যুৎপাত কিংবা ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও হয়তো হয়নি।

প্রকৃতি আজ আর মানুষের শত্রু নয়–অনুগত। জীবজগৎ মানুষের কৃপাজীবী। মানুষ আজ অকুতোভয়। জগৎ প্রতিবেশে সে আজ যথার্থই স্বস্থ ও সুস্থ। তাহলে তাকে অমৃতের পুত্ররূপে, আনন্দের সন্তান স্বরূপ পাইনে কেন! তার কারণ, বাইরে যে স্বপ্রতিষ্ঠ বটে, কিন্তু তার মর্মমূলে জন্মেছে কীট। সে-কীটের দংশনে সে পীড়িত। বহির্জীবনের ঐশ্বর্যের মধ্যেও সে দুঃস্থ আর্ত। অপরিশ্রুত মনের আত্মরতি, বিদ্বেষ, অবজ্ঞা সংকীর্ণতা বদ্ধচিত্ততা ও স্বার্থবুদ্ধি জন্ম দিয়েছে এ কীটের। এ চিত্তে পরশ্রীকাতরতা ও পরপীড়নের উল্লাস ছাড়া কিছুই ঠাই পায় না। তাই মুসার পাপবোধ, ঈসার প্রীতিবাঞ্ছ, গৌতমের সহ-অবস্থান তত্ত্ব, মুহম্মদের যুক্তিনিষ্ঠা প্রভৃতি জনচিত্তাধারে ব্যঞ্জনাহীন বুলিরূপে বিধৃত। তার প্রয়োগও স্কুল এবং মারাত্মক।

অবশেষে মতানৈক্য আর আচার পার্থক্যই স্বাতন্ত্র্য সংজ্ঞায় পরিগৃহীত হয়েছে। তাও আবার কুড়িয়ে পাওয়া তথা বহিরারোপিত মত-আচার, স্বতঃউপলব্ধ কিংবা স্বসৃষ্ট নয় এবং সে কারণেই অকৃত্রিম নয়–আপাত-অপরিহার্য সংস্কার মাত্র। সমাজে ধর্মে জাতে কিংবা রাষ্ট্রে এই বুনো বদ্ধ নিষ্ঠা মানুষকে করেছে অমানুষ ও যান্ত্রিক। উপায়কে তারা ঠাওরিয়েছে লক্ষ্যরূপে, উদ্দেশ্যের ঘটেছে বিস্মৃতি। তাই দিশাহারা মানুষের মতাদর্শ হয়েছে মারণাস্ত্র। খ্যাপা মানুষকে মায়েতেও ভয় পায়। কেননা উন্মত্ত বা ক্রোধান্ধ লোকের সুমুখে মায়ের ধনপ্রাণও নিরাপদ নয়। বিশ্বমানবের উন্মত্তরূপ তাই পারস্পরিক শঙ্কার ও সঙ্কটের কারণ হয়ে রয়েছে। এই মত, আদর্শ ও আচারে যে নিষ্ঠা, তাতে রয়েছে কেবল অন্ধ আবেগ যুক্তি-বুদ্ধি নেই। ও আমার মতে আস্থা রাখে না, অতএব আমার দলের নয়; ও আমার আচার মানে না, কাজেই ও আমার পর। সে আমার দেশে বাস করে না, তাই সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। সে আমার রাষ্ট্রবাসী নয়, অতএব সে বিজাতি। ও তো আমার ধর্মে বিশ্বাস রাখে না, কাজেই ও আমার শত্রু। ওর দেহাকৃতি আমার মতো নয়, অতএব ও অমানুষ। সমাজে ধর্মে জাতে রাষ্ট্রে অভিন্ন না হলেই সন্দেহ করতে হবে, শত্রু ভাবতে হবে–এই হচ্ছে মানুষের কয়েক হাজার বছরের উদ্যোগ-আয়োজন-আড়ম্বরের ফল। মনুষ্যসাধনার কী মর্মান্তিক ব্যর্থতা, মানব মনীষার কী বিস্ময়কর অপচয়! এই হিংস্র বিদ্বেষভাব জিইয়ে রাখার নাম স্বাতন্ত্র্য। গর্বোদ্ধত উচ্চারণের পৌনপুনিকতায় স্বাতন্ত্র্য তার মৌল অভিধা হারিয়ে অনুদার, অসহিষ্ণু, আত্মরতি সুখাভিলাষীর কুপমণ্ডুকতার প্রতিশব্দ রূপেই টিকে আছে।

তাই পরধর্মে ঘৃণাই ধার্মিকতা, বিজাতি বিদ্বেষই জাতীয়তা, পরমত অসহিষ্ণুতাই আদর্শনিষ্ঠা, সংস্কারাচ্ছন্নতাই সমাজানুগত্য, বিদেশী বিমুখতাই স্বদেশপ্রীতি আর পরশ্রীকাতরতাই রাষ্ট্রচেতনা নামে প্রশংসিত।

সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনচেতনার নামে আদিম জৈববৃত্তির লালনে উৎসাহবোধ যেন বেড়েই চলেছে। আদিম মানুষের জৈব-বাসনা ও নির্বোধের সংস্কার জীবন-সত্য রূপে আজো নামান্তরে মানুষের জীবনের আদর্শ-উদ্দেশ্যের নিয়ামক–এ ভাবলে হতাশ হতে হয়।

যন্ত্র কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। সংস্কার-যন্ত্র চালিত মানুষও যান্ত্রিকতামুক্ত হতে চায় না। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শঙ্কা-সংশয়ই মানুষের জীবনে বিধিলিপি রূপে স্বীকৃত। প্রাকৃত ও জৈবজগতে মানুষ আজ শত্রুজিৎ। মানব-মহিমার এ যে কত বড় দলিল, তা বলে শেষ করা যায় না। কেননা যখন ভাবি যে মানুষই একমাত্র জীব, যাকে নিজের জীবন নিজে রচনা করতে হয় বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে, যার নিজের দেহও ছিল না নিজের অনুগত তখন বিস্ময়ের সীমা পাইনে। কল্পনার সামান্য আশ্রয় নিলেই বুঝতে পারি, মানুষ কী অসামান্য উদ্ভাবন-শক্তির পরিচয় দিয়েছে, কী জগজ্জয়ী প্রতিভা রয়েছে তার! এমন একদিন ছিল যখন মাথায় চুল বাড়ছে, জটা হচ্ছে, উকুনে উত্ত্যক্ত করছে, দাড়ি-গোঁফ অসহ্য অস্বস্তির কারণ হয়েছে, হাত-পায়ের নখ অচল-অকর্মণ্য করে তুলেছে, অথচ অসহায় মানুষ কাটবার-ছিড়বার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। তাছাড়া রোদ-বৃষ্টি-শীত তো রয়েইছে! জীবনারিকে মানুষ ক্রমে জীবন-মিত্রে পরিণত করছে! মানুষের এ মনীষা, এ নৈপুণ্য স্মরণে অভিভূত হতে হয়।

কিন্তু মানুষের সম্পর্কে মানুষ আজো পাশববৃত্তি মুক্ত হতে পারল না। আজ মানুষের একমাত্র শত্ৰু মানুষ। মানুষকেই মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়। গৃহাশ্রিত বিশেষ জীবের মতো ঈর্ষ ও লোভী মানুষই মানুষের সুখে বাদ সাধে। বাইরে সে যেমন অসাধ্য সাধন করেছে, মনের অনুশীলনেও যদি তেমনি যত্নবান হত, তাহলে জীবনবৃক্ষে ফুল ফুটত, ফল, ফলত। সুন্দর হত জীবন, মধুময় হত তার দিন ক্ষণ। কিন্তু সম্ভাবনার এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা–এ আফসোসই শুধু জেগে রইল। অথচ স্বাতন্ত্র-বুদ্ধি স্বরূপে জাগলে কেউ কারো সুখের প্রতিবাদী হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। কেননা উচ্চমানের সংস্কৃতিই স্বাতন্ত্রবোধের ভিত্তি। আর সংস্কৃতিচর্চার পূর্বশর্ত হচ্ছে আত্মমর্যাদাবোধের উদ্বোধন। যার মর্যাদাবোধ আছে, সে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে পারে না। সংস্কৃতির প্রথম পাঠ সহিষ্ণুতা ও উদারতা। রুচিবান মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণার শিকার হতে চায় না। তার মধ্যে থাকবে স্বাতন্ত্র-চেতনা, সে-স্বাতন্ত্র অর্জিত ও রক্ষিত হবে আত্মোকর্ষের ভিত্তিতে। অপরের তুলনায় নিজের উৎকর্ষ অনুভব করে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে, আস্ফালন করবে না কখনো। আবার অপরের উৎকর্ষ-উন্নতি দেখে আত্মোন্নয়নে যত্নবান হবে, পিছুটান দিয়ে সমান করবার চেষ্টা করবে না, আর অসূয়ানলেও দগ্ধ হবে অকারণ। তার পথ প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয়। অপরের ক্ষতি করে নিজের প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছ তার নয়। ঋণাত্মক নিবর্তনে তার উল্লাস নেই, ধনাত্মক উদ্বর্তনেই তার তৃপ্তি।

স্বাতন্ত্র্য হবে অসামান্যতার প্রতীক। তার মনোভূমি হবে সৃজনশীল–নিত্য বাসন্তী হাওয়া বইবে তাতে। ভাঙনে থাকবে তার বেদনাবোধ, গড়নে জাগবে উল্লাস। To know all is to pardon all হবে তার উপলব্ধ সত্যসার। সেক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র হবে অনন্যতার নামান্তর। Live and let live শ্রেণীর সহ-অবস্থানতত্ত্ব হবে তার জীবনের নিয়ামক। নিজে ভালো হও, আর অপরের ভালো চাও, ভালো করো–আদর্শ হবে তার জীবনের দিশারী।

কিন্তু এ যে বিশেষ সাধনা-সাপেক্ষ, তাও মনে হয় না। কেননা ঘরে-সংসারে আমরা মায়ের সন্তান, স্ত্রীর স্বামী আর কন্যার পিতা; বাইরে কারো মজুর, কারো মনিব, কোনো প্রতিষ্ঠানে। সদস্য–কিন্তু তাতে তো দ্বন্দ্ব দেখিনে। তেমনি নিজের সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত অনুগত থেকেই মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অসূয়া-অবিশ্বাস-অপ্রীতিমুক্ত মনোভাব পোষণ করতে বাধা কি! মনের তেমন অবস্থাতেই কেবল নিজের স্বাতন্ত্র্য দাবী করা চলে। এই স্বাতন্ত্র উত্তম্মন্যতার ধারক, সমকক্ষের অসূয়া-দ্বন্দ্বের বাহক নয়।