জীবন-শিল্পী

জীবন-শিল্পী

০১.

আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো অস্তিত্ব নেই, শিল্পও তেমনি জীবন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। জীবন-চেতনাকে অবলম্বন করেই সৃজনশীলতার প্রকাশ-শিল্পের উদ্ভব।

জীবনকে যিনি ভালোবাসেন, জীবনের কোনো মুহূর্তই যার কাছে তুচ্ছ নয়, প্রতিক্ষণেই যিনি জীবনকে গভীর তাৎপর্য দিয়ে অনুভব করতে প্রয়াসী, জীবনের তুচ্ছতম কিংবা মহত্তম ক্ষণকে যিনি সমান গুরুত্বে গ্রহণ করতে সমর্থ, শিল্পী হওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। জীবন-চেতনা যার ক্ষীণ, বিচরণক্ষেত্র যার সংকীর্ণ, অভিজ্ঞতা যার সীমিত, সংবেদনশীলতা যাতে অনুপস্থিত, জীবন-শিল্পীর গৌরব তাঁর ভাগ্যে নেই।

এ যে বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞানে লভ্য নয়, তা বলে দেয়ায় অপেক্ষা রাখে না। সদাসচেতন ইন্দ্রিয়, সমীক্ষুমন, দরদভরা হৃদয় আর গুছিয়ে ও পিজিয়ে বলার কায়দা যার আয়ত্তে, শিল্পী হওয়া তাঁরই সাজে।

এসব গুণের সমন্বিত শক্তিই সৃজনশীলতা। না বললেও চলে যে নক্শা আর সাহিত্য এক বস্তু নয়। নিরবয়বকে অবয়ব দানই সাহিত্য-শিল্পের লক্ষ্য। কেননা সাহিত্য জীবনালেখ্য নয়– জীবনচেতনার উদ্ভাস মাত্র। বাহ্য আচরণ, ঘটনা কিংবা দৃশ্যের বর্ণনা মাত্রই সাহিত্য হয় না, তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে নিরীক্ষণশীল মন, বিশ্লেষণী মনীষা, সংশ্লেষণী দৃষ্টি আর জীবনরসের রসিকচিত্ত। এতেই বর্ণিত বিষয় রূপে, লাবণ্যে, রসে ও তাৎপর্যে অপরূপ হয়ে ওঠে। শিল্পীরা আমাদেরই জীবন নিয়ে লেখেন। আমরা ভোলা চোখে বিচ্ছিন্ন আচরণ, ঘটনা ও দৃশ্য দেখি। কিন্তু পরিবেষ্টনীর গুরুত্ববোধ, কার্যকারণ সম্পর্ক-চেতনা কিংবা সামগ্রিক চেতনার অভাবে আমরা কোনো যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারিনে। তাই আমাদের চেতনায় খণ্ড কখনো অখণ্ড অবয়বে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না, পাইনে কোনো তাৎপর্য। ফলে আমাদের অবোধ চেতনার খণ্ড সবসময়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর তুচ্ছ চিরকালই অবহেলিত। কিন্তু শিল্পীর চোখে ক্ষুদ্র-বৃহৎ তুচ্ছ-উচ্চ সব এক অখণ্ড জীবনপ্রবাহের বিচিত্র প্রকাশরূপে ধরা দেয়। জীবনের সামগ্রিক রূপ প্রত্যক্ষ করা, জীবনকে বিশ্লেষণ করা, জীবনের বিচিত্র বিকাশ কিংবা প্রকাশের তাৎপর্য আবিষ্কার করা তাই শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। যেমন একটা খাটের বিভিন্ন অংশ যদি বিভিন্ন কক্ষে রক্ষিত হয়, সেসব-যে একখানা খাটেরই অংশ তা শিশুর পক্ষে ধারণা করা শক্ত হলেও বয়স্ক লোকের পক্ষে সহজ। শিল্পী ও সাধারণ লোকের পার্থক্য এখানেই। শিল্পীর রয়েছে অখণ্ড দৃষ্টি আর অশিল্পীর আছে খণ্ড চেতনা। তাই আমাদের ঘরের কথা ও কালের খবর সাহিত্য পড়েই জানতে পাই আমরা। সুন্দর, সুস্থ ও স্বস্থ জীবনের অনুধ্যানই শিল্পীর ব্রত। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান এবং উপলব্ধিই শিল্পীর লক্ষ্য।

ঔপন্যাসিক হচ্ছেন জীবনশিল্পী। জীবনরূপ মহাকাব্যের মহাকবি। জীবননাট্যের নাট্যকার। তাঁর দায়িত্ব অনেক। সে-দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকা চাই তার। মানুষের জীবনে বিচরণক্ষেত্র সীমিত, কিন্তু মনের সঞ্চরণ-পথ ঋজু নয়। সেই বিচিত্রগামী সদাচঞ্চল তুরঙ্গ-গতি মনের দিশা পাওয়া সাধনা-সাধ্য বিষয়। একে অনুসরণ করার নৈপুণ্য অর্জন করতে হলে বিচিত্র প্রতিবেশে, বিভিন্ন অবস্থায় নানা মানুষের আচরণের, নানা ঘটনার ও অনেক ঘনিষ্ঠ হৃদয়ের উষ্ণ স্পর্শের অভিজ্ঞতা আবশ্যক। আমাদের দেশেও তেমনি শিল্পী একেবারে দুর্লভ নয়। যদিও বেদনার সঙ্গেই বলতে হয় সাধারণভাবে আমাদের উপন্যাসশাখা দুর্বল। এর দৈন্য গুহায়িত নয়। আমাদের অনেক ঔপন্যাসিকের শিল্পীসুলভ দৃষ্টি আছে কিন্তু তাঁদের প্রায় সৃষ্টিই অসম্পূর্ণ। উপন্যাসে পাঠক বিস্তৃত পরিসরে বিচিত্র পরিবেশে, সংঘাতময় জটিল জীবনালেখ্য আশা করে। সর্পিল জীবনধারায় সমাজ প্রতিবেশে জীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রকাশ, বিকাশ, বিবর্তন ও রূপান্তর প্রত্যক্ষ করার আগ্রহ রাখে পাঠক, আর চায় লোভ-ক্ষোভ, প্রেম-ঈর্ষা, বিরোধ-মিলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সুখ-শান্তি, আনন্দ-আরাম, দুঃখ-শোক আর হার-জিৎ আকীর্ণ বন্ধুর জীবনে বিচিত্রগামী মন-মানসের অঋজু পরিক্রমণ-চিত্র। কেননা মানুষ একাও নয়, স্বাধীনও নয়। তার আছে দেশ, কাল, সমাজ, ধর্ম, আইন-কানুন, বিশ্বাস সংস্কার, ভয়-শঙ্কা, আশা-নৈরাশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এসবের হাজারো বাঁধন। ভোলা চোখে জীবনের খণ্ডরূপই দৃশ্যমান। তাই তা নিতান্ত সরল, তার রূপ এক। এজন্যেই সে জীবনের বর্ণালি অথচ অখণ্ড আলেখ্য দেখতে চায় শিল্পীর তুলিতে। আমাদের নামকরা ভালো উপন্যাসেও এ গুণ দুর্লক্ষ্য। এমনকি দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আমাদের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোও আঙ্গিকে আর বহরে বড় গল্পের ঊর্ধ্বে ওঠেনি। মানুষের আচরণ, ঘটনা কিংবা দৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু তার অন্তনিহিত কার্যকারণ ধরে দেয়াই শিল্পীর কাজ।

এজন্যে প্রয়োজন গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মনোবিশ্লেষণে দক্ষতা। ব্যক্তিক আচরণ কিংবা বাহ্যঘটনা মনুষ্য হৃদয়ে কী ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে কীভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে তার স্বরূপ জানার আগ্রহ নিয়েই পাঠক বই খোলে। পাঠকের এ সাধ যে-উপন্যাস মেটাতে অসমর্থ, ব্যর্থ রচনা বলেই মানতে হবে তাকে।

পূর্ব পাকিস্তানে সার্থক উপন্যাস প্রায় নেই–এমন অনুযোগ আমাদের অজানা নয়। কিন্তু লেখকের পক্ষেও বক্তব্য রয়েছে। এ যুগে প্রতীচ্য প্রভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য চেতনা বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে আর্থিক সাচ্ছল্য আসেনি। গার্হস্থ্যজীবনে নানা অভাবের টানাপড়েন-সমস্যায় মধ্যবিত্ত বা বিত্তহীনের জীবন বিপর্যস্ত। বলা বাহুল্য, লেখকরা এ শ্ৰেণীরই লোক। তাদের কেউ কেউ লেখাকেই পেশা হিসেবে বরণ করেছেন, আবার কেউ কেউ চাকুরিজীবী হলেও বেতন বেশি নয়। তাই এসব ছা-পোষা লেখক প্রাণের প্রেরণা না পেয়েও প্রকাশকের আহবানে সাড়া দিতে বাধ্য হন। ফলে সিনেমার কাগজের এবং পুস্তক প্রকাশকের ফরমায়েশি তাড়নায় রচিত উপন্যাস পড়ে পাঠক-মন তৃপ্তি পায় না। আর ফরমায়েশি হয়েও মহৎ-সাহিত্য হবে সৃষ্টির তেমন দুর্লভক্ষণ সবসময় মেলে না। এ যুগে পাঠক অসংখ্য, প্রকাশকও অনেক। সে তুলনায় লেখক কম। তাই লেখকরা আজকাল রোজগারের সুযোগ পাচ্ছেন, দরিদ্রের পক্ষে সে সুযোগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে প্রকাশকের কাছে লেখকদের কদর বাড়ছে, গ্রন্থের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রচ্ছদ-শিল্পের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু লেখার মান যাচ্ছে নেমে, পাঠকের ক্ষোভও হচ্ছে তীব্র। লেখক ও পাঠকের এ দুর্ভাগ্যের কথা নাহয় না-ই বললাম, কিন্তু দেশ ও সাহিত্যের এ ক্ষতি গুরুতর।

মুদ্রাস্ফীতির কুফল কবলিত আজকের দিনে লেখকদের শিল্প-সাধনায় অনন্য-নিষ্ঠ রাখতে হলে তাদেরকে প্রতুল না হোক–প্রচুর সম্পদের অধিকার দিতে হবে।

.

০২.

জীবনে যখন জাগরণ আসে, তখন মানুষ উন্মুক্ত হয়ে উঠে আত্মপ্রসারে। তখন তাজা প্রাণ ঘিরে থাকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস। তখন সে হয় সৃজনশীল, চারদিকে কেবল নিজেকে রচনা করাই তার কাজ। সুন্দর করে বয়ন, শোভন করে রচন, আর কল্যাণমুখী সৃজন তার লক্ষ্য।

তাই প্রগতি কিংবা অগ্রগতি আসলে মনেরই চিন্তা-ভাবনার ফসল। আকাঙ্ক্ষা-প্রবল সুস্থ ও স্বস্থ মনের স্বভাবধর্মই হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া। অগ্রগতির জন্যে চাই মনের ঘাহিকা শক্তি ও উচ্চাভিলাষ। সেক্ষেত্রে জ্ঞান তার সহায় আর আত্মবিশ্বাস তার অবলম্বন। এতেই মেলে সৃজনশীলতা। নতুনের অনুভবে, সুন্দরের অনুধ্যানে এবং মনোজীবনে আর ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে বিচিত্র উদ্ভাবনায় মেলে তার পরিচয়। স্বাধীনতা লাভের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি অন্তজীবনের বিকাশ এবং ব্যবহারিক জীবনের উন্নয়ন। শিল্পে-বাণিজ্যে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে-স্থাপত্যে সর্বত্রই অনুভব করছি নতুন জীবনের বিকাশোনুখ প্রাণের সাড়া। দেহ-মন আত্মার মুক্তি না ঘটলে এমনি এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ আসে না।

সাহিত্যই হচ্ছে জাতীয় জীবনের অগ্রগতির শ্রেষ্ঠ পরিমাপক। কেননা, সাহিত্যেই ঘটে মন মানসের অন্তরঙ্গ ও সুন্দরতম প্রকাশ। ব্যক্তি ও জাতিকে চেনা যায় তার সাহিত্য পড়েই। এ অর্থেই সাহিত্য জাতীয় জীবনের মুকুর ও প্রতিভূ।

আমাদের জাতীয় সাহিত্যে অগ্রগতির পরিচয় নিলে বোঝা যাবে আমাদের কতখানি ঘটেছে মনের মুক্তি, কতখানি সুস্থ ও সুস্থ আমাদের চিত্তলোক আর কীভাবে এবং কোনো পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা-বিশেষ করে তরুণের দৃষ্টিতে তার সামগ্রিক রূপটি কীভাবে ধরা পড়ছে মিলবে তারও আভাস।