লালন শাহ্

লালন শাহ্

সাধক কবি লালন শাহর কথা বলতে হলে একটু ভূমিকা দরকার। মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন প্রশ্ন। রয়েছে, তারই মনোরম জবাব খোঁজার প্রয়াস আছে আমাদের তত্ত্ব–সাহিত্যে। বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সুফীমতের প্রত্যক্ষ সংযোগে বাউলমতের উদ্ভব হলেও, এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস-শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যে উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যক হয়। মনে হয়, এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে, বৌদ্ধদর্শনে ও সুফীসাধনতত্ত্বে দেহকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে চৈতন্য, সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শরীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে : দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধন-তত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অসামান্য। তাই এদেশে অধ্যাত্মসাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। যোগ-সাধন পাক-ভারতের আদিম অনার্যশাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সুফীপ্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মতরূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্যাপদের পরিণতি ঘটে বাউল গানে ও সহজিয়া পদে।

মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথম দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তর ভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ–ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দু মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সুফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। উত্তর ভারতের সন্তধর্ম, দক্ষিণভারতের ভক্তিধর্ম আর বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউলমতবাদ সুফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন নির্যাতিত নিম্নশ্রেণীর মনে ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী যে আবেগ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে উদার আকাশের তলে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনতর প্রয়াস মাত্র। জীবনের যে-চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা; উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। তখন মনে হয়, যদিও হিন্দু ধাবই দেহরা মুসলমান মসীত। কিন্তু সেখানে আল্লাহ নেই। তাদের মতে এই বিপথগামীদের আল্লাহ বলছেন–

মো কো কঁহা ছুঁড়ো বন্দে মৈ তো তেরে পাসমে।
না র্মৈ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাসমে।

জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপন আত্মার পরিশুদ্ধিই খোদা-প্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই এঁদের প্রাথমিক ব্রত। এঁদের আদর্শ হচ্ছে Knoweth thyself, আত্মাং বিদ্ধি–নিজেকে চেনো। হাদিসের কথায় মাআরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু।–যে নিজেকে চিনেছে, সে–আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা সে-খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে-পরমাত্মা হচ্ছেন–মনের মানুষ, অচিন পাখি, মানুষরতন, মমনুরা ও অলখ সাই (অলক্ষ্য স্বামী) প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে-রূপক দেহধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত।

মোটামুটিভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয়পাদ থেকেই বাউল-মতের উন্মেষ। মুসলমান মাধববিধি ও আউলচাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে পণ্ডিতগণের ধারণা। মাধববিধির শিষ্য নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্রই বাউল-মত জনপ্রিয় করেন। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পরিপূর্ণ বিকাশ।

লালনের সঠিক জীবনকথা আজো জানা যায়নি। তাঁর সম্বন্ধে রূপকথার মতো নানা কাহিনী চালু আছে। লালন সম্বন্ধে সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য যে তথ্য পাওয়া যায়, তা এই:: লালন হিন্দুসন্তুতি। অল্প বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি শ্রীক্ষেত্রে তীর্থযাত্রা করেন। ফেরার পথে তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে পথে ফেলে বাড়ি চলে যায় এবং তাঁর মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়। সিরাজ ফকির নামের এক নিঃসন্তান গরিব লকিবাহক তাঁকে পথ থেকে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। স্বামী-স্ত্রীর সেবাযত্নে লালন প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু একটি চোখ হারালেন। লালন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু মুসলমানের অন্ন খেয়েছেন বলে ঘরে উঠতে পারলেন না, তাঁর স্ত্রীও জাতিচ্যুত স্বামীর অনুগামী হতে অস্বীকার করলেন। এতে লালনের বিক্ষুব্ধচিত্তে বৈরাগ্য দেখা দেয়। তিনি আশ্রয়দাতা সাধক সিরাজের কাছে ফিরে আসেন ও তাঁকে গুরুপদে বরণ করেন। ১৮২৩ সালের দিকে লালন নানা তীর্থ পর্যটনের পর কুষ্টিয়ার গোরাই নদীর ধারে সেঁউড়িয়া গায়ের জোলাজাতীয় মুসলিম-স্ত্রী গ্রহণ করে এখানেই বাস করতে থাকেন।

 কুমারখালির কাছাকাছি কোনো গায়ে লালনের পৈত্রিক নিবাস ছিল। আর সিরাজ সাঁইয়ের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার কালুখালি স্টেশনের কাছাকাছি কোনো গায়ে। ১৭৭৪ খ্রীস্টাব্দে(?) দীর্ঘজীবী লালনের জন্ম এবং ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর শুক্রবারে(?) তাঁর মৃত্যু হয় বলেই অধিকাংশ পণ্ডিতের মত। লালন কায়স্থ সন্তান ছিলেন। কেউ বলেন তাঁর কুল-বাচি ছিল কর, আবার কারুর মতে, দাস। সেঁউড়িয়ায়ই লালন দেহত্যাগ করেন। এখানে তার মাজার আছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত দুদুশা রচিত লালন চরিত-এর অকৃত্রিমতা নানা কারণে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তাঁর গান লোকসাহিত্য মাত্র নয়–বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। আমাদের উনিশ শতকী পাশ্চাত্যমুখিতার জন্যেই তাঁর যথাযোগ্য আদর-কদর হয়নি। তবু আড়াই লক্ষ বাউলের তিনি গুরু–জীবনপথের দিশারী।

লালন বলেন—

এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।
ডুবে দেখ দেখি মন তারে; কিরূপ লীলাময়।
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ এই দেহে তিনি রয়।

অথবা,

দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ।
ডাকলে কথা কয়
তোমার মনের মধ্যে আর এক মন আছে গো
তুমি মন মিশাও সেই মনের সাথে।

রবীন্দ্রনাথও বলেন–

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি
হৃদয় পানে চাইনি।

অথবা,

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারি সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।

কিংবা,

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।

রুমীও বলেন—

-I gazed into my own heart
There I saw Him, He was nowhere else.

 আনল হক ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা যায় লালনের মুখে–

আপন সুরতে আদম গড়লেন দয়াময়
নইলে কী আর ফেরেস্তারে সেজদা দিতে কয়।…
লালন বলে আদ্য ধরম আদম চিনলে হয়।
এবং আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেনো না।

আসল কথা

আপনার আপনি যদি চেনা যায়।
তবে তার চিনতে পারি সেই পরিচয়।

কেননা,

যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন
যেমন বাজায় বাজে তেমন
তেমনি যন্ত্র আমার মন
বোল তোমার হাতে।

 জাত-বিচার সম্বন্ধে লালন প্রশ্ন করেন–

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন কয়, জেতের কী রূপ, দেখলাম না নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী-লোকের কী হয় বিধান?
 বামন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কী ধরে?

দেহাত্মবাদী লালন বলেন :

উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থ ব্রত যার জন্য।
এ-দেহে তার সব মিলে।

কাজেই

ক্ষ্যাপা, তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না-বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।
আমি যেরূপ, দেখ না সেরূপ দীন দয়াময়।

পরমাত্মা এ আত্মারই দোসর। কাছে থাকে, দেখা দেয় না, ধরা যায় না, এ জ্বালা কী হৃদয়ে সয়! তাই ক্ষোভ, তাই বেদনা :

আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
তারে জনম ভর একবার দেখলাম নারে।
 কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়ে-চড়ে হাতের কাছে।
খুঁজলে জনম-ভর মেলে না

তাই—

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশী নগর।
এক পড়শী বসত করে।

তার কারণ

 জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়,
ধরতে গেলে হাতে কে পায়।
তেমনি সে থাকে সদায় আলেকে বসে।

লালণের কণ্ঠে মানব মনের চিরন্তন কামনা ধ্বনিত হয়েছে :

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

কিংবা

কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে
 হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশ বেড়াই ঘুরে।

লালনের ও বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় বাউল প্রভাবও কম নয়। তাঁর ভাষাতেই আলোচনা শেষ করছি : (বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়।… এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে।–এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

লালনের গান আমাদের মূল্যবান সাহিত্য ও মানস-সম্পদ।