সৈয়দ এমদাদ আলীর সাধনা
উনিশ শতকের শেষদিককার আবহাওয়ায় ও ধ্যান-ধারণায় যাঁদের মন-মনন প্রভাবিত, বিশ শতকের গোড়ার দিকের সেসব সাহিত্যিকের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র ক্রমশ ছিন্ন ও অবলুপ্ত হয়ে আসছে। সৈয়দ এমদাদ আলীর প্রয়াণে আর একটি সূত্র ছিন্ন হল।
নতুনের সঙ্গে পুরাতনের সম্পর্ক এভাবেই ছিন্ন ও লুপ্ত হয়। নতুনকে ঠাই করে দিয়ে পুরাতন চিরকাল এভাবেই অতর্কিতে সরে পড়ে। পুরোনো বিবর্ণ পাতা কিশলয়কে অভিনন্দন জানিয়ে দায়িত্বমুক্ত হয়। বস্তুত জগৎ নিত্যনতুনের মেলা। একে ধরে রাখবার–ভরে থাকবার অধিকার কোনো পুরাতনেরই নেই। নতুন সূর্যের উদয়ে, নবতররূপে পৃথিবী উদ্ভাসিত ও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে–এ-ই নিয়ম।
সৈয়দ এমদাদ আলী পরিণত বয়সেই ইন্তিকাল করেছেন! তবু আত্মীয়-বন্ধুর প্রাণে হারানোর বেদনা বাজবেই। কিন্তু আমরা যারা দূরের মানুষ, আমাদের দুঃখ অন্য কারণে।
পলাশীর পরাজয়ের পর সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের প্রথম আবির্ভাব উনিশ শতকের অষ্টম দশকে মীর মশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে। নবম দশকে পেলাম মোজাম্মেল হককে এবং শেষদশকে এগিয়ে এলেন কবি কায়কোবাদ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এ সময়টাতে এঁদের যারা সহযোগী ছিলেন, আজ তাদের অবদানের বাহ্য-নিদর্শন বিশেষ কিছু নেই সত্যি; কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সমাজ-জীবনে ও অন্তর্লোকে তাঁদের প্রচেষ্টার প্রভাব প্রায় অপরিমেয়। এসব বিষয় যে আমরা শুধু ভুলে গেছি তা নয়, আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবার প্রয়াস পাচ্ছিনে, দুঃখ এজন্যেই। আর একজন যিনি জাতিকে গ্লানিমুক্ত ও অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন এবং বিজাতিকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাবান করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন, তিনি সৈয়দ আমীর আলী। কিন্তু সমাজ তখনো অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল বলে, তাঁর রচনার প্রভাবসুদূর প্রসারী হতে পারেনি। তাই তিনি শক্তিমান হয়েও মেঘলাদিনের মধ্যাহ্ন মার্তণ্ড-রূপেই আমাদের মনের আকাশে অস্পষ্ট হয়ে রইলেন। তাঁর সাধনা ছিল ইংরেজি ভাষা নির্ভর।
অপরদিকে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, স্যার সৈয়দ আহমদ, জামালউদ্দীন আফগানী, মওলানা কেরামত আলী প্রমুখ বহিবঙ্গীয় মনীষীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তিতুমির থেকে দুদুমিয়া অবধি অনেক স্বজাতিপ্রাণ ও কল্যাণকামী মনীষী মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে শোধন ও বোধনের জন্যে প্রাণপণ সাধনা করে গেছেন। আমাদের ভাগ্যদোষে এসব আজ রূপকথায় পরিণত হয়েছে।
মোটের উপর, এইসব মহাপ্রাণ মনীষীর প্রচেষ্টাতেই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রাণস্পন্দন ফিরে আসে। বিদেশী শাসকের প্রতিকূলতা-লাঞ্ছিত ও প্রতিবেশীর শোষণ ও অবজ্ঞাপীড়িত সেদিনকার মুসলিমে নতুন করে জীবন-জিজ্ঞাসা জাগানো কিরূপ কষ্টসাধ্য সাধনার ব্যাপার ছিল; আজ তা, আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারব না।
মুসলমানদের পদক্ষেপ যখন প্রাথমিক পর্যায়ের ভীরুতাও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তখন বাঙালি হিন্দুরা তাদের ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের ঐতিহ্য-সম্বল রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণকে অবলম্বন করে সাহিত্যে, সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্র-চেতনায় হিন্দুত্ব ও হিন্দুয়ানির পতাকা অনেক উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। মুসলমান সাহিত্যিকগণ অনুরূপ আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করে জাতীয়সত্তা দৃঢ়মূল করবার প্রয়াসী হলেন। ফলে হযরত মোহাম্মদ কাব্য, হযরত মোহাম্মদের জীবন চরিত, শাহনামা, সৌভাগ্য স্পর্শমণি, বিষাদসিন্ধু, মহাশ্মশান, জাতীয় ফোয়ারা শ্রেণীর রচনা আমরা পেলাম। তাঁদের ধারণায় জাতীয় ঐতিহ্যভিত্তিক সাধনাই প্রগতির পথ! এজন্যে বাঙালি হিন্দুর অবলম্বন হয়েছে আর্যাবর্ত রাজস্থান তথা উত্তরভারত আর বাঙালি মুসলমান প্রেরণা খুঁজেছেন আরবে-পারস্যে।
আমরা আত্মবিস্মৃত ও আত্মসম্বিৎহীন জাতি বলেই সৈয়দ এমদাদ আলী সম্বন্ধে দুটো কথা বলবার জন্যে এত দীর্ঘ ভূমিকার দরকার হল। নতুবা কবিতার বই ডালি, পত্রোপন্যাস হাফেজা ও জীবন-কাহিনী রাবেয়ার লেখক এমদাদ আলী সম্বন্ধে সোজাসুজি দুটো কথা বললে, যে-কেউ ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার বাঁকা হাসি টেনে কথাগুলো এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে পারেন। কেননা এসব রচনার যথার্থ সাহিত্যমূল্য বেশি নয়।
আমাদের নজরুল-পূর্ব যুগের সাহিত্য-প্রচেষ্টা সম্বন্ধে বলা চলে, সেখানে সার্থক সাহিত্য-সৃষ্টি বিরল। কিন্তু তারা উত্তরপুরুষ ও উত্তরসাধকের জন্যে যে-ক্ষেত্ৰ কৰ্ষণ ও তৈরি করে রাখলেন, তার যথার্থ মূল্য নিরূপিত হলে একদিন আমরা শ্রদ্ধায় ও বিস্ময়ে অভিভূত হব–এ নিশ্চিত জানি।
১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে সৈয়দ এমদাদ আলীর জন্ম। তিনি উনিশ শতকের শেষ পাদে মুসলিম জাগরণের উন্মেষকালের আবহাওয়ায় বর্ধিত। তাঁর মন-মননের উপর জাতীয় হিতৈষণা ও কল্যাণকামিতার যে-প্রভাব পড়ে, তার তাগিদে-অন্তরজাত প্রতিভার আবেগে নয়–তিনি সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর মনের পরিচয় মিলবে তাঁর বাঙলা ও ইংরেজি প্রবন্ধগুলোতে আর তাঁর নবযুগ নামক অসমাপ্ত উপন্যাসে। এদিক দিয়ে বিচার করলে তার আদর্শ ও অবদানের আভাস পাওয়া যাবে তার মাসিক নবনূর পত্রিকার প্রকাশ ও পরিচালনায়। এ পত্রিকাখানি তার স্বল্পকাল-স্থায়ী জীবনে জাতির আলোকবর্তিকা ও দিশারী স্বরূপ ছিল। এজন্যে কেউ কেউ একে বঙ্গদর্শনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর সাধনার স্বরূপ সাহিত্যসৃষ্টিতে নয়–জাতিকে অনুপ্রাণিত করে গড়ে তোলার কাজের মধ্যেই খুঁজতে হবে।
এ ব্যাপারে আর একটি কথা আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে সে-যুগে যারা সাহিত্যক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন, তাঁদের কেউ উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, তেমন শক্তিমান লেখকও ছিলেন বিরল। প্রায় সকলেই হিন্দুলেখকদের বাঙলা রচনা পড়েই সাহিত্য সৃষ্টি করতেন। আরবি-ফারসি ভাষায়ও বিশেষে ব্যুৎপত্তির পরিচয় তাঁদের রচনা বহন করে না।
এমনি অবস্থায় তারা যা বলতে বা করতে চেয়েছেন, তাতে তাদের প্রাণগত সাধনা ও স্বজাতিবাৎসল্যের অপরিমেয় আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের সাধ যত ছিল, সাধ্য ততটুকু ছিল না। তাই তাঁদের হাতে তাঁদের অবদানের বাহ্য নিদর্শনস্বরূপ উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু পাইনি। কিন্তু যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য, যে আন্তরিকতা, উদ্যম ও অক্লান্ত সাধনা তাঁদের প্রচেষ্টাকে মহিমান্বিত করে রেখেছে, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধান্বিত না হলে, তাঁদের ঋণ স্বীকার না করলে, আজকের দিনে শুধু জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি নয়, নিজেদের প্রতিও অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে লিখিত এক পত্রে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেছিলেন, যতই ক্ষুদ্র হই না কেন, আমরা সে-যুগে জাতির ভাগ্যাকাশে জ্যোতিষ্কস্বরূপ উদিত হয়ে জাতিকে দিশা দিতে চেষ্টা করেছি। অবিকল কথাগুলো আমার মনে নেই তবে ভাবটা এ-ই। একে কেউ তাঁর অহমিকার অভিব্যক্তি বলে ভাবলে তাঁর উপর অবিচার করা হবে। এতে তাঁর বা তাঁর সতীর্থদের সাধনার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই প্রকাশ পেয়েছে। পুরাতন ও প্রবীণদের আমরা ধরে রাখতে পারব না। কিন্তু পুরোনো ও প্রবীণের অবদানকে আমরা মহামূল্য পাথেয় করে রাখব। তা আমাদের জীবনে ও জাগরণে, সাধে ও সাধনায় কাজে লাগবে।
সৈয়দ এমদাদ আলী গেলেন কিন্তু তার আদর্শ আমাদের মধ্যে চিরন্তন হয়ে থাক–এ-ই কামনা করি।