সাহিত্যের রূপকল্পে ও রসকল্পে বিবর্তনের ধারা
বর্বরতম যুগে মানুষে আর পশুতে কোনো ভেদ ছিল না। পশুর মতো তারও সেদিন একমাত্র কাম্য ছিল ক্ষুন্নিবৃত্তি; তবু তার মন বলে পশুর থেকে উন্নততর একটি বৃত্তি ছিল; ফলে, তার শুধু পেটে ক্ষুধা নয়, মনেও ছিল পিপাসা। সেটাও ভোগে। সেদিন সে শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়াসী ছিল, বাস্তব ব্যবহারিক জীবনে আর কোনো ভোগ্যবস্তুর প্রত্যাশী ছিল না। সে-বোধই জাগেনি তখনো; কাজেই বঞ্চিত জীবনের হতবাঞ্ছার কোনো বিক্ষোভ ছিল না তার মনে। সেজন্যে ব্যবহারিক প্রয়েজনে কোনো চিন্তাই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। তাই বাস্তব জীবনোপলব্ধির কোনো গরজ, জীবনকে যাচাই করবার কোনো প্রেরণাই সে বোধ করেনি সেদিন। সে তাকিয়েছিল তার চারদিককার অজানা ও রহস্যাবৃত চিরবিস্ময়কর সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের দিকে। তা-ই তাকে করেছিল চকিত, বিস্মিত, ভীত, এস্ত ও উল্লসিত। সেজন্যেই সে–চাটাইয়ে নয়, ঘাস বা পাতায় শুয়ে স্বপ্ন দেখত পাখির মতো দূর-দূরান্তরে উড়ে যেতে; খুঁজত আকাশের কিনারা দুনিয়ার শেষ। সে কল্পনা করত, মানুষের অগম্য হিমালয়-সাহারা-অলিম্পাসে না-জানি কী আছে, কারা আছে! নিশ্চয়ই সেখানে এমন কিছু আছে, এমন কেউ থাকে, যা কাম্য, যা শ্রেয়, বা সুন্দরতর ও মহত্তর এবং আকৃতি-প্রকৃতিতে, রূপে-গুণে, বলে-ছলে যে বা যারা বিচিত্রতর।
মানুষ যা জানে না, যা বোঝে না, যা রহস্যাবৃত, যা অচেনা; তাকে জানবার, বুঝবার ও আয়ত্ত করবার এক উদ্দাম বাসনা, এক অসহ্য ব্যাকুলতা বোধ করে। মন দিয়ে, কল্পনা দিয়ে, বুদ্ধির সাহায্যে, বোধির প্রয়োগে, চিন্তার মাধ্যমে তার একটা যুক্তিসহ বা বুদ্ধিগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না দিয়ে সে স্বস্তি পায় না। এভাবে সে বাহ্যজগতের সবকিছুর একটি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দিয়ে আত্মপ্রবোধ পেয়েছিল। লাভ করেছিল আত্মপ্রসাদ।
এমনি করে মানুষ সেদিন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছিল। তাতে ছিল পঙ্খিরাজ ঘোড়া, বিচিত্র হাত-পা-মাথা-মুখ-চোখ-কানওয়ালা দেব-দৈত্য-পরী-জীন রাক্ষস-ড্রাগন। কল্পলোকের এসব জীবের কল্পিত রোমাঞ্চকর জীবনোপখ্যানই ছিল সেদিন মানুষের মনের রস-পিপাসা–মনের ক্ষুধা মিটাবার অবলম্বন। এ মনের প্রতিফলন দেখি রূপকথায়। রূপকথা সে যুগের জীবন্তিকা। রূপকথার জন্ম হল এভাবেই। কথায় বলে–অদারু দারু হয় শিলে পিষিলে। অকথা কথা হয় লোকে। ঘোষিলে। ফলে রূপকথাই যুগান্তরে হয়ে দাঁড়াল মানুষের অতি-শোনা প্রতিবেশী রাজ্যের সত্য কাহিনী। মাটির গড়া রক্তমাংসের মানুষের বাস্তবজীবনে প্রতিবেশীর প্রভাবের মতো সে প্রভাব পড়ল মানুষের মনে-মানসে আর ব্যবহারিক জীবনে। এসব কল্পলোকবাসী মানুষের ব্যবহারিক জীবনের গরজে কল্পিত হয় দুইরূপে-অরি ও মিত্ররূপে। দেবতারা শক্তিমান অতি-মানুষ ও মানুষের সহায়রূপে কীর্তিত; আর সব দেব-মানবের শত্রুরূপে কল্পিত। এদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক সগ্রামে দেব-মানব পরস্পরের সহায়ক। বর্বরতম মানুষের শৈশব অতিক্রান্ত হল এভাবে। মানুষের জীবনবোধের কিছুটা প্রসার হল। হতে থাকল জ্ঞানপ্রজ্ঞা-বোধির উন্মেষ। পূর্বের কল্পনালব্ধ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়ে চলল। বিকশিত বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানবমনে জেগে উঠল নতুনতর পিপাসা। জীবন পরিধি হল কিছুটা প্রসারিত। বাহুবলে বলীয়ান মানুষের মনের ক্ষেত্র হল বিস্তৃত। আবার যেখানে অজ্ঞতা সেখানেই মানুষের ভয়, সেখানে মানুষ অসহায়। তাই সৃষ্টির আদিতে মানুষ ভয় করেছে মাটির দূর্বা থেকে আকাশের নক্ষত্র অবধি সবাইকে।
জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অর্জন করেছে আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি। কল্পনা ও ভাবপ্রবণতা হয়েছে পরিমিত, কাঁচা মন হয়েছে পাকা। সে বিশেষ মানুষ। ইতরের চাইতে জীবনে তার চাহিদা বেশি, সে দেহে শক্তিমান, কৌশলে কুলীন আর মনে উচ্চাভিলাষী। শিশুমানুষের–পশুমানুষের মন এভাবে একটু একটু করে ক্রমে জেগে উঠেছে। বিস্ময়বিমূঢ় মনে, শঙ্কাকাতর মনে, কল্পনাপ্রবণ মনে, আত্মপ্রত্যয়হীন মনে, ত্রাসদলিত মনে অঙ্কুরিত হয় কামনা–সে কামনা ভোগের, আত্মপ্রসারের-পরাক্রান্ত মনের। উচ্চাভিলাষী শক্তিবিলাসী মনে সাড়া দিয়ে নড়ে উঠল অজ্ঞাতপূর্ব দুটো লোভ-জমির আর জরুর। যেমন-তেমন জমি নয়–রাজ্য, আর যে-সে কন্যা নয়–সুন্দরীতম ডানাকাটা পরী। দুটোই দুর্লভ। তাই শুরু হল অভিযান, বেধে গেল সগ্রাম, দেখা দিল পদে পদে সংঘাত। এ অভিযানে দেবতা হল মানুষের সহায়, আর দেও-জিন-রাক্ষস দাঁড়াল পথরোধ করে। মানুষের মধ্যে এ উচ্চাভিলাষী সগ্রামী দলে রয়েছে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান রাজকুমার, মন্ত্রীপুতুর, সদাগর আর কোটাল। এভাবে কল্পলোকের সঙ্গে যুক্ত হল ইহলোক। কল্পরাজ্যে-মনোরাজ্যে ঘটল মিতালি, স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হল জৈব-কামনা। জীবন পরিব্যাপ্ত হল জীবনের লোকে। দেব-মানবে জীবনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এবার রূপকথা নয়, কল্পনোক নয়, আবার তাকে বাদ দিয়েও নয়। এবার প্রবুদ্ধ জীবনের জয়যাত্রা–আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার স্পৃহার মূর্তস্বরূপ। এ-যুগ রোমন্সের যুগ। সভ্যতার ইতিহাসে মহাকাব্যের যুগ।–ইলিয়াড-ওডেসী আর রামায়ণ-মহাভারতে বিধৃত রয়েছে তার স্বরূপ। এ থেকে মনুষ্যসমাজেও সৃষ্টি হল শ্রেণী–তুচ্ছ ও উচ্চ মানবশ্রেণী। উচ্চমানুষের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার দেখে সেদিন তুচ্ছ মানুষ ঈর্ষা করেনি বরং স্বাজাত্যবোধে সে উল্লসিতই হয়েছিল মানুষের জয়যাত্রায়। নির্বোধ তুচ্ছ মানুষ সেদিন আত্মভোলা হয়ে স্বজাতির প্রগতিতে আত্মপ্রসাদই লাভ করেছিল, উপভোগ করেছিল পরমানন্দ। এভাবে মনুষ্যজীবনে সার্থক হয়ে উঠল স্বপ্ন ও সত্য, কল্পনা ও মনন, মাটি ও আকাশ, আর জীবন ও জিজ্ঞাসা। বাস্তবজীবনই ব্যাপ্ত হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে। এ ত্রয়ীর পটভূমিকায় সংঘাতে-ঈর্ষায় বিদ্বেষে ও প্রীতি-অনুকম্পায় দেব-দৈত্য-নর রইল পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে।
এ যুগটি মানুষের জীবনে তথা ইতিহাসে দীর্ঘতম স্থায়ী স্তর। মনুষ্যজাতির কোনো কোনো সম্প্রদায়ে আজো এর পূর্ণ ও প্রবল জের চলছে। এক সমাজেও প্রতিবেশ ও শিক্ষাগত কারণে সব মানুষ একই স্তরে উন্নীত হতে পারে না। তাই আলো-আঁধারি, কায়া-ছায়া, কল্পনা-বাস্তব, জ্ঞান অজ্ঞান, বোধি-প্রজ্ঞা, ভাব-প্রবণতা, ভয়-ভাবনা, চেতনা-অবচেতনা, শঙ্কা-কৌতুক, বিস্ময়-জিজ্ঞাসা মিশ্রিত বহু বিচিত্র এ জীবনলীলার মোহ কোনো ছলেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ। যতই ভাবে, যতই দেখে, ততই রহস্যের মায়াজালে আত্মসমর্পণ করে আত্মসমাহিত হতে চায়, গদগদ কণ্ঠে বিমুগ্ধ ও অতৃপ্ত চিত্তের বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠে একটি কথায়–আহা! কিংবা একটি উচ্ছ্বসিত নিশ্বাসে। এ যুগে মানবজাতি সাংস্কৃতিক মানানুসারে নানা স্তরে বিভক্ত রয়েছে। আমরা এর সবচেয়ে প্রগতিশীল সম্প্রদায়কেই আমাদের বক্তব্যের অবলম্বন করব।
মনুষ্যের জাতীয় জীবনের তৃতীয় স্তর শুরু হয়ে গেল। এ যুগে আর রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র, সদাগর ও কোটালে জীবনবোধ, উচ্চাভিলাষ ও ভোগেচ্ছা সীমাবদ্ধ রইল না। রাজ-রাজড়াদের সান্নিধ্যে, দেশ-দেশান্তরের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগে, শিক্ষার প্রসারে জনমনেও ফুটে উঠল প্রসারিত জীবনের মোহময় রূপ। জীবনবোধ হয়ে উঠল সূক্ষ্ম। এবার আর স্বর্গপাতাল নয় শুধু মর্ত, ভাবপ্রবণতা নয়–ভাবনা; পখিরাজের পিঠ নয়, আকাশের কিনারা নয়-জীবনের শারীর চাহিদা মিটাবার আগ্রহই মানুষকে কল্পনার স্বর্গলোক থেকে কঠিন মাটির সংগ্রামে নিয়োজিত করল। এবার আর আকাশ-বিহারের সাধ নয়, জমিচাষের গরজবোধই কর্মমুখর করে তুলল মানুষকে। এবার গানে-গাথায় দেও-জিন-রাক্ষসের কথা নয়, পরী-বিদ্যাধরী অপ্সরীর কামনা নয়; হতবা জীবনের বিক্ষোভ, বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথার আক্ষেপ, তৃপ্ত হৃদয়ের প্রশান্তি, কৃতার্থ মনের উল্লাস, বিজয়ী বীরের আস্ফালন ও দলিতজনের আর্তনাদই হল সাহিত্যের সামগ্রী। কাম আর অর্থ–এ দ্বিবিধ বর্গীয় ফল লাভেচ্ছাই গণজীবন নিয়ন্ত্রিত করছিল এ স্তরে।
এবার আর বৃহৎ বা মহৎ কোনো জিজ্ঞাসা নয়, নিতান্ত বাসনা চরিতার্থ করাই জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য। জীবন ও জীবিকার তফাৎ আর রইল না, জীবিকাই জীবন অর্থাৎ জীবিকা জীবন দ্বারাই জীবনের স্বরূপ অভিব্যক্তি পেতে শুরু করেছে। আগে মানুষ ছিল কম। পৃথ্বী ছিল বিপুলা, তার উপর। নিতান্ত উদরপূর্তির সামগ্রী ছাড়া অন্য সামগ্রীর প্রয়োজনবোধ তখনো জাগেনি বলে হানাহানির কারণ ছিল না আহার্য নিয়ে। কেননা, তখনো সঞ্চয়-বুদ্ধি জাগেনি, পশুপাখির মতো দিনভর খুঁজে পেতে আহার করাই ছিল কাজ। তখনো মন অবচেতন স্তর পার হয়ে আসেনি, কাজেই কৃত্রিম হয়ে ওঠেনি যৌনবোধ ও যৌন-উত্তেজনা। তবু আহার্য সংগ্রহঘটিত দ্বন্দ্ব আর যৌন-সম্ভোগ-সংক্রান্ত নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী সংঘাত যে ঘটেনি তা নয়। তবে তা মনে পুষে রাখার মতো নয়। পশুতে, পাখিতে এসব ব্যাপার যেমন ঘটে এবং যতক্ষণ স্থায়ী হয়, এও তেমনি আর ততক্ষণ ও ততটুকু।
তারপর ক্রমে মানুষ জাগল। মানুষের জীবন-বিলাস বহু বিচিত্ররূপ ধরে বিকশিত হয়ে চলল। মানুষ বাড়ল। টান পড়ল ভোগ্যসামগ্রীতে। প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল শুরু। লাগল কাড়াকাড়ি, মারামারি আর হানাহানি। পৃথিবী হয়ে উঠল বসবাসের প্রায় অযোগ্য। নিশ্চিত-নির্বিঘ্ন নিরুদ্বেগ জীবন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। দুর্বলের সহায়, কল্যাণ ও শান্তিকামী, করুণা-বিহ্বল মানুষ এমনি সংকটে উচ্চারণ করেন একাধারে সাবধানধ্বনি ও অভয়বাণী; তাদের একচোখের দৃষ্টিতে থাকে ধমক, আর চোখে থাকে আশ্বাসের দীপ্তি! তাঁরা দোহাই কাড়েন। বাহুবল, ধনবল, জনবল নয়, আনবল ও বাক্যবলই তাঁদের মূলধন আর দোহাই-ই তাদের অস্ত্র। আল্লাহর দোহাই ও স্বর্গ নরকের দোহাই, লাভ-ক্ষতির দোহাই, রোগ-শোক-মৃত্যুর দোহাই ও আপদ-বিপদের দোহাই কেড়ে তারা লোকমনে এমন এক ভয়-ভাবনা ও আশা-আশ্বাসের পার্থিব-অপার্থিব পরিবেশ ও সংস্কার সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তার সত্যাসত্য নির্ণয় অসম্ভব। এ রহস্যঘন, ত্রাসদুষ্ট, সন্দেহ শঙ্কাপুষ্ট সংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে বের হওয়া দুঃসাহসী লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য হয়ে রইল। তাতেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিমিত ও লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মনুষ্যসমাজের আবহ স্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। এ স্তরের মনুষ্যমনের প্রতিচ্ছবি পাই এ যুগে সৃষ্ট সাহিত্যে। সে-সাহিত্য রোমাঞ্চময় ও রোমান্টিক। তাতে রয়েছে বাস্তবজীবনে পাওয়া-না-পাওয়া হৃদয়ের স্বরূপ। জীবনের সাধ-আহ্লাদ, দুঃখবেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চিত বুকের বিক্ষোভ, তৃপ্ত হৃদয়ের মধুর প্রসাদ ও প্রশান্তি অভিব্যক্তি পায় সাহিত্যে। তাতে অলৌকিক-অসম্ভবতা আর রইল না, থাকল জীবনে সম্ভব অথচ অসাধারণ অস্বাভাবিক পরিবেশে ও উপায়ে কামনা পূর্ণ করবার দিশা। এ সাহিত্যের সংজ্ঞা ও আদর্শের স্বরূপ এই জীবনে যে-সাধ মিটাতে পারিনি, সে-সাধ জেগেছে গানে। অথবা জীবন যাহার অতি দুর্বহ– দীনদুর্বল সবি। রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ সেইজন বটে কবি। যেমন গত শতকে রচিত রোমান্সগুলো।
শুধু জীবনবোধের প্রসারেই মানুষের জৈব চাহিদা বাড়েনি, সভ্যতার দান তথা আবিস্ক্রিয়াও মানুষের প্রয়োজন বাড়িয়ে দিচ্ছে। যতই রকমারি ভোগ্যসামগ্রী বাড়ছে, ততই অসংযত হয়ে উঠছে মানুষের বাসনাও। তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি কিছুতেই হচ্ছে না। চাহিদা মিটাবার উপলক্ষে জীবিকার ধান্দাতেই ছুটোছুটি করে জীবন কাটছে চোখ তুলে চারদিকে দেখবার, ভাববার বা বিস্মিত হবার আগের মতো অবকাশই বা কোথায়! কারো যদি অবকাশ ঘটেও যায়, তবু জ্ঞানে প্রবীণ পৃথিবীর লোক জগৎ ও জীবনের, প্রকৃতি ও নিসর্গের, আকাশের আর পাতালের সব রহস্য, সব খবর এমন করে বিশ্লেষণ করে নগ্ন করে তুলে ধরেছে জনসমক্ষে যে, জগতে আর জীবনে নতুন কিছুই রইল না যা মানুষের ভয়-বিশ্বাস, ত্রাস-শঙ্কা বা আনন্দ-উল্লাস-ঔৎসুক্য জাগাতে পারে। ফলে খাও, গাও আর নাচো এ-ই হয়ে উঠেছে জীবনাদর্শ ও জীবনদর্শন। কেননা জানা গেছে, আর কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। সব ফাঁকি, সব ভাঁওতা। যুগযুগান্তরে লালিত মানুষের পূর্বাৰ্জিত বিশ্বাস-সংস্কারের ভিত উবে গেছে চোরাবালির মতো। ধসে পড়েছে ধর্মবিশ্বাস, সমাজ-সংস্কার ও নৈতিক মূল্যমানের সৌধ। ভেঙে গেছে পারলৌকিক অস্তিত্বের স্বপ্নে গড়া আশা-আশংকার মনোময় ইমারত। কিসের ভরসায়, কার ভয়ে কোনো মহৎ ও বৃহৎ প্রেরণায় মানুষ ভোগে থাকবে বিরত, বঞ্চিত হৃদয়ে প্রবোধের শান্তি বারি ছিটোবে; আর কেমন করে দিন-রজনীর অভাবে ধৈর্য ধারণ করবে?
মহৎ ও বৃহৎ আদর্শবিহীন, জীবাত্মা-পরমাত্মারহস্য পরাখুখ, পরলোক-বিভ্রান্তিবিমুক্ত জৈব জীবন-সর্বস্ব বস্তু-নির্ভর নাস্তিক্যাদর্শবাদীরা তাই একান্তভাবে ভোগ্যবস্তু লোলুপ। তাদের ধ্যানজ্ঞান আর কর্মভোগেচ্ছা পূরণেই নিয়োজিত। তাদের বুকে বিক্ষোভ, মুখে অভিযোগ, চোখে লোভ।
গাঁয়ে কোনো শক্তিমানের গরুতে যদি গরিব চাষীর ধান খেয়ে যায় তখন সে শক্তিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সাহস না পেয়ে বা প্রতিকারের উপায় না দেখে, গাঁয়ের আর দশজনের কাছেই আবেদন জানায়–আজ অমুকের গরুতে আমার ধান খেয়েছে, কাল তোমার ধান খাবে। পরশু অমুকের খাবে। অতএব, এস আমরা সবাই মিলে এর প্রতিকারের একটা ব্যবস্থা করি। আজকাল শহরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে এমনিভাবেই সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলেরা লড়াই করে। এরমধ্যে কোনো মহৎ প্রেরণা নেই। স্ব স্ব স্বার্থে লোক নিতান্ত সহজাতবৃত্তিবশে একজোট হয় মাত্র। একই মামলার আসামিরা যেমন আত্মনিষ্কৃতির জন্যে একমুখো চেষ্টা চালায়।
আজকাল মানুষ দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত–ভোগী ও ভোগেচ্ছ, ধনী ও গরিব, ভোগী ধনীরা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিত্তে বড়। ভোগেন্দুরা সংখ্যায় অগুণতি। তারা সব একজোট হয়েছে। তাদের বক্তব্য এই–পৃথিবী ও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী প্রকৃতির দান, আমরাও প্রকৃতিসৃষ্ট। কাজেই এতে সবার সমান অধিকার রয়েছে, এ কারো বা কোনো দল-বিশেষের একচেটিয়া ভোগ্য হতে পারে না। ধনী, তুমি অট্টালিকায় আছ, রাজা তুমি প্রাসাদে রয়েছ; মধ্যবিত্ত, তুমি ভবনবাসী-আমরা এত গরিব-কাঙাল যখন কুটির আর গাছতলা সার করেছি, আর সবার জন্যে যখন অট্টালিকা ও প্রসাদের ব্যবস্থা করা যাবে না, তখন তোমরাও প্রাসাদ-অট্টালিকা-ভবন থেকে নেমে এস, আমরাও গাছতলা থেকে উঠে যাই। সবার জন্যে সমবিত্ত ও সম-ভাগের ব্যবস্থা হয়ে যাক। সুখে থাকি আর দুঃখে পড়ি তাতে আর ক্ষোভ বা ঈর্ষা থাকবে না। তোমাদের ভোগ দেখে আমাদের ঈর্ষা জাগে, তোমাদের বিত্ত দেখে আমাদের মনে ক্ষোভের উদয় হয়, তোমাদের ঐশ্বর্যে আমাদের লালসা বাড়ে। ভোগেছু বিক্ষুব্ধ দলবদ্ধ বঞ্চিত জনগণ মহৎ-নামের আবরণে এ মনোবৃত্তিকেই মহিমময় করে তুলে ধরেছে। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, জীবনবাদ প্রভৃতি বুলির আবরণে ও আভরণে এমনি এক নগ্ন অসঙ্গত অথচ যৌক্তিক বাসনার দাবী পেশ করেছে। এ মনের অভিব্যক্তি যে-সাহিত্যে লাভ করেছে, তার নাম গণসাহিত্য। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, গণজীবনে শ্রদ্ধা ও দরদ, প্রচলিত সমাজ ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবজ্ঞা, বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ এসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। বাস্তবে জীবনায়ণের গৌরবে মানবতার বাণী প্রচারের দম্ভে, জীবন ও জীবিকার অভিন্ন স্বরূপ উঘাটন-গর্বে, জগৎ ও জীবনের যথার্থ সূত্র আবিষ্কার ও অকৃত্রিম সংজ্ঞা প্রয়োগ-গৌরবে এ সাহিত্য আজ বিশ্বনন্দিত ও গণবন্দিত। এ সাহিত্যের মহান আদর্শ হচ্ছে-মানুষের জন্যে, জীবন-জীবিকার জন্যে, মানবতাবোধ প্রসারের জন্যে, মানবকল্যাণের জন্যে, সমাজ-উন্নয়নের জন্যেই সাহিত্য। মূলত ঈর্ষা, ভোগেচ্ছা, বঞ্চিত বুকের বিক্ষোভ ও অভিযোগ সম্বলিত এ সাহিত্যও রোমান্টিক। এ রোমান্টিকতা আকাশচারী নয়–ভূমি-নির্ভর, কল্পনাসর্বস্ব নয়-ক্লেদাক্ত কামনাপুষ্ট বাস্তব। জীবনভিত্তিক। মহিমময় বুলির আবরণে এরই জয়গানে আমরা মুখর।
মানুষের সাহিত্য মানুষের মন-মননেরই প্রতিচ্ছবি–মানুষের আন্তর্জীবনেরই বাগ-বন্ধ রূপ। এ অর্থে সাহিত্য চিরদিনই বাস্তব-জীবন ও বাস্তববোধ-ভিত্তিক। কাজেই সাহিত্য কোনোকালে। কৃত্রিম অবাস্তব অলৌকিক ছিল না। মানুষের জীবনবোধ যে-যুগে যেমনটি ছিল, সাহিত্যে তেমনটিই বিবৃত হয়েছে।