নজরুল-মানস
নজরুলের মন ছিল সরল, বুদ্ধি ছিল ঋজু, আত্মা ছিল অনাবিল। তিনি যা চেয়েছেন সহজভাবেই তা বলেছেন, যা ভেবেছেন তাতে কোনো কূট-সমস্যা নেই- জটিল যুক্তিজাল নেই। সরল মানুষের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে চাওয়া ও পাওয়ার দাবীই তিনি পেশ করেছেন। তাই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, তত্ত্ব নেই। তার কাম্য ছিল : পারস্পরিক প্রীতি, সাম্য ও স্বস্তিপূর্ণ সমাজ। সুস্থ, স্বস্থ ও সুখী মানুষের সমাজ এবং এই মানুষকে ভালোবেসে, এই মানুষেরই ভালোবাসা পেয়ে তিনি আত্মপ্রসাদ ভালো করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন : আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। কাজেই তিনি সাম্য– কামী ও অভাবমুক্ত মানুষ তথা কাঙাল-বিরল সমাজকামী হলেও মার্কসবাদী ছিলেন না, তা তিনি বুঝবার চেষ্টাও করেননি কোনোদিন।
বলেছি, তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন সে-ভালোবাসা যেমন ছিল অকপট, তেমনি ছিল গভীর। তাই ভালোবাসার পথে যারা বাধা হয়ে রইল, তাদের প্রতি মারমুখো হয়ে রইলেন তিনি। এ হচ্ছে সরল হৃদয়ের অনভূতিজাত উত্তেজনা, চিন্তাপ্রসূত বিক্ষেভ নয়। তাই তার রচনায় ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই। এজন্যেই তিনি সোজা কথাটা ভাবতে পারেননি যে, যাদেরকে তিনি গরিব ও দুর্বলের দুশমন মনে করেছেন, দোষ তাদের নয়– তাদের রক্ত ঝরলেই শত্ৰুনিপাত হয় না। এক জমিদার পথে বসলে আর এক জমিদার গজায়, এক পুঁজিপতি দেউলিয়া হলে আর এক ধনী মাথা উঁচু করে। গলদ রয়েছে গোড়ায়–অর্থাৎ সমাজকাঠামো, নৈতিক আদর্শ এবং ব্যষ্টির দায়িত্ব ও দাবী, কর্তব্য ও অধিকারবোধ না পাল্টালে এ ব্যাধির কবল থেকে নিষ্কৃতি মেলে না। সহজ প্রাণের চাহিদা আর প্রয়োজন-উপলব্ধি এক জিনিস নয়। নজরুল যা চেয়েছেন তা তাঁর প্রেমিকহৃদয়ের চাহিদা। এজন্যেই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, সমাজতত্ত্ব নেই, নতুন সমাজ গড়ার সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। কেবল যা চেয়েছেন তা পাননি বলে, প্রবল উত্তেজনায় সুমুখে যাকে পেয়েছেন তাকেই আক্রমণ করেছেন; কার্যকে ভেবেছেন কারণ, আর কারণ-এর খোঁজ পাননি বড় একটা।
ফলে প্রেমিক হলেন সংগ্রামী। প্রেম বিলোতে এসে বিরুদ্ধ-পরিবেশে পড়ে রক্ত ঝরানোর সংকল্প নিলেন। তার কথায়; দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি)। প্রত্যক্ষভাবে পারছেন না বলে পরোক্ষ উপায় গ্রহণ করলেন। অসির বদলে মসিই করলেন সম্বল এবং প্রকাশ্যে বললেন, রক্ত ঝরাতে পারি না যে একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা। এও হৃদয়বান কবির প্রায়-কায়িক উত্তেজনারই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে জাতপ্রেমিক–বিশ্বমানব প্রেমিক হলেন বিদ্রোহী, বিপ্লবী, সংগ্রামী ও জাতীয় কবি। ভাগ্যের পরিহাস!
এতে আমরা কিন্তু ভাগ্যবান হলাম। কেননা এতে আমরা জানলাম, জাগলাম আর অংশত জয়ীও হলাম। আবার এক ক্ষেত্রে নজরুল বাস্তববোধের ও সমস্যা-সচেতনতার বিস্ময়কর পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন– বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ভারতে ধর্মীয় পরিচয় গৌণ করে না তুললে কেয়ামত তক মারামারি চলতেই থাকবে। তাই এক্ষেত্রে অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে দেশগত জাতীয়তাবাদ প্রচারকে তিনি বিশেষ ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এই মুখ্যব্রতে বাঙলাদেশে তিনি অতুলনীয় এবং এর উদযাপনেও তিনি অসীম ধৈর্য, অপরিমেয় সহনশীলতা ও প্রচুর অধ্যবসায়ের স্বাক্ষর রেখেছেন।
নজরুলের হৃদয় ছিল কুসুমকোমল। তার বাইরের ধর্মও ছিল আবার বজ্রকঠোর–তাই তাঁকে কুলিশ-কঠোর সংগ্রামী বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও তা তার যথার্থ পরিচয় নয়। কোনো প্রেমিকই কঠোর হতে জানে না, যদিও উত্তেজনাবশে নিষ্ঠুর আচরণও তার পক্ষে সম্ভব। সে কেবল আকস্মিক এবং ক্ষণিকের রূপ–স্থায়ীভাবে নয়। তাই তার প্রেমের কবিতায় তাঁকে পৌরুষের অভিমান-বর্জিত কেঁদে-লুটানো অসহায় প্রেমপ্রার্থী রূপে দেখি, যদিও তিনি বলেছেন এবং কাজে দেখিয়েওছেন;
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশী আর হাতে রণ তুর্য।
তবু এহো বাহ্য। অন্তরে তিনি প্রেমিক, দয়ালু ও হৃদয়বান। মানুষকে ভালোবাসাই তার স্বভাব, দরদই তাঁর পুঁজি। কোন্দল করা নয়–গান গাওয়াই তার ব্রত। কিন্তু তাঁর বীণা প্রতিকূল প্রতিবেশে তরবারি হল। সে-তরবারিই আমরা দেখলাম, সংগ্রামী বলেই তাঁকে জানলাম, মানবপ্রেমিক আমাদের দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল। বিরাট সম্ভাবনা বিপ্লবে, সংগ্রামে ও জাতীয়তাবোধ-প্রচারেই নিঃশেষ হল। নজরুলের ভাগ্যের বিড়ম্বনা!
নজরুল হলেন প্রমূর্ত প্রাণময়তা। প্রাণচঞ্চল এ মানুষটি যখন ক্রুদ্ধ হন তখন চিৎকার করেন; যখন আনন্দিত হন, তখন অট্টহাস্য করেন। গাইবার সময় উঁচুকণ্ঠেই গান; উল্লসিত হলে হৈ হৈ, করেন; আর হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে দীলে চোট পেলে শিশুর মতো অসহায়ভাবে কান্নাকাটি করেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও অপরিমেয় মমতার আধারস্বরূপ এই পুরুষটি সংগ্রামে আলীর মতো নির্ভীক, অন্তরে বুদ্ধের মতো ক্ষমাসুন্দর, প্রীতিতে ঈসার মতো উকণ্ঠ আর প্রণয়-ব্যাপারে কৃষ্ণের মতোই। নিঃসংকোচ। এমন মানুষকে ভালো না–বেসে পারা যায় না। তাই নজরুল আমাদের প্রিয়।
যে করেই হোক, নজরুল পূর্ববাঙালিদের প্রিয় ও সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যাপারে প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন। সেজন্যেই নজরুল-কাব্যের চর্চা যত বেশি হয়, ততই মঙ্গল। তাঁকে বারোয়ারিভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের রেওয়াজ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের আজকের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনজিজ্ঞাসায় নজরুলের কাব্যের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। যেজন্যে নজরুলের সগ্রাম, তা আজো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। নজরুলেরই সংকল্প–আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম-গণমানসে সংক্রামিত হোক।