পুথি সাহিত্যের ইতিকথা
০১.
পুস্তিকার বিকৃতিতে পুথি শব্দের উদ্ভব। নাসিক্য উচ্চারণে হয় পুঁথি। ছাপাখানা প্রবর্তিত হবার আগে গ্রন্থমাত্রই পুথি অভিধায় চিহ্নিত হত। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত অথবা জ্যোতিষ বৈদ্যক-গণিতশাস্ত্রের গ্রন্থ কিংবা পদ্মাবতী-সতীময়না-সয়ফুলমূলক প্রভৃতি সর্বপ্রকারের গ্রন্থেরই সাধারণ নাম ছিল পুথি। অতএব পুথি ছিল সেকালের গ্রন্থের বা একালের বই-এর প্রতিশব্দ।
ছাপাখানার বহুল ব্যবহার এবং প্রসারের ফলে এদেশে ছাপাবই গ্রন্থ, পুস্তক কিংবা বহি নামে অভিহিত হতে থাকে, আর হাতে-লেখা পুরোনো গ্রন্থগুলো পুথি অভিধায় নতুন তাৎপর্য লাভ করে। যেমন, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ছাপাকপি হল পুস্তক, গ্রন্থ কিংবা বহি, এবং এর হাতে-লেখা পুরোনো প্রতিলিপি অভিহিত হলে পুথি নামে। এমনি করে, পুথি হয়ে উঠল ইংরেজি Manuscript-এর বাঙলা পরিভাষা। হিন্দুসমাজে নতুন-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিধা-নিরূপণ পর্ব এখানেই শেষ হল। যদিও সাধারণ অর্থে Manuscript বা Script নামে যে-কোনো আধুনিক রচনার পাণ্ডুলিপি নির্দেশ করাও অবিহিত নয়।
কিন্তু মুসলমান সমাজে নাম-নিরূপণের জের চলে ১৯৪০ সাল অবধি। তার কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত ১৮৫০-এর পরে বটতলার মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বহু মুসলমান এগিয়ে আসেন। মুসলমান সমাজে তখনো ইংরেজিশিক্ষার প্রসার ঘটেনি বলে আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কাজেই স্বল্প-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের চাহিদা মেটানোর জন্যে তারা মধ্যযুগের সাহিত্য এবং মধ্যযুগীয় রসে ও আঙ্গিকে রচিত ফরমায়েশি গ্রন্থ ছেপে বাজারে ছাড়তে থাকেন। আবার একই গ্রন্থ শায়েরের নাম পালটে তথা ভণিতা বদল করে ছাপানো অর্থলোভী প্রতিযোগী প্রকাশকদের পেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ কারণে ছাপাগ্রন্থেও ছহি বড়–পুঁথি কথাগুলো মুদ্রিত থাকত। তাই এই ছাপাপুথি আর হাতে-লেখা পুরোনো প্রতিলিপি বা পাণ্ডুলিপির পার্থক্য নির্দেশক শব্দ নির্মাণের কিংবা চয়নের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ফলে ছাপাপুথি অর্থে পুঁথি আর হাতে-লেখা পুথি বলতে কলমীপুঁথি নাম চালু হল। আবার বটতলার পুথি বলতে মধ্যযুগের এবং মধ্যযুগীয় ধারার যাবতীয় ছাপাগ্রন্থকেই নির্দেশ করে।
তাছাড়া অবিমিশ্র বাঙলায় রচিত পুথি এবং মিশ্রভাষারীতিতে লিখিত পুথির পার্থক্য বোঝানোর জন্যে শেষোক্তরীতির পুথিগুলোকে দোভাষী পুথি নাম দেয়া হয়। এই নাম কবে থেকে চালু হল, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না–তবে মুনশী রিয়াজউদ্দীন আহমদ ও মীর মশাররফ হোসেনকে দোভাষী পুথি কথাটি যেভাবে ব্যবহার করতে দেখি, তাতে মনে হয় উনিশ শতকের শেষ দশকেও তা নিত্য উচ্চারিত নাম। অবশ্য পাদ্রী লঙ এর নাম দিয়েছিলেন মুসলমানী বাঙলা মাঝি-মাল্লার ভাষা। ব্রুমহার্ট, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখ মৃত ও জীবিত অমুসলমান বিদ্বানেরা এই নামেই এই রীতির উল্লেখ করেছেন, আজো করেন।
.
০২.
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে কাজী দৌলত, আলাউল, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর, আবদুল হাকিম, হায়াত মাহমুদ প্রভৃতির অবিমিশ্র বাঙলায় রচিত কাব্যগুলোর প্রকাশনার আগ্রহ দোভাষীরীতি-প্রিয় প্রকাশকদের কমে যায়, সম্ভবত পাঠক-শ্রোতা মহলেও এগুলো জনপ্রিয়তা হারায়। এর অনুমিত কারণ দুটো। এক. এসব কাব্যের কলেবর স্থূল, ভাষা পরিসুত ও সংস্কৃতঘেঁষা, ভাব ক্ষেত্রবিশেষে দুরূহ, এবং অলঙ্কার বৈদগ্ধ্যাঙ্কিত। দুই. দোভাষীরীতি-প্রিয় প্রকাশকরা তর্জমা নয়–উর্দু রোমান্সগুলোর কাহিনীর সংক্ষিপ্ত পদ্যায়ন প্রকাশ করে ছাড়লেন বাজারে। পাঠক ও শ্রোতারা বিকল্প পাঠ্য-উপকরণের অভাবেই হয়তো নতুন রীতির পুথিগুলো কিনতে বাধ্য হল, কিংবা দোভাষী পুথির আদর বেড়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। কেননা এগুলো অবসরের এক বৈঠকেই শেষ করা সম্ভব, ভাবের দুর্বোধ্যতাও ছিল না, ছিল না শব্দের দুরূহতা। (কারণ শতেক হিন্দুস্তানী শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগেই এসব পুথি রচিত। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে প্রয়োগের আনুমানিক হার শতকরা ৩২টি)। তারপর এই আদলে নানা বিষয়ে কয়েকশত গ্রন্থ রচিত হয়েছে গত দেড়শ বছরের মধ্যে। আলাউল প্রভৃতির কাব্যগুলোকে বাজারছাড়া করে এগুলোই।
গণচাহিদা মিটানোর জন্যে রচিত প্রাকৃতজনের এ সাহিত্য যখন নগর-গ্রামের সর্বত্র চালু, তখন ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে আধুনিক জীবনচেতনা প্রবল হয়ে উঠে বাঙালি মুসলিম সমাজে। এই শতকের চতুর্থদশকেই তার শুরু। মুসলিম সমাজের দারিদ্র্য, মহাজনি, জমিদারি ও চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দু-সমাজের একাধিপত্য এবং সুদে-ঘুষে হিন্দু-সাধারণের সাচ্ছল্য মুসলমানদের ক্ষোভ, ঈর্ষা ও দারিদ্র্যদুঃখ বৃদ্ধি করে।
অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে এই অসম প্রতিযোগিতা হৃতসর্বস্ব পরাভূত মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনা করে তীক্ষ্ণ আর সংস্কৃতিক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রবোধ হয়ে ওঠে তীব্র। তখন বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য-সূত্র আবিষ্কারের প্রেরণাবশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজে এবং আজাদ পত্রিকা-অফিসে গড়ে ওঠে পাকিস্তান রেনেসা শোসাইটি। এখানেই শুরু হয় পুথির চর্চা। তাঁরাই মুসলিম রচিত আধুনিক সাহিত্য থেকে দোভাষী পুথির পার্থক্যজ্ঞাপক পুথি-সাহিত্য নামটি চালু করেন। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা এ ভাষাকেই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা তথা ঘরোয়া আটপৌরে ভাষা বলে প্রচার করলেন তাঁরা! কাজেই দোভাষী পুথি বলার আর উপায় ছিল না, সেক্ষেত্রে তাদের আন্দোলন ও উদ্দেশ্য দু-ই হত ব্যর্থ!
সেই থেকে গত পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে পুঁথি সাহিত্য বলতে মুসলমানেরা দোভাষী পুথিকেই নির্দেশ করে। অভিধার দিক দিয়ে পুঁথি সাহিত্য কথাটি অর্থহীন। কেননা, বই সাহিত্য যেমন হয় না, পুথি সাহিত্যও হওয়া উচিত নয়, কিন্তু এটি এখন একটি যোগরূঢ় বিশেষ নাম। সেজন্যে আর আপত্তি করা চলবে না। আজ পুথি সাহিত্য আর দোভাষী পুথি সমার্থক এবং একটি অপরটির প্রতিশব্দ।
ইদানীং দোভাষী পুথি নামটার ব্যবহার বেড়ে গেছে। কেননা যে প্রয়োজনে এ নামটি পরিবর্তিত বা লোপ করবার প্রয়াস ছিল, পাকিস্তানোত্তর যুগে তা অনুপস্থিত। কিন্তু এ রীতিকে দোভাষীরীতি বলতে কোনো কোনো বিদ্বানের আপত্তি আছে। তাঁদের মতে তথাকথিত দোভাষীরীতিতে মিশ্রণ ঘটেছে আসলে,–আরবি-ফারসি-তুর্কী, হিন্দুস্তানী ও বাঙলা শব্দের অতএব দ্বিভাষা নয়, অন্তত পঞ্চভাষার মিশ্রণ রয়েছে। কাজেই একে মিশ্ররীতি আখ্যাত করাই যৌক্তিক।
কিন্তু তাঁদের ধারণা যথার্থ নয়। কেননা এ-কথা আজকাল কেউ অস্বীকার করে না যে ভারতীয় ভাষায় কোনো আরবি শব্দই সোজাসুজি আসেনি, এসেছে ফারসির মাধ্যমে। ফারসি ও তুর্কী এদেশের ভাষায় গৃহীত হয়েছে শাসকদের প্রয়োগে ও প্রভাবে। ফারসি (কিছু তুর্কী) শব্দের আধিক্যে গড়ে উঠেছে আধুনিক উর্দু ভাষা, আর এর বিপুল প্রভাব রয়েছে হিন্দিভাষায়। এ দুটোর আদি সাধারণ নাম ছিল হিন্দুস্তানী এবং মুসলিম আমল থেকেই দিল্লী সাম্রাজ্যে Lingua Franca হিসেবে চালু ছিল এ ভাষা। এই হিন্দুস্তানী তথা উর্দুর সঙ্গে বাঙলার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের দোভাষীরীতি। অতএব, দোভাষীরীতিই এর যোগ্য ও যথার্থ অভিধা। একটি উদাহরণ নেয়া যাক। যদি বলি : There stands a rickshaw in front of Gulistan restaurant in the Jinnah Avenue.–এ বাক্যে জাপানি, ফরাসি, গুজরাটি, ফারসি ও ল্যাটিন শব্দ থাকা সত্ত্বেও একে ইংরেজি বলে জানি ও মানি। শব্দের জাতিনির্ণয় কিংবা ব্যুৎপত্তি নিরূপণ করা বক্তা কিংবা শ্রোতার সাধ ও সাধ্যের অন্তর্গত নয়। অপর ভাষার শব্দ আত্মস্থ করেনি, তেমন ভাষা জগতে নেই। কিন্তু তাতেই কোনো ভাষা মিশ্রভাষা হয় না। দোভাষীরীতিতে মিশ্রণ ঘটেছে বাঙলা ও হিন্দুস্তানীর। আর হিন্দুস্তানীতে আগেই মিশেছিল প্রচুর আরবি-ফারসি-তুর্কী শব্দ ফারসির মাধ্যমে। এখন বিদ্বানের বিশ্লেষণে যদি দোভাষীরীতির ভাষা অলক্ষ্যে প্রবিষ্ট আরবি, ফারসি ও তুর্কীশব্দ বের হয়, তাতে এ রীতির নাম পালটানোর কারণ ঘটে না। রচনায় আরবি-ফারসি তথা বিদেশী শব্দের বাহুল্যই রচনাশৈলীকে দোভাষী করে না, যদি তা-ই হত তাহলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ–সবাই দোভাষী শায়ের বলে পরিচিত হতেন। অতএব দোভাষী রীতির বৈশিষ্ট অন্যবিধ। একে মুসলমানী বা ইসলামী বাঙলা কিংবা খিচুড়ি বাঙলা বলাও ঐ একই কারণে অসঙ্গত।
.
০৩.
সত্যনারায়ণ এদেশের লৌকিক দেবতা। মুসলিম প্রভাবেই এ দেবতার উদ্ভব। শাসিত হিন্দুশাসক মুসলমানের প্রীতি ও প্রসন্নদৃষ্টি লাভের বাঞ্ছবশে এ দেবতা সৃষ্টি করেছে। মুসলমানেরা এঁকে পীরের মর্যাদা দিতে দ্বিধা করেনি। আসলে প্রমূর্ত সত্যই (Truth) সত্যনারায়ণ তথা সত্যপীর। সত্যপীরের পূজা-শিরনী উপলক্ষে এদেশের দুঃখী জনগণ এক মিলন-ময়দানে একত্রিত হতে চেয়েছে, খুঁজেছে দুর্যোগে-দুর্ভোগে যন্ত্রণায়-নির্যাতনে নিশ্চিত আশ্রয়,জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা। সত্যনারায়ণ মূলত মুসলমান পীর, সে কারণে অবাঙালি,–এ ধারণা ছিল হিন্দুমনে বদ্ধমূল। তাই সতেরো শতকে কবি কৃষ্ণরামদাস যখন রায়মঙ্গল (১৬৮৭) রচনা করেন, তখন দক্ষিণরায়ের প্রতদ্বন্দ্বী বড় খা গাজী এবং উভয়ের মান্যজন সত্যনারায়ণের উক্তিতে ভাঙা হিন্দুস্তানী ও বিকৃত বাঙলা ব্যবহার করেন তিনি। পাত্রপাত্রীর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সংলাপের ভাষা প্রয়োগ নাটকের বিশেষ আঙ্গিক। কৃষ্ণরামদাসের রায়মঙ্গলে এই নাট্যরীতির অনুসরণ ছিল! তাঁর প্রদর্শিত রীতি প্রায় নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন সত্যনারায়ণ পাঁচালির পরবর্তী রচয়িতারা। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখ কবি বিদ্যাসুন্দর কাব্যেও মাধবভাটের জবানিতে এমনি ভাষা প্রয়োগ করেছেন, যখন মাধবভাট বিদ্যার পণের কথা ঘোষণা করেছে উত্তরভারতীয় রাজদরবারগুলোতে। ভারতচন্দ্রের মানসিংহ খণ্ডেও মানসিংহ-জাহাগীরাদির সংলাপের ভাষা এমনি মিশ্র করে তৈরি। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষ্ণরাম, ভরতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, বিদ্যাপতি, রাধাচরণ গোপ প্রভৃতি হুগলী, বর্ধমান, হাওড়া ও চব্বিশ পরগনার লোক তথা বন্দর এলাকার অধিবাসী।
এভাবে দোভাষীরীতি হিন্দুকবিদের লেখনীপ্রসূত হলেও এর বহুল প্রচলন ও জনপ্রিয়তার জন্যে ফকির গরীবুল্লাহর (১৭৬০-৮০) প্রতিভা ও পরিচর্যার প্রয়োজন ছিল। তিনিই প্রথম দোভাষীরীতি প্রয়োগে তার সব-কয়টি গ্রন্থ রচনা করেন। একে তো তাঁর নিজের বুলি ছিল এ রীতির পরিপোষক, তার উপর ব্রজবুলির মাধুর্য আর উপযোগও হয়তো তার অবচেতন প্রেরণার উৎস ছিল। তাকে প্রথম অনুসরণ করেন সৈয়দ হামজা (১৭৮৮–১৮০৫)। তারপরে মালে মুহম্মদ, মুহম্মদ খাতের, জনাব আলী, আবদুর রহিম, মনিরুদ্দিন, আয়েজুদ্দিন, মুহম্মদ মুন্শী, তাজউদ্দিন, দানিশ, আরিফ, রেজাউল্লাহ, সাদ আলী, আবদুল ওহাব প্রভৃতি প্রায় শতাধিক শায়ের আজ অবধি কয়েকশ কাব্য রচনা করেছেন এ ভাষা-শৈলীর প্রয়োগে।
.
০৪.
হ্যালহেড ১৭৭৮ সনে রচিত তার বাঙলা ব্যাকরণের ভূমিকায় বলেছেন, বাঙলা ক্রিয়াপদযোগে আরবি-ফারসি শব্দবহুল বাক্য ব্যবহারই ছিল তাঁর সমকালে সংস্কৃতিবানতার পরিচায়ক।
আবার ১৮৫৫ সনে পাদ্রী লঙ তাঁর গ্রন্থ-তালিকায় (Descriptive catalogue of Bengali Books) লিখেছেন : আরবি-ফারসিবহুল ভাষা মাঝিমাল্লাদের মধ্যেই প্রচলিত এবং এটি মুসলমানী বাঙলা, আর এ ভাষায় রচিত সাহিত্য মুসলমানী বাঙলা সাহিত্য।
সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখলে দুটো তথ্যই নির্ভুল বলে মানা যাবে। ১৭৭৮ সনেও দেশে মুসলিম প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল, তাই সে-যুগের শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান ফারসি মিশ্রিত ভাষায় কথা বলতে গৌরববোধ করত, আর তা দরবাররি ভাষার বহুল চর্চায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, যেমনটি একালে ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি মিশানো বাঙলা বলে : ডাক্তার blood examine করে report দিয়েছেন, একটা medicine ও prescribe করেছেন। কিন্তু তবু মনে হয় exact diagonosis হয়নি। আজকাল হাসপাতালে admission না নিলে ভালো treatment আর regular diet ও নিখুঁত nursing-এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। রাজনারায়ণ বসুদের মতো রুচিবান রক্ষণশীলদের নিন্দা সত্ত্বেও আজও শিক্ষিত লোকমাত্রই ঘরে-বাইরে এমনি মিশ্রভাষাতেই কথা বলে। ১৮৩৫ সনে ফারসি নিঃশেষে হারায় দরবাবি ভাষার মর্যাদা ও অধিকার। আর ১৮৫৫ সনে কলকাতা শহরে নগণ্য ছিল না ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত লোকের সংখ্যা। তার উপর সুন্দর গদ্যশৈলী সৃষ্টি-লক্ষ্যে কেরী থেকে বিদ্যাসাগর অবধি লিখিয়ে লোকদের অর্ধশতাব্দব্যাপী সচেতন ও সুপরিকল্পিত সাধনা বাঙলাকে কেবল সংস্কৃত-ঘেঁষা নয়–করে তুলেছিল প্রায় সংস্কৃত-সম। কাজেই নগরের মুসলমান ও গঙ্গাভাগীরথীর মাঝিমাল্লাদের মুখেই এ এককালের নগরবন্দরের বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় ভাষা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, তাতে বিস্ময়ের নেই কিছু।
.
০৫.
দোভাষীরীতির উদ্ভবের একটি অনুমিত ইতিহাস আছে। যে-কারণে এবং যেভাবে উর্দুভাষা অবয়ব পেয়েছে, এও গড়ে উঠেছে অনেকটা সেভাবেই।
তুর্কী বিজয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে মুসলিম সংস্কৃতির ও ধর্মের প্রভাব পড়তে থাকে এদেশে। তেরো-চৌদ্দশতক থেকেই ফারসি দরবাবিভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল। ফলে, জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের বুলিতেও নতুন ভাব ও বস্তু নির্দেশক কিছু সংখ্যক ফারসি-তুর্কী এবং সেগুলোর মাধ্যমে আরবি শব্দ মিশে যায়। তাই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের সাহিত্যিক ভাষাতেও আমরা পাচ্ছি গোটা বারো ফারসি-তুর্কী শব্দ। এদেশে ফারসির চর্চা বৃদ্ধি পায় মুঘল শাসনকালে; শিক্ষিতমাত্রই একালের ইংরেজি-জানা লোকের মতোই জানত ফারসি। তার উপর প্রশাসক ও পদস্থ চাকুরেরা ছিল সাধারণত উত্তরভারতীয় ও ইরানি। এদিকে হিন্দুস্তানী ভাষায় বিপুল হয়ে উঠে ফারসি প্রভাব এবং কথ্য উর্দু চালু হয় সতেরো শতকেরও আগে, আর শালীন সাহিত্যের বাহনের মর্যাদা পায় উর্দু সতেরো শতকের শেষার্ধ থেকেই। দক্ষিণভারতে দাখিনী উর্দুর উদ্ভবও ঘটে এভাবে।
আবার গৌড়, পাণ্ডুয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি নতুন-পুরোনো শাসন-কেন্দ্রের মতো নতুন-জাগা বন্দর হাওড়া-হুঁগলী-কলকাতায়ও ঘটে বিদেশী লোকের সংখ্যাধিক্য! স্থায়ী বাসিন্দাও হয়ে যায় এদের অনেকেই। ফারসি-উর্দুভাষী বিদেশীর প্রভাবে স্থানীয় জনগণের মাতৃভাষাও হতে থাকে বিকৃত। আজো সেই বিকৃত বাঙলা ও বিকৃত হিন্দুস্তানী চালু রয়েছে উক্ত সব অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে। বড়র অনুকরণ করা মানুষের স্বভাব। এজন্যেই বন্দর এলাকায় একদা পর্তুগীজ ভাষাও শিখেছিল আত্যন্তিক আগ্রহে। হুগলীতে নাকি ইরানি ব্যবসায়ী শিয়াদের আড্ডা ও বসতি শুরু হয় মুর্শিদাবাদেরও আগে এবং ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও হুগলীর খ্যাতি ছিল দূর-বিস্তৃত। উল্লেখ্য যে, দোভাষীরীতির আদিকবি ফকির গরীবুল্লাহও ছিলেন হুগলীর বালিয়া হাফিজপুরের লোক।
ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব সর্বগ্রাসী ও সর্বাত্মক হয় আঠারো শতকে যখন উটের পিঠে শেষ তৃণখণ্ডের মতো বাঙলার শাসনভার পেলেন শিয়া-মুর্শিদকুলি খান। বংশানুক্রমিক নওয়াবীতে পরিণত হয় তাঁর সুবাদারী। ইরানে শিয়া সাফাভী বংশীয় রাজত্বের অবসান ঘটে সতেরো শতকে। ফলে কৃপাবঞ্চিত ও পীড়ন-ভীত বহু শিয়া তখন দেশত্যাগ করে। শিয়া মুর্শিদকুলি খানের অনুগ্রহকামী বহু ইরানি শিয়া আশ্রয় নেয় বাঙলাদেশে। এ সময়ে শহর অঞ্চলে তথা মুর্শিদাবাদ ও হাওড়া-হুঁগলী বন্দর এলাকায় ফারসি-উর্দু ও শিয়া-সংস্কৃতির প্রভাব হয় গভীর ও ব্যাপক। এই প্রভাবেরই সাক্ষ্য রয়েছে হালহেডের উক্তিতে, চিঠিপত্রের ভাষায়, সত্যনারায়ণ পাঁচালি ও মর্সিয়ার জনপ্রিয়তায় এবং পাঞ্জাতন, পাঁচপীর প্রভৃতির সংস্কারে, মহররমের তাজিয়া-উৎসবের পার্বণিক প্রতিষ্ঠায় এবং ফকির গরীবুল্লাহ প্রবর্তিত দোভাষী রীতিতে। উত্তরভারতীয় আদলে যখন একটি দেশী মুসলিম সংস্কৃতি প্রকাশমান এবং উর্দুর মতো একটি মুসলিম ভাষা সৃজ্যমান, তখন হঠাৎ নতুন দিগন্তের সন্ধান দিল পলাশীর প্রান্তর। পালে লাগল সেই দিগন্তমুখী বাতাস। পরিণামদর্শী স্বস্থ হিন্দুরা বরণ করে নিল নতুনকে; দ্বিধাগ্রস্ত মুসলমান আকর্ষণ হারাল পুরাতনে, কিন্তু আগ্রহ জাগল না নতুনেও, তাই অর্ধ শতাব্দ ধরে তারা রইল নিঃস্ব ও বিমূঢ়। তখন তারা মনেও কাঙাল, ধনেও কাঙাল। যে-নওয়াবীর প্রচ্ছায় একদা শহর-বন্দরের মুসলমানরা নতুন জীবনস্বপ্ন রচনা করছিল, তা অলক্ষ্যে লাটগিরিতে পরিণত হওয়ায় এভাবে ব্যর্থ হল তাদের স্বপ্ন। স্বপ্ন উবে গেল, কিন্তু ঘোর কাটল না অনেকদিন। যদিও সম্ভাবনাটা উদ্ভাসিত হয়েছিল উত্তরভারতীয় আদলেই, কিন্তু সৌভাগ্যটা আর মিলল না। কেননা রূপায়ণের আর সাফল্যের সব আয়োজন যখন সমাপ্ত, তখন আকাশে দেখা দিয়েছে নতুন সূর্য। নতুন দিনে পুরোনো রচনা অতীতের ঘটনা।
অতএব দোভাষীরীতির উদ্ভব, পরিচর্যা ও বিকাশক্ষেত্র হচ্ছে কলকাতা, হাওড়া ও হুগলীর বন্দর এলাকা। এখানকার এটিই ছিল চলিত বাঙলা। রেজাউল্লাহ (১৮৬১), মালে মুহম্মদ, বেলায়েত ও দানিশ তাই দোভাষী রীতিকে বলেছেন এছলামি বাঙলা, কেউ অভিহিত করেছেন চলিত বাঙলা বলে, আর এর বিকাশ ও বিস্তারকাল হল ইংরেজ আমল। যা উচ্চবর্গের অভিজাতের পরিচর্যার অপেক্ষা রাখত, তা-ই নিম্নবিত্তের স্বল্পশিক্ষিত লোকের অনুশীলনে টিকে রইল শহরের সংকীর্ণ-সীমায়। এ যেন দুধের প্রত্যাশায় ঘোলের সাধনা অথবা দুধের সাধ ঘোলে মিটানো। কেননা এ সাধনায় যারা ব্ৰতী রইলেন, তাঁদের অসম্পূর্ণ শিক্ষা ও অপরিসুত শিল্পরুচি যোগ্য ছিল না কোনো সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করার সামর্থ্য ছিল না তাদের লক্ষ্য-চেতনা মনে জাগিয়ে রেখে এগিয়ে যাবার। এভাবে ব্যর্থ হল একটি জাতীয় স্বপ্ন, একটি ইপ্সিত সম্ভাবনা ও একটি মহৎ প্রয়াস।
উনিশ শতকের শেষপাদ থেকেই কেবল কলকাতা, হাওড়া ও হুগলী অঞ্চলের বাইরের লোক বটতলার প্রকাশকদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে ফরমায়েশি রচনায় দোভাষী রীতি প্রয়োগ করতে থাকেন। এ রীতি আজো অনুসৃত হচ্ছে প্রাকৃত মুসলমানদের জন্যে সৃষ্ট বটতলা সাহিত্যে–এমনকি মাওলানা আকরম খানের পাকিস্তান নামায় কিংবা কাজী আবুল হোসেনের জিন্নানামায় এবং আবুল মনসুর আহমদের আসমানি পর্দায়ও।
গৌড়, পাণ্ডুয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি শাসনকেন্দ্র ও বন্দর এলাকা ছাড়া, অন্যান্য অঞ্চলের দেশজ মুসলমানের কথ্য ভাষা তো বটেই, লেখ্যভাষাও চিরকাল অবিমিশ্র বাঙলা।
.
০৬.
বিদেশী শব্দের বহুল প্রয়োগ নয়–হিন্দুস্তানী বাঙ্গির অনুকৃতিই এ রীতিকে দোভাষী করেছে :
সর্বনাম–তেরা, মেরা, তুঝে, মুঝে ইত্যাদি।
বিশেষণ–এয়ছা, যেয়ছা, তেয়ছা, কেয়ছা, কব, কাহে, এত্তা, কেত্তা, হোড়া, ভি, আভি।
সংখ্যাবাচক–পয়লা, দোছরা, তেছরা প্রভৃতি।
অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয়–বিচে, খাতেরে, হুজুরে ইত্যাদি।
হিন্দুস্তানী ক্রিয়াপদ-তোড়, ডাল, ছোড়, নিকাল, গির, উতার, ভেজ, কিয়া, পাকড়, ঘুম ইত্যাদি।
ফারসি নামধাতু-খেসালিত, নেওয়াজিয়া, গোজারিয়া ইত্যাদি।
আরবি-ফারসি বহুবচন-বেরাদরান, এজিদান, শহীদান, মোমেনিন, চাকরান!
পুংলিঙ্গে স্ত্রীলিঙ্গের প্রত্যয় প্রয়োগ-বালা, প্রিয়া, উদাসিনী। পুরো
হিন্দুস্তানী বাক্যের প্রয়োগ :
তেরা মেরা শাদী হোগা আয়েন্দা জুমারাত
কাদের রহিম আল্লা রহমানের রহিম,
আলমের পালনে ওয়ালা হক্কের হাকিম।
নেক কামে রাজি সেহ বদি কামে দেক।
পহেলা দাওত ভেজে রসুল খাতেরে।
খানা বেগর দো ইমাম বড়া পেরেসান।
সেতাবি এ মোছফেরে লেহ পাকড়িয়া।
সুন্দর করে বলা কথাই কাব্য তথা সাহিত্য। শায়েরদের রচনায় সে-সৌন্দর্যের অভাব। কে না জানে, ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি হয় সূচিত শব্দের সুবিন্যাসেই। এ চেতনা স্বল্পশিক্ষিত পুথি শায়েরদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য। তাই অনবরত শব্দের নির্লক্ষ্য বিশৃঙ্খল প্রয়োগে বক্তব্যের অনর্গল প্রকাশই ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে, অমার্জিত সুরুচির প্রলেপে ঐ ভাষায় এবং ভঙ্গিতে একটা সামগ্রিক অশ্লীলতা যেন প্রকাশমান। অবশ্য এ হচ্ছে বিরূপ শিক্ষিত মনের কথা। কিন্তু যারা এ সাহিত্যের লেখক আর যাদের জন্যে লেখা তাদের মধ্যে এসব ব্যাপারে কোনো বিচলন হয়তো নেই। বহুকালের অনুশীলনে এটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বীকৃত ও সমাদৃত রীতি, বিশেষত বিকল্প রীতি যখন অনুপস্থিত এবং পাঠকেরও শিক্ষা আর রুচির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি।
মিশ্রভাষায় হালকা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনারীতির ঐতিহ্য এদেশেও সুপ্রাচীন। আমীর খসরু (ফারসি-হিন্দি), ভারতচন্দ্র (বাঙলা-ফারসি-হিন্দুস্তানী), দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত সেন (বাঙলা ইংরেজি), আহসান হাবীব (দোভাষীরীতি : ফরমান, হকনাম ভরসা, জঙ্গনামা), আবুল মনসুর আহমদ (দোভাষী রীতি : আসমানী পর্দা) প্রমুখ কবির রচনা তার সাক্ষ্য।
আবার ইরানি কবি নিজামীর সিকান্দরনামা এবং বাঙালি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবির বহু উৎকৃষ্ট কবিতা বিদেশী শব্দবহুল।
অতএব, শব্দের প্রয়োেগ-নৈপুণ্য বা কুশলতার উপরই কাব্যের উৎকর্ষ নির্ভর করে এবং ব্যবহার-যোগ্যতাই ঔচিত্য ও উপযোগের নিয়ামক ও পরিমাপক।
দোভাষী শায়েরা প্রাকৃতজনের কবি। তাই পরিশীলিত মানসের শিল্পরুচি এবং সুন্দর ও মহৎ জীবনের মাহাত্ম্যচেতনা কিংবা জীবন-জিজ্ঞাসা তাদের রচনায় অনুপস্থিত।
.
০৭.
দোভাষী সাহিত্য পাঁচটি ধারায় বিভক্ত?
(ক) প্রণয়োপাখ্যান : সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, ইউসুফ জোলেখা, চন্দ্রভান, চন্দ্রাবতী, গুল-হরমুজ, গুল-সনোবর, গুলে বকাওলি, মধুমালতী, মৃগাবতী-যামিনীভান, লায়লী মজনু, আলেফ লায়লা প্রভৃতি। এগুলো উর্দু গ্রন্থেরকৃচিৎ ফারসি ও হিন্দি-অওধী কাব্যের স্বাধীন অনুবাদ তথা কাহিনীর স্বাধীন অনুসৃতিমূলক। এগুলোর মধ্যে রূপকথা শ্রেণীর গল্প-কথন প্রয়াস আছে, বাস্তব জীবনবোধের কোনো পরিচয় বা জীবনের কোনো তাত্ত্বিক চেতনার বা রূপের উদ্ভাস নেই। বাঙালি রচিত বা অনূদিত এ সাহিত্যে বাঙলার প্রকৃতি বা সমাজ, বাঙালি জীবনের সমস্যা কিংবা যন্ত্রণা বা উল্লাসের কোনো ছাপ নেই। আছে কেবল আঙ্গিকের ও রসের গতানুগতিকতা এবং ব্যক্তিমনের স্পর্শনিরপেক্ষ যান্ত্রিক পরিচর্যা।
(খ) যুদ্ধকাব্য : জঙ্গে খয়বর, জঙ্গে ওহুদ, জঙ্গে বদর, শাহনামা, আমির হামজা, সোনাভান, জৈগুন, কারবালা যুদ্ধ, কাসাসূল আম্বিয়া প্রভৃতি কাব্যে রসুল, আলি, হামজা, হানিফা, হোসেন প্রমুখ ইসলামের উন্মেষযুগের বীরদের কাফের-দলন এবং ইসলাম প্রচারকাহিনী বিবৃত। এসব যুদ্ধকাব্যে রোমান্সের তথা প্রণয়-রসের অবতারণা থাকলেও এগুলো মূলত জেহাদী প্রেরণার কাব্য। কোনো স্বার্থবুদ্ধি নয়–ইসলাম প্রচার-প্রীতিই প্রেরণার উৎস। তাঁদের এক হাতে কোরআন আর এক হাতে তরবারি, মুখে রয়েছে বেদীনের প্রতি তাদের আহ্বান : হয় কোরআন বরণ কর, নয়তো তরবারির মোকাবেলা কর। তাঁরা কাফের-পূজ্য দেবতাদের বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব কাব্যে স্বধর্মের ও স্বজাতির অতীত গৌরব স্মরণে উল্লাসবোধের আভাস আছে, অবশ্য সে-উল্লাস হচ্ছে আত্মপ্রত্যয়হীন নিঃস্ব দুর্বলের আত্মীয়-গৌরবে আত্মপ্রসাদলাভের বাঞ্ছাজাত এবং এতে রয়েছে বর্তমান আর্তনাদকে অতীত আস্ফালনে ঢাকা দেবার প্রয়াস–দুর্দিনে আত্মপ্রবোধ ও স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা।
(গ) পীর পাঁচালী : পীর পাঁচালিগুলো শায়েরদের মৌলিক সৃষ্টি, যে-অর্থে মঙ্গল কাব্যগুলো মৌলিক সে-অর্থেই অবশ্য। কেননা এখানেও রয়েছে পুচ্ছগ্রাহীর অনুসৃতি। পীর পাঁচালি দুই শ্রেণীর : (১) ঐতিহাসিক ব্যক্তি নির্ভর ও (২) কাল্পনিক।
(১) মোবারক, গোরাচাঁদ, ইসমাইল গাজী, খাঞ্জা খা গাজী (খান-ই জাহাঁ খান), সফি খা গাজী শাহ শফিউদ্দিন (খা?)] ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এঁরা হিন্দুর লৌকিক দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী কাফের-মর্দন ও ইসলামপ্রচারক পীররূপে কল্পিত। অতএব এঁরা মঙ্গল কাব্যের দেবতার আদলে সৃষ্ট এবং এঁদের ভূমিকাও অভিন্ন।
(২) শাসক-শাসিতের তথা হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম সমন্বয়, সদ্ভাব ও প্রীতির ভিত্তিতে এসব মৌলিক তথা কাল্পনিক পীর সৃষ্ট। জীবন ও জীবিকার এবং পীড়ন ও নিরাপত্তার অভিন্নতাবোধ থেকেই এই প্রীতি ও মিলন-প্রয়াসের জন্ম। তাই এসব পীর হিন্দুদেবতারই প্রতিরূপ : সত্যনারায়ণ-সত্যপীর, কালুরায়-কালুগাজী, বনদেবী-বনবিবি, মছন্দর-মছলন্দি, ওলাদেবী-ওলাবিবি, দক্ষিণরায়-বড় খাঁ গাজী, উদ্ধারদেবী-উদ্ধার বিবি, বাস্তদেবী-বাস্তুবিবি। এঁদের মধ্যে সত্যপীরই আদি ও প্রধান ঐক্যদূত। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হল মিলনসেতু। মিলন-ময়দানের তিনিই ইমাম।
(ঘ) ধর্মশাস্ত্রীয় রচনা : শরীয়ত ও মারফত বিষয়ক বহু গ্রন্থও রচনা করেছেন এরা? মোহাম্মদী বেদতত্ত্ব, ফকির বিলাস, নসিয়তনামা, মুর্শিদনামা, তম্বিয়াতুন্নেসা, আহকামুল জুমা, সেরাতুল মুমেনীন, একশত বত্রিশ ফরজ, নামাজ মাহাত্ম্য, হাজার মোসায়েল, তরিকতে হক্কানি, হকিকতে সিতারা প্রভৃতি এ শ্রেণীর গ্রন্থ।
(ঙ) বিবিধ :তাজকিরাতুল আউলিয়া, আবু সামা, ইরিস নামা, যুগীকাঁচ, ফালনামা, গান, কিয়ামতনামা প্রভৃতি।
প্রণয়োপখ্যান ছাড়া অন্য শ্রেণীর রচনাগুলো কম-বেশি ধর্ম-সংপৃক্ত। এবং প্রাকৃতজনের এ ইসলাম হচ্ছে লৌকিক ইসলাম। অর্থাৎ স্থান-কালে প্রভাবজ এবং দেশী মুসলমানের মানস-প্রসূত এ ইসলাম নতুন অবয়বে প্রকাশমান। এই তথ্য মনে রেখে বলা যাবে দোভাষী সাহিত্য স্বধর্মনিষ্ঠ, আদর্শবাদী ও জাতীয় ঐতিহ্যগর্বী এবং অদ্ভুত কল্পনাপ্রিয় স্বাপ্নিক কবির রচনা। অসম্পূর্ণ শিক্ষার দরুন নীতিবোধ ও জীবনাদর্শ সম্বন্ধে একটি লোকায়ত স্কুলবোধের প্রতিচ্ছবি পাই এঁদের রচনায়। দেশ, জাতি ও ধর্মের ইতিকথা এবং সমাজ-সংস্কৃতির একটি অতি স্কুলবোধ ও রূপ এ সাহিত্যে প্রতিফলিত।
অতএব, আঠারো-উনিশ শতকী দোভাষী সাহিত্য আমাদের নগর-বন্দর এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন-মানসের তথা জীবনচর্যার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিভূ! এ সাহিত্যই উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ অবধি, শতকরা নিরানব্বইজন বাঙালি মুসলমানের মনে জাগিয়ে রেখেছে ইসলামী জীবন ও ঐতিহ্য চেতনা। সাহিত্য রচনার শেষ লক্ষ্য যদি সমাজকল্যাণ হয়, তাহলে মানতেই হবে দোভাষী সাহিত্যই গত একশ বছর ধরে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানের জগৎ ও জীবন ভাবনার নিয়ামক। এই দিক দিয়ে এ সাহিত্যের সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিমেয়! এ ভাষাও দাখিনী উর্দু ও উত্তরভারতীয় উর্দুর মতো একটি মুসলিম ভাষা হতে পারত–এ উল্লাসবোধ, কিন্তু হল না–এ ক্ষোভই দোভাষী রীতি চিরকাল জাগিয়ে রাখবে স্বজাতি ও সংস্কৃতিপ্রিয় মুসলিম ঐতিহাসিকের মনে।