নজরুল ইসলাম : এক বিরূপ পাঠকের দৃষ্টিতে
আমার এক বন্ধু আড্ডার আসরে সেদিন নজরুল-কাব্য সম্বন্ধে তার যে-বক্তব্য পেশ করেছেন, এখানে আমি তার সার সংকলন, করে দিচ্ছি। দিচ্ছি এজন্যে যে এতে ভাববার ও ভাবনার বিষয় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে তর্কের অবকাশ।
তিনি বললেন, নজরুলকে কোনো মতেই বিদ্রোহী বলা চলে না। কেননা, সুব্যবস্থা ও ন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ যে করে সে-ই বিদ্রোহী। নজরুলের সমকালীন সমাজ ও সামাজিক বিশ্বাস সংস্কার যাদের পছন্দসই ছিল তাদের চোখেই নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, আর যারা নিশ্চিত ব্যবস্থায় নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছে, ভালো-মন্দের অনুভূতি নেই–তাদের কাছে তিনি বিপ্লবী। আর আমরা-যারা তাঁর মতাদর্শের সমর্থক আমাদের কাছে তিনি সংগ্রামী বা যিহাদী কবি–তিনি মুযাহিদ।
তাকে মানবতার কবিও বলাও ভুল। মানবতা বিশ্বমানবপ্রীতির দ্যোতক। মানুষ অবিশেষের প্রতি প্রীতি তাঁর ছিল না। মার কোনো সন্তান দুবৃত্ত হলে মা বেদনা বোধ করেন, কিন্তু তার মৃত্যু কামনা করেন না বা নির্মম শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন না। গৌতমবুদ্ধকে বলা যায় মানবতার পূজারী। নজরুল বঞ্চিত উৎপীড়িতের পক্ষ নিয়ে উৎপীড়কের বিরুদ্ধ সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন, চেয়েছেন তাদের বুকের রক্ত পান করে প্রতিশোধ নিতে। কাজেই তাঁকে বড়জোর নির্যাতিত মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা যায়।
আবার তাও বলা যায় কি-না তলিয়ে দেখবার মতো। কেননা, নজরুলের ঠিক ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ব্রত ছিল না। তিনি নিজেও বঞ্চিতের একজন, দুঃখ- লাঞ্ছনায় তার জীবনও হয়েছিল দুঃসহ। কাজেই তার সংগ্রামের মূলে নির্জলা লাঞ্ছিত-বাৎসল্য ছিল না–আত্মরতিও ছিল। এজন্যেই তাঁর কাব্যে উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা বেশি, আদর্শবাদের আবেগের চাইতে চিত্ত-বিক্ষোভের পরিমাণ অধিক। রবীন্দ্রনাথ ধনীর দুলাল। তাই তাঁর এবার ফিরাও মোরে, দুরন্ত আশা দেশের উন্নতি অপমান প্রভৃতি কবিতায় তিরস্কার আছে, ভৎর্সনা আছে, সদিচ্ছাও রয়েছে, কিন্তু ক্ষুব্ধচিত্তের উত্তেজনা নেই! ফলে রবীন্দ্রনাথের আবেদন হয়তো হৃয়দবানদের ভাবিয়ে তুলেছে, কিন্তু নজরুলের কথার আগুনে-গোলা পাঠককে করেছে বিক্ষুব্ধ এবং সগ্রামী।
আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি বলে প্রচার করি। অন্যত্র যেমনই হোক, সুধীসভায় তাঁকে জাতীয় কবি বলে পরিচিত করাবার চেষ্টা অনুচিত কর্ম। কেননা জাতীয় কবির যে-সংজ্ঞা আমাদের জানা আছে, তাতে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি হতে পারেন না। সগ্রামী আদর্শেও না, বোধেও না।
নজরুলই বাঙলাদেশে একমাত্র লেখক, যার অবচেতন মনেও হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। তাঁর কথায়, কাজে ও আচরণে তিনি যে উদার মন ও মতের পরিচয় দিয়েছেন তা একান্তই বিস্ময়কর। বিশুদ্ধ-বুদ্ধি প্রত্যেক মানুষেরই অনুকরণীয়। এদিক দিয়ে নজরুলের জুড়ি নেই। মানুষ নজরুল ও কবি নজরুলের চরিত্র ও কাব্যের কেবল এদিকটি স্মরণে রাখলেও যে-কোনো মানুষেরই আত্মিক উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ে। এ দুর্লভ উদারতার একটি কারণ হয়তো এই যে, সেদিনকার ভারতের স্বাধীনতা এবং শোষিত জনের মুক্তিই তার কাম্য ও সাধ্য ছিল, তাই তিনি কোনো তুচ্ছ আবেগকে প্রশ্রয় দেননি–আদর্শ ও লক্ষ্যে বিপর্য ঘটবে বলে।
এই মনোভাব ছিল বলেই নজরুল ও তাঁর কাব্যকে সহসা কোনো বিশেষ সাম্প্রদায়িক ছাপে চিহ্নিত করা যায় না। নিতান্ত এ যুগের লোক না হলে ফকির লালনের ন্যায় নজরুলের জাতিত্ব ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিতর্কের কারণ ঘটত। তাঁর কাব্যে ত যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে। শ্যামাসঙ্গীত; মুসলিম ঐতিহ্যের পাশে রয়েছে হিন্দু পুরাণ; আল্লাহ্-রাসুলে বিশ্বাসের সাথে পাই তাঁর দেবদ্বিজে ভক্তি। তার পারিবারিক জীবনেও ঘটেছে হিন্দু-মুসলিম মিলন। সে-মিলন। সমন্বয়ভিত্তিক নয়–সংযোগমূলক। এতে দুটো জাতির ধার্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পারস্পরিক শ্রদ্ধার সূত্রেই গড়ে উঠেছে। এও কারুর চোখে ভালো, আবার কারুর কাছে মন্দ।
জীবনচর্যায় নজরুলে মুসলমানী যতটুকু আছে, হিন্দুয়ানী আছে তার চেয়েও বেশি। তিনি মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাস রাখেননি। তার আস্থা ছিল হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তায়। রবীন্দ্রনাথ তবু মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বার্থ স্বীকার করেছেন, নজরুল তাও করেননি। রবীন্দ্রনাথকে ত্যাগ করতে হলে নজরুলকেও রাখা চলে না।
অবশ্য নজরুল ছিলেন বাঙালি ও মুসলমান। বাঙালি হিসেবে দেশী প্রাচীন ঐতিহ্যে ছিল তাঁর জন্মগত অধিকার। আর ধর্মীয় ঐক্যের সুবাদে আরব-ইরানের ঐতিহ্যে জন্মেছে তার আকর্ষণ। তাই তাঁর মধ্যে আমরা হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি সমান আগ্রহ লক্ষ্য করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালি আর ভারতের বাইরে হিন্দু নেই। কাজেই তাঁর দেশী ও ধর্মীয় ঐতিহ্য ছিল অভিন্ন এবং দুটোই আপাতদৃষ্টিতে হিন্দুয়ানী। একের প্রশংসা ও অপরের নিন্দার কারণ ঘটেছে এভাবেই। ভুল বোঝাবুঝির অবকাশও মিলেছে এখানেই।
আঙ্গিক হচ্ছে কাব্যের দেহ, অনুভূত ভাব হল কাব্যের প্রাণ। দুটোই আপেক্ষিক বস্তু। কারণ দেহহীন প্রাণের কল্পনা অলীক আর প্রাণহীন দেহ নিরর্থক। কাজেই কাব্যের আঙ্গিক কাব্যের আত্মার মতোই মূল্যবান এবং অপরিহার্য নজরুল-কাব্যে আঙ্গিক সৌন্দর্যের অভাব রয়েছে। অথচ সাধারণ্যে রূপ যে গুণের চেয়ে চড়া দামে বিকায়–তা কে না জানে! কবিতায় বক্তব্য প্রকাশে তিনি যত ব্যস্ত, অঙ্গ সৃষ্টিতে তত মনোযোগী নন। ফলে যে-পরিমাণে দ্যুতি রয়েছে, সে-অনুপাতে অঙ্গ-সুষমা নেই। এজন্যেই নজরুল-কাব্যে ভাবে, ভাষায় ও আঙ্গিকে ক্রম-উৎকর্ষ বা ক্রমবিকাশ কিংবা ক্রমপরিণতি দুর্লক্ষ্য। প্রতিভাও যে পরিশীলন ও অনুশীলনের অপেক্ষা রাখে, নজরুল কাব্যই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বক্তব্য প্রকাশে অর্থাৎ মত প্রচারেও তিনি মন দিয়েছিলেন যতটুকু, ততটুকু মনন দেননি। ফলে তার বক্তব্যের পেছনে কোনো তত্ত্ব, বিজ্ঞান বা দর্শনের পষ্ট ভিত্তি নেই। এ যুগে কবিমাত্রই কবি-দার্শনিক বা কবি-বিজ্ঞানী কিংবা কবি-তাত্ত্বিক। শাদা কথায়; নীতি, ধর্ম, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্পর্কীয় একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বা দর্শনানুগ মতবাদ থাকে আজকালকার কবি-সাহিত্যিকের রচনার পটভূমিকায়। নজরুলেরও মত আছে, বক্তব্য আছে, কিন্তু তা পষ্ট করে কোনো সমাজবিজ্ঞানের বা রাষ্ট্রাদর্শের বা নীতি-দর্শনের ধারণা দেয় না। তিনি চেয়েছেন পীড়নমুক্ত সুস্থ ও স্বস্থ মনুষ্যসমাজ। সে-ই যে বলেছি, তাঁর বক্তব্যের পেছনে মনন ছিল না, কেবল ক্ষুব্ধ চিত্তের আবেগই ছিল; তাই তিনি সুমুখে যাকেই পেয়েছেন তাকেই শত্রু বলে জেনেছেন এবং আক্রমণ করেছেন। তলিয়ে দেখেননি যে, পীড়ক-পীড়িত দুই-ই পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্রকলেরই by product। যন্ত্র আর যন্ত্রী বদল না হলে ধনীর ধনী না হয়ে উপায় নেই, নির্ধনেরও ধনাগমের পথ নেই। ঘুষ শুধু আমরা দিতে বাধ্য হইনে, নিতেও বাধ্য থাকি। আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। যন্ত্রের পরিবর্তন না হলে যন্ত্রজ পদার্থের রূপ-রস বদল হতেই পারে না। কাজেই যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষিত হয়েছে, তারা আসলে সংগ্রামের লক্ষ্য হবার যোগ্য নয়, এর নাম শ্ৰেণী-সংগ্রাম–ভাঙার গান। আদর্শ প্রতিষ্ঠার সাধনা এ নয়–গড়ার কারিগরিও নয়। এ কারণেই লোকে বলে তাঁর কাব্যে ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই। উদার সমাজ দর্শন বা সমাজবিজ্ঞান এতে নেই।
বলেছি, নজরুল কাব্যে আঙ্গিকের প্রতি অবহেলা আছে, তবু উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা তথা আবেগ আন্তরিক হলে বাণীর আপনিতেই একটা ছন্দ গড়ে ওঠে–বক্তব্য হয় মর্মস্পর্শ, তাতে কাব্য-সুষমাও ফুটে ওঠে, নজরুল কাব্যেও তাই রয়েছে। তাঁর কাব্যে সামগ্রিক সুষমা না থাক–দ্যুতি আছে, স্থানে স্থানে দীপ্তি আছে এবং তা হীরেমুক্তোর মতো উজ্জ্বল। বিদ্রোহী, সিন্ধু, দারিদ্র্য প্রভৃতি কবিতাই তার প্রমাণ। আবার এ উচ্ছ্বাস-প্রবণতার জন্যেই নজরুল সনেটও রচনা করতে পারেননি এবং তার গদ্যও উচ্ছ্বাসের পঙ্কে মজেছে।
একে তো নজরুল সম্বন্ধে অধিকাংশ পাঠকের আজো বিস্ময় ও উত্তেজনার ঘোর কাটেনি, তার উপর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নজরুল সম্বন্ধে আমাদের উচ্ছ্বাস দেখানোর গরজও অনুভূত হয়, ফলে তাঁর কাব্যের নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাই আজো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কবি আজো বেঁচে আছেন এবং কালের হিসেবেও পুরোনো নন।
কবির জিঞ্জির কাব্যখানা ইসলামি কবিতার সংকলন বলে সাধারণ্যে প্রচারিত। আসলে এর Spirit তা নয়। কবি পরাধীন দেশের লোক ছিলেন, বিদেশী-বিজাতির শাসন-শোষণের প্রতি ছিলেন হাড়ে হাড়ে চটা। বলা যায়, তার সংগ্রামের অন্যতম মুখ্য প্রতিপক্ষ বিদেশী শোষক। তাঁর ব্রতই ছিল এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। তাই আফ্রিকা-এশিয়ার পরাধীন ও উৎপীড়িত জাতি এবং দেশগুলো ছিল তাঁর সহানুভূতি ও সমবেদনার পাত্র। এদের জাগরণে কবি উল্লসিত হয়েছেন, অভিনন্দনে সে-উল্লাসের অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। এ হচ্ছে সমদুঃখী ও সমব্যথী আত্মীয়ের সাফল্যে উল্লাস– মুসলমান বলে নয়, পরাধীন ও উৎপীড়িত বলে। এরা যে মুসলমান তা আকস্মিক।
নজরুল আসলে প্রেমিক, প্রতিকূল পরিবেশই তাঁকে সগ্রামী ও মারমুখো করেছে। সে খবর তাঁর মুখেই শোনা যাক্ : যার ইচ্ছায় আজ দেহের মাঝে দেহাতীতের নিত্য-মধুর রূপ দর্শন করেছি, তিনি যদি আমার সর্ব অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমার আনন্দময়ী প্রেমময়ী শক্তিকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে এই বিদ্বেষ জর্জরিত…. ভেদজ্ঞানে কলুষিত, অসুন্দর অসুরনিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর করে যাব। এই তৃষিতা পৃথিবী বহুকাল যে প্রেম, যে অমৃত, যে আনন্দরসধারা থেকে বঞ্চিত; সেই আনন্দ, সেই প্রেম সে আবার পাবে। আমি হব উপলক্ষ্যমাত্র। সেই সাম্য, অভেদ শান্তি, আনন্দ, প্রেম আবার আসবে আমার নিত্য পরম সুন্দর পরম প্রেমময়ের কাছ থেকে। …. বিশ্বাস করো, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসেনি– আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না ….।
এ কারণেই কবির বেদনা-করুণ কণ্ঠে শোনা গেল-বীণা মোর শাপে তব হল তরবার। মানুষের বিরুদ্ধে–সমাজাদির বিরুদ্ধে কবির যে অভিযোগ, তা আজকের মানুষ আমাদেরও। তাই নজরুল, আমাদের হৃদয়রাজ্যের রাজা, নজরুল আমাদের প্রিয় সেনাপতি। নজরুল যেসব সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, সেসবের সমাধান-পন্থা আজো আমাদের দৃষ্টির বাইরে। তাই নজরুলের কাব্যে আমাদের মনের কথা–প্রাণের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এসব কারণেই নজরুল-কাব্য আমাদের প্রিয় ও পাঠ্য এবং আমাদের প্রেরণার উৎস। চিত্ত-বিক্ষোভের নিঃসঙ্কোচ প্রকাশান্তের যে দাহ-শান্ত ভাব–তাও হয়তো তাঁর কাব্য থেকে পাই।
—-বিবৃত কথাগুলো আমার বন্ধুরই উক্তি। এগুলোর সঙ্গে আমার মনের বা মতের মিল আছে। মনে না-করাই বাঞ্ছনীয়। এও বলে রাখছি, তার কোনো কথাই আমি বানিয়ে-বাড়িয়ে বা কমিয়ে লুকিয়ে বলিনি।