সাহিত্যে আর্দশবাদ বা অর্ডিন্যান্স

সাহিত্যে আর্দশবাদ বা অর্ডিন্যান্স

সাহিত্যের রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক অভিব্যক্তি দেওয়া আজো সম্ভব হয়নি, যদিও এ পথে সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথেই চেষ্টা চলে আসছে। তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, সাহিত্য মূলত উপভোগের বস্তু; অনুভূতিজাত উপলব্ধিই এর চরম কথা; ব্যাখ্যা করে বুঝে নেয়া বা বুঝিয়ে দেয়ার বস্তুই এ নয়। এমনও অনেক রচনা আছে যার বস্তু আছে–ভাষাও ত্রুটিহীন অথচ তা সাহিত্যই নয়! যেমন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলি। সুতরাং সাহিত্য যে কী বস্তু, তার স্বরূপ কী প্রকার, তা ব্যক্ত করা ব্যাখা করা সম্ভব নয়। শুধু বলা চলে, সাহিত্য রস-স্বরূপ। সে-রসের বহু সংজ্ঞা প্রচলিত আছে সত্যি, কিন্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য একটিও নয়; শুধু উপলব্ধি এবং উপভোগ-সম্ভাব্যতাই এর একমাত্র পরিচয়। এছাড়া প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ও রসগ্রাহিতামূলক যত সংজ্ঞা আছে সবগুলোই বাহ্য-অন্তরপরিচয়বাহী নয়। এগুলোকে আহা-আহা মরি-মরি ধাচের আবেদনমূলক সংজ্ঞা বললে একটু খটকার কারণ ঘটে বটে–কিন্তু আসলে এগুলো তা-ই।

অতএব, সাহিত্য বিচারে সার্বজনিক কোনো নিরিখ নেই। পাঠকের রুচি, বিদ্যাবুদ্ধি, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি-প্রবৃত্তি অনুসারে সাহিত্যের রসরূপ উপলব্ধ হয়। এখানে ভালো লাগাটাই বড় কথা। ইংরেজি গানের সুর-তাল যতই উৎকৃষ্ট হোক, সাধারণ বাঙালির কাছে তার কোনোই আবেদন নেই। তার কাছে–বাঙলা গান জগতের সর্বসঙ্গীতের বাড়া। তেমনি শেলির কবিতার বা শর নাটকের তীক্ষ্ণ মনীষাদীপ্ত সংলাপের মূল্য ইংরেজি ভাষার ব্যুৎপত্তিহীন পাঠকের কাছে কানাকড়িও নয়। এমন পাঠকের কাছে নজরুল কী দ্বিজেন রায়েরই কদর। শেলি বা শ অপাঠ্য, অন্তত দুম্পাঠ্য তো বটেই। সুতরাং পাঠকসাধারণের মতামতের উপর নির্ভর করে সাহিত্যের উত্তৰ্ষ-অপকর্ষ সম্বন্ধে ডিগ্রি-ডিসমিস দেয়া চলে না। এমন দেখা গেছে, সবেচেয়ে ভালো বইয়ের কদর সবশেষে হয়েছে। তবে সাহিত্য ব্যাপারে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে–যেসব পাঠকের বিদ্যা-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও রস-জ্ঞানে বিশ্বাস ও ভরসা আছে, তাদের মতামতকে চরম এবং যথার্থ মনে করে সাহিত্যের সাধারণ পাঠকগোষ্ঠী বুঝে বা না-বুঝে রচনা-বিশেষের সমাদর করে। কিন্তু এমন বিজ্ঞ সমালোচক ও রসবেত্তারাও শুধু ভালো লাগা বা মন্দ লাগার বড় জোর কারণ দর্শাতে পারেন, কিন্তু নির্দেশ দিয়ে সৃষ্টি করাতে পারেন না–যেমন যেসব উপাদানে বৃক্ষের জীবন ও দেহ গঠিত, সে-সব বিশ্লেষণ করা সম্ভব, কিন্তু বৃক্ষ তৈরি করা অসম্ভব।

এ পর্যন্ত গেল রসের কথা। তারপর আসে আদর্শবাদের বিষয়।

স্রষ্টা নিজের ভাব-চিন্তা এবং বুদ্ধি ও বোধি দিয়ে সৃষ্টি করেন। তাঁর স্বকীয় অনুভূতি-উপলব্ধি বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। বস্তুত মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়। লেখক তাঁর রুচি, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি ও বুদ্ধি-বোধিজাত আত্মদৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন এবং এভাবে সর্বসমন্বয়ে মনের মধ্যে জগৎ ও জীবনের যে একটি সংহতরূপ গড়ে উঠে, তা-ই প্রকাশিত হয় তাঁর রচনায়। তার মতামতও একান্তভাবে তাঁরই। অপরের সাথে সে মতামতের মিল ঘটে নিতান্ত আকস্মিকভাবে। অতএব ব্যক্তি-বিশেষের মনের উপর বাহ্য প্রভাব যতই গভীর ও ব্যাপক হোক না কেন, তা যদি স্বাঙ্গীকরণ ব্যতীত প্রকাশিত হয়, তবে একে অজীর্ণরোগের সাথেই তুলনা করা উচিত। তা রচনা হবে–রসায়ত্ত সাহিত্য হবে না। সুতরাং তার জন্যে কারো ভাবনার প্রয়োজনই নেই। অতএব দেখা যাচ্ছে–লেখক-বিশেষের স্বকীয় ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও প্রজ্ঞালব্ধ যে মতামত রচনায় প্রকাশিত হয়, তা-ই লেখকের আদর্শ। এদিক দিয়ে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব–প্রত্যেক লেখকেরই এক একটি আদর্শ রয়েছে। কারো রয়েছে সমাজাদর্শ, কারো রাষ্ট্রাদর্শ, কারো বা ধর্মাদর্শ। তবে এ-কথায় বোধ হয় দ্বিমত নেই যে, হোমার থেকে শ অবধি কেউ সভা ডেকে পরামর্শ করে তাদের সাহিত্যাদর্শ স্থির করেননি। তাঁদের যিনি যেভাবে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন-বুঝেছেন, সেভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

এ যুগে যে-কোনো আদর্শ সম্বন্ধে কিছু বলা মানেই বিপদ ঘাড়ে করা। সুতরাং আমি সে-চেষ্টা করব না। আমি অন্য উপায়ে আমার বক্তব্য পেশ করব। এতে অবশ্য কথাগুলো কিছুটা অবৈজ্ঞানিক হবে, তবু হয়তো বুঝতে কষ্ট হবে না।

পূর্বেই বলেছি, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা সাহিত্যে যখন যিনি যা প্রচার করেন তাতে বাহ্য প্রভাব যতই থাক না কেন, তাকে প্রচারকের নিজের অনুভূতি-উপলব্ধি বা বিশ্বাসের ফল বলেই ধরে নিতে হবে। বহু পুরাতন পরিত্যক্ত আদর্শ কেউ যদি নতুন করে প্রচার করে, তবে বুঝতে হবে তা পুরাতনের পুচ্ছগ্রাহিতা নয়, স্বকীয় নতুন উপলব্ধির প্রকাশ মাত্র। এখানে আমাদের আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মানুষের রুচি-প্রকৃতির যতই বৈচিত্র্য থাক না কেন, মানুষের বুদ্ধি-প্রজ্ঞা অপরিসীম নয়। ফলে মানুষ এ-পর্যন্ত জগৎ ও জীবন ব্যাপারে যে-কয়টি মৌল-শক্তির উৎসের ধারণা করতে সমর্থ হয়েছেন, আমার অবৈজ্ঞানিক অভিধায় সেগুলোর নাম দেওয়া যাক সমাজসত্তা, ব্যক্তিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তা, ধর্মসত্তা, নাস্তিক্যসত্তা, নীতিসত্তা, নৈর্ব্যক্তিক রসসত্তা (মানে দার্শনিকতা), নীতিলেশহীন বিচিত্রসত্তা ইত্যাদি। স্ব স্ব জ্ঞান-মনীষা দিয়ে কেউ ব্যক্তি-মহিমা, কেউ ধর্ম-মহিমা, কেউ রাষ্ট্র-মহিমা, কেউ সমাজ-মহিমা, কেউবা নাস্তিক্য-মহিমা, আবার কেউ বা ব্যষ্টির বিচিত্র অনুভূতিরস-মহিমা প্রচার করেছেন। এ-কথা যথার্থ যে, প্রত্যেকেই স্ব স্ব উপলব্ধিরই অভিব্যক্তি দিয়েছেন, কেউ কারো আদেশ-নির্দেশ বা উপদেশ-পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কেননা নিজের বুদ্ধিগ্রাহ্য বা হৃদয়গ্রাহ্য না হলে কেউ কারো অনুকরণও করতে পারে না। অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো হয় আমরা সবাই ভুল ধারণা পোষণ করছি অথবা আমরা সবাই সত্য কথাই বলছি। এ-নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু মীমাংসা পাওয়া যাবে না, সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব। কাজেই ধরে নেয়া যাক মানব-বুদ্ধি ও প্রকৃতি যেমন বিচিত্র, সত্যও তেমনি একক নয়–বহু ও বিচিত্র এবং সত্য অরূপ অর্থাৎ তার বিশিষ্ট কোনো রূপ নেই। কেননা জগৎ, জীবন, বস্তু ও অনুভূতি নিছক বাস্তব নয়, বাস্তব সম্পর্কে ব্যক্তিক ধারণার প্রসূনমাত্র। তাই কোনো দুইজনের দুনিয়া এক রকম নয়।

অতএব, যে-কেউ কিছু বলবেন বা লিখবেন তাতে তার অচেতন, অবচেতন বা সচেতন মনের বিশেষ দৃষ্টি বা মত বা আদর্শ প্রকাশ পাবে। এ হচ্ছে নিতান্ত স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি–প্রয়াস বা প্রভাবপ্রসূত নয়। মানুষের ব্যবহারিক গতিবিধিকে অর্ডিন্যান্স যোগে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব তো বটেই, সহজও। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত মনন-চিন্তন ধারাকে কোনো আদেশ-নির্দেশ-উপদেশের অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ করলে মননধারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কোনো বিশিষ্ট খাতে প্রবাহিত তো হবেই না, বরং বলপ্রয়োগে তা লুপ্ত বা ধ্বংস হতে বাধ্য। মানুষের মন-মননের উপর অর্ডিন্যান্স মারাত্মক অভিসন্ধি। আগের যুগেও এরূপ অর্ডিন্যান্স জারির লিপ্সা কারো কারো হয়েছিল। ফল কী হয়েছিল কারো অজানা নেই।

এ যুগে–এই জ্ঞানপ্রবুদ্ধ যুগেও নানা দেশে যেসব বিজ্ঞলোক মানুষের মনন-চিন্তনের উপর অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে প্রয়াসী, তাঁদের বিজ্ঞতায় অশ্রদ্ধা জাগা অস্বাভাবিক নয়। কারণ আমার কাছে যা সত্য ও সুন্দর, তা-ই একমাত্র সত্য এবং একমাত্র সুন্দর, আর সব মিথ্যা ও ক্ষতিকর–এমন ধারণা যার মনে বাসা বাঁধে, তাঁর জ্ঞান-মনীষায় আস্থা বা শ্রদ্ধা রাখা কোনো সুস্থমস্তিষ্ক লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অপরাপর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিধানের মতো সাহিত্যেও বিধিবিধান প্রয়োগের ধৃষ্টতা দেখা দিয়েছে। কোনো আদর্শে কী বিষয়বস্তু নিয়ে কিরূপ ভাষায় কোনো ছাদে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, পূর্বাহ্নে তার permit নিতে হবে নীতিবেত্তা ও নিয়ামকদের কাছ থেকে!

যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তাঁদের সৃষ্টির মূলে রয়েছে একাগ্র ধ্যান, অবিচলিত নিষ্ঠা, একান্ত বিশ্বাস এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। মনন ও প্রকাশের স্বাধীনতা জীবনের অন্যক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও হয়তো তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে এই-ই হচ্ছে সৃষ্টির উৎসমুখ। এই স্বাধীনতা যদি না থাকে, তবে সাহিত্য-সৃষ্টি অসম্ভব। হোমার, শেকসপিয়ার, শ বা সাদী-রুমীর সৃষ্টি এক আদর্শপ্রসূত নয়; তাতে মানুষের চিন্তা রাজ্যে সংঘাত ঘটেনি বরং মনোসঞ্চরণের ক্ষেত্র বিচিত্রতর ও প্রশস্ততর হয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তিবিশেষের কাছে জ্ঞানরাজ্যের সীমা-পরিসীমা নেই। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন পথে সে-জ্ঞান আহরণেই আরাম, আনন্দ এবং কল্যাণ। সে-কল্যাণ মানবসাধারণের। সাহিত্যক্ষেত্রে যারা বিধাতার আসনে বসে নির্দেশে ফরমায়েশি সাহিত্য সৃষ্টি করতে চান, তাঁরা জাতির-বৃহত্তর অর্থে মানুষের রসের ও উপলব্ধির ক্ষেত্রকে সংকীর্ণতর করে মনুষ্যসাধারণের সাংস্কৃতিক তথা মানবিক অধিকারই হরণ করছেন। লেখক-পাঠকের প্রতি এরচেয়ে বড় অবিচার, সাধারণভাবে মানুষের কাছে এরচেয়ে বড় বিপত্তি আর কিছুই নেই।

মানুষ প্রতিমুহূর্তে নিজেকে এবং জগৎকে নতুনভাবে উপলব্ধি করছে। তার সেই অপূর্ব বিচিত্র উপলব্ধির প্রকাশে জগৎ ও জীবন বৈচিত্র্যে সুন্দরতর ও বিস্তৃততর হচ্ছে। এভাবে মনোজগতে যে বিপ্লব অহরহ ঘটছে তাকে রোধ করা মানেই জীবনের অপমৃত্যু ঘটানো। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন আজকের নতুন ব্যাপার নয়। চিরকাল এমনিই হয়ে আসছে। যারা বিবর্তনকে বাধা দিয়েছে, সহজভাবে অভিনন্দিত করতে পারেনি, তারাই হতভাগ্য। কারণ পরিণামে তারাই ঠকেছে। যা আসবার তা আসবেই, যা ঘটবার তা না ঘটে যাবে না–তা বাধা যত বড়ই হোক, আর সাবধানতা যতই নিখুঁত থাক! সেজন্যেই সাহিত্যে যে-কোনো মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকাই বাঞ্ছনীয় এবং বিশেষ আবশ্যকতা ঈশ্বরবাদ হোক, অথবা ব্যক্তিবাদ, সমাজবাদ, রাষ্ট্রবাদ বা ধর্মবাদ হোক! এর মধ্যে যা রসায়ত্ত, যা সাহিত্য তা টিকে থাকবে, অন্য দশজনকে প্রভাবিতও করবে; যা নিঃসার তা যাবে–আবর্জনার মতোই লোকচক্ষুর আড়ালে ঢাকা পড়বে, তার জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারো নিজের বিশ্বাস ও খেয়ালখুশিমতো বিশ্বজগৎ ও বিশ্বমানবকে কোনো বিশেষ নিয়ম-নিগড়ে বাঁধতে যাওয়া শুধু বাতুলতা নয়, অদূরদর্শিতা এবং মুখতাও বটে।

তবু যদি কারো মন বুঝ না মানে, তবে বাধা দেয়া উচিত নিজের কণ্ঠ আরো চড়িয়ে–অন্যের কণ্ঠরোধ করে নয়। আগাছা যদি নষ্ট করতে হয়, তবে নিজেকে বটগাছ হতে হবে, অন্যথায় আস্ফালন ব্যর্থ ও দুঃখবহ হতে বাধ্য।