বুর্জোয়া সাহিত্য বনাম গণসাহিত্য
অত্যাধুনিক যুগে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রাদর্শের পরিবর্তন সাধনার্থ বিশেষ মত প্রচারের জন্যে এক ধারার সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে প্রচার সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য বা গণসাহিত্য। অধুনা দুনিয়াব্যাপী এই ধারার সাহিত্য-সৃষ্টিরই সাধনা চলছে। আধুনিক যুগে মানুষ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটন-জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। অধিকাংশ লোকের ডাল-ভাতের সংস্থান না থাকায় যেন তারা বুনিয়াদী শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর মনের উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধনবৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব-বিকাশক বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা বা শিল্পকলা ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন সম্ভব নয়।
তাই অধিকারবাদের লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। ব্যবহারিক জীবনে যে মনো-জীবন রয়েছে, তা দুঃখ-দৈন্য, অভাব-উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আজ লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত।
এইজন্যে সাম্প্ৰত-পূর্বযুগের সাহিত্যকে বলা হচ্ছে বুর্জোয়া সাহিত্য। প্রাক্তন জীবনবোধের মুকুরস্বরূপ এই সাহিত্য এবং সাহিত্যাদর্শ এখনকার পাঠকের নিকট সুপ্রাচীন ভগ্ন ইমারতের মতো পরিহার্য এবং উপেক্ষণীয়। প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধাবানদের কাছে যেমন নতুন হর্মের চেয়ে পুরোনো ভাঙা ইমারতের কদর অনেক বেশি, তেমনি মননধর্মীদের কাছেও প্রাক্তন সাহিত্যের মূল্য কম নয়। কিন্তু গণসাহিত্যবাদীরা বলেন–জীবন ধারণ ও জৈব-ক্ষুধা নিবারণের পক্ষে যা অপরিহার্য, তা-ই শুধু সাহিত্যে প্রতিফলিত হবে–এর অতিরিক্ত কিছু থাকলে তা হবে মাতলামি। সুতরাং এদের মতে শুধু তন্ময় (objective) বিষয়েই সাহিত্য রচিত হবে, মন্ময় (subjective) বিষয় নিয়ে বিলাস করবার দিন আর নেই। সরাব আর সাকি, প্রিয় আর প্রেয়সীর কাহিনী শুধু অবান্তর নয়–অনর্থ সৃষ্টিকারীও বটে। এঁরা বুঝতে চান না যে, যাকে আমরা জীবন বলি, তা-ও একটা অদৃশ্যবস্তু। দেহ নিশ্চয়ই জীবন নয়; জীবন মানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়-পরিধিতে উখিত অনভূতির সমষ্টিমাত্র। সে-অনুভূতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য-জগৎ থেকে শুধু উপাদান সংগ্রহ করে। এছাড়া জীবনের সাথে জগতের সম্পর্ক আর বিশেষ কিছুই নেই। নেই বলেই জগৎ ও জীবনের কোনো সর্বজনীন রূপ নেই, কেননা একই বস্তু বা ঘটনা বা দৃশ্য থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ও বিচিত্র অনুভূতি লাভ করে। তাই প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র জগৎ ও জীবন। গাছের কোনো দুটো পাতা একরূপ নয়–তবু তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য রয়েছে। তেমনি মানুষের মধ্যেও ভাব ও রুচির সাদৃশ্য আছে। এই সাদৃশ্যই হচ্ছে আমাদের পারস্পরিক মিলনের ভিত্তিভূমি। সে মিলন সামাজিক, ধর্মীয়, বা রাষ্ট্রীয় মিলন-আদর্শের ও অনুভূতির মিলন। সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা অনুভব করে যে-মন, তার চেয়ে অনুভূতির উপলক্ষ দেহ কী বড় হতে পারে? সুতরাং ডাল ভাতের জীবন অপরিহার্য হলেও সে-জীবন মানুষের কাম্য নয়। যেমন বৃক্ষমূল বৃক্ষ-জীবনের ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু ফল ফলায় যে-অংশ, সে-অংশের রসদ জোগানোতেই এর সার্থকতা। যে-মাটির উপর তাজমহল দাঁড়িয়ে, সে-মাটির গুরুত্ব অনেকখানি–তবু তার গুরুত্ব শুধু তাজমহলের ভিত্তিভূমি বলেই। তাজমহলই কাম্য-মাটি নয়, অতএব আদর্শ বা মতপ্রচার বিরহিত সাহিত্যের যে utility নেই বলা হয়–তাতে সত্যি কতটুকু?
এমনিতেই আমরা দেখতে পাই, সৌন্দর্য বস্তুটাই প্রয়োজনাতিরিক্ত। যেমন ইটের গাঁথুনিতেই ঘর তৈরি হয়, এতেই থাকা চলে অর্থাৎ প্রয়োজন মিটে, চূণকাম করে যে অনর্থক পরিশ্রম করা হয়, তাতে কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না। যেমন আমরা কাপড় পরি আব্রুরক্ষার জন্যে, রঙ আর কারুশিল্পের ঠিক প্রয়োজন নেই। সুতরাং সৌন্দর্য সৃষ্টিটা সবসময়েই ব্যবহারিক প্রয়োজনের বাইরে। কিন্তু সে-কি আরো গভীরতর প্রয়োজনের তাগিদ নয়? বস্তুত জৈব প্রয়োজনের যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আসল জীবনের চাহিদা আরম্ভ হয়। যারা art for arts sake আদর্শকে গহিত বলে নিন্দা করেন তারাও বক্তব্য বিষয়কে উপমা-অলঙ্কার সহযোগে সুন্দর (অর্থাৎ সাহিত্য) করে তুলতে চান! এই সৌন্দর্য-প্রীতির কারণ ও প্রেরণার উৎসের সন্ধান করলে অনেক অবোধ্য অস্বীকৃত কথাই উপলব্ধ ও স্বীকৃত হবে। বিশেষত প্রত্যেক কথারই একটা প্রতিক্রিয়া আছে, সেভাবে বিচার করলে নিছক রস সৃষ্টির জন্যে যে-সাহিত্য, তা-ও হৃদয়মনের বিকাশে ও প্রসারে সাহায্য করে নিশ্চয়ই।
বুভুক্ষাপীড়িত নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতার বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথার অভিযান চালানোর জন্যে প্রচার সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এ-যুগে অস্বীকার করা চলে না। নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যে ডাল-ভাতের দাবী স্বীকৃতি না পেলে দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ অকালে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে না–এ অতি সত্যি কথা। সুতরাং গণসাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি এ-যুগে অপরিহার্য। কিন্তু তবু রোগ-শোক, অভাব-উৎপীড়ন, অতৃপ্তি-অনটন, জরা-মৃত্যু, দুঃখ-বেদনা মনুষ্যজীবনে এবং জগতে নতুন কিছু নয়। এদের অনেকগুলো দুরতিক্রম্য বা অনতিক্ৰমণীয়। যদি কেউ ব্যবহারিক জীবনের এ দুঃখ-বেদনা-লাঞ্ছনাকে ভুলে থাকবার জন্যে মনোময় কল্পজগৎ সৃষ্টি করে মনকে মুক্তপক্ষ এবং হৃদয়কে বল্গাহীন করে ক্ষণেকের জন্যে হলেও জগতের রূপ-রস ও আনন্দ পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে উপভোগ করে, তবে তা-ই কী তার যথালাভ নয়? ব্যবহারিক জীবনের অভাবে উৎপীড়নে পৃষ্ট দেহের সাথে মন-প্রাণকেও বিক্ষত করে যন্ত্রণা বাড়ানোতে কী জীবন-রসের উৎস শুকিয়ে যায় না? তার চেয়ে কেউ যদি দেহকে পিষ্ট হতে দিয়ে মন-প্রাণকে যন্ত্রণার কবলমুক্ত রেখে কল্পনার রসলোকে আশ্রয় খোঁজে, তবে তার সেই পলাতক মনোবৃত্তি নিন্দনীয় হবার হেতু কী? মোহিতলাল বলেছেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ দীনদুর্বল সবি
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সে-জন বটে কবি। (বিধাতার বর)
রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল
সে সাধ ফুটিছে (এবং মিটেছেও) গানে।
বরং এ আদর্শ জীবনীশক্তি বর্ধক ও সগ্রাম-শক্তি (resisting power) প্রদায়ক। যারা আজ ক্ষোভে-উত্তেজনায় নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিকতার উপাসক হয়ে উঠেছেন, সে-ই অধিকারবাদের সংগ্রামীদলও উপলব্ধি করেন–জৈবক্ষুধার চেয়ে মনের ক্ষুধা অনেক তীব্র এবং স্কুল দৈহিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, সেই অনুভূতির জীবনই সত্যিকার জীবন এবং সে-জীবন রসলোক-বিহারী–ডাল-ভাতের কাতর নয়। জগতের রূপ-রস সে-জীবনেরই সাধ-আহ্লাদের উৎস এবং ডাল-ভাত সে-জীবনে পুষ্টির সহায়ক মাত্র।
এ-কথা স্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনে শত অভাব-দুঃখের মধ্যেও এমন মুহূর্ত আসে, যখন —
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে
ফুল মোরে ঘিরে বসে; কে
মনে না জানি জ্যোৎস্না প্রবাহ
সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবনভরা বাহু পাশে তার
বেষ্টনন করে কায়া।
জীবনকুঞ্জে–মনের বনে যে-বসন্ত আসে, তাকে ঠেকায় কে! বস্তুত গণ-সাহিত্যবাদী আর রস-সাহিত্যপন্থীদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন–তা হচ্ছে জীবনকে নির্বিঘ্নে উপভোগ করা। অতএব গণসাহিত্যবাদীদের ডাল-ভাতের সংগ্রাম সেই মনো-জীবন বা মনন-জীবনকে স্বচ্ছন্দে-নির্বিঘ্নে উপলব্ধি ও উপভোগ করবার জন্যেই। তারা আজ means (উপায় বা উপলক্ষ)-এর জন্যেই সংগ্রামরত, এই means (উপায় বা উপলক্ষ) যে end-এ (সিদ্ধিতে) পৌঁছাবে, তা অনুভূতির জীবন বা মনন-জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলবে। সুতরাং তাদের গণসাহিত্য অস্থায়ী সংগ্রামী সাহিত্য মাত্র–স্থায়ী রস-সাহিত্য নয়। যেদিন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন হবে–তাঁদের দাবীদাওয়া মিটবে, সেদিন তাদের হাতে যে-সাহিত্য পাব, তা হবে উপেক্ষিত বিগত যুগের সাহিত্যেরই পুনরাবর্তন। সেদিন আবার শিউলি, বকুল, যূথী, গোলাপ, নার্গিস, হাসুহানার গন্ধে এবং দ্রাক্ষাবনের বুলবুল ও বসন্তের কোকিলের ধ্বনিতে সাহিত্যকুঞ্জ মুখরিত হয়ে উঠবে! তাও হবে নতুন-পুরাতনের অনুবর্তন নয়। কেননা নতুন মানুষের মনে পুরোনো কখনো ফিরে আসে না স্বরূপে।