বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের খসড়াচিত্র

বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের খসড়াচিত্র

০১.

বাঙালি যে গোত্র-সঙ্কর জাতি তা সবই স্বীকার করেন। সঙ্করজাতির ভাষাও মিশ্রভাষা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা পুরোপুরি হয়নি। বাঙলা ভাষায় এদেশের সব গোত্রীয় অধিবাসীর বুলির উপাদান থাকলেও এর মূল কাঠামো গড়ে উঠেছে আর্যভাষার এক বুলি ভিত্তি করে।

নৃতাত্ত্বিক পরিভাষা ব্যবহার না করে সাধারণভাবে বলা যায়, এদেশের অধিবাসী হচ্ছে কোল, মুণ্ডা, দ্রাবিড় ও মোঙ্গল গোত্রীয় লোক। কাজেই অনুমান করতে হবে যে আধুনিক বাঙলা নামের আর্যবুলির আগে এদেশে বিভিন্ন গোত্রীয় বুলিগুলো চালু ছিল; এবং গোত্রগুলোর পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ও লেনদেনের প্রয়োজনে হয়তো কোনো প্রবল কিংবা সংখ্যাগুরু গোত্রের ভাষা Lingua Franca-রূপে ব্যবহৃত হত। কিন্তু তার কোনো আভাস পাইনে। এতে বোঝা যায় তাদের যে কেবল লিখন-পদ্ধতি জানা ছিল না তা নয়, তাদের সাংস্কৃতিক মানও নিতান্ত আদিম পর্যায়ে ছিল। মুণ্ডা, কুরুক, বোরো, সাঁওতাল, নাগা, খাসী, কুকী প্রভৃতি গোত্রের আজকের দিনের ভাষায় ও আচারে-সংস্কারে তার পরোক্ষ আভাস মেলে। কবে যে এদেশে আর্য-বসতি ও আর্যপ্রভাব শুরু হয়, ইতিহাস তা সঠিক বলতে পারে না। তবে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বিশেষ করে জৈন-বৌদ্ধ মত প্রচারের জন্যেই বাঙলা দেশে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটে। সম্প্রতি ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন এদেশে আর্যভাষা অন্ততপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দী হতে প্রচলিত আছে। তার এ মতের সমর্থনে তিনি ইরান হইতে ভারতবর্ষে আর্যভাষা ও সংস্কৃতি দুই বা ততোধিক ধারায় আসিয়াছিল এবং অর্বাচীন ধারার কাছে ব্রাত্য নামে অভিহিত প্রাচীন ধারার ব্রাত্যরাই বাঙলা দেশে আর্য-সংস্কৃতির প্রথম বাহক ছিল বলিয়া মনে করেন। অনার্য ভাষা ও সংস্কৃতির নিদর্শনের বিরলতাই তাঁকে সম্ভবত অনুমানে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের ধারণায়, জৈন-বৌদ্ধমত প্রচারসূত্রেই বাঙলা দেশে উল্লেখ্য আৰ্যবসতি ঘটে এবং এ সময় থেকেই জৈন-বৌদ্ধমতের মাধ্যমে এদেশবাসী আর্যভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে। এই দুই মতবাদের উদ্ভব-ক্ষেত্র ছিল বিহার। আধুনিক বিহার গড়ে উঠেছে সেকালের অঙ্গ, বিদেহ ও মগধ রাজ্য নিয়ে। দেব-দ্বিজ ও বেদদ্বেষী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমত হচ্ছে আর্য ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনার্য অভ্যুত্থান। গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং অনার্য বংশ-সস্তৃত; তা তার জন্মস্থান, বংশের নাম ও চেহারা থেকে বোঝা যায়। অনেক জৈন তীর্থঙ্করের জন্মস্থান, সাধনা আর প্রচারক্ষেত্রও বাঙলা দেশ তথা পশ্চিমবঙ্গ। অতএব কারুর অস্বীকৃতির আশঙ্কা না করেই বলা চলে, আজীবক ও জৈন-বৌদ্ধমত সম্বল করেই উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্যভাষা ও সংস্কৃতি বাঙলা দেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে আর অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েই তা স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পায়। জৈনমত সম্ভবত উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যায়নি, কিন্তু বৌদ্ধমত বাঙলার সর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পাল আমলে বৌদ্ধমত রাজধর্মের মর্যাদা ও অধিকার পেয়ে বিচিত্র বিকাশের সুযোগ লাভ করে। এ কারণে পাল রাজত্ব বাঙলার ও বাঙালি সংস্কৃতির সোনার যুগ।

তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে বাঙলা দেশে আর্যভাষা চালু হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ ভাষার নাম রেখেছেন প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত। তাঁর অনুমান গৌতম ও মহাবীর এ ভাষায় কথা বলতেন। অতএব জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে এ ভাষারই লিখিত রূপ পাই। আমরা জানি কোনো বুলিরই লেখ্য ও কথ্যরূপ এক হতে পারে না। লেখ্যভাষা গভীর ও বিচিত্রভাববাহী হয়ে শালীন ও মার্জিত রূপ ধারণ করে। এ যদি সত্য হয়, তাহলে এ সময়কার কথ্য প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত কিছুটা বিকৃত ছিলই। ডক্টর শহীদুল্লাহ্ সম্প্রতি অর্ধমাগধী ও মাগধী প্রাকৃতের সমস্তরের গৌড়ী প্রাকৃতকেই বিহারী, উড়িয়া ও বঙ্গকামরূপী বুলির জননী বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। তার মতে :

বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের খসড়াচিত্র

আর জর্জ গ্রিয়ার্সন ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাঙলা ভাষার উদ্ভব। ডক্টর শহীদুল্লাহর গৌড়ী প্রাকৃতে ও অন্যান্য মাগধী প্রাকৃতে কেবল নামেই তফাৎ, কেননা ডক্টর শহীদুল্লাহ্ বিহারকে গৌড়ী- প্রাকৃতের আওতাভুক্ত করেছেন। অথচ এই বিহারের এক অংশই ছিল মগধ। বিশেষ করে তার গৌড়ী-প্রাকৃত এবং গিয়ার্সন ও সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মাগধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলো অভিন্ন। তাঁর এই মত প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে তিনি মাগধী প্রাকৃতকে দেশছাড়া করেছেন, বেদিয়া-জিপসির ভাষাতেই খুঁজেছেন এই ভাষার জীবন্ত বিবর্তন। আর্যভাষা বাঙলা দেশে যখনই আসুক, এসেছে বিহার হয়েই। মৌর্য ও গুপ্তবংশের শাসন-কেন্দ্র আর্যাবর্ত ঘেঁষা বিহারের আর্যসংস্কৃতি পুষ্ট ও আভিজাত্য-গী অধিবাসীরা গৌড়ীয় আসুরিক ভাষার প্রভাবে পড়েছিল, এই কথা ভাবতে অদ্ভুত ঠেকে। এমনকি পাল আমলে বাঙলার সংস্কৃতি-কেন্দ্র ছিল বাঙলার বাইরে–বিক্রমশীলা, উড্ডিয়ানা ও নালন্দায়। কাজেই প্রাচ্য প্রাকৃতের আদি মঞ্জিল মগধের নামে একে মাগধী প্রাকৃত বলাই সঙ্গত। ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো; জনে জনে, যুগে যুগে ও অঞ্চলে অঞ্চলে তার বিচিত্র বিকৃতি ঘটেছে। সেই বিকৃতির উপর আত্যন্তিক গুরুত্ব আরোপ করেই° ডক্টর শহীদুল্লাহ গৌড়ী-প্রাকৃত কল্পনা করেছেন এবং দণ্ডী প্রমুখ পণ্ডিতের উক্তিতে সমর্থন খুঁজেছেন। আজকের বাঙলা দেশের আঞ্চলিক বুলিগুলোর ধ্বনি ও রূপে এত তফাৎ যে, এগুলো যে একই জননীর সন্তান তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য; তাই বলে কি আমরা প্রত্যেক অঞ্চলের জন্যে পৃথক প্রাকৃত, অপভ্রষ্ট ও অবহট্ঠ কল্পনা করব?

ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, কথ্য সংস্কৃত হইতে কথ্য প্রাকৃত এবং তাহা হইতে বাঙলার উৎপত্তি। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কথ্য সংস্কৃতের যে রূপ চলিত ছিল তাহা ক্রমে প্রাচ্য-প্রাকৃতে রূপান্তরিত হয় খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দের আগেই। এই প্রাচ্য-প্রাকৃত কালক্রমে বাঙলা-বিহার উড়িষ্যায় যে রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহাকেই বলা হয় প্রাচ্য অপভ্রংশ।

এই প্রাচ্য অপভ্রংশের অর্বাচীনরূপ অবহটঠ। অবহটঠ পরে (আনুমানিক ১০০০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি) তিনটি আঞ্চলিক আধুনিক আর্যভাষায় পরিণত হয়। পশ্চিমে বিহারী, উত্তর-পশ্চিমে মৈথিলী এবং পূর্বে বাঙলার উড়িয়া। বিহারী ভাষা হইতে আধুনিক ভোজপুরী (পশ্চিম-বিহারে) ও মগহী (দক্ষিণ-বিহারে) আসিয়াছে। বাঙলা হইতে আরো পরে অসমীয়া উৎপন্ন হইয়াছে।

সংস্কৃত এ নামেই প্রকাশ এটি কথ্য হতে পারে না। এ বিষয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতই সুচিন্তিত ও সুযৌক্তিক বলে মনে করি। তাঁর মতে লেখ্যবৈদিক ভাষার পাশে কথ্য যে সমকালীন ভাষা ছিল, সেই প্রাচীন বুলি থেকে ক্রমবিবর্তনে আমাদের বাঙলা ভাষা গড়ে উঠেছে। পীঠিকায় এরূপ দাঁড়ায়২৪ :

১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (১২০০ –৮০০ খ্র. পূ.)।

২ প্রাচীন ভারতীয় কথ্য আর্য বা আদি প্রাকৃত (৮০০ –৫০০ খ্রী. পূ.)

৩. প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (৫০০ খ্র. পূ. –২০০ খ্র.)

৪. গৌড়ী প্রাকৃত (অপর মতে মাগধী) (২০০ –৪৫০ খ্র.)

 ৫. গৌড়ী অপভ্রংশ (অপভ্রষ্ট) (৪৫০ –৬৫০ খ্রী.)

৬. প্রাচীন বাঙলা যুগ (৬৫০ –১২০০ খ্রী.)

 ডক্টর সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে :

১. ১৫০০/১২০০ –৫০০ খ্র. পূর্বাব্দ। ২. ৬০০ –২০০ খ্র. পূর্বাব্দ। ৩, ২০০ খ্রী. পূ. –২০০ খ্রীস্টাব্দ ৪. ২০০ –৬০০  ৫. ৬০০-১০০০  ৬. ১০০০-১২০০ 

কথ্যভাষা বিভিন্ন স্তরের, গোত্রের ও অঞ্চলের লোকের মুখে বিচিত্র বিকৃতি লাভ করে। আর কথ্য ভাষা যখন লিখিতও হয়, তখনো কথ্য ও লেখ্য কথায় তফাৎ কম থাকে না। লিখিত কথ্যের ব্যাকরণ চেতনাজাত বিশুদ্ধি ও শব্দচয়ন ও বিন্যাস প্রসূত লাবণ্য কথ্য বুলিতে দুর্লভ এবং কথ্যভাষা বা বুলিই দ্রুত পরিবর্তনশীল। লেখ্য ভাষা কৃত্রিম উপায়ে অবিকৃত রাখার চেষ্টা চলে। তাই লেখ্য ভাষার রূপান্তর অত্যন্ত মন্থর। সেজন্যে আমাদের ধারণায় প্রাচীন ভারতিক কথ্য বুলি থেকে কথ্য প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত; তার থেকে কথ্য মাগধী প্রাকৃত এর গৌড়ীয় বিকৃতি, অপভ্রষ্ট; তার থেকে অর্বাচীন অবহটঠ, তার থেকে প্রাচীন বাঙলা, উড়িয়া ও আসামী ভাষা উদ্ভূত হয়েছে।

আমাদের বাঙলা কিংবা সংস্কৃত অবিমিশ্র আর্যভাষা নয়। অনেক অনার্য শব্দ, ধ্বনি, রূপতত্ত্ব বা পদরূপ Morphology ও বাক্যরীতি বা পদক্রম syntax এ ভাষা গোড়া থেকেই আত্মস্থ করেছে। এগুলোর উত্তরাধিকার তো রয়েইছে, তাছাড়া প্রাকৃত, অপভ্রষ্ট ও নব্য ভারতীয় বুলিও বিভিন্ন স্তরে নানা অনার্য উপকরণ-উপাদান নিয়ে হয়েছে পুষ্ট। এমনি করে সংস্কৃত যুগে উত্তরভারতীয় অনার্য, বিদেশী পহলভী ও গ্রীক শব্দ সংস্কৃত শব্দ-সম্ভারকে ঋদ্ধ করেছে। বাঙলায় এসব ছাড়াও দেশী কোল, দ্রাবিড়, মোঙ্গল, মুণ্ডা, বিদেশী ফারসি এবং এর মাধ্যমে আরবি ও তুর্কী; আর পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজি এবং এর মাধ্যমে ইয়োরোপীয় ল্যাটিন আদি যাবতীয় ভাষার শব্দ, একালে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠার ফলে পৃথিবীর উল্লেখ্য সব ভাষারই দু-চারটি করে শব্দ বাঙলা ভাষায় প্রবেশ করেছে বা করছে। বাঙলা শব্দসম্পদকে পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করে দেখানো হয়: তৎসম. (সংস্কৃত সম), তদ্ভব (সংস্কৃত জাত), অর্ধ বা ভগ্ন তৎসম (বিকৃত সংস্কৃত সম), দেশী (কোল, মুণ্ডা, দ্রাবিড়, মোঙ্গল) ও বিদেশী। এদের মধ্যে ফারসি শব্দের সংখ্যা প্রায় চার হাজার, এবং বাঙলা শব্দকোষের শতকরা চার ভাগ, ইয়োরোপীয় তথা ইংরেজি শতকরা প্রায় দুই ভাগ (চিকিৎসা ও যন্ত্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ)।

.

০২. – আশ্চর্যচর্যাচয় বা চর্যাগীতি

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ-গ্রন্থাগার থেকে এক পুথি আবিষ্কার করেন। এটি একটি পদ বা গীতির সঙ্কলন গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৩২৩ সন। পুথিটি মুনি দত্ত নামের এক পণ্ডিতের সংস্কৃত টীকা সম্বলিত। এই সঠিক গ্রন্থের টীকাকার-প্রদত্ত নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (অবস্য চর্যাচর্য বিনিশ্চয় রূপে লিপীকৃত)। এজন্যে পদসগ্রহের শুদ্ধ নাম আশ্চর্যচর্যাচয় ছিল বলে অনুমান করা হয়। আমাদের আলোচনার ভাষায় চর্যাগীতি বা চর্যাকোষ। সঙ্কলন গ্রন্থে মোট একান্নটি গান ছিল। মুনিদত্ত একটা বাদ দিয়েছেন। প্রাপ্ত পুথিতে তিনটি পদ খোয়া গেছে; অপর একটির অর্ধেক নেই। কাজেই সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ ও তেইশ জন পদকারের নাম পাচ্ছি। তবে ভণিতায় যার নাম রয়েছে তিনিই রচয়িতা এমন অনুমান করা চলে না। কেউ কেউ গুরুর নামে ভণিতা দিয়েছেন। তা বুঝি নামের সঙ্গে গৌরবসূচক পা-এর যোগে। কতগুলি স্পষ্টতই ছদ্মনাম। যেমন কুকুরী, বীনা, তন্ত্রী, ডোম্বী, তাড়ক, কঙ্কন, শববৃ°। এঁদের কেউ কেউ প্রখ্যাত চোরাশী সিদ্ধার অন্তর্ভুক্ত (চোরাশী অঙুলি পরিমিত দেহে সাধনায় সিদ্ধ যে, সে-ই চোরাশী সিদ্ধা]।

চর্যাগীতি বৌদ্ধ মহাযান মতের উপশাখ তান্ত্রিক বজ্রযান সম্প্রদায়ের বামাচারী-সহজিয়া যোগী-শৈব পন্থের সাধন-ইঙ্গিত সম্বলিত রূপক রচনা। এতে তৎকালীন বিভিন্ন মতের মিশ্রণ ঘটেছে। এ রূপকাশ্রিত হেঁয়ালি সান্ধ্যভাষায় রচিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর নাম দিয়েছেন আলো আঁধারী ভাষা। এই ধর্মমত, সাধনতত্ত্ব ও রচনারীতির অনুবর্তন রয়েছে নাথপন্থী, বৈষ্ণব সাহজিয়াং ও বাউলদের মধ্যে! গোরক্ষ-বিজয়ে, বৈষ্ণব সহজিয়া পদে ও বাউল গানে তা আজও সুলভ।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পরে বিজয় চন্দ্র মজুমদার, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মণীন্দ্র মোহন বসু, ডক্টর অবোধচন্দ্র বাগচি, ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, ডক্টর সুকুমার সেন, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সুখময় মুখোপাধ্যায় ও উড়িয়া-আসামী বিদ্বানেরা চর্যাগীতি সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা করেছেন। এঁদের মতে লঘু-গুরু অনৈক্য রয়েছে বহুবিষয়ে। ডক্টর সুনীতিকুমার ও তাঁর অনুসারীরা চর্যার ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে চর্যাগীতিকে দশ থেকে বারো শতকের রচনা বলে মত দিয়েছেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ ও তাঁর মতের সমর্থকেরা তিব্বতী সূত্রে প্রাপ্ত চৌরাশী সিদ্ধার আবির্ভাবকালের উপর আস্থা রেখে মনে করেন সাত থেকে এগারো শতকের মধ্যেই চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল।

 রাহুল সাংকৃত্যায়নের পুরাতত্ত্ব নিবন্ধাবলী, বিনয়ভোষ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস Dev-ther snon-Po-এর জর্জ রোরিককৃত অনুবাদ The Blue Annals আর Bu Ston Rin-Po. Che-এর E. Obermiller-কৃত অনুবাদের আলোকে সুখময় মুখোপাধ্যায় চর্যালেখক সিদ্ধাচার্যদের আবির্ভাবকাল নির্ণয় করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর অনুমান ৭৫০-১০৫০ সনের মধ্যে চর্যাগীতিগুলো রচিত হয়েছিল। আমরাও তাঁর অনুমান যৌক্তিক বলে মনে করি।

.

০৩.

বাঙালিরা চর্যাপদকে বাঙলা বলেই জানে। এবং বারো শতক অবধি চর্যাপদের রচনাকাল বলে মানে। এর পরে তেরো শতক থেকে চৌদ্দশ পঞ্চাশের মধ্যেকার কোনো বাঙলা রচনার নিশ্চিত নিদর্শন মেলে না; তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ মনে করেন, এ সময় বাঙলার কিছুই রচিত হয়নি এবং তারা তুর্কী বিজয়কেই এজন্যে দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, বিজয়ের ফলে দেড়শ দুশ কিংবা আড়াইশ বছর ধরে বাঙলা দেশে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব লীলা চলে। তাদের জীবন জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির উপর বেপরওয়া ও নির্মম হামলা চলে। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর মধ্যে মাটি কামড়ে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন- রজনী গুনে গুনে রইল। কাজেই নতুন করে কিছু তো হলই না, সাহিত্য-সংস্কৃতির যা ছিল, তাও লোপ পেল। এই হল তাঁদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত। এসব উক্তির মূলে যে কোনো তথ্য নেই, তা বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সাহায্যেই প্রমাণ করা চলে।

এক, উত্তরভারতে আগেই তুকী বিজয় ঘটেছিল, সেখানে শতাব্দব্যাপী রক্ত ও আগুনের বিভীষিকার কথা শোনা যায় না; বাঙলা তো দিল্লীর সুলতানের অভিপ্রায় ক্রমেই বিজিত হয়। লক্ষণসেন বাধা দেয়ার চেষ্টা না করেই পালিয়ে গেলেন, কাজেই বখতিয়ার বিনাযুদ্ধেই পেলেন উত্তরবাঙলার অধিকার। যেখানে রাজা কিংবা প্রজা রুখে দাঁড়ায়নি, সেখানে অহেতুক পীড়ন চালানোর কথা নয়। প্রায় একশ বছরেরও অধিককাল ধরে তুর্কীরা বাঙলা দেশের এক তৃতীয়াংশেরও কম অঞ্চলেই আধিপত্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ছিল উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয় রাজাদের শাসনে আর পূর্ববঙ্গও ছিল সেন-সামন্তদের অধীনে। বাঙলা ভাষায় তখন সাহিত্যরচনার রেওয়াজ থাকলে হিন্দুশাসিত এসব অঞ্চলের সাহিত্য পাওয়া যেত।

দুই, ১২০৪ থেকে ১৫৩৮ সন অবধি ৩৫৫ বছরের মধ্যে বিখতিয়ার খলজী থেকে গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ্ ওর্কে আবদুল বদর অবধি, History of Bengal vol II-এর অনুসরণে] হিন্দু পীড়ক ও অত্যাচারী শাসক হচ্ছেন বখতিয়ার খলজী (১২০৪-০৬), আলী মর্দান (১২১০-১৩), মালিক তাজুদ্দীন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫), সোনার গাঁয়ের ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮ ৫০) এবং শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর (১৪৯১-৯৩)। এঁদের রাজত্বকালে একুনে বিশ বছর। অবশিষ্ট ৩১৫ বছরের ফসল কী!

তিন, সেনরাজারা নিম্নবর্ণের লোকদের লেখাপড়া করার সুযোগ দেননি।

চার, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও উচ্চবর্ণের বৌদ্ধেরা সংস্কৃতেই লিখতেন, তাই তুর্কী বিজয়ের আগেকার কোনো বাঙলা রচনার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।

পাঁচ, শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনো অবহট্‌ঠেই লিখবার রেওয়াজ ছিল না। গৌড়ী অবহট্‌ঠে লিখবার রেওয়াজ চালু না হয়ে থাকলে বাঙলাতেও থাকার কথা নয়।

ছয়, এ সময় বাঙলা পদাদি রচিত হলে প্রাকৃত পৈঙ্গল ও সদুক্তি কর্ণামৃতে সংকলিত হত। অথবা এরূপ বাঙলা সংকলন থাকত।

সাত, মুসলমানেরা নিশ্চয়ই বেছে বেছে বাঙলা বইগুলোই নষ্ট করেনি, বাঙলায় বই থাকলে সেন-দরবারে রচিত কাব্য ও শাস্ত্রগ্রন্থের সঙ্গে এগুলোও থাকত। তুর্কী অধিকারেও নিশ্চয়ই সব বাড়ি ও সব মন্দির জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়নি। এছাড়া হিন্দুশাসিত অঞ্চল তো ছিলই।

আট, এ সময় বাঙলায় কিছু রচিত হলেও আগুন-পানি-উই-কীটে ধ্বংস করেছে অথবা জনপ্রিয়তা হারিয়ে তথা পাঠকের অভাবে অযত্নে লোপ পেয়েছে। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শেখ শুভোদয়া বা চর্যাগীতির একাধিক পুথি পাওয়া যায়নি।

.

০৪.

 এবার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কথায় আসা যাক। চর্যাগীতি যে বাঙলা এ বিশ্বাস থেকেই বাঙলা সাহিত্যের তামস-যুগ তত্ত্বের উদ্ভব। অথচ চর্যাগীতি যে প্রাচীন বাঙলা তা আজো সর্বজন-স্বীকৃত সত্য নয়। হিন্দি, মৈথিল, উড়িয়া, অসমীয়াও এর দাবীদার। ডক্টর শহীদুল্লাহ, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর সুকামার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও ওদের দাবীর আংশিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সব সিদ্ধার বাড়ি বাঙলায় নয়, বাঙলা তখনো শালীন ও লেখ্য সাহিত্যের ভাষা নয়–আঞ্চলিক বুলি মাত্র। কাজেই উড়িষ্যা, মিথিলা কিংবা আসামের লোকের বাঙলা পদ রচনা করার তখনো সাধ-সাধ্য থাকার কথা নয়। অতএব মানতে হয় যে, চর্যাপদ অর্বাচীন প্রাচ্য (গৌড়ী?) অবহট্‌ঠে রচিত। সে সময় আঞ্চলিক বিকৃতিজাত সামান্য প্রভেদ থাকলেও উড়িয়া-বিহারী-বাঙলা-আসামী অবহট্ঠ মোটামুটি অভিন্ন ছিল। নাথ-সহজিয়া পন্থের অন্যতম প্রসারক্ষেত্র চন্দ্ররাজদের রাজ্য পূর্ববঙ্গ। কাজেই মানিকচাঁদ-ময়নামতী-গোপীচাঁদের দেশে (আধুনিক কুমিল্লাদি জেলা) বহুল চর্চার ফলে (নেপালেও চর্যাগীতি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশাদি পূর্ববাঙলার লোকেরাই নিয়ে যান) চর্যাগীতিতে বঙ্গ-গৌড়ীয় বিকৃতি এসেছে। এতেই জোরালো হয়েছে বাঙলার দাবী।

মুনিদত্তের টীকাযুক্ত চর্যাগীতি নেপালে পাওয়া গেছে নেওয়ারী হরফে লিখিত পুথিতেই। বিদেশে বিভাষীর পক্ষে ভিন্ন ভাষার অলিখিত শাস্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। কাজেই চর্যাগীতি নেপালে স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ও টীকা-সম্বলিত হয়েছে। কিন্তু আসাম-বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যাতেও তার লেখ্যরূপ ছিল বলে মনে করার সঙ্গত কারণ নেই। নাথ-সহজিয়া পন্থ যোগতান্ত্রিক বজ্রযান বৌদ্ধদের বিকৃত উপশাখা। কাজেই এই উপসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি ছিল না এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপন করেনি। অতএব সেকালের বাঙালি–বিহারী-আসামী-উড়িয়া সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের দাবী বা যোগ্যতা এদের ছিল না। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পাল আমলের মধ্যকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চা করত। শাস্ত্রচর্চার ও শাসন পরিচালনের বাহন ছিল সংস্কৃত। তাই প্রাচ্য অবহটঠেরও লেখ্যরূপ মেলে না। গৌড়ী-মাগধী অবহট্‌ঠেই যদি লেখার রেওয়াজ না থাকে, তাহলে তখনো নিতান্ত অবজ্ঞেয় আঞ্চলিক মুখের বুলি আসামী-বাঙলা-উড়িয়া-বিহারীতেই বা লেখ্য রচনার সম্ভাব্যতা কোথায়? কাজেই এদেশে চর্যাগীতির কোনো লেখ্যরূপ ছিল না এবং এগুলো মুখে মুখে রচিত ও গীত লোকসাহিত্য বা লোকায়ত শাস্ত্ররূপেই চালু ছিল বলে আমাদের ধারণা।

অতএব আমাদের অনুমান এই যে, চর্যাগীতি লিখিত রচনাও নয়, বাঙলাও নয়–অর্বাচীন গৌড়ী-মাগধী অবহট্ঠ এবং মৌখিক রচনা। কেবল ডক্টর শহীদুল্লাহ আর ডক্টর সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ই নন, ডক্টর সুকুমার সেনও বলেছেন, অসমীয়া ভাষীদের দাবী অযৌক্তিক নয়, কেননা ষোড়শ শতাব্দী অবধি বাঙলা ও অসমীয়া দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না এবং উড়িয়া আসামীদের সঙ্গে বাঙলার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আদিতে এই তিনটি একই ভাষা ছিল। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হইতে মূল ধারা হইতে ওড়িয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। কাজেই ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে বাঙলা, ওড়িয়া, মৈথিল ও অসমীয়ার উদ্ভব। ডক্টর সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন প্রত্ন-বাঙলা-অসমীয়া-ওড়িয়া। এই সাধারণ স্তর আমাদের ধারণায় অর্বাচীন অবহট্ঠ বা আধুনিক ভাষাগুলোর লক্ষণ ফুটনকালীন অবহট্‌ঠ। অতএব চর্যাগীতি কেবল বাঙলার নয়, উক্ত অপর ভাষাগুলোরও সাধারণ ঐতিহ্য এবং এর ভাষা আলোচ্য সবকয়টি ভাষার জননী।

তবে অধিকাংশ চর্যাগীতি বাঙলা দেশের আবহে এবং বাঙালি র রচিত তাতে সন্দেহ নেই। বাঙলাদেশ, বঙ্গাল জাতি, পঁউয়া (পদ্ম) খাল, বঙ্গ প্রভৃতির উল্লেখ, সাধারণের প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেয়া রূপপ্রতীক-তুলা-ধূনা, নৌকা চালান, মদ চোলাই করা, নদীঘাট থেকে জলভরা, সাঁকো তৈরি করা, দাবা খেলা, শবরবৃত্তি, গোয়ালবৃত্তি প্রভৃতির রূপক সেকালের নিম্ন ও নিঃস্ব শ্রেণীর সমাজ-চিত্র দান করছে। এমনটি বৈষ্ণব পদাবলীতেও মেলে না, সেখানে রাধা-কৃষ্ণ সমাজ ও বাস্তব জীবনকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন।

ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্য সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদি যুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলে লোকের ভাব-বিনিময়ের বাহন। তাই কোনো অঞ্চলের মধ্যে আর্য-ভারতিক বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা কিংবা শালীন সাহিত্যের বাহন হবার সুযোগ পায়নি। বৌদ্ধ ও জৈন মত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেক কাল রাষ্ট্র শাসন কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে আর কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠী ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।

এর পরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরবারি ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাববিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্যভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, কবীর, নানক, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।

এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভালো। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ঠ বৌদ্ধ বজ্রযান সম্প্রদায়ের যোগ, তন্ত্র ও শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়–যার ফলে আধুনিক আর্যভাষার (অবহট্ঠ থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুই স্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শন-স্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।

তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল–চৈতন্য প্রবর্তিত মত। আবার আঠারো-উনিশ শতকে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের, হিন্দু-সমাজ সংস্কারের এবং কোম্পানির শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেনি, কারণ পর পর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনোদিন জাতীয় ভাষার বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।

শিক্ষার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা শিক্ষিত লোকের ভাষা। সেকালে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কাজেই প্রাকৃতজন তাদের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশ করত নিজেদের মুখের বুলিতেই। এভাবে তারা গান, গাথা, ছড়া, বচন ও রূপকথা-রসবার্তা তৈরি করে মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। বহু মুখের স্পর্শে ওগুলো রূপ ও রস বদলায়, ফলে ও-সবকে ব্যক্তির রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না। তাই আজকাল ঐ সাহিত্যকে গণরচনা বলে নির্দেশ করা হয়। আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় ঐগুলোই লোক-সাহিত্য বা পল্লী-সাহিত্য। আঞ্চলিক বুলিতে রচিত বলে লোক-সাহিত্য সাধারণত অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারত না। পল্লী-সাহিত্য সাহিত্য-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস-প্রসূতও নয়। তবু মানবমনের কোমল অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ বলেই এগুলো সুন্দর এবং স্থানে স্থানে শিল্পগুণে মণ্ডিত। মুখের বুলির পুষ্টি ও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃতজনের রচনা লোক-সাহিত্যের মাধ্যমেই। বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে শেখশুভোদয়া ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কয়েকটা পদ, ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবচন, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, যোগাপাল-ভোগীপাল-মহীপাল গীত (অপ্রাপ্ত), ময়নামতী মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদ গীত, মীননাথ, গোর্শ্বনাথ-হাড়িপা-কাহিনী, শিবের ছড়া, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালি, ভারত কথা প্রভৃতি আর শিলা বা তাম্রলিপিতে এবং বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দের টীকা সর্বম্বে, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে, শূন্য পুরাণে প্রাপ্ত কিছু শব্দ। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কাহিনীগুলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও মঙ্গলকাব্যাদিতে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ কাহিনী ময়নামতী-গোপীচাঁদ কথা গাথা রূপেই রয়ে গেছে, এবং পালগীতি লোপ পেয়েছে।

অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মমত প্রচারের বাহন বা রাজ্যশাসনের বাহন কিংবা প্রাকৃতজনের রচনার অবলম্বন হয়ে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে, বাঙলার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলমান সুলতান-সুবেদারেরাও শাসিতদের জানবার ও শাসন পরিচালনার গরজেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পোষকতা করেন। লেখ্য-ভাষা বইপত্র ছাড়া শেখা যায় না। কাজেই গ্রন্থ লিখিয়ে নিতে হল–ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেমনটি হয়েছিল। আর ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে ওঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে! বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।

অতএব আলোচ্য দুশ বছরের মধ্যেকার বাঙলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মেলার অনুমিত কারণ এই :

ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্য শাসনের বাহন হয়নি বলে বাঙলা তুর্কী বিজয়ের পূর্বে লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি।

খ ফলে, তেরো-চৌদ্দ শতক অবধি বাঙলা ভাষা উচ্চবিত্তের লোকের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গান, গাথা ও ছড়া-পাঁচালিই চলত।

গ, সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রস-সাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ভাষাকে লৌকিক দেবতার মাহাত্ম প্রচারের বাহনরূপেই প্রাকৃতজনেরা গ্রহণ করে। সাহিত্যের ভাষা তখনো সংস্কৃত ও প্রাকৃত ও শৌরসেনী অবহট্ঠই ছিল। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র ভাষায় রচন, পঠন ও শ্রবণ ছিল নিষিদ্ধ। সংস্কৃতের মাধ্যমে বৌদ্ধশাস্ত্রেরও চর্চা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর অপরিণত বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা ও সম্ভাব্যতা কোনো উচ্চশিক্ষিত লোকের মনে জাগেনি। পাল ও সেন আমলে সংস্কৃত চর্চা হয়েছে এবং মুসলমান বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাঙলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এতেই ভাষা বিকশিত হয়েছে; তার প্রমাণ মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তথা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে। এ গ্রন্থেই দেখা যায়, ইতিমধ্যে এক ডজন ফারসি-তুর্কী শব্দ বাঙলা-সাহিত্যের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে।

ঘ. তেরো-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দুশাসিত মিথিলায়। তাই এ সময় বাঙলা দেশে সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি, কেবল কিছু কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল। মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার তথা শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে।

ঙ, তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারও করা যায় যে আলোচ্যযুগে বাঙলায় কিছু কিছু পুথিপত্র রচিত হয়েছিল, তাহলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপিকরণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। যত্ন করে রক্ষা না করলে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও লোপ পায়। আগুন-পানি-উই-কীট তো রয়েইছে। কিন্তু আলোচ্য যুগে যে ভাষায় কিছু লিখবার রীতি ছিল না, তার বড় প্রমাণ পনেরো শতকের শেষাবধি নানা মঙ্গল গীতি, রামায়ণ গান, ভারত পাঁচালি এবং বিশ শতকেও পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়নামতীর গানের লিখিতরূপ পাওয়া যায়নি। অথচ এগুলো সুপ্রাচীন।

চ. আবার লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন), শেখশুভোদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।

ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বারো শতক হয়, তাহলে তেরো-চৌদ্দ শতক বাঙলা ভাষার গঠন-যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়ে কোনো লিখিত রচনা না থাকারই কথা। চর্যাগীতি ছাড়াও বারো শতকের বাঙলা-ঘেঁষা রচনার নমুনা মেলে শেখশুভোদয়ার আর্যার ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কোনো কোনো পদে। বাঙলা তখন সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, লক্ষণ সেনের সভায় আমরা বাঙলা কবিও দেখতে পেতাম। এবং পূর্ববঙ্গ ও রাঢ়ের মতো হিন্দুশাসিত অঞ্চলে তেরো শতকে লিখিত বাঙলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যেত।

. জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাঙলা। বাঙলায়-লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কী বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না। এবং মুসলিম বিজয়ে তাদের মূৰ্ছাহত হবার কথাও নয় বলে তাদের রচনার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হবার কারণ ঘটেনি। কেবল তা ই নয়, বাঙলা লেখ্য-ভাষা হলে গৌড় সুলতানের দরবারে রাজ্য-শাসনের প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অন্তত বাঙলা ফরমান লিখিয়ে মুসলমান পাওয়া যেত। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাঙলায় কখনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়নি, লৌকিক দেবতার পূজা-প্রচার প্রয়াসীই ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠারো শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।

অত্যাচার যতই তীব্র হোক, তা দেড়শ-দুশ বছর অবধি চলতে পারে না। সাত-আট পুরুষ ধরে পীড়ন চালানোর পরেও দেশে হিন্দু প্রজা রইল; তাদের খাওয়া-পরার, বিয়ে করার আর ধর্মরক্ষার অধিকারও রইল; আর আনুষঙ্গিক উৎসব-পার্বণও চলছিল নিশ্চয়ই প্রাকৃত পৈঙ্গল, সদুক্তি কর্ণামৃতও সংকলিত হল এ-সময়ে; কেবল বাধা পেল গান-গাথা রচনায় ও কথকতায়–এমন অদ্ভুত ধারণা পোষণের জন্যে কল্পনার অতিপ্রাকৃত প্রসার প্রয়োজন। আমরা দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ আর দাঙ্গার দিনেও সাহিত্য রচিত হতে দেখেছি; পারিবারিক ও সামাজিক আনন্দ-উৎসবও চলতে দেখেছি অবাধে। সাত-আট পুরুষ ধরে মানুষ এস্ত ও স্তব্ধ থাকতে পারে না। বাঙলায় লিখিত রচনার রেওয়াজ থাকলে তার নিদর্শন আমাদের হাতে আসতই।

পরাধীনতার গ্লানি হিন্দুর মনে অবশ্যই ছিল। তেমন অবস্থায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারে তার সাক্ষ্য রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চারশ বছরেও আশানুরূপ উন্নতি ও বিকাশ হয়নি, বাঙলা দরবাবি কিংবা জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি বলেই।

অতএব আমাদের অনুমান এই যে : বাঙলা বারো, তেরো ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয়নি। এই হচ্ছে বাঙলার স্বাকার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার যুগ।

.

০৫.

বাঙলা সাহিত্যের পরিচয় পেতে হলে বাঙালি র পরিচয় নিতে হবে। নইলে এ সাহিত্যের স্বরূপ ধরা যাবে না।

আর্যেরা ছিল প্রাকৃত শক্তির পূজক। তাদের প্রভাবেই হয়তো এদেশে প্রাকৃত শক্তিকে জয় করবার প্রয়াস বিশেষ দেখা যায়নি। সে-শক্তিকে তোয়াজে তুষ্ট রেখে জীবন যাপনের চেষ্টাই হয়েছে চিরকাল। অরি ও ইষ্ট শক্তির পূজাই বাঙালি র ধর্ম। বাঙলা দেশের ভোগেছু অনার্য মানস একান্তভাবে জীবনমুখী। তাই এদেশে বৃহৎ ও মহৎ আদর্শচেতনা কিংবা আধ্যাত্মবোধ তত তীব্র ছিল না কখনো, যত প্রবল ছিল জীবনোপভোগের প্রয়াস। উপনিষদের মহৎ বাণী, নির্বাণের সূক্ষ্মতত্ত্ব কিংবা গীতার জীবনবোধ বা শঙ্করের জ্ঞানবাদ তাদের নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। তাই এদেশে বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি আদর্শ এত বিকৃত হয়েছে! অনার্য বাঙালি র প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারই বারবার বহিরারোপিত শাস্ত্র ও নীতিবোধের উপর জয়ী হয়েছে। বাঙালি ভোগেচ্ছ কিন্তু কর্মকুণ্ঠ, তাই দৈবশক্তি ও তুকতাকের উপরই তার ভরসা। পৌরুষ প্রয়োগে তার উদ্যোগ কম। ইহ জীবনবাদী এসব মানুষের দেবতাও ইহকালীন জীবন-বিধাতা। মনসা, শীতলা, শনি প্রভৃতি অরি দেবতার পূজায় যেমন একদিকে পার্থিব অকল্যাণ এড়ানোর ভরসা পেয়েছে; তেমনি লক্ষ্মী, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ প্রভৃতির সেবায় সুখ, শান্তি ও ঐশ্বর্যের আশ্বাস লাভ করেছে। তাই ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনের নিয়ন্ত্ৰী মহৎ ধর্মশাস্ত্রে তারা খেই পায়নি।

অতএব আদিকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে কোনো বহিরারোপিত ধর্মমত বা জীবনাদর্শ বাঙলা দেশে টেকেনি, বাঙালি রা সবসময় নিজেদের জীবন-জীবিকার গরজমত ধর্মমত ইষ্টদেবতা এবং জীবনদর্শন তৈরি করে নিয়েছে। যখনই জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তখনই বাঙালি নিজের পসন্দমতো দৈব আশ্রয় খুঁজেছে।

এতে বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ ধরা পড়েছে। সাহিত্য মানুষের মানস-মুকুর। তাই সাহিত্য থেকেই জাতির অকৃত্রিম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। বাঙলা সাহিত্যে বাঙালি চরিত্রের যেরূপ প্রতিফলন হয়েছে, তাতে নানা বিরুদ্ধ-গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবপ্রবণতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ভোগলিপ্সা ও বৈরাগ্য, কর্মকণ্ঠা ও উচ্চাভিলাষ, ভীরুতা ও অদম্যতা, স্বার্থপরতা ও আদর্শবাদ, বন্ধন ভীরুতা ও কাঙালপনা প্রভৃতি দ্বান্দ্বিক গুণই বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

আমাদের মধ্যযুগীয় পাঁচালি সাহিত্যে বিশেষ করে বাঙালি র এই চরিত্র–এই মানসই ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে তাই ইষ্ট-দেবতাই প্রধান হয়ে উঠেছেন। কারণ তিনি জীবন-জীবিকার অবলম্বন। তবু তার প্রাণপ্রাচুর্যের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তার স্বধর্মে সুস্থিরতায়। বহিরাগত কোনো ধর্ম, কোনো নীতি-আদর্শ সে মনেপ্রাণে বরণ করে নেয়নি। সে তর্ক করে, যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়ানুভূতি গোচর না হলে কিছুই গ্রহণ করে না। তাই সে মুখে বড় বড় বুলি আওড়ায় কিছু আচরণে প্রয়োজনকেই কেবল স্বীকৃতি দেয়।

ভাবপ্রবণ বলেই বাঙালি মুখে আদর্শবাদী ও বৈরাগ্যধর্মী, কিন্তু প্রবৃত্তিতে সে আধ্যাত্মবাদীর ভাষায় বস্তুবাদী, গণভাষায় জীবনবাদী এবং নীতিবিদের ভাষায় ভোগবাদী। এজন্যেই নৈরাশ্য ও নিরীশ্বরবাদী নির্বাণকামী বৌদ্ধধর্ম বাঙালি স্বীকার করে নিলেও বৌদ্ধচৈত্য হয়ে উঠেছিল দেবদেবীর আখড়া। 

বৌদ্ধযুগে নির্বাণের জন্যে নয়–অমরত্বরও চিরসুখের প্রত্যাশায় সুকঠোর যোগতান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে দৈবশক্তিধর হয়ে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে জীবনোপভোগের প্রয়াসী হয়ে উঠল বাঙালি। মহাজ্ঞান, তুকতাক, ডাকিনী-যোগিনী প্রভৃতির দ্বারা সিসম ফাঁক আয়ত্ত করে খিড়কীদের দিয়ে জীবনের ভোগ্য সম্পদ আহরণের অপপ্রয়াসই তাদের কর্মাদর্শ বা জীবনের লক্ষ্য হল। যোগ ও সাংখ্য–এই দুই অনার্য দর্শনজাত যোগতান্ত্রিক সাধনাই হল একশ্রেণীর লক্ষ্য। এরই নমুনা পাচ্ছি। চর্যাগীতিতে।

পাল আমল এমনি করেই কাটল। আবার সেন আমলে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রসার লাভ করে তখন বাঙালি বাহ্যত ব্রাহ্মণ্য মতবাদ গ্রহণ করল। কিন্তু মায়াবাদ, পরব্রহ্মপ্রীতি, জীবাত্মা পরমারাত্মার রহস্য প্রভৃতিতে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। তাই নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও ভোগের দেবতা সৃষ্টি করে সে আশ্বস্ত হয়। এভাবে সে চণ্ডী, মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবতার পূজা দিয়ে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে হয় নিশ্চিত। জয়দেবের গীতগোবিন্দই প্রমাণ করে যে, এ সময় বৈষ্ণব মতবাদও জনপ্রিয় হয়ে উঠে, যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদ দৃঢ়মূল করবার জন্যে সমাজকাঠামো স্থায়ীভাবে তৈরি করবার প্রয়াসে সেন রাজারা উচ্চবর্ণের লোক আমদানি করে কৌলীন্যপ্রথা প্রবর্তনে তৎপর হয়ে ওঠেন।

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই লৌকিক দেবতারা তার পরলৌকিক মুক্তির কিংবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, সেন-রাজাদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হইতেছিল সত্য, কিন্তু এতকালের একটা দেশীয় ধর্ম-সংস্কৃতিও–যাহা জাতির একেবারে মজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছিল–মুখ্যত না হউক গৌণত হইলেও এই সমাজ-দেহেই রহিয়া গেল। সেকালের বাঙালি হিন্দুর সামাজিক জীবনের এই সন্ধিযুগে, দেশীয় প্রাচীন সংস্কার ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের নতুন আদর্শ–এই উভয়ের সংঘাত মুহূর্তে বাঙলা পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যগুলি সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। তাহারা (বাঙালি রা) নূতনকে (ব্রাহ্মণ্যধর্মকে) যেভাবে গ্রহণ করিল, তাহা পুরাতনেরই রূপান্তর মাত্র হইল। এই দেশীয় প্রচলিত ধর্মসংস্কারই যুগোচিত-পরিমার্জনা মাত্র লাভ করিয়া সমাজের অন্তঃস্থলে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করিতে লাগিল। মঙ্গলকাব্যগুলি এই নূতন ও পুরাতনের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিয়া পরস্পরমুখী দুইটি সংস্কারকে একসূত্রে গাঁথিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। বাঙলার জলবায়ুতে দেশীয় লৌকিক সংস্কারের সহিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার যে কীভাবে একদেহে লীন হইয়া আছে, মঙ্গলকাব্যগুলি পাঠ করিলে তাহাই জানিতে পারা যায়। ….. তাহারই ফলে বর্তমান বাঙলার। হিন্দুসমাজের পঞ্চোপাসক হিন্দুসম্প্রদায়ের সৃষ্ঠি।

একই কারণে ইসলামোত্তর যুগে বিশেষত মুঘল আমলে বাঙলাদেশে হিন্দুর পুরোনো দেবতা ও ইসলামের নির্দেশকে ছাপিয়ে ওঠেন সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, বনদেবী-বনবিবি, কালুগাজী কালুরায়, বড় খাঁ গাজী-দক্ষিণরায়, ওলাবিবি-শীতলা প্রভৃতি জীবন ও জীবিকার এবং নিরাপত্তা ও কল্যাণের ইষ্ট ও অরিদেবতা। মধ্যযুগে চৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমধর্ম এবং গত শতকের রামমোহন প্রচারিত ব্রাহ্মমত এবং শিক্ষিত সাধারণের পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনানুগত্য বাঙালি র এই বন্ধনমুক্ত মনোভাবের ধারা অব্যাহত রেখেছে। অতএব কোনো বৃহৎ ও মহতের সাধনা বাঙালি র কোনোকালে ছিল না। সে একান্তভাবে জীবনসেবী ও ভোগবাদী। এ ব্যাপারে সে আত্মপরমাত্মাকে তুচ্ছ জেনেছে, স্বর্গ-নরককে করেছে অবহেলা। বৈষ্ণব সমাজের বিকৃতিও এই একই মানসের ফল। এ কারণে বাঙলার সংস্কৃতি চিরকালই পনেরো আনা বাঙালি সংস্কৃতি। চন্দ্ৰশাসনে ও পাল আমলে বৌদ্ধদের যোগতান্ত্রিক সাধনায় আগ্রহের প্রমাণ মেলে চর্যাগীতিতে, ডাকিনী ও যোগিনীর কিংবদন্তিতে, ময়নামতি-মাণিকাদ-গোপীচাঁদ গাথায়, গোরক্ষ-বিজয় প্রভৃতি পাচালিতে এবং যোগীপাল, মহীপাল, ভোগীপাল গীতির ঐতিহ্যে। [যোগী, মহী ও ভোগী নামেতেই রূপকাশ্রিত তত্ত্ব-সিদ্ধান্তের আভাস রয়েছে।]

সেনদের স্বল্পকাল রাজত্বের সময়কার শূন্য-পুরাণতত্ত্বে, শেখ-শুভোদয়ায়, গীত-গোবিন্দে ব্রাহ্মণ্য-বিকৃতি লক্ষণীয়। রাজধর্মে ও ক্ষাত্রশক্তিতে এসেছিল শিথিলতা। মন্ত্রতন্ত্র প্রভৃতি আধিদৈবিক শক্তির উপর একান্ত নির্ভরতা এ যুগের প্রাসাদ ও কুটির বাসীর চিত্ত-দৌর্বল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। বৌদ্ধদের উপর এ সময়ে উৎপীড়ন চলছিল; নিরঞ্জনের রুম্মাই তার সাক্ষ্য। বৌদ্ধেরা তখন শৈব, সহজিয়া, নাথযোগী ও ধর্মপন্থী হয়ে হিন্দুসমাজে আত্মগোপন করতে প্রয়াসী হয়। সেন আমলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এ সময়ে শূদ্রমাত্রেরই উচ্চশ্রেণীর লেখাপড়ার অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইল। … এই জনসাধারণ অজ্ঞ ও মূর্খ রহিয়া গেল। দেশীলোক ও দেশী ভাষার প্রতি অবজ্ঞাবশে সেনেরা বিদেশী ব্রাহ্মণ আনয়নে এবং সংস্কৃত-চর্চার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। এসব কারণে বাঙলাভাষায় লিখিত সাহিত্য সৃষ্টি হতে দেরি হল অনেক। তার জন্যে তুর্কী বিজয়ের প্রয়োজন ছিল। কাজেই তুর্কী বিজয়ে কেবল সধর্মীদেরই পীড়নমুক্তির নিশ্বাস পড়েনি, বাঙলা ভাষারও সুদিনের শুরু হয়েছে। তুর্কী অধিকারে সেন-আমলের বৈষম্যমূলক শাসন রহিত হয়। রাজ্য শাসনে ও রাজস্বব্যবস্থায় এমনকী সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুর হাতে ছাড়িয়া দিতেন। … এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্ত ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং হঁহারাই ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। বাঙলা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাঙলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশে সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়া উঠিয়াছিল এই পরাধীন যুগে সেই শ্ৰী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। … এই পাঠান যুগে সর্বপ্রথম হিন্দুসমাজে নূতন বিক্ষোভ দৃষ্ট হইল। জনসাধারণের মধ্যে শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ প্রচারিত হওয়াতে তাহারা গরুড় পক্ষী হইয়া ব্রাহ্মণের নিকট করজোড়ে থাকিতে দ্বিধাবোধ করিল। ব্রাহ্মণেরা বাধ্য হইয়া শাস্ত্রগ্রন্থ বাঙলায় প্রচার করিলেন; তাহারা ঘোর অনিচ্ছায় ইহা করিয়াছিলেন। এই অনুবাদ কার্য শেষ করিয়া তাঁহারা শাস্ত্রের অনুবাদক ও শ্রোতাগিদের বাপান্ত করিয়া অভিশাপ দিতে লাগিলেন, অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। একদিকে মুসলমান ধর্মের প্রভাব, অপরদিকে বাঙলা ভাষায় ধর্ম প্রচার–এই দুই কারণে বঙ্গীয় জনসাধারণের মন নব্যভাবে জাগ্রত হইল। শাসন ও রুচি হইতে মুক্ত হইয়া চিন্তাজগতে হিন্দুরাজগণ তান্ত্রিক হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণেরাও রাজ্য শাসন হইতে মুক্তি পাইয়া অবাধে স্বীয় মত সমাজে চালাইতে লাগাইলেন। এই পাঠান-প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল। এই স্বাধীনতার ফলে বাঙ্গালার প্রতিভার যেরূপ অদ্ভুত বিকাশ পাইয়াছিল, এদেশের ইতিহাসে অন্য কোনোও সময়ে দ্রুপ বিকাশ সচরাচর দেখা যায় নাই।

অনার্য সংস্কার বশে নিম্নশ্রেণীর জনগণ কীভাবে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য যুগে রাজশক্তির প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজেদের পূর্বতন ধর্ম, আচার ও সংস্কার জিইয়ে রেখেছিল, তা আমরা দেখেছি। বৌদ্ধ তারিতা, বজ্রতারা, অবলোকিতেশ্বর শিব কিংবা ধর্মঠাকুর লোক-মানস প্রশ্রয়ে বৌদ্ধ আবরণে যেমন পূজিত হয়েছেন, তেমনি ব্রাহ্মণ্য যুগে তাঁরা যথাক্রমে মনসা, চণ্ডী, লৌকিক বিষ্ণু, শিব, ধর্মঠাকুররূপে নতুন পোশাকে হিন্দুদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; নাথ ও সহজিয়াপন্থও বৌদ্ধ এবং হিন্দুর সাম্প্রদায়িক মত রূপে গৃহীত হয়। এসব সুপ্রাচীন মতের উদ্ভবের স্থান ও কাল সম্বন্ধে মতভেদ আছে। তবে এগুলো যে অতি প্রাচীন অনার্য মানস-সদ্ভূত ও জাদুবিশ্বাস যুগের সৃষ্টি তাতে কেউ সন্দেহ পোষণ করে না।

বৌদ্ধ-হিন্দু যুগে রাজশক্তির বিরূপতায় বহিরাগত বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যদের মধ্যে তথা অভিজাত ও উচ্চবর্ণের মধ্যে এসব লৌকিক মত ও দেবতার প্রতিষ্ঠা ছিল না। তুর্কী আমলে রাজভয় থেকে মুক্ত হয়ে জনসাধারণ উচ্চবিত্তের সমাজেও তাদের ধর্ম ও দেবতার সার্বভৌম প্রতিষ্ঠাদানে প্রয়াসী হয়। এ কারণেই তখন থেকে শুরু হয় দেব-মানবের সংগ্রাম। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এককালে পুরুষ-দেবতা যিনি ছিলেন; তাঁর বিশেষ কোনো উপদ্রব ছিল না। খামকা মেয়ে দেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন, আমার পূজা চাই। অর্থাৎ যে-জায়গায় আমার দখল নাই সে-জায়গা আমি দখল করবই। তোমার দলিল কী? গায়ের জোর। কী উপায়ে দখল করবে? যে উপায়েই হোক। তারপর যে-সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদ্বুদ্ধিতে তাকে সদুপায় বলে না। কিন্তু পরিণামে এইসকল উপায়ের জয় হল। ছলনা, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা কেবল মন্দির দখল করল তা নয়, কবিদের দিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে চামর দুলিয়ে আপন জয়গান গাইয়ে নিলেই। মনসা চাঁদের দ্বন্দ্ব, কালকেতু-ধনপতির উপর চণ্ডীর অহেতুক নির্যাতন ও অনুকম্পা, লাউসেনের সৌভাগ্য, ঈছাই ঘোষের বিপর্যয় প্রভৃতি এরই ফল। কবিরাও স্বপ্নদিষ্ট হয়ে মহিমা কীর্তনে তৎপর হয়েছেন। পাঠক-শ্রোতাও বংশনিপাতের ভয়ে শ্রদ্ধা নিয়ে পঠন-শ্রবণে মনোযোগী হয়েছে। এমনি করে উচ্চবর্ণের লোকেরা লৌকিক দেবতার কাছে হার মেনেছে। বাঙলা সাহিত্যের বারোআনা রচনাই নিয়োজিত হয়েছে এই লৌকিক দেবতার প্রতিষ্ঠা প্রয়াসে।

 এভাবে তেরো-পনেরো শতকের মধ্যে বাঙলার নিম্নবর্ণের গণদেবতা জাতীয় ইষ্টদেবতার মর্যাদায় উন্নীত হলেন। তখন এসব লৌকিক দেবতায় আভিজাত্য দানের জন্যে আর্যীকৃত প্রাচীন দেবতা সূর্য ও শিবের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরিকল্পিত হল। এভাবে ধর্মঠাকুর হলেন স্বয়ং সূর্য; চণ্ডী বা কালী হলেন শিবপত্নী; মনসা, লক্ষ্মী, সরস্বতী হলেন শিবকন্যা।

 কাজেই বৌদ্ধযুগ থেকেই লৌকিক দেবতার পূজা-পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য-কথা মুখে মুখে চালু ছিল। পাল আমলের শেষের দিকে তাঁদের কেউ কেউ পৌরাণিক মর্যাদা লাভ করেন এবং তুর্কী শাসনকালে নির্বিঘ্ন প্রচার পেয়ে উন্নীত হন জাতীয় দেবতার স্তরে, সে-সঙ্গে তাদের মাহাত্ম্য-কথাও বৈচিত্র্য এবং বিপুলতা লাভ করে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে তাই —

ধর্ম কর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন
 পুত্তলি করএ কেহ দিয়া বহু ধন।
বাশুলী পূজএ কেহ নানা উপহারে
মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে।
যোগিপাল ভোগিপাল মহীপাল গীত
ইহা শুনিবারে সলোক আনন্দিত।

কিন্তু পাল আমলে অবহট্‌ঠে কিংবা সেন আমলের বাঙলা বুলিতে এগুলো লিখিত হয়নি। একে তো সেনরাজারা নিম্নবর্ণের লেখাপড়া শেখার বিরোধী ছিলেন, তার উপর সমাজের উচ্চবিত্তের লোকেরা রাজশক্তির প্রভাবে পড়ে লৌকিক দেবতা ও প্রাকৃতজনের ভাষা এড়িয়ে চলতেন এবং তাঁদের সংস্কৃত-প্রীতিও এসময়ে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেল; তাই জয়দেব, সন্ধ্যাকর নন্দী, সর্বানন্দ,– হলায়ুধ মিশ্র, ঘোয়ী, মুরারি মিশ্র প্রভৃতি অবহটঠের বাক্-রীতিতে রচনা করেছেন সংস্কৃত।

কাজেই বাঙলায় লেখার রেওয়াজ যত আগে চালু হওয়া সম্ভব ছিল, তত আগে হয়নি। তবে এই সময়ে মনসার কাহিনী, ধর্মের কাহিনী, চণ্ডীর কাহিনী ইত্যাদি দেশীয় বস্তু এবং রামায়ণ কাহিনী, কৃষ্ণলীলা কাহিনী ইত্যাদি পৌরাণিক বস্তু ছোট বড় গানে অথবা পাচালিতে বাদ্য ও নৃত্যের যোগে পরিবেশিত হইত গ্রামোৎসবে অথবা দেবপূজা উপলক্ষে দেবমন্দিরে। ….. রামায়ণ মহাভারত কাহিনী ও কৃষ্ণলীলা গান রাজসভায় ও সামন্তসভায় প্রধানভাবে অনুশীলিত ছিল। সমাজের নিম্নস্তরে অর্থাৎ দেশী-ভাষাবলম্বী লোকসাহিত্যে বিশেষভাবে কৃষ্ণের ব্রজলীলা এবং মনসা চণ্ডী ধর্মদেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী প্রচলিত ছিল। এই অনুমানের সমর্থন মিলে ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে। যুধিষ্ঠির অর্জুন ভীম দ্রেীপদী দশরথ রাম সীতা ইত্যাদি মহাভারত রামায়ণ কাহিনীর নামগুলি তৎসম (সংস্কৃত) রূপেই প্রচলিত। কিন্তু কানু বা কানাই (কৃষ্ণ), রাই (রাধিকা), আয়ান (অভিমন্যু), গোই, গুই (গোপী, গোপিকা), ফুল্লরা, খুল্লনা (ক্ষুদ্র), লহনা (লোভনা), বেহুলা (বিহ্বলা) ইত্যাদি নামগুলি, তদ্ভবরূপেই মিলিতেছে। ইহা হইতে এ অনুমান অপরিহার্য যে শেষের সব কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত অপভ্রংশ অবহট্ঠ ও প্রাচীন বাঙ্গালার মধ্যে দিয়াই আসিয়াছে।

লিখিত বাঙলা সাহিত্য

বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ দেব-গাথাগুলো পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হয়ে লিখিত রূপ পায়নি। কিন্তু হিন্দু দেব-কাহিনী চৌদ্দ শতক থেকে লিখিত রূপ পেতে থাকে। মানিকদত্ত, কানাহরি দত্ত প্রভৃতির নামসার স্মৃতি থেকে এবং শূন্য পুরাণের ভাষার কাঠামো থেকে এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের (শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ) পুঁথি প্রাপ্তি থেকে আমরা তা অনুমান করতে পারি। আমরা নাথ কাহিনী-বিধৃত সমাজ পরিবেশের আভাস থেকেও আমাদের এ অনুমানের সমর্থন পাই। লিখিত বাঙলা সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে তথা আদি বাঙলা কাব্য হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাহিনী স্বীকৃতি পাচ্ছে সম্প্রতি। কিছুটা তথ্য ও কিছুটা অনুমানের উপর নির্ভর করে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন এটি সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের আমলে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত হয়। ভাষা কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো প্রাচীন নয়। তবে শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের ভাষা স্মরণে রেখে এর প্রাচীনত্ব স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না।

মহানরপতি গ্যেছ পিরথিম্বীর সার।
ঠাঁই ঠাঁই ইচ্ছে রাজা আপনা বিজএ
পত্র সিস্য হন্তে তিই মাগে পরাজএ।
 মোহাজন বাক্য ইহ পুরন করিয়া
লৈলেন্ত রাজ্যপাট বঙ্গাল গৌড়িয়া।

এর মধ্যেই সোনারগাঁয়ের যুদ্ধে পিতৃহন্তা গিয়াসুদ্দীন আযম শাহকে নির্দেশ করা হয়েছে বলে ডক্টর হক অনুমান করেছেন।

লিখিত বাঙলা সাহিত্যের সর্বজন-স্বীকৃত আদি নিদর্শন হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি সম্পাদক প্রদত্ত নাম। রচয়িতা বাসুলীর সেবক অনন্ত বড় চণ্ডীদাস। আনুমানিক রচনাকাল চৌদ্দ শতকের শেষার্ধ বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধ। জয়দেবের গীতগোবিন্দেই প্রথম রাধাকৃষ্ণলীলার পর্বানুগ বিভাগ লক্ষ্য করা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রসানুগ লীলাবিভাগ এবং পর্ব বিন্যাস রয়েছে। এতে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক রাগানুগ সুফী সাধনা-পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তবে এসময়ে যে শাসক-শাসিতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তার, আভাস পাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাহিত্যিক ভাষায় তুর্কী-ফারসি-আরবি শব্দের মিশ্রণে। এই রাধাকৃষ্ণলীলা মহাভারতীয় নয়, লৌকিক কাহিনী প্রসূত। আভীর জাতির লোকগাথার নায়ক কৃষ্ণ কালে লোকস্মৃতিতে মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে ওঠেন। নয়-দশ শতক থেকেই এ লীলার লিখিত সাক্ষ্য মেলে। যদিও লৌকিক ধামালী ভিত্তি করেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গীতিনাট্য রচিত এবং এর সঙ্গে বৈষ্ণবীয় রাধাকৃষ্ণ লীলাতত্ত্বের ভাব ও তত্ত্বগত তফাৎ বিস্তর, তবু পরবর্তী বৈষ্ণবতত্ত্বে ও সাহিত্যের এ গ্রন্থের প্রভাব বিপুল। এটি পৌরাণিক আবরণে লৌকিক প্রণয়-কাহিনী। নায়ক দেবকল্প বলে মধ্যে মধ্যে আধ্যাত্মিকতার আভা আছে। কেবল পদাবলী নয়, রাধাকৃষ্ণ লীলারস কল্পনাও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদলে গড়ে উঠেছে। রূপ-সনাতন-জীব-রঘুনাথ আদি গোস্বামীর তাত্ত্বিক রচনায় এর প্রভাব দৃশ্যমান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত আধ্যাত্মিকতা বর্জিত আদিরসাত্মক রচনা হলেও এর বিশেষ গুরুত্ব অবশ্য স্বীকার্য। এটি গীতিনাট্য, বিভিন্ন ছন্দ ও রাগ-রাগিণীযুক্ত এবং ভাষা প্রাথমিকতার আড়ষ্টতা মুক্ত। এতে বোঝা যায়, এর আগে মুখে মুখে বাঙলা ভাষা শব্দে সমৃদ্ধি এবং প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও মূলত লোকসাহিত্য এবং কথকতারই লেখ্যরূপ। তাই বক্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গি প্রায়ই পৌনপুনিকতা দোষে দুষ্ট।

এর পরের রচনা হচ্ছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। আমাদের অনুমান কৃত্তিবাস রুকনউদ্দীন বরবক শাহর প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন, যেমন পেয়েছিলেন গুণরাজখান মালাধর বসু। কৃত্তিবাসের বিকৃত আত্মবিবরণীর অংশ পাওয়া গেছে। তা দিয়ে তার পৃষ্ঠপোষক রাজা ও সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে লড়াই চলছে গত ষাট বছর ধরে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অতি জনপ্রিয় গ্রন্থ। তাই ভাষায় প্রাচীনতার কোনো ছাপ রক্ষিত হয়নি। বাঙালি র ধর্মবোধ মহাভারত প্রভাবিত এবং বাঙালি র উপর রামায়ণের ধর্মাচরণ সংপৃক্ত প্রভাব নিতান্ত সামান্য। বাঙলাদেশে রাম-মন্দির নেই। কোথাও কোথাও প্রথা-রক্ষাগোছের রামনবমী উদযাপিত হয়। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি হিন্দুর কাছে রামকে একান্ত আপন করে তুলেছে। বাঙালি হিন্দুর পারিবারিক জীবনে রয়েছে এর সর্বাত্মক প্রভাব। বাঙালি হিন্দুর জীবনের আদর্শ হচ্ছে রামায়ণের পাত্রপাত্রীগণ। তাছাড়া আধুনিক হিন্দুর সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মননের উৎস হয়েছে রামায়ণ আর মহাভারত।

রামায়ণ তিনটে স্বাধীন কাহিনীর সমষ্টি। যোগসূত্র কেবল নায়ক রাম। প্রথমটিতে ঘরোয়া জীবনে ঈর্ষা-অসূয়া জাত বিপর্যয়, দ্বিতীয়টিতে গৃহবিবাদে বা ভ্রাতৃবিরোধকালে রাষ্ট্রিক জীবনে পরাশ্রিত হওয়ার পরিণাম এবং তৃতীয়টিতে দর্প ও দাপট বশে নারী সম্পর্কে নীতিভ্রষ্টতার পরিণাম স্বতোউঘাটিত। অবশ্য আর্য গৌরবগবী কবি বাল্মীকি স্বগণ-ও স্বদেশদ্রোহী সুগ্রীব-বিভীষণকে অনুগতের সম্মান দিয়েছেন যেমনটি সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদীরা এ-যুগে দিয়ে থাকে।

মালাধর বসু বরবক শাহর আগ্রহে ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশের অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন। বরবক শাহ তাঁকে গুণরাজ খান উপাধি দিয়েছিলেন। কবি বলেছেন :

স্বপ্নে আদেশ দিলেন প্রভু ব্যাস।
তাঁর আজ্ঞামত গ্রন্থ করিনু রচন।

আদিযুগে হিন্দুরা বাঙলা লিখতে গিয়ে সমাজের ভয় করেছেন। তাই স্বপ্নে প্রাপ্ত দেবাদেশের দোহাই পেড়েছেন, মুসলমানেরা করেছেন পাপের ভয়, তাই পাপ-ভয় খণ্ডন করতে চেয়েছেন যুক্তি দিয়ে। আর একটি তথ্য এই :

পুরান পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার
পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার।

পাঁচালি লেখার সাহস ও পড়ার এই অধিকার তুর্কী শাসনের দান।

কবি বলেছেন –ভাগবত শুনিল আমি পণ্ডিতের মুখে।
লৌকিকে কহিয়ে সার বুঝ মহাসুখে ॥

 কাব্যরচনার কাল–তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন ॥

১৩৯৫-১৪০২ শক বা ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ। অতএব গ্রন্থ বরবক শাহর আমলে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় ইউসুফ শাহর আমলে। কবি ছিলেন বর্ধমানের কুলীন গ্রামবাসী কায়স্থ।

জৈনুদ্দীন নামের এক কবির রসুল বিজয় কাব্যের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। এতে রসুলের সঙ্গে ইরাকরাজ জয়কুমের কাল্পনিক যুদ্ধকথা বর্ণিত হয়েছে। ভণিতায় রাজর, সুনায়ক ও রাজেশ্বর ইউসুফ খানের প্রশস্তি আছে। কেউ কেউ এই ইউসুফ খান ও সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহকে অভিন্ন মনে করেন।

এরপরে পাচ্ছি বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ বা মনসার ভাসান। বরিশালের ফুল্লশ্রী গায়ের কবি বিজয়গুপ্ত —

ঋতু শূন্য বেদ শশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতিতিলক ॥
–এই শ্লোকে কাব্যরচনাকাল নির্দেশ করেছেন। এতে ১৪০৬ শক বা ১৪৮৪-৮৫ সন মেলে। অতএব এই হোসেন শাহ আসলে সুলতান জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ যার সাধারণ্যে ডাক নাম ছিল হোসেন শাহ। এঁর কোনো কোনো মুদ্রায় হোসেন শাহী কথাটি লেখা রয়েছে।

বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য হিসেবে সুন্দর ও সুখপাঠ্য। বিদ্যাপতি কীর্তিলতায়, বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে, জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে একইভাবে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন, এতে মনে হয়, শাসক-শাসিতের সম্পর্কসূচক একটা গাধা কথা সর্বত্র চালু হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাপতি মিথিলার হিন্দুরাজার আশ্রয়পুষ্ট কবি। মুসলমান অত্যাচারের কাহিনী তাঁর কাছে শোনা কথা-মাত্র। অথচ কীর্তিলতার বর্ণনা দেখে মনে হয় তার চারপাশে এমনি ঘটনা অহরহই ঘটছে এবং তিনি নিজেও সে বিভীষিকায় ত্রস্ত। বিজয়গুপ্ত হাসন হোসেন পালায় একইরূপ অত্যাচার কাহিনী বর্ণনা করেছেন; অথচ তিনিই গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, রাজার পালনে প্রজা সুখ ভুঞ্জে নিত এবং ফুলিয়া গাঁয়ের হিন্দু ও মুসলমান সবাই সজ্জন এবং সুখে বাস করে। জয়ানন্দও চৈতন্যদেবের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেও চৈতন্য-সমকালে হিন্দুপীড়নের বাঁধাগতে বর্ণনা দিয়েছেন অথচ চৈতন্যভাবগত কিংবা চৈতন্যচরিতামৃতে তেমনটি নেই।

পনেরো শতকের অপর কবি হচ্ছেন মনসা বিজয় রচয়িতা বিপ্রদাস পিপিলাই। তিনি ছিলেন পশ্চিমবাঙলার কোনো অঞ্চলের বাদুড্যা বা নাদুড্যা গ্রামবাসী। তাঁর গ্রন্থ রচনাকাল —

সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ
নৃপতি হোসেন শাহা গৌড়ের প্রধান।

 এতে ১৪১৭ শক ১৪৯৫ খ্রীস্টাব্দ হয়।

এই হোসেন শাহ অবশ্য সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)।

বৈষ্ণব সাহিত্য

বাংলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চৈতন্যদেবের আবির্ভাব।

মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ফলে নূতন জাতি, সমাজ ও সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্দুসমাজে যে মানস-আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই বিদেশী, বিজাতি, বিধর্মী ও বিভাষীর ধর্মাদর্শ, বৈষম্য-মুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা ও মানবিকতার মোকাবেলা করতে গিয়ে হিন্দুসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দিল, তার সমাধান খুঁজলেন শঙ্কর তাঁর জ্ঞানবাদ বা মায়বাদ বলে পরিচিত অদ্বৈততত্ত্বে। ইসলাম অধ্যাত্ম হেঁয়ালি-মুক্ত প্রত্যক্ষ জীবনের ব্যবহার বিধি। একেশ্বরবাদ তার শিক্ষার উৎস। শঙ্করের বৈরাগ্যবাদে বাস্তব জীবনের গুরুত্ব অস্বীকৃত রইল বটে, তবে অদ্বৈতবাদের আবরণে একেশ্বরবাদে ও মানবিক যুক্তিবাদে আস্থা রেখে ইসলামের মোকাবেলায় তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর এ মতবাদ জীবনচর্যার সহায়ক না হলেও সেদিন একদিকে ইসলামের প্রসার রোধে এবং অপরদিকে বৌদ্ধ উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রাবল্যের সহায়ক হয়েছিল। এবং তাঁর দর্শনের পরোক্ষ প্রভাবে অর্থাৎ অদ্বৈত তত্ত্বের ভিত্তিতে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদ প্রসার লাভ করতে থাকে। ভাস্করের ভেদাভেদবাদ, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, মধ্বের দ্বৈতবাদ, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ এ ধারার বিকাশ ও বৈচিত্রের ফল। একেশ্বরবাদ, ভক্তিবাদ, বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈব ধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড় দেশে। নবীন ইসলামধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দুধর্মের ঘাত প্রতিঘাতের ফলেই দক্ষিণভারতে এই নূতন ধর্মের সমন্বয় ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে। …. ইসলামের এক দেবতা ও এক ধর্মের বিপুল বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে শঙ্কর আপসহীন অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন। …… ইসলাম ধর্মের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করাচার্যের কেবলাদ্বৈত্য বাদ থেকে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রগতির ধারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয়।…. ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমানাধিকার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান-সাধকেরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এদেশে প্রচার করছেন; রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শঙ্করের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রীতির স্তরে নেমে এলেন।

মুসলিম বিজয়ের পরে উত্তরভারতেও ইসলামের সাম্যবাদ ও উদার মানবিকতা নিম্নশ্রেণীর নিপীড়িত জনমনে নতুন আশা জাগাল, এক নয়া সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে গেল তাদের সামনে। তারা বুঝল জন্মসূত্রে নয়, যোগ্যতা দিয়েই হবে জীবন নিয়ন্ত্রিত। তখন স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হল না, আবার ইসলাম গ্রহণেও ছিল সমাজ-সংস্কারের বাধা। ফলে ঘরের বাঁধন হল আলগা, কিন্তু গন্তব্য ছিল না স্থির, তাই দেখা দিল পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস।

রামানন্দ, কবীর, নানক, একলব্য, দাদু, রামদাস প্রভৃতি সন্তদের ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ লোপ, সমাজে ও শাস্ত্রে নিম্নবর্ণের অধিকার প্রতিষ্ঠা আর মনুষ্য-সত্তায় মর্যাদা দান এবং সে-সঙ্গে শাসক-শাসিতের মধ্যে প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণীও প্রচারিত হল। এরূপে দক্ষিণভারতে ভক্তিবাদের ও উত্তরভারতে সন্তধর্মের উদ্ভব ঘটে ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবে।

বাঙলা দেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে ইসলামের প্রভাবে হিন্দুসমাজে যে ভাঙন ধরে তা রোধ করবার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দন, রঘুনাথ শিরোমণি প্রভৃতি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন। তারা শাস্ত্রের উদার ও শিথিল ব্যাখ্যায় জনচিত্ত আকর্ষণে প্রয়াসী হলেন। সমাজে নতুন মেলবন্ধনের সাড়াও পড়ে গেল। এই প্রতিরোধমূলক আন্দোলনের প্রতি জনমনে আস্থা সৃষ্টির জন্যে গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হবে হেন আছে বলে ভবিষ্যদ্বাণীও রটিয়ে দেয়া হল, তবু এতে ভাঙন রোধ করা গেল না দেখে চৈতন্য দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের সন্তদের অনুসরণে এখানেও ভূক্তিধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হলেন। চৈতন্যের সাধনাতেই ভক্তি প্রেমরূপে মহিমান্বিত হল।

১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে চৈতন্যদেবের জন্ম হয় নবদ্বীপে এবং ১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যু ঘটে। চৈতন্যদেব অল্প বয়সেই পাণ্ডিত্য, তর্কপটুতায়, চরিত্র-মাধুর্যে ও ব্যক্তিত্বে নদীয়ার গুণী-জ্ঞানী বয়স্কদেরও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন। তাঁর পিতামহের বয়সী অদ্বৈতাচার্য, বয়োজ্যেষ্ঠ রামানন্দ প্রমুখ গুণীব্যক্তিদের আনুগত্যই তার প্রমাণ। যখন তিনি হরি সংকীর্তনের মাধ্যমে তাঁর নব মতবাদ প্রচারে ব্রতী হয়েছেন, তখন তাঁর বয়স বিশ-বাইশের বেশি নয়। এতেই তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অসামান্যতা বোঝা যায়। মুসলিম রাজশক্তি পাছে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এই ভয়ে তিনি হিন্দুরাজ্যান্তৰ্গত নীলাচলে গিয়ে আখড়া করলেন। পদস্থ রাজ-কর্মচারী রূপ-সনাতন প্রমুখ অনেক গুণী-জ্ঞানী তাঁর শিষ্য হয়ে দেশে দেশে নতুন প্রেমধর্ম প্রচারে ব্রতী হলেন। বাঙলা দেশে অদ্বৈতাচার্য ও রামানন্দ রয়ে গেলেন তার প্রতিনিধিরূপে। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে চৈতন্যদেব এক অধ্যাত্ম-মনোজীবন সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন। এ কারণেই সম্ভবত বাঙলায় বৈষ্ণব মতবাদ বিশেষ প্রসার লাভ করেনি।

কিন্তু বৈষ্ণবসাহিত্য একসময়ে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনে রসের তরঙ্গ তুলেছিল। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ তৈরি হয়, আর বৈষ্ণব রচনার দ্বারা ভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত প্রসার ও বিকাশ ঘটে। কেবল সাহিত্য সৃষ্টি ও ভাষার পুষ্টির ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে বাঙলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি এবং মননেও এর প্রভাব ও দান অপরিমেয়। পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য প্রভাবের বিপুলতা ও বৈচিত্রের সঙ্গেই কেবল এর তুলনা চলতে পারে। বৈষ্ণবের প্রেমবাদের মাধ্যমে নরে নারায়ণ ও জীবে ব্রহ্ম-দর্শনের দীক্ষা পেল বাঙালি। এই প্রীতিধর্মের প্রভাবে বাঙালি র মানবতাবোধ হল তীব্র, তীক্ষ্ণ ও উদ্দীপ্ত। ষোলো শতক তাই বাঙালি র ও বাঙলা সাহিত্যের রেনেসাঁসের যুগ। বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ফলে এদেশের হিন্দু মুসলমান বৈষ্ণব মতবাদ গ্রহণ করে। এ মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে সহজিয়া ও বাউল মতবাদ পুষ্ট হয়। বৈষ্ণব-তত্ত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাবে শাক্ত-সম্প্রদায়ে ভক্তিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে এবং প্রধানত বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত পদাবলী রচিত হয়। মুসলমানেরাও রাধাকৃষ্ণকে আত্মা-পরমাত্মা, দেহ মন এবং ভক্ত-ভগবানের রূপক হিসেবে গ্রহণ করে পদ রচনা ও আস্বাদন করেছে। লৌকিক প্রণয়গীতিতেও নায়িকা অর্থে রাই এবং নায়ক অর্থে কালা সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। ব্রজবুলি নামে একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার সৃষ্টিও হয় এ সময়ে। ভাগবতাদির কথা বাদ দিলে চোখে দেখা রক্ত-মাংসের মানুষের চরিতাখ্যান রচনাও শুরু হয় এ সময় থেকেই। বাঙলায় গীতিকবিতা রচনার এবং অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার সূত্রপাতও করেন বৈষ্ণবেরাই। বৈষ্ণবীয় ভক্তি ও উদার মানবিকতার প্রভাবে কুর, নিষ্ঠুর, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ লৌকিক দেবতাও বৈষ্ণবোত্তর যুগে উদার কৃপাশীল এবং ভক্তবৎসল রূপে চিত্রিত হয়েছেন।

 চৈতন্যপূর্ব যুগের রাধাকৃষ্ণলীলার পদকার ছিলেন সংস্কৃতে জয়দেব এবং বাঙলায় বড়চণ্ডীদাস, মিথিলার বিদ্যাপতি, হোসেন শাহর কর্মচারী যশোরাজ খান এবং ত্রিপুরার রাজপণ্ডিত। চৈতন্যোত্তর যুগে প্রায় দশ হাজারের মতো বাঙলা ও ব্রজবুলি পদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ-ছয়শ পদই গীতিকবিতা হিসেবে উৎকর্ষ লাভ করেছে, বাকি পদগুলো পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে দুষ্ট ও কৃত্রিম অনুশীলনে আড়ষ্ট। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির পদও বাঙালি র মুখে মুখে বাঙলা পদে পরিণত হয়েছে। ফলে বিদ্যাপতিও এখন বাঙলার ও বাঙালি র প্রিয় কবি।

বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস, বলরাম দাস, রামানন্দ বসু, বংশীবদন, জগদানন্দ, বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ, মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস, নরোত্তম দাস প্রভৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, আলাউল ও সৈয়দ মর্তুজা শ্রেষ্ঠ পদকার। প্রেমানুভূতির ও প্রেমের আনুষঙ্গিক ভাবের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অভিব্যক্তির আধার হয়ে পদাবলী হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে অতুল্য।

চৈতন্যদেবের বাঙলা জীবনীগ্রন্থের মধ্যে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত (১৫৪১-৪২) এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত (১৫৬০-৮০) শ্রেষ্ঠ। চরিতামৃতের মূল্য বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হিসেবেই সমধিক। লোচনদাসের চৈতন্য মঙ্গলও জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল (১৫৫০-৬০) অতিরঞ্জিত বর্ণনায় দুষ্ট। চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়ের খণ্ডাংশও সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া বৈষ্ণব মোহান্ত তথা চৈতন্য পার্ষদাদির জীবনীগ্রন্থও আছে–অদ্বৈত মঙ্গল, অদ্বৈত প্রকাশ ও সীতা চরিত্র প্রভৃতি। সতেরো শতকে রচিত হয় প্রখ্যাত প্রেম বিলাস, বীর রত্নাবলী, রসিক মঙ্গল, জগদীশ বিজয়, অনুরাগ বল্লী, অভিরাম লীলামৃত প্রভৃতি; আবার আঠারো শতকে পাচ্ছি চৈতন্য চন্দ্রোদয় কৌমুদী, উদ্ধব দাসের ব্রজমঙ্গল, ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তম বিলাস প্রভৃতি।

॥ মহাভারত

আগেই বলেছি বাঙালি হিন্দুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে বলে রামায়ণ বা রাম পাঁচালি তাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মহাভারত যদিও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদর্শের কুঞ্জী তবু তা ধর্মাদর্শের উঁচু মঞ্চ থেকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রে নেমে আসেনি। কেননা মহাভারতের কুন্তী, দ্রৌপদী, ভীষ্ম, কর্ণ প্রভৃতির কাহিনী এবং অন্য নানা উপকাহিনী বাঙালি র নীতিবোধের অনুকূল নয়। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল বাঙলায় অনূদিত হয়নি। পরেও তুলনায় কম হয়েছে। অথচ আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের বারোআনা উপকরণই মহাভারতীয়। রাজকীয় কূটনীতি ও যুদ্ধশাস্ত্র সম্বলিত হওয়ায় মহাভারত রাজা ও রাজপুরুষদের প্রিয় ছিল। এরূপ কৌতূহলই ছিল পরাগল ও ছুটি খানের। তাই অশ্বমেধাদি পর্বই তাঁরা শুনতে চেয়েছেন। কামতা দরবারেও তাই এর আধিক্য দেখতে পাই। পরাগল পরমেশ্বরকে বলেছেন :

কুতুহল বহুল ভারত কথা শুনি
কেমতে পাণ্ডবে হারাইল রাজধানী।
বনবাসে বঞ্চিলেক দ্বাদশ বৎসর …
কেমত পৌরুষে পাইল নিজ বসুমতী
এহি সব কথা কহ সংক্ষেপ করিয়া
দিনেকে শুনিতে পারি পাঁচালি পড়িয়া!

তাই এর কাব্যের নাম পাণ্ডব বিজয়।

বাঙলা ভাষায় আদি মহাভারত অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। গৌড় সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর উত্তর-চট্টগ্রামস্থ সেনানী শাসক পরাগল খানে (আনু. ১৫১৩-৩২) আগ্রহে পরমেশ্বর সংক্ষেপে মহাভারত কাহিনী বর্ণনা করেন এবং সম্ভবত তাঁর পুত্র নসরত খানের ওরফে ছুটিখানের প্রবর্তনায় শ্রীকর নন্দী অনুবাদ করেন অশ্বমেধ পর্ব। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে শ্রীকর নন্দীর আদেষ্টাও পরাগল–ছুটিখান নন।

মহাভারতের তৃতীয় অনুবাদক সম্ভবত রাঢ় অঞ্চলের রামচন্দ্র খান। ইনি সম্ভবত ১৫৫২-৫৩ সনে তার কাব্য রচনা করেন। এ তিনজনের কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। বাঙলা দেশের সর্বত্র এঁদের পুথি পাওয়া গেছে। সম্ভবত সতেরো শতকের কবি কাশীরাম দাসের মহাভারত এঁদের কাব্যযশ ম্লান করে দেয়।

কামতা-কামরূপের রাজসভায় মহাভারতের চর্চা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক কবিই বাঙলায় মহাভারত অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন রাজা ও রাজকুমারের আগ্রহে। কামতা-কামরূপের রাজা বিশ্বসিংহের পুত্র সমরসিংহের অভিপ্রায় অনুসারে কবি পীতাম্বর উষাপরিণয় (১৫৩৩) ও নলদময়ন্তী (১৫৪৪) রচনা করেন। দুটোই যথাক্রমে বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত ও মহাভারত অবলম্বনে রচিত। পীড়াম্বর মার্কণ্ডেয় পুরাণ কাহিনীও (১৫০৩) বাঙলায় লিখেছিলেন। এছাড়া কামতা কামরূপের পরবর্তী রাজা শুক্লধ্বজের সভাকবি অনিরুদ্ধ মহাভারত, তাঁর পুত্র গোপীনাথ মহাভারতের দৌণপর্ব এবং অনিরুদ্ধের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কবিচন্দ্রও নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। কামতা রাজ্যে মহাভারত রচয়িতা আর আর কবি হচ্ছেন বিশারদ চক্রবর্তী, রুদ্রদেব, গোবিন্দ কবিশেখর (১৬২৭-৩২), শ্রীনাথ (১৬৩২-৬৫), দ্বিজ রঘুরাম, জয়দেব, হরেন্দ্র নারায়ণ, ব্রজসুন্দর কৌশারি, দ্বিজ বলরাম, বৈদ্যনাথ, পরমানন্দ, মহীনাথ, রামবল্লভদাস, লক্ষ্মীরাম, বৈদ্য পঞ্চানন, রামনন্দন প্রভৃতি।

এদিকে মহাভারত কাহিনীর অনুসরণ পাচ্ছি সতেরো শতকে। এই শতকের কবিদের মধ্যে কাশীরামদাস সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাঁর কাব্য আজো হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে পরম আগ্রহে পড়াশুনা হয়। কাশীরামের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত, পিতামহ সুধাকর ও প্রপিতামহ প্রিয়ঙ্কর। নিবাস বর্ধমান জেলার সিঙ্গি বা সিদ্ধি গ্রামে। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা গদাধরও কবি ছিলেন। কনিষ্ঠ কৃষ্ণদাস রচনা করেন শ্রীকৃষ্ণ বিলাস এবং গদাধর লেখেন জগন্নাথ মঙ্গল। কাশীরাম বিরাট-পর্বের কতকাংশ অবধি লিখে পরলোক গমন করেন।

আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর।

তারপর তার ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ রচনা করেন। তাঁর উক্তি এরূপ :

ভ্রাতৃপুত্র হই আমি তিহে খুল্লতাত
 প্রশংসিয়া আমারে করিল আশীর্বাদ।
 আয়ুত্যাগে আমি বাপু যাই পরলোক
 রচিতে না পাইল পোথা রহি গেল শোক।
রচিবে পাণ্ডব কথা পরম সাদরে।
তাহার প্রসাদে আমি পুরাণ রচিল।

কিন্তু নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ পুরো রচনা করেছিলেন কিনা বলা যায় না। কেননা কাশীদাসী মহাভারতের শান্তি পর্ব ও স্বর্গারোহণ পর্বের পুথির পাঠে যথাক্রমে কৃষ্ণানন্দ বসু ও কাশীরামের পুত্র জয়ন্ত দাসের ভণিতা মেলে। কাশীদাসের কাব্যের মাধ্যমেই মহাভারত ও তার ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালি র পরিচয়। সেজন্যে কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতো কাশীরাম দাসের মহাভারতের দানও বাঙালি জীবনে অপরিমেয়। মহাভারতের অপর এক রচয়িতার নাম বিশারদ। রচনাকাল ১৬১৩ সন। সতেরো শতকে মহাভরাতের অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন নিত্যানন্দ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ বসু, রামনারায়ণ দত্ত, অনন্ত মিশ্র, দ্বিজ হরিদাস, ঘনশ্যাম দাস, দ্বিজ প্রেমানন্দ, দ্বিজ অভিরাম, কৃষ্ণরামদাস, জ্ঞানদাস, ষষ্ঠীবর সেন, তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, রাজেন্দ্র দাস, রামেশ্বরী নন্দী, রামলোচন প্রভৃতি। এঁরা সম্ভবত মহাভারতের খণ্ডাংশের অনুবাদক।

আঠারো শতকের কবি দুর্লভসিংহ, গোপীনাথ দত্ত (বা নন্দী বা পাঠক), সুবুদ্ধি রায়, অম্বষ্ঠ বল্লভ, পুরুষোত্তম দাস, ভবানী দাস, দ্বিজরাম লোচন, দ্বিজ গোবর্ধন, শ্রীকৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ, অকিষ্ণন দাস, বসুদেব, নিমাই, রাজীব সেন প্রভৃতির কাব্যের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে।

মানুষের চরিত্রের, আচরণের, সমস্যার ও সম্পদের হেন দিক নেই, যা মহাভারতে চিত্রিত ও বর্ণিত হয়নি। তাই বলা হয়–যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই জগতে। পাত্র-পাত্রী ও ঘটনা কাহিনীভারে ভারী বলেই নাম মহাভারত! গীতাও মহাভারতের একটা সর্গ।

॥ রামায়ণ ॥

কৃত্তিবাসের পরে পনেরো-ষোল শতকে রামায়ণ কেউ রচনা করেননি। বৈষ্ণব প্রভাবে তখন সবাই কৃষ্ণলীলা-রসের তরঙ্গাঘাতে দিশাহারা। কাজেই রামায়ণ রচন-শ্রবণের দিকে কারুর উৎসাহ ছিল না। সতেরো শতকে যখন বৈষ্ণবীয় নেশা কিছুটা মন্দা হল তখন আবার নতুন করে রামায়ণ গান শুরু হয়েছে। এ সময়কার উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান রামায়ণ-রচক হলেন নিত্যানন্দ আচার্য। ইনি সতেলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি ছিলেন, পৈত্রিকনিবাস পাবনা জেলার বড়বাড়ী বা অমৃতকুণ্ডা। ইনি সতেরো শতকের শেষার্ধের কবি। অদ্ভুত রামায়ণ অবলম্বনে রচিত বলে এই গায়েন-কবিও অদ্ভুতাচার্য নামে পরিচিত হন। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে রামশঙ্কর দত্ত নামের এক কবিও অদ্ভুতাচার্য বলে কলমী নাম গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিজ ভবানী নাথ, দ্বিজ লক্ষ্মণ প্রভৃতিও রামায়ণ : রচনা করেন আঠারো শতকে।

॥ ভাগবত ও কৃষ্ণ বিষয়ক রচনা ৷

 মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্যের পরে ষোলো ও সতেরো শতকীয় অনেক কবিরই ভাগবত কৃষ্ণ বিষয়ক বাঙলা রচনা পাওয়া গেছে। বৈষ্ণবেরা তো লিখেইছেন, তাঁদের প্রভাবে পড়ে অবৈষ্ণবেরাও পৌরাণিক ও মহাভারতীয় কৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করেছেন উচ্চকণ্ঠে।

সম্ভবত ষোলো শতকের প্রথমার্ধে রচিত হয় দ্বিজ গোবিন্দের কৃষ্ণমঙ্গল, এটি ভক্ত বৈষ্ণবের রচনা। এ শতকের দ্বিতীয় রচনা রঘু পণ্ডিতের কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গিণী। মাধব আচার্যের শ্রীকৃষ্ণ– মঙ্গল, কবিশেখরের গোপাল বিজয়, শ্যামদাসের গোবিন্দ মঙ্গল, কৃষ্ণদাসের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গলও ষোলো শতকের রচনা। এ সময়কার একটি বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত গ্রন্থ তথা তাত্ত্বিক গ্রন্থ হচ্ছে কবিবল্লভের রসকদম্ব। সতেরো শতকে এই ধারায় আরো কয়েকখানি কাব্য রচিত হয়েছে। এগুলোতে পৌরাণিক প্রভাব ক্ষীণ হয়ে বৈষ্ণবীয় প্রভাবই প্রকট হয়েছে বেশি। সতেরো শতকের বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হচ্ছে ব্রজমোহনদাসের চৈতন্যতত্ত্ব প্রদীপ। এ শতকের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণলীলাবিষয়ক কাব্য হচ্ছে ভবানন্দের হরিবংশ। পরশুরাম, জীবন, অভিরাম দাস, হরিদাস, যশশ্চন্দ্র, বাণীকণ্ঠ, বংশীদাস প্রভৃতি শ্ৰীকৃষ্ণলীলার পূর্ণ বা খণ্ড বিবরণ-কাব্য রচনা করেছিলেন। আঠারো শতকের কৃষ্ণবিষয়ক কাব্যের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে বলরাম দাসের কৃষ্ণলীলামৃত, দ্বিজ রামনাথের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, শঙ্কর চক্রবর্তীর গোবিন্দ মঙ্গল, মাধবেন্দ্রের ভাগবত সার, দ্বিজ রামেশ্বরের গোবিন্দ মঙ্গল, প্রভুরামের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল, গঙ্গারামের গোপাল চরিত, রামদাসের শ্রীকৃষ্ণ চরিত, শিবানন্দের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, যুগল কিশোরের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও মনোহর সেনের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এবং এমনি আরো অনেকের কাব্যের সন্ধান মিলেছে। এ ধারা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি অব্যাহত ছিল।

॥ লৌকিক দেবতার পাঁচালি

রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত হচ্ছে আদর্শ অনুশীলনের কৃত্রিম প্রয়াসজাত সৃষ্টি। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল জনসমাজে সমাদৃত হয়নি। রামায়ণ বৈষ্ণব-প্রভাবের যুগে বিস্মৃতপ্রায় কাব্য, এবং যদিও ভক্তিবাদ সুফীমতের মিশ্রণে প্রেমরূপের মহিমান্বিত রূপ লাভ করে চৈতন্যমতবাদে, তবু তা জীবনকে আড়াল করে অধ্যাত্মলোক সৃষ্টির প্রয়াস বলে বাঙালি র স্বভাব-ধর্মের সঙ্গে এর অকৃত্রিম সঙ্গতি ছিল না। তাই বাঙালি চরিত্রের খাঁটি পরিচয় রয়েছে তার মানসপ্রবণতার অনুগ লৌকিক দেব-কল্পনায়। তার জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতা সৃষ্টির কল্পনায়, আদর্শে ও তত্ত্বে প্রকটিত হয়েছে তার চারিত্রিক স্বরূপ লক্ষণ, অঙ্কিত হয়েছে তার সমাজ-সংস্কৃতির নকশা। এখানে দেবতাও প্রবল-প্রতাপ মানুষ। মঙ্গলকাব্যে তাই মানুষ আর মানবিক রমই মেলে। মঙ্গল কাব্যগুলো বাঙালি হিন্দুর মন-মনন ও সংস্কৃতির প্রসূন।

অর্থই হচ্ছে শক্তির উৎস, ধন যার আছে মান তারই। ধনী বলেই তো রাজা শক্তিমান, রাজার পরে সমাজে সদাগরই ধনী। তাই মধ্যযুগের বাঙলায় বণিক চাঁদ সদাগর-ধনপতি সদাগরেরাই ছিল সমাজের নিয়ামক। বহির্বাণিজ্যে তাদের বাধা ছিল না। তারাই ব্রাহ্মণ্য আদর্শের ধারক ও রক্ষক। তাই লৌকিক দেবতার লক্ষ্যও তারা। মানুষ মুখে যতবড় মহৎ কথাই বলুক, বুকে পোষণ করে জীবন-জীবিকায় নিরাপত্তার ভাবনা। তাই প্রাকৃত শক্তির প্রসন্নতাকামী কৃষি-নির্ভর, রোগভীরু, অজ্ঞ এবং অসহায় মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নিয়তিরূপ দেবতার প্রভাব অনুভব করল যখন, তখন দেবতার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় রইল না তাদের। মধ্যযুগের বাঙলায় লৌকিক ধর্মের ইতিহাস হচ্ছে এই পার্থিব জীবনে সুখ ও নিরাপত্তাকামী মানুষের উপ ও অপদেবতা সৃষ্টির ও পূজার কাহিনী। এর ভিতরে কোনো অপার্থিব সুমহৎ আদর্শ বা লক্ষ্য নেই। আছে এই মাটিকে–এই জীবনকে ভালোবাসার স্বাক্ষর; সুখ ও শান্তি লাভের নিদারুণ প্রয়াস। মঙ্গলকাব্যগুলোতে তাই। দেবলীলার আবরণে বর্ণিত হয়েছে সমকালীন বাঙলাদেশের ও বাঙালি জীবনের অন্তরঙ্গ ইতিকথা। ফুল্লরা-খুল্লনা-বেহুলা-রঞ্জাবতী-লখাই-গৌরী, কিংবা লহনা-দুর্বলা-হীরা-মনসা-চণ্ডী অথবা শিবাদ ধনপতি-শ্ৰীমন্ত-কালকেতু-লাউসেন-কর্ণসেন-কালুডোম আর মহামদ-মুরারিশীল-ভাড়দত্ত ভালোয়ময় নামভেদে আমাদেরই প্রতিবেশী–আমাদেরই ঘরের লোক।

॥ চণ্ডীমঙ্গল ॥

চণ্ডীদেবী এক নন, অনেক। তাঁদের মধ্যে যিনি পরে তারা-গৌরী-পার্বতী-দুর্গা প্রভৃতি নামে পৌরাণিক আভিজাত্য লাভ করেন, সেই শিবপত্নী চণ্ডীই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উপজীব্য। চণ্ডী কাব্যের দুটো উপাখ্যান। একটি আদি, যা নিম্নবর্ণের কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনতে রূপ পেয়েছে। আর একটি পরবর্তী-ধনপতি সদাগর নামেতেই তা তুর্কী আমলের প্রভাব স্বীকার করেছে। চণ্ডী মাহাত্ম্যের জড় পাই বৃহদ্ধর্ম পুরাণে। আসলে এক অনার্য নারীদেবতা-চণ্ডী নামই যার সাক্ষ্য বহন করছে–বৌদ্ধসমাজে বজ্রতারা রূপে পূজিতা হন, সেই বজ্রতারাই ব্রাহ্মণ্য সমাজে তারা বা চণ্ডী নামের আবরণে গৃহীত হয়েছেন।

প্রাচীন অনার্য নারীদেবতা এই চণ্ডী, ইনি শক্তিস্বরূপা, শতাধিক নামে চণ্ডী অনার্যসমাজে পূজিতা হতেন। ক্রমে আর্যসমাজে তিনি শিব বা হর-গৃহিণীরূপে শিবানী, উমা, গৌরী, তারা প্রভৃতি নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, পৌরাণিক যুগে এর মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অসামান্যরূপে বেড়ে যায়। দশ প্রকার শক্তির আধার-রূপে তার দশ মহাবিদ্যার দশমূর্তি পরিকল্পিত হয়েছে, যথা : কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। চণ্ড-চণ্ডী নামের মধ্যেই তাদেরকে প্রচণ্ড শক্তির আধার-রূপে স্বীকার করা হয়েছে। চণ্ডী মুখ্যত পশ্চিমবঙ্গীয় তথা রাঢ় অঞ্চলের দেবতা।

একসময় ব্রাহ্মণ্য দর্শনে শিব আশুতোষ-ভোলানাথ নামে যোগী-তপস্বী হিসেবে নিগুণ শক্তি স্বয়ম্ভুরূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পান। আর চণ্ডী কালো বলে কালিকা, কালী বা শ্যামা নামে শক্তিদেবতারূপে পূজিতা হতে থাকেন। সম্ভবত বৌদ্ধপ্রভাবে পরে পরে তার উগ্র রৌদ্র-রূপ কমনীয় করুণাময়ী-রূপে পরিণত হয়। তখন তিনি অন্নপূর্ণা, কমলা ও দুর্গারূপে বাঙলা দেশে পূজিতা হতে থাকেন। দূর্গারূপে দশদিক রক্ষার প্রতীক দশপ্রহরণধারিণী হিসেবে তাঁর দশভূজা মূর্তি পরিকল্পিত হয়। দুর্গারূপে তিনি শ্যামা নন–গৌরী। অনার্য প্রভাবে এককালে তিন-অনার্য দেবতা–বিষ্ণু, শিব ও কালী (চণ্ডী) সর্বভারতিক দেবতারূপে পূজিত হন। ফলে ব্রাহ্মণ্যসমাজ বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৈষ্ণবীয় প্রেমবাদের প্রভাবে বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত মত তথা সন্তানবৎসল জননী রূপিণী শ্যামা-ভক্তিবাদ বাঙলা দেশে আঠারো শতক থেকে প্রসার লাভ করতে থাকে। এভাবে চণ্ডীমাহাত্মজ্ঞাপক চণ্ডীমঙ্গল, কালিকা মাহাত্ম্যসূচক কালিকামঙ্গল, গৌরী পরিচায়ক সারদামঙ্গল ও গৌরীমঙ্গল দুর্গামহিমা জ্ঞাপক দুর্গামঙ্গল এবং মাতৃরূপিণী শ্যামার স্তুতির জন্যে শ্যামাসঙ্গীত রচিত হয়েছে। এতে গৌরী-দুর্গা-উমা-কালী এ চার স্বরূপে তাঁর মহিমা বর্ণিত। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন মধুর রসের প্রাধান্য, এখানে তেমনি মান-অভিমানের সুরই প্রবল। এই শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠকবি রামপ্রসাদ সেন।

চণ্ডী মুখ্যত রাঢ় অঞ্চলের দেবতা। পশুর ইষ্টদেবী চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতু উপাখ্যানে ব্যাধের ইষ্টদেবীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বাহন গোধিকা। মনসা, চণ্ডী প্রভৃতির কাহিনী পাঁচালিরূপে লিখিত হওয়ার আগে কথকতার মাধ্যমে চালু ছিল :

ধর্মকর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গল চণ্ডীর গীত করে জাগরণে,
 দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন…..
মদ্যমাংস দিয়া কেহ যক্ষপূজা করে।
 যোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল গীত
এই সব শুনিতে লোক আনন্দিত।

চণ্ডীমঙ্গলের প্রথম লিখিত পাঁচালির উল্লেখ রয়েছে মুকুন্দরামের ও মাণিক দত্তের কাব্যে। তারা এক মাণিক দত্তকে চণ্ডীগীতির আদি রচয়িতা বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় এক মাণিক দত্তের পাঁচালি পাওয়া গেছে। ইনি মালদহ অঞ্চলের কবি। তাঁর কবিত্ব-সম্পদ ছিল না বটে, তবে চণ্ডী পাঁচালির প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তাঁর কাব্যেই পাচ্ছি। তাঁর কাব্যও রচিত হয় দেবীর স্বপ্নদেশে এবং বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই যে, কাব্যের উপক্রমণিকায় কবি স্বয়ং দেবীর বরপুষ্ট নায়ক। ইনি সম্ভবত আঠারো শতকের লোক। দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য হচ্ছেন চণ্ডী পাঁচালির তৃতীয় কবি। এর কাব্য রচনাকাল ১৫০১ শক বা ১৫৭৯-৮০ খ্রীস্টাব্দ।

ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক নিয়োজিত
দ্বিজ মাধবে কহে সারদা চরিত।

তাঁর কাব্যে অর্জুন-তুল্য বাদশাহ আকবরের স্তুতি আছে।

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং ষোলো শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের যুগ রূপকথার আমল। আলৌকিক দেব-মহিমার কাহিনী বর্ণনা করতে বসেও মুকুন্দরাম তার প্রতিবেশ ভুলতে পারেননি। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব এখানেই। তিনি কাব্যে এক গ্রাম্য পরিবেশে যুগদুর্লভ ঘরোয়া আবহ সৃষ্টি করেছেন।এ হয় তার কল্পনাশক্তির অভাবপ্রসূত, নয়তো তাঁর যুগোত্তর অসামান্য জীবনবোধ, লোকচরিত্র জ্ঞান ও শিল্পীসুলভ তীক্ষ্ণ রসিকদৃষ্টির সুফল। চিত্র, নকশা এবং আধুনিক উপন্যাসের আদল এতে আশ্চর্য নৈপুণ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে আমরা নাট্যকার দীনবন্ধুর মধ্যে এমনি কবি-দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছি। জীবনে-রসে রসিক এই কবির কাব্যের সুষমা তাই আজো অম্লান। বৈষ্ণব প্রভাব-পুষ্ট কবিচিত্তের স্নিগ্ধ সহানুভূতির প্রলেপে চণ্ডীমঙ্গল রসশ্রীমণ্ডিত হয়েছে। অবশ্য মুকুন্দরাম দ্বিজ মাধবাচর্যের কাছে নানা বিষয়ে ঋণী। মুকুন্দরাম ষোলো শতকের শেষপাদে কাব্য রচনা করেন।

এরপর সম্ভবত বৈষ্ণবমতের ও সাহিত্যের প্রভাববশত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বিশেষ বিকাশ লাভ করেনি। রামানন্দ, যতি লালা, জয়নারায়ণ রায়, দ্বিজ কমললোচন, দ্বিজ জনার্দন প্রভৃতি দু-চার জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রচনাই সতেরো শতকে এই ধারার ক্ষীণ ও ম্লান অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। হরিরাম, ভবানী শঙ্কর, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, রামদেব প্রভৃতিও চণ্ডীর মাহাত্ম্য-কথা রচনা করেছেন।

এরপর চণ্ডী নাম ও কালকেতু-ধনপতি-উপাখ্যান বর্জিত হয়েছে। কালিকা নাম ও বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়োপাখ্যান দিয়ে নতুন করে কালিকা মঙ্গল রচিত হতে থাকে। এতে মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই। কেবল কালিকার বরে সন্তান লাভ এবং কালিকার স্তুতির দ্বারা সুন্দরের জীবন রক্ষা ছাড়া এতে কালিকার মঙ্গলকাব্য-সুলভ কোনো ভূমিকা নেই। এখানে কালিকা সুপ্রতিষ্ঠিত তথা স্বীকৃত ইষ্ট দেবতা মাত্র।

অবশ্য কালিকামঙ্গলও ষোলো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই রচিত হয়েছে। এর প্রথম কবি দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ যুবরাজ (ও সুলতান) ফিরোজ শাহর (১৫৩২-৩৩) প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন। আর শাবারিদ খানও এই শতকের প্রথমার্ধে কাব্য রচনা করেন। আঠারো শতক অবধি কালিকামঙ্গলের অন্যান্য কবি হচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী, গোবিন্দ দাস, কৃষ্ণরাম দাস, রাধাকান্ত মিশ্র, রামপ্রসাদ সেন, কবীন্দ্র চক্রবর্তী, প্রাণরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য প্রভৃতি। ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গলও একটি কালিকামঙ্গল। তাঁর কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত–দেবী খণ্ড, বিদ্যাসুন্দর খণ্ড ও মানসিংহ-ভবানন্দ খণ্ড। শেষোক্ত কাহিনী তার মৌলিক সৃষ্টি। গোটা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্রের স্থান নানা কারণে অনন্য। তাঁর কাব্যের নামও অভিনব। আঠারো শতকে বগী হার্মাদের হামলা, য়ুরোপীয় বেনের দৌরাত্ম্য, পতনোখ মুঘল সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খল শাসন, অমাত্য ও সামন্ত প্রাধান্য ও তজ্জাত স্বৈরাচার প্রভৃতি যখন জন-জীবনে অভিশাপরূপে নেমে এসেছে, তাদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ব্যাহত করেছে, তেমনি পরিবেশে ভারতচন্দ্রের জন্ম। তিনি নিজেও প্রথম জীবনে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে নানা দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন। তাই তাঁর দেবী অন্নদা– অন্নপূর্ণা। আশ্রয়দাতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগ্রহে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের কীর্তিকথা দেবীমাহাত্মের আবরণে রচনা করেছেন। কিন্তু অখ্যাত ভবানন্দের ঘটনা-বিরল জীবন কাহিনী কাব্যরস সৃষ্টির অনুকূল নয় বলেই ইনি দেবী খণ্ড এবং বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান সুকৌশলে কাব্যান্তর্ভুক্ত করেন। ভারতচন্দ্র বিদগ্ধ কবি, শহুরে কবি, দরবারি কবি, রসিক কবি। তার চেয়েও বড় কথা–ভাব, ভাষা, ছন্দ ও ভঙ্গির উপর তার অসামান্য কর্তৃত্ব। জগৎ ও জীবন, সমাজ ও ধর্ম, মানুষের দোষ ও গুণ, আশা ও হতাশা তাঁর বিকারহীন রস-দৃষ্টিতে তামাশার মতো প্রতিভাত হয়েছে। উদার ও সহিষ্ণু রসিকের মতো তিনি জনজীবনের সর্বপ্রকার অসঙ্গতি থেকে কেবল বিদূষক-সুলভ রসিকতার উপাদানই খুঁজে পেয়েছেন। বলা চলে এক বেপরোয়া বাঁচালতার কাব্য এই অন্নদামঙ্গল। এ কাব্য রচিত হয় :

বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা।
সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা ॥

১৬৭৪ শকে বা ১৭৫২-৫৩ খ্রীস্টাব্দে।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাজসভা কবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।

মুক্তারাম সেনের সারদামঙ্গল (১৬৬৯ শকে বা ১৭৪৭-৪৮ খ্রীস্টাব্দে), কৃষ্ণজীবন দাসের দুর্গামঙ্গল (১৭ শতকের শেষার্ধে), কবিচন্দ্র মিশ্র (১৪৯৩-১৫১৯) ও দ্বিজ শিব-চরণের গৌরীমঙ্গল প্রভৃতি চণ্ডীরই বিভিন্ন রূপ ও গুণের পরিচায়ক কাব্য।

॥ শিবায়ন ॥

 এই চণ্ডীমঙ্গল ও নাথসাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিবের স্বতন্ত্র মাহাত্ম্য-কাহিনী শিবায়ন নামে রচিত হতে থাকে। শিব অতি প্রাচীন সর্বভারতীয় অনার্য দেবতা। তাই তাকে কেন্দ্র করে নানা গোত্রীয় ধারণা অসমন্বিত ও বিচিত্ররূপে প্রকটিত হয়েছে। এ জন্যে শিব নানা বিরুদ্ধ-গুণে, বিভিন্ন আকারে ও অসংলগ্ন জটিল তত্ত্বে অদ্ভুত মূর্তি লাভ করেছেন। বাঙলা শিবায়নে তাঁর দুইরূপ দুইধারা। একটি পৌরাণিক, অপরটি লৌকিক। পৌরাণিক ধারায় শিব-চতুর্দশীর গুরুত্ব জ্ঞাপক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। চট্টগ্রামের রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) ও রাম রাজার মৃগলুব্ধ সংবাদ এই ধারার রচনা।

কৃষির দেবতা চাষী শিবের লৌকিক কাহিনীতেই দরিদ্র বাঙালি র গার্হস্থ্য জীবনের অকৃত্রিম আলেখ্য বিধৃত। মেনকা কন্যাবিদায়কালে জামাতা শিবকে মিনতি করে বলছেন : কুলীনের পো-কে অন্য কী বলিব আমি, (আমার মেয়েকে) আঁঠু ঢাকি বস্ত্র দিও পেট ভরি ভাত-কন্যার ভাগ্য সম্বন্ধে পিতামাতার চিরন্তন উৎকণ্ঠার এমন মর্মস্পর্শী আন্তরিক প্রকাশ সুদুর্লভ। এই লৌকিক শিবায়ন কাব্যের মধ্যে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের (১৭১০ খ্রী.) কাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ। কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়, শঙ্কর, কবিচন্দ্র, দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম প্রভৃতিও শিবায়ন রচনা করেছেন। মধ্যযুগে দেবকাহিনী প্রায়শ মঙ্গল নামে পরিচিত ছিল। আলোচ্য প্রধান শাখাগুলো ছাড়াও বহু উপ ও অপদেবতার মঙ্গল রচিত হয়েছে, যেমন গঙ্গামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, সরস্বতী মঙ্গল, লক্ষ্মী মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, কপিলা মঙ্গল, শনি মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল প্রভৃতি।

॥ মনসামঙ্গল ॥

মনসামঙ্গলের কাহিনী দেব-মানবের সংগ্রামের ইতিকথা। সে-সংগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু মানব ও মানবিকতা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর ও বেহুলা গোটা বাঙলা সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি। মনসামঙ্গল কাব্য মুখ্যত পূর্ব বাঙলার দান। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র তীরের সংগ্রামী মানুষের অদম্য অধ্যবসায়ের ও মুসলমানের একেশ্বরবাদের প্রভাব রয়েছে চাঁদ-বেহুলার চরিত্র কল্পনায়। চাঁদ দেবীর কাছে মাথা নত করেনি, সে আত্মসমর্পণ করেছে এক বালিকার অসামান্য সাহস, অধ্যবসায় ও কৃসাধনার কাছে। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও কৃতসঙ্কল্প মানুষের ও মনুষ্যত্বের এমনি চিত্র সাহিত্যে বিরল।

পনেরো শতকের কানা হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাইর পরে মোলো শতকে কোনো মনসার ভাসান রচয়িতার সন্ধান পাইনে; আমাদের বিশ্বাস বৈষ্ণবপদাবলীর রস-বন্যায় কিছুকালের জন্যে অন্য তত্ত্বচিন্তা চাপা পড়েছিল। তাই আবার সতেরো শতক থেকেই মনসামঙ্গল রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি। এই শতকে আমরা দ্বিজ বংশীদাস রামায়ণের কবি চন্দ্রাবতী এঁরই কন্যা] নারায়ণদেব, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিষ্ণুপাল, কালিদাস, রসিক মিশ্র, দ্বিজ কবিচন্দ্র, সীতারাম দাস প্রভৃতি কবিদের পাচ্ছি। এদের মধ্যে দ্বিজ বংশীদাস, নারায়ণ দেব ও ক্ষেমানন্দ শ্রেষ্ঠ।

আঠারো শতকের কবি হচ্ছেন জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, হরিদাস, কৃষ্ণানন্দ, জানকীনাথ, জগন্নাথ, ষষ্ঠীবর সেন, গঙ্গাদাস সেন, বাণেশ্বর প্রভৃতি।

॥ পীর পাঁচালি

 সত্যপীর মাহাত্ম্য-কথা ষোলো শতক থেকেই রচিত হতে থাকে। মোলো শতকে শেখ ফয়জুল্লাহ সত্যপীর বিজয়, কঙ্ক বিদ্যাসুন্দর এবং কৃষ্ণরাম দাস রায়মঙ্গল রচনা করেন। সত্যপীরের হিন্দু চেলা দক্ষিণের রায় (রাজা) এবং মুসলমান-ভক্ত বড় খাঁ গাজী। প্রায় ষাট-সত্তর জন হিন্দু কবি ও কিছু মুসলমান কবি সতেরো থেকে উনিশ শতক অবধি সত্যপীর পাঁচালি রচনা করেছেন। সত্যপীর তত্ত্বের প্রভাবে অনেক লৌকিক দেবতা বা কাল্পনিক পীর কাহিনীও লিখিত হয়েছে, যেমন বনবিবি-বনদেবী, শীতলা, ওলা, দক্ষিণরায় বড়খগাজী, ষষ্ঠীদেবী, কালুগাজী-কালুরায় প্রভৃতি। আবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিকেন্দ্রী পীর-পাঁচালি যথা–মোবারক, গোরাচাঁদ, ইসমাইল গাজী, খাঞ্জা খা, সফী গাজীর কাহিনী প্রভৃতিও রচিত হয়েছে এ সূত্রে। পীর পাঁচালি নিম্ন ও পশ্চিম বঙ্গের সৃষ্টি। বাউলমতের মতো পীর-নারায়ণ সত্যকে কেন্দ্র করেও নিম্ন ও পশ্চিম বাঙলার সাধারণ ও দুস্থ হিন্দু মুসলমানের এক মিলন-ময়দান তৈরি হচ্ছিল। হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পীর। দুইকুলে সেবা লয় হইয়া জাহির। পীর-নারায়ণ সত্য এমনকি অল্লোপরিষদের মতো একসময়ে সর্বভারতীয় ও সর্বজনীন দেবতা হয়ে উঠেছিলেন। ভৈরবচন্দ্র ঘটক, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামেশ্বর চক্রবর্তী, ফকির রাম দাস, বিকল চট্টো, কৃষ্ণকান্ত, শিবচরণ, রামশঙ্কর, গিরিধর, অযোধ্যারাম, দ্বিজ বিশ্বেশ্বর, জনার্দন, ফকির চাঁদ, ভারতচন্দ্র রায়, ফকির গরীবুল্লাহ, কঙ্ক, আরিফ, ফৈজুল্লাশাহ প্রভৃতি অনেকেই সত্যনারায়ণ পাঁচালি লিখেছেন উনিশ শতক অবধি।

॥ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য।

শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে ব্রাহ্মণ্য সমাজে যে রেনেসাস আসে তার ফলে নব ব্রাহ্মণ্যধর্মের দ্রুত প্রসার ঘটে। বৌদ্ধ বিলুপ্তি তার অনিবার্য ফল। বাঙলাদেশের বজ্রযান, কালচক্র্যান ও সহজ যানভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় হিন্দুয়ানি আবরণ গ্রহণ করেই প্রচ্ছন্নভাবে স্বধর্মে সুস্থির থাকতে চেষ্টা করে। এই চেষ্টারই পরিণতি দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গের ধর্মমতবাদে, নাথ-যোগী-পন্থে, বৈষ্ণব সহজিয়াবাদে ও বাউল মতে।

বৌদ্ধ বিলুপ্ত সত্ত্বেও নাথ-সাহিত্য লুপ্ত হয়নি, কারণ যোগতাত্ত্বিক বিষয় বলে হিন্দু যোগী ও মুসলমান সূফীর কাছে তা সমাদৃত ছিল। তাই ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদের গান, গোরক্ষবিজয়-যোগীকাঁচ প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান কর্তৃক রচিত হয়েছে। ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয় (১৫৭৫), সতেরো শতকের কবি ভবানীদাসের ময়নামতীর গান, আঠারো শতকের দুর্লভ মল্লিক ও শুকুর মুহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস এবং পুরোনো গাথা প্রভৃতি এই ধারাকে প্রবহমান রেখেছে।

সহজযানপন্থী প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা এই সময়ে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু তাদের বিশ্বাস-সংস্কার তখনো তারা জিইয়ে রাখে। ফলে বৈষ্ণব থেকে বৈষ্ণব-সহজিয়া, মুসলমান ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ থেকে বাউল মত গড়ে উঠে। চর্যাগীতি এদেরই ঐতিহ্য এবং বৈষ্ণব সহজিয়াপদ ও বাউল গান চর্যাগীতিরই আধুনিক রূপান্তর। হিন্দু সমাজের নাথ-যুগীরা (পেশায় তাঁতি) পুরোনো বৌদ্ধ নাথপন্থরই ধারক।

বৌদ্ধ আদিনাথ ও বজ্রতারাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা শিব-তারা নামের আবরণে পূজা করতে থাকে এবং গোরক্ষনাথ, মীন নাথ বা মৎস্যেন্দ্র নাথ প্রভৃতি বৌদ্ধ সিদ্ধা প্রবর্তিত সাধনপন্থও শৈবনাথপন্থরূপে পরিচিত হয়। ফলে এগুলো শৈবমতের শাখারূপে ব্রাহ্মণ্য সমাজে গৃহীত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুর পূজারীর ধর্মঠাকুর মূলত অনার্য সূর্যদেবতা। বৌদ্ধ আমলে বৌদ্ধের ত্রিশরণের অন্যতম প্রমূর্ত ধর্মরূপে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের পর নিম্নবর্ণের দেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হচ্ছেন। তার মাহাত্ম্য-কথাই ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হয়েছে।

মনসা ও চণ্ডীমঙ্গলের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের পার্থক্য এই যে, ধর্মঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত নির্বিবাদী দেবতা। কাহিনীতেও বৈচিত্র্য এবং বিস্তার আছে। এক বিস্তৃত পরিসরে রাজা আর ভিখারি, অভিজাত ও ডোম, ন্যায়নিষ্ঠা ও শাঠ্য, বাহুবল ও কূটকৌশল, বিদ্রাহ ও বিগ্রহ, গার্হস্থ্য সমস্যা ও রাজসভার দুশ্চিন্তার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এসব কারণে ধর্মমঙ্গলগুলো বিশিষ্ট রচনা। এখানে বাঙলার বিশেষ করে প্রাচীন রাঢ় অঞ্চলের সর্বস্তরের নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র বিধৃত রয়েছে। রাজসভার ছল-চাতুরী, প্রতারণা-বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন-বিদ্রোহ, সন্ধি-বিগ্রহ, বীরত্ব-মহত্ত্ব প্রভৃতির চিত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ধনী-নির্ধনের ঘরোয়া জীবনের প্রেম-ঈর্ষা, ক্ষমা-প্রতিহিংসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উল্লাস-যন্ত্রণা ও আশা-হতাশার আলেখ্য। কাহিনী সুসংবদ্ধ নয় বটে, কিন্তু মহামদ-কর্ণসেন-কালু-লখাই-রঞ্জাবতী- লাউসেন-ইছাই প্রভৃতি স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যের লিখিতরূপ অর্বাচীন। কিন্তু এগুলোতে যেসব কাহিনী ও সমাজ-সংস্কৃতির চিত্র রয়েছে, তা প্রাচীন। এদিক দিয়ে এ সাহিত্য বাঙলা ও বাঙালি র প্রাচীন ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ।

রামাই পণ্ডিতের শূণ্যপুরাণ ও ধর্ম পূজাবিধান হচ্ছে এ মতের শাস্ত্রগ্রন্থ। নিরঞ্জনের রুম্মাটি কিলিমা জলাল] এই শূন্যপূরাণেই পাওয়া গেছে। ফিরোজ শাহ তুগলকের উড়িষ্যা বিজয় উপলক্ষে এটি রচিত। এ উপাখ্যানে কেউ কেউ বিস্মৃত সামাজিক ইতিহাসের ছায়া লক্ষ্য করেন। ধর্মমঙ্গলের আদি লেখক বলে ময়ূর ভট্ট নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়। যাদের পাঁচালি পাওয়া গেছে তাঁদের অনেকেই ব্রাহ্মণ। উচ্চবর্ণ থেকে ধর্মঠাকুরের স্বীকৃতি আদায়ই হচ্ছে এসব মঙ্গল রচনার পরোক্ষ উদ্দেশ্য। সতেরো শতক থেকেই ধর্মমঙ্গল রচিত হতে থাকে। খেলারাম চক্রবর্তীও ধর্ম পাঁচালরি আদি লেখক বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কাব্যও পাওয়া যায়নি। সতেরো শতকের আর যে-সব কবির নাম মেলে তাঁরা হচ্ছেন শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, যাদবনাথ, রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতা রামদাস প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তী প্রধান। আঠারো শতকে পাচ্ছি ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ রামচন্দ্র, নরসিংহ বসু, দ্বিজ প্রভু রাম, হৃদয়রাম সাধু, শঙ্কর চক্রবর্তী, নিধিরাম গাঙ্গুলী, দ্বিজ গোবিন্দ রাম, দ্বিজ ক্ষেত্ৰনাথ, মাণিকরাম গাঙ্গুলী, রামকান্ত রায়, দ্বিজ রাজীব প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী কবিত্বে ও জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠ।

.

০৬.

॥ লোকসাহিত্য ॥

বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে চর্যাগীতি, ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবচন, প্রবাদ, রূপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল-মহীপাল গীত (অপ্রাপ্ত), ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী, ধর্মঠাকুরের কথা, চণ্ডী-মনসার কথা, যজ্ঞকথা, শিবের পাঁচালি, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালি, ভারত পাঁচালিত প্রভৃতি। এগুলো মুখে মুখে ফিরেছে বলে এগুলোর ভাষা কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কাহিনী প্রাচীন। তেমনি তুর্কী-মুঘল আমলের নিদর্শন হচ্ছে ব্ৰত কথা, গাজীর গান, সত্যপীর, ওলা বিবি প্রভৃতি কাহিনী, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পীর-মাহাত্ম্য কথা, বাউলগান, আদ্যের গম্ভীরা, ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি এবং ব্রিটিশ যুগের ও হাল আমলের লোক-সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল, ভাটিয়ালী ও কবিগান এবং সাময়িক ঘটনা অবলম্বনে রচিত নানা গান, গাথা, কবিতা ও লোকসাহিত্য নামে পরিচিত। এর মধ্যে কবিওয়ালার ও কবিগানের উদ্ভবের আলাদা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এ হচ্ছে যুগসন্ধিকালের বিপর্যস্ত জীবনের সাক্ষ্য অথবা পূর্ব-প্রভাতিক অন্ধকারের (Predawn darkness-এর) প্রতিরূপ।

স্থানীয় কবি, গায়েন ও কথক কর্তৃক আঞ্চলিক বুলিতে স্থানীয় নিরক্ষর লোকের উদ্দেশে মুখে মুখে রচিত বলে লোকসাহিত্য অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে সর্ববঙ্গীয় হতে পারেনি। এজন্যে লোকসাহিত্য মাত্রই আঞ্চলিক এবং কালে কালে বহু মুখের স্পর্শে ও পরিচর্যায় এগুলো ভাবে বিচিত্র, ভাষায় কালোপযোগী, ভঙ্গিতে চাহিদানুসারী এবং কল্পনায় পল্লবিত হয়েছে বলে লোকসাহিত্য ব্যক্তিনিরপেক্ষ গণরচনা-রূপে পরিচিত। অতএব ভাবে, ভাষায়, ভঙ্গিতে ও কাহিনী বিন্যাসে লোকসাহিত্য যুগে যুগে নবকলেবর পরিগ্রহ করে যুগের চাহিদা মিটিয়েছে, এবং নতুন বিষয়ে হয়েছে পুষ্ট।

পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়মনসিংহ গীতিকা লোকসাহিত্যের তথা বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাস্তবতায়, মানবিকতায় ও জীবনচেতনায় এগুলো অনন্য। এতে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি বিধৃত রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ মেলে গাথাগুলোতে। গীতিকাগুলোর রচনাকালের পরিধি ষোলো থেকে আঠারো শতক অবধি বিস্তৃত।   

বলেছি, এদেশে তুকী-মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ধর্মচর্চার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাঙলা তখন মুখের বুলির স্তর পার হয়নি। এ ভাষায়-যে কিছু লেখা যায়, এ ভাষাও-যে সাহিত্যের ভাষা হতে পারে তা কখনো কোনো গুণীজন ভাবেননি। অশিক্ষিত জনগণ তাদের বুলিতে মুখে মুখে গান, গাথা, ছড়া, ব্রতকথা, রূপকথা ও উপকথা রচনা করে মনের ভাব প্রকাশ করত। এছাড়া দেবতার পূজা করবার কিংবা তাঁর কাছে সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা নিজে নিবেদন করবার এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্র রচনে-পঠনে-শ্রবণে শূদ্রের ও নারীর অধিকার ছিল না বলে। জনগণ কথকতার মাধ্যমে দেবকথা ও ধর্মকথা জানবার চেষ্টা করত। এভাবে রামের ছড়া, ভারতকথা, কৃষ্ণ ধামালী, মনসা ও চণ্ডীর কথা, ব্রতকথা প্রভৃতি মুখে মুখে রচিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।–ব্রাহ্মণ্য সমাজপতিদের এরকম কঠোর পতি ছিল বলে কেউ সেসব লিখবার ও পড়ে শুনবার সাহস পায়নি।

তাছাড়া সেন আমলে সাধারণ লোকের বিশেষ করে শূদ্রের লেখাপড়া শেখার অধিকার ছিল না। অতএব মুসলিম বিজয়ের আগে এদেশে বাঙলায় কিছু লিখিত হয়নি। চর্যাগীতিরও এদেশে লিখিত রূপ চালু ছিল বলে মনে করবার কারণ নেই। কাজেই আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হইবার] সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাই নিরঞ্জনের রুম্মাতে°৬ কেবল নিপীড়িত বৌদ্ধদের স্বস্তি ও উল্লাস ধ্বনিত হয়নি, বাঙলা ভাষারও সুদিনের আভাস সূচিত হয়েছে। মুসলিম শাসকের প্রশ্রয়ে ও প্রতিপোষণে সম্ভবত চৌদ্দ শতকের শেষ বা পনেরো শতকের গোড়া থেকেই বাঙলা রচনা লিখিত রূপ পেতে থাকে। এজন্যে এ সময় থেকেই কৃষ্ণ ধামালী, মনসার ভাসান, রামায়ণ কথা ও ভারতকথা পাঁচালিরূপে গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ পাল গীতি লুপ্ত হয়েছে এবং ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা যোগ-সম্বন্ধীয় হওয়ায় যোগপ্রিয় হিন্দু-মুসলমান দ্বারা রক্ষিত হয় এবং মুসলমানদের হাতে যোগীর কাহিনী বলে গোরক্ষ কাহিনী কিংবা ময়না-গোপীচাঁদ কাহিনী যথাক্রমে ষোলো ও আঠারো শতকে পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হল। মৌখিক রচনায়ও ভাষা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়েছিল। নইলে শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে) কিংবা শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে ভাষার এমন অর্থবহ বিকশিত রূপ পেতাম না। শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে ব্যবহৃত গোটা বারো আরবি-ফারসি শব্দ থেকে বোঝা যায় এ সময়ে দরবার আর দরবারি ভাষাও লোকপরিচিত এবং লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অতএব মুসলমানেরাই লেখ্য বাঙলার সৃষ্টি সহায় ও পোষ্টা।

.

০৭.

॥ রাজকীয় প্রতিপোষণ ॥

এ-কথা না বললেও চলে যে মুসলিম সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণেই প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য লেখ্যরূপ লাভ করে। যেমন ধর্মপ্রচার ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ আমলে বাঙলা গদ্যের চর্চা হয়।

গঠনযুগে ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে ওঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের আগ্রহে সংস্কৃত, ফারসি ও হিন্দি সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলোর বাঙলা অনুবাদ শুরু হয়। কেবল তা-ই নয়, এ ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানও অগ্রণী ছিল। গৌড় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহর আমলে (১৩৮৯-১৪০৯ খ্র.) তাঁর কর্মচারী শাহ মুহম্মদ সগীর কিতাব চাহিয়া ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। রুকনউদ্দীন বরবক শাহর (১৪৫৯-৭৪) অভিপ্রায় অনুসারে কৃত্তিবাস অনুবাদ করেন রামায়ণ ৫° বরবক শাহ ও তাঁর পুত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহর আমলে গুণরাজ খান মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণ বিজয় নামে ভাগবতের অংশবিশেষের অনুবাদ করেন (১৪৭৪-৮০ খ্র.) আর জায়নুদ্দিন রচনা করেন রসুল বিজয়।

বরিশালের ফুলিয়া (ফুল্লশ্রী) গাঁয়ের বিজয় গুপ্ত (১৪৮৫ খ্রী.)৫২, জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ ওর্ফে হোসেন শাহর আমলে (১৪৮২-৮৬ খ্রী.) পদ্মাপুরাণ অবলম্বনে মনসার ভাসান রচনা করেন। মধ্য বঙ্গে বিপ্রদাস পিপলাই (১৪৯৪ খ্রী.) মনসামঙ্গল ও কবিচন্দ্র মিশ্র গৌরীমঙ্গল রচনা করেন সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলে। সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর চট্টগ্রামস্থ অধিকারের সেনানী শাসক (Military Governor) পরাগল খানের সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলী মহাভারত এবং তাঁর পুত্র ছুটি খানের সভাকবি শ্রীকর নন্দী ছুটি খানী অশ্বমেধ পর্ব রচনা। করেন। হোসেন শাহর পৌত্র ফিরোজ শাহর আদেশে সংস্কৃত কাহিনীর অনুসরণে বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেন দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ (১৫১৯-৩৩ খ্রী.)৫৩। কবিশেখর বিদ্যাপতি আর যশোরাজও তাঁদের পদে নাসির শাহ (নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ) ও আলাউদ্দীন হোসেন শাহর স্তুতি করেছেন।

চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত। আর আরাকানের রাজধানী ছিল মোহং (Mrauhang)। এর বিকৃত বাঙলা নাম রোহাং বা রোসাঙ। রোসাঙের বাঙালি মুসলমান রাজসচিব আশরাফ খানের আগ্রহে কাজী দৌলত (১৬২২-৩৫) অনুবাদ করেন হিন্দি কবি মিয়া সাধনের অধ্যাত্ম-রূপক কাব্য ময়নাসৎ। এর বাঙলা নাম সতী ময়না-লোর-চন্দ্রানী। মাগন ঠাকুর, সোলায়মান, সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মুহম্মদ খান, নবরাজ মজলিস প্রমুখ রাজসচিবের আদেশে পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, রতন কলিকা-আনন্দ বর্মা, তোহফা, সপ্ত পয়কর ও সেকান্দর নামা অনুবাদ করেন আলাউল। এভাবে কারো-না-কারো প্রতিপোষকতায় মধ্যযুগীর ধারায় অনুবাদের কাজ উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি চলেছে।

মধ্যযুগে পাক-ভারতের হিন্দুরা সংস্কৃতের ভাষাকে ধর্মকথা তথা লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপেই কেবল ব্যবহার করতেন। মালাধর বসুর কথায়, পুরাণ পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার। পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার। এ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অতএব তাঁরা গরজে পড়ে ধর্মীয় প্রচার-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সাহিত্যশিল্প গড়ে তুলবার প্রয়াসী হননি। দেবতার মাহাত্ম্যকথা জনপ্রিয় করাবার জন্যে তারা প্রেম ও বিরহ কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন এবং এতে সাহিত্য-শিল্প যা গড়ে উঠেছে তথা সাহিত্যরস যা জমে উঠেছে তা আনুষঙ্গিক ও আকস্মিক, উদ্দিষ্ট নয়। কাজেই বলতে হয় মধ্যযুগে হিন্দুদের বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না, লৌকিক ধর্মের প্রচারই লক্ষ্য ছিল। এর এক সম্ভাব্য কারণ এ হতে পারে যে শিক্ষা ও সাহিত্যের বাহন ছিল সংস্কৃত। কাজেই শিক্ষিতমাত্রই সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করত। তাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টির গরজ কেউ অনুভব করেনি। তারা অশিক্ষিতদেরকে ধর্মকথা শোনানোর জন্যে ধর্ম সংপৃক্ত পাঁচালি রচনা করতেন। পরে সংস্কৃতের প্রভাব কমে গেলেও এবং বাঙলা প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব পেলেও পূর্বেকার রীতির বদল হয়নি আঠারো শতক অবধি। কেবল আঠারো শতকেই কয়েকজন হিন্দু-প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি৫৫।

আর্যেরা প্রকৃতিপূজক ছিল। আর্যভাবে পাক-ভারতিক জনগণ প্রাকৃত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে তোয়াজে-তারিফে তুষ্ট করে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা খুঁজেছে চিরকাল। ফলে প্রাকৃতিক শক্তিকে পদানত করে জীবনকে বিপন্মুক্ত করবার চেষ্টা দেখা যায়নি কখনো। এভাবে বাঙালি হিন্দুর মন-মানসে সাহস স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারেনি। ফলে দেবতা ও অপদেবতার কাল্পনিক অনুকম্পানির্ভর জীবনের স্বাভাবিক স্ফুর্তিও ব্যাহত হয়েছে অনেকাংশে। এ বিকৃত মনমানসের স্বাক্ষর রয়েছে পুরাণমিশ্ৰিত মঙ্গলকাব্যে ও অন্যান্য পাঁচালিতে। সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের সংস্পর্শে আসার ফলে এদেশী হিন্দুর প্রাণে-মনে মানবাত্মার মহিমা এবং মানবিক শক্তি, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে অভিনব বোধ জাগে। মুসলিম প্রভাবে এই মানব মহিমা ও মানবিকতার উদ্বোধনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভূত হয়েছে মানবাত্মার অপরিসীম মহিমা ও সম্ভাবনার বাণীবাহী বৈষ্ণব মতের, আর পূর্ব বাঙলার নদী-নির্যাতিত সগ্রামী মনে জেগেছে পৌরুষ, দেবদ্রোহিতা, আত্মনির্ভরশীলতা ও মর্যাদাবোধ; যেমন হয়েছিল দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে অদ্বৈতবাদ ও ভক্তিভিত্তিক সন্তধর্মের উদ্ভব। তাই মনসামঙ্গলের বিকাশ-ভূমি পূর্ব বাঙলা। মনসার ভাসান দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কাহিনী। সে-সগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার আত্মা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর আত্মবিশ্বাস ও আত্মিক শক্তির প্রতীক। তিনি মাথা নোয়ালেন দেবতার পায়ে নয়, একটি কিশোরীর অনমনীয়কৃচ্ছু সাধনার কাছে। চাঁদ বেনে ও বেহুলা বাঙালি পুরুষ ও নারী। মানুষকে এ স্বরূপে ইতিপূর্বে বাঙালি র রচনায় আর দেখা যায়নি। ইসলামি সংস্কৃতির বিস্তার যে বাঙালি র চিত্তলোকে বাসন্তী হাওয়া বয়ে আনে, তাদের মানস জগৎ

যে নবজীবনের সংস্পর্শে বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠে, তার প্রমাণ মঙ্গলকাব্য আর বৈষ্ণব। মতবাদ ও সাহিত্য। মধ্যযুগের মুসলিম-রচিত সাহিত্য দেশ-দুর্লভ নতুন ভাব, চিন্তা, রস ও আত্মবিশ্বাস-পুষ্ট জীবনবোধের আকর।

.

০৮.

 ॥ মুসলিমরচিত বাঙলা সাহিত্য

বাঙলা দেশের প্রায় সবাই দেশজ মুসলমান। তাই বাঙলা সাহিত্যের উন্মেষ- যুগে সুলতান সুবাদারের প্রতিপোষকতা পেয়ে কেবল হিন্দুরাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি, মুসলমানেরাও তাঁদের সাথে সাথে কলম ধরেছিলেন এবং মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানগণের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে ধর্মপ্রেরণাবিহীন নিছক সাহিত্যরস পরিবেশনের জন্যে তাঁরাই লেখনী ধারণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য আমরা তাদের হাতেই পেয়েছি। কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য দানের গৌরবও তাদেরই। কেননা সবরকমের বিষয়বস্তুই তাঁদের রচনার অবলম্বন হয়েছে। মুসলমানের দ্বারা এই মানব-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন সম্ভব হয়েছে ইরানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। দরবারের ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এদেশের হিন্দু ও মুসলমানের একই সূত্রে এবং একই কালে হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ তাদের ইরানি সংস্কৃতি দ্রুত গ্রহণে ও সাঙ্গীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর। কিন্তু গোঁড়ামিপ্রবণ হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান-কবিগণ যখন আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছিলেন, হিন্দু-লেখকগণ তখনো দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহমুক্ত হতে পারেননি।

মুসলমান-রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিকতা, যা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে অর্থাৎ বিস্ময়-ব্যাকুল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানুষের প্রতি নিবদ্ধ হল। অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল, মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ জগতে। নদী নগরী, গিরি-মরু-কান্তার ও স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে দেব-দানব-রাক্ষস, ভূত-প্রেত-জ্বিন এবং বুনো পশুপাখি-সরীসৃপের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল, আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ, সগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠা সে জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায় সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে পরিব্যক্ত।

পাক-ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালি রা ইরানি ও হিন্দুস্তানী ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।

.

০৯.

॥ উপাখ্যান ॥

হিন্দুরচিত সাহিত্য যেমন মুখ্যত অনুকৃতি, বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যও প্রধানত অনুবাদ। গোটা মধ্যযুগব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের বাঙলা রচনা অনুকৃতি ও অনুবাদে সীমিত। এ অসম্পূর্ণ শিক্ষা ও অসামর্থ্যেরই সাক্ষ্য। এঁদের রচনা পরিমাণে প্রচুর কিন্তু উৎকর্ষে বিশিষ্ট নয়। আমাদের মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন তখন শেক্সপিয়র লিখেছেন তাঁর কালজয়ী নাটক। এতেই বোঝা যায় উনিশ শতকের আগে বাঙলা কখনো প্রতিভার পরিচর্যা পায়নি। তাই তারা লাটিমের মতো কেবলই ঘুরেছে, কিন্তু পাঁচশ বছরেও ভাষায় ও সাহিত্যে এতটুকু অগ্রসর হয়নি। মূলত, ফরাসি ও হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্য এবং আরবি ও ফারসি থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ধর্ম ও যুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থগুলো। অনুবাদ সাধারণ তিন প্রকারের হত– কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অর্থাৎ আক্ষরিক, স্বাধীন অনুসৃতি ও ভাবানুসরণ। সেকালে অনুবাদ কৃচিৎ আক্ষরিক হত। হিন্দি ও ফারসি প্রণয়োপাখ্যানগুলো সাধারণত সূফীতত্ত্বের তথা জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপকাশ্রিত হলেও বাঙলায় তর্জমা হয়েছে লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান রূপেই। তত্ত্বকথাকে এভাবে রস কথায় রূপান্তরের প্রবণতার মধ্যে ঐহিক জীবনবাদী বাঙালি মানসের স্বরূপ ধরা পড়েছে। চর্যাপদ, বৈষ্ণবগান, বাউল-মুর্শিদা-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মগীতির দেশে এ মানবিক রস-প্রীতি লক্ষণীয় ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বাঙালি চরিত্রের একটি নতুন দিগদর্শন। এদিক দিয়ে শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.) ইউসুফ-জোলেখাই সম্ভবত গোটা আধুনিক পাক-ভারতিক সাহিত্যে প্রথম লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান।

সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ আর ভাবে-ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই। আর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।

চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা। ষোলো শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শা বারিদ খানের বিদ্যাসুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল; কাজী দৌলতের সতীময়নালোর-চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সপ্ত পয়কর, রতন কলিকা; মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুলমুলক, ইউসুফ জোলেখা; নওয়াজিস খানের গুলে বকাউলি, পরাগলের শাহ পরী, মঙ্গলাদের শাহজালাল-মধুমালা, সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মূলক সামারোখ, আবদুল করিম খোন্দকারের তমিম আনসারী, শরীফ শাহর লালমতি সয়ফুলমুলুক। আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে মুহম্মদ মুকিমের কালাকাম, মৃগাবতী, গুলে বকাউলি; মুহম্মদ রফিউদ্দিনের জেবল মূলক শামারোখ, শাকের মাহমুদের মনোহর মধুমালা, নুর মুহম্মদের মধুমালা, ফকির গরীবুল্লাহর ইউসুফ জোলেখা; সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা; মুহম্মদ আলী রজার তমিম গোলাম চতুন্নছিলাল, মিশরীজামাল, মুহম্মদ আলীর শাহপরী মল্লিকাজাদা, হাসান বানু; আবদুর রাজ্জাকের সয়ফুলমুলুক লালবানু, শমসের আলীর রেজওয়ান শাহ এবং মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর, কামরূপ-কালাকাম, খলিলের চন্দ্রমুখী প্রভৃতি। মুসলিম প্রভাবে আঠারো-উনিশ শতকের কয়েকজন হিন্দুও প্রণয়োপাখ্যান লিখেছেন। সুশীল মিশ্রের রূপবান-রূপবতী উপাখ্যান, বাণীরাম ধরের শীত-বসন্ত কাহিনী, রামজী দাসের শশিচন্দ্রের পুথি, দ্বিজ পশুপতির চন্দ্রাবলী, মহেশ চন্দ্র দাসের সয়ফুল তমিজ জরুখভান, গোপীনাথ দাসের মনোহর মধুমালতী, এ যাবৎ আমাদের হাতে এসেছে। এসবের মধ্যে ইউসুফ জোলেখা, লায়লীমজনু, সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী, পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক, লালমতী সয়ফুলমুলুক, মধুমালতী, গুলেবকাউলি ও চন্দ্রাবতী কাব্যগুণে, কাহিনী-মাধুর্যে কিংবা বৈদগ্ধ্যে শ্রেষ্ঠ।

.

১০.

॥ তত্ত্বসাহিত্য

মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন জিজ্ঞাসা রয়েছে তারই মনোময় জবাব খোঁজা হয়েছে আমাদের ধর্ম ও অধ্যাত্মজীবন সম্পর্কিত রচনায়। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের জিজ্ঞাসা মানুষকে করেছে বিজ্ঞানী; ভাববাদী দুর্বলকে তা-ই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। একই জিজ্ঞাসা আপাতবিরোধী দু-কোটির চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা ও জন্ম দিয়েছে। এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে দিয়েছে বহিষ্টি, কাউকে দিয়েছে অন্তদৃষ্টি। বহিদৃষ্টি মানুষকে করেছে বিষয়ী ও বিজ্ঞানী। অন্তদৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদী; গড়ে তুলেছে আধ্যাত্মবাদ, দিয়েছে বৈরাগ্য বা ইহবিমুখতা, জাগিয়েছে জীবনের জীবনের পিপাসা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানস-সম্পদ আর বিজ্ঞান পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য। দু-টোরই মূল প্রেরণা জিগীষা। একটার লক্ষ্য আত্মজ্ঞান, অপরটার কাম্য দুনিয়ার জয়। একটা সম্বল হৃদয় ও মনোবল, অপরটার হাতিয়ার বুদ্ধি ও বাহুবল। একটি হৃদয়বৃত্তিক লীলা, অপরটি প্রাণধর্মের অভিব্যক্তি।

তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিন মার্গের সন্ধান দিয়েছে–জ্ঞানের, কর্মের ও ভক্তির। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে। আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস এবং ভক্তিবাদের উপজাত (by product)-কারুর কারুর মতে পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।

বাঙলা ভাষারও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে, এগুলো: ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও অধ্যাত্ম প্রেমগীতি।

ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে : নেয়াজ ও পরানের (১৬ শতক) কায়দানী কেতাব; খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক), হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়তনামা; শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মোসায়েল, দুল্লামজলিস; আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহর (১৮ শতক), নসিয়ত নামা, আলী রজার (১৮ শতক) সিরাজকুলুব, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক), সিফৎ-ই ইমান, সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের (১৮ শতক) সিরাজ সবিল, বালক ফকির ও মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুকতদী, সৈয়দ নূরুদ্দিনের (১৮ শতক) দাকায়েতুল হাকায়েক, রুহুনামা, রাহাতুল কুলুব; মুহম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতুল ফেকাহ্, হায়াৎ মাহমুদের হিতজ্ঞানবাণী, সর্বভেদ বাণী প্রভৃতি।

খ. তত্ত্ব সাহিত্যে সাধারণত যোগ ও সূফী সাধন-তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সমাজ ও ধর্মের আচারগত প্রভেদ সত্ত্বেও শাসক-শাসিত সম্পর্কের অন্তরালে দুটো ভিন্নাদর্শ জাতির মধ্যে কী নিবিড় প্রাণের যোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে এ ধরনের রচনায়। জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা, উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। মানস-সংস্কৃতির এরূপ লেনদেন, এমনি আত্মিক যোগাযোগ চিরকালই মানুষের চিত্ত-প্রসারের ও আত্মবিকাশের সহায়ক হয়েছে।

ইরানি সূফী সাধনাও যৌগিক প্রক্রিয়া-নির্ভর। পাক-ভারতের যোগসাধনার সঙ্গে পরিচয়ের পরে সূফীদের দেহতত্ত্বের সঙ্গে যোগশাস্ত্রের সার্থক মিশ্রণ ঘটিয়ে উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে যিনি পাক-ভারতে মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তাঁর নাম শেখ শরফুদ্দীন বু আলী কলন্দর শাহ (মৃত্যু ১৩২৪ খ্র.)। তাঁর প্রবর্তিত সাধনপদ্ধতির বাঙলা নাম যোগ কলন্দর। পানিপথে তার সমাধি আছে। উত্তরভারতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর খ্যাতি আজো ম্লান হয়নি। একসময়ে বাঙলায় কলন্দরপন্থী বৈরাগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, কলন্দর বলতে মুসলিম বৈরাগীই বোঝাত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে :

কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি।
 ঋণ কড়ি নাহি দাও, নহ কলন্দর।

এই তত্ত্ব বা সূফী সাহিত্যে পাই ষোলো শতকের শেখ ফয়জুল্লাহার গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, কবি হাজী মুহম্মদের সুরতনামা বা নুরজামাল; সতেরো শতকের কবি শেখচান্দের হর-গৌরীসম্বাদ, শাহদৌলপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের শিহাবুদ্দীননামা ও চারিমোকামভেদ, মীর মুহম্মদ সফীর নুরনামা; আর আঠারো শতকের কবি আলি রজার আগমজ্ঞানসাগর, কাজী মনসুরের শিনামা, শেখ জেবুর আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্য ব্যক্ত, মোহসীন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি।

গ. সওয়াল সাহিত্য : এ ধরনের গ্রন্থে জগৎ ও জীবনের নানা রহস্য-চিন্তা, হেঁয়ালি ও সাধারণ ইতিহাস, ভূগোল, জীবতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর রয়েছে। শেখ সাদীর গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফক্করনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, আবদুল হাকিমের নুরনামা, আকিলের নুরনামা, মুসানামা, সৈয়দ নূরুদ্দীন ও নসরুল্লাহ খোন্দকারের মুসার সওয়াল প্রভৃতি এ জাতীয় গ্রন্থ।

ঘ. সাধন ও ভজনসঙ্গীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীতি, বাউল গান ও অন্যান্য আধ্যাত্ম সঙ্গীত।

রাধাকৃষ্ণ রূপকে জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রেমবিষয়ক সূফীমতের অধ্যাত্ম সঙ্গীত যারা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মীর ফয়জুল্লাহ, মির্জা কাঙালী, সৈয়দ মোর্তুজা, নসির মাহমুদ, সৈয়দ সুলতান, চাঁদ কাজী, আলাউল, ফাজিল নাসির মুহম্মদ, সৈয়দ আইনুদ্দীন, মোহসেন আলী, আবাল ফকির, পীর মুহম্মদ, বকশা আলী, এবাদুল্লাহ, শেখ ভিখন, শেখ ফতন (ফতেহ), আলিমুদ্দিন, মনোহর, আফজল, শমসের আলী, আলি রজা এশাদুল্লাহ, সফতুল্লাহ, আলি মিয়া, মোহাম্মদ হানিফ, কমর আলি, চম্পা গাজী, মোহাম্মদ হাসিম প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সূফী মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ও সংযোগে বাউল মতের আধুনিক রূপান্তর হয়েছে সত্য, কিন্তু এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মনে হয় এই বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। সাংখ্যে, যোগে, বৌদ্ধ দর্শনে ও সূফী সাধনতত্ত্বে দেহের বিশেষ মূল্য রয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরূপ-নিরাকার আত্মার স্বরূপ মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে–দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহ-যন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়া অসামান্য গুরুত্ব পেয়েছে। তাই এদেশের অধ্যাত্ম সাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র পাক-ভারতের আদিম অনার্য শাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলার পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই প্রাচীন যুগে সহজিয়া গানে ও মধ্যযুগে বৈষ্ণব-সহজিয়া পদে আর পরবর্তীকালে বাউলগানে রূপ পেয়েছে।

উনিশ শতকের আগে রচিত বাউলগান দুর্লভ। বাউলগানের প্রধান কবি ফকির লালন সাঁই, শেখ মদন, পাগলা কানাই, তিনু, আতর চাঁদ, শ্রীনাথ, নলিন চাঁদ, হীরালাল, মেছেল চাঁদ, সদাই সাই, খেদমত সাঁই, ইরফান সাঁই, শীতলাং সাঁই, গোপাল প্রভৃতি।

মুরশিদা-মারফতি গানের কবি হচ্ছেন সৈয়দ শাহানুর, মুন্সী হোসেন আলী, রহিমুদ্দিন ফকির, রজবউদ্দিন, মিয়াধন, মোতালেব, নজির হোসেন বুরহানি, ফজলুল শিকদার, সাওয়াল শাহ (রমজান আলী), খতিশাহ (আবদুল মজিদ), উসমান, উমর আলী, হেকিম আবদুল মালেক, সৈয়দ আবদুল বারী, হাসান উদাস, শেখ কিনু প্রভৃতি। এবং চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার খানকার ভক্তগণের রচিত গানগুলোও এ শ্রেণীর অন্তর্গত। অধিকাংশ মুর্শিদা-মারফতি গানে বাউল প্রভাব লক্ষণীয়।

মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু ও মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণভারতে পরে উত্তরভারতে এবং সবশেষে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে যে আলোড়ন হয় তার বাহ্যরূপ ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সূফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম, উত্তরভারতের সন্তধর্ম, এবং বাঙলার বৈষ্ণবধর্মও বাউল মত সূফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল।

আত্মা পরমাত্মার অংশ। কাজেই আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। তাই দেহাধারস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত।

ক. সখীগো জন্ম-মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।
 উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব সার।
তীর্থব্রত যার জন্য
এই দেহে তার সব মিলে।

 খ. খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম তাহার পায়।

গ. এ দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।

বাউলেরা তাদের ভাষায় অচিন পাখি অলখাই (অলক্ষ্য স্বামী), মনের মানুষ বা মানুষ রতন-রূপ আত্মা তথা পরমাত্মাকে জানবার সাধনা করেন। বৈষ্ণব বা সুফীর মতো এঁরা প্রেমিক নন, যোগীর মতো তাত্ত্বিক। মুর্শিদা-মারফতি ও বাউল গান আমাদের লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। বাউলেরা উদার মানবতাবাদী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য। বাউল মত ও সত্যপীরকে কেন্দ্র করে বাঙলার নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলন সম্ভব হয়েছিল।

॥ জীবনী সাহিত্য

 মুসলমান কবিগণ এক বিরাট জীবনীসাহিত্যও সৃষ্টি করেছেন। চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুচরদের চরিতকথাগুলো যেমন একাধারে জীবনী, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মকথা, ও কাহিনীকাব্য; এসব চরিতাখ্যান তেমন নয়। এখানে বাস্তব-অবাস্তব, লৌকিক-অলৌকিক কিংবা প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের সীমারেখা মানা হয়নি। এখানে কল্পনা ইতিহাসাশ্রিত নয়। চরিতাখ্যানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈনুদ্দিনের রসুল বিজয় (১৪৭৩ খ্রী.) সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ (১৫৮৬ খ্র.), শাহ বারিদ খানের হানিফার বিজয় ও রসুল বিজয়, শেখ ফয়জুল্লাহর গাজী বিজয়, শেখ চাঁদের রসুলবিজয়, নসরুল্লাহ খোন্দকারের জঙ্গনামা, আবদুল নবীর আমীর হামজা, গরীবুল্লাহ (পশ্চিমবঙ্গ) ইউসুফ-জোলেখা; আমির হামজা; সৈয়দ হামজার (পশ্চিমবঙ্গ) আমীর হামজা, হাতেম তাই; উজীর আলীর নসলে উসমান ইসলামাবাদ (ইতিহাসমূলক) এবং বিভিন্ন কবির কাসাসুল আম্বিয়া, সিফাতুল আম্বিয়া ও অন্যান্য আউলিয়া কাহিনী প্রভৃতি। এগুলো রচিত হয়েছে। মুখ্যত মুসলমানদের মুসলিম ঐতিহ্য-গর্বে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই।

॥ জঙ্গনামা ॥

কারবালা কাহিনী নিয়েও অনেক যুদ্ধকাব্য ও মর্সিয়া-সাহিত্য গড়ে উঠেছে। এগুলো সাধারণত জারি ও জঙ্গনামা নামে পরিচিত। এ বিষয়ক ফারসি কেতাব মক্তুল হোসেনকে আদর্শ করেই বাঙলা জঙ্গনামাগুলো রচিত হয়েছে। বাঙলায় মত্তুল হোসেন বা জঙ্গনামার আদি কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬ শতক)। দ্বিতীয় কবি শেখ ফয়জুল্লাহ, ইনি জয়নবের চৌতিশা নামে বিলাপ রচনা করেন। তৃতীয় কবি মোহাম্মদ খান। ইনিই জঙ্গনামার শ্রেষ্ঠ কবি; তার কাব্যের নাম মক্তুল হোসেন। এর পরে যারা জঙ্গনামা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে হায়াত মাহমুদ, জাফর, গরীবুল্লাহ ইয়াকুব, সফীউদ্দিন, সাদ আলী, আলি মোহাম্মদ, জিন্নাত আলী, হামিদুল্লাহ খান, আবদুল ওহাব, রাধাচরণ গোপ, মুহম্মদ মুন্সী, আবদুল হামিদ ও জনাব আলীর নাম উল্লেখযোগ্য। কারবালা যুদ্ধ ঐতিহাসিক কাহিনী। কিন্তু আমাদের পুথিকারেরা অলৌকিক ও অপ্রাকৃত কাহিনী সংযোগে তাকে রূপকথায় পরিণত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন যুদ্ধকাহিনী রয়েছে–রসুল বিজয়, আলির জঙ্গনামা, জয়কুমরাজার লড়াই, হানিফার লড়াই, হামজার দিগ্বিজয়, জঙ্গে বদর, জঙ্গে খয়বর প্রভৃতি। ইসলামের উন্মেষযুগের এসব গৌরবগাথা রচনা করে মুসলমানকে স্বাজাত্যগর্বী ও স্বধর্মনিষ্ঠ করার প্রয়োস ছিল কবিদের।

॥ বিবিধ রচনা ॥

 এ ছাড়া, রাগ-তাল, জ্যোতিষ, চিকিৎসাশাস্ত্র, তুক্তা প্রভৃতি নানা বিষয়ক অনেক রচনা পাওয়া যায়। বারোমাসী কিংবা চৌত্রিশা কোনো বিশেষ বিষয়ক রচনা নয়। বারোমাসীতে মাস ও ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে নায়িকার (কৃচিৎ নায়কের) হৃদয়ের বৃত্তি-প্রবৃত্তির রূপান্তরের, বিশেষ করে বিরহ ব্যথার, চিত্র অঙ্কিত হয়। আর বাঙলার চৌত্রিশটি বর্ণের প্রত্যেকটিকে এক বা একাধিক পঙক্তির আদ্যক্ষর রূপে প্রয়োগ করে যে-পদবন্ধ রচনা করা হয় তাকেই চৌত্রিশা বলে। প্রায় সব পুথিতে বারোমাসী ও চৌত্রিশা পাওয়া যায়। এগুলো সেকালের সাহিত্য-শিল্পের বিশেষ অঙ্গ ছিল।

॥ দোভাষীরীতি ॥

সতেরো শতকের কবি কৃষ্ণরাম দাস তাঁর রায় মঙ্গল নামক কাব্যে বড় খা গাজীর মুখে ভাঙা হিন্দি প্রয়োগ করেছিলেন, সেই থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন সত্যনারায়ণ পাঁচালিকার ও ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখ কবি অবাঙালি পাত্র-পাত্রী মুখে বিকৃত হিন্দুস্তানী ব্যবহার করেছেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে হাওড়াবাসী কবি ফকির গরীবুল্লাহই (১৭৫৭-৮০ ) প্রথম বাঙলা ও হিন্দুস্তানী বাকধারার মিশ্রণে তার ইউসুফ জোলেখা, সোনাভান, মদন কামদেব পালা (সত্যপীরের পাঁচালি) ও জঙ্গনামা (হোসেন মঙ্গল) রচনা করেন। এই রীতির নাম দোভাষী রীতি। এ ভাষার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হিন্দুস্থানী (অর্থাৎ আরবি-ফারসি ও হিন্দি শব্দাধিক্য) শব্দ এবং হিন্দি বাক্য গঠন-রীতির প্রভাবপ্রসূত তেরা, মেরা, এয়সা, যেএসা প্রভৃতির বহুল প্রয়োগ। আঠারো শতকে গরীবুল্লাহ অনুসরণ করেন হাওড়াবাসী সৈয়দ হামজা (১৭৮৮-১৮০৫ খ্র.)। উনিশ-বিশ শতকে হাওড়া-হুঁগলীবাসী কবি মালে মুহম্মদ, জনাব আলি, মুহম্মদ খাতের প্রমুখ বহু কবি দোভাষী রীতিতে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু হাওড়া, হুগলী ও কলকাতা অঞ্চলের বাইরে কোথাও মুসলমানেরা এ রীতির অনুকরণ চর্চা করেনি।

কাজেই দোভাষী রীতি ব্রজবুলির মতো একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা। নতুন বন্দর কলকাতাকে কেন্দ্র করেই এর উদ্ভব এবং তার চতুম্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরাই এর স্রষ্টা এবং ধারক। দোভাষী সাহিত্য ইংরেজ আমলের রাজধানী ও বন্দর অঞ্চলের অর্থাৎ কলকাতা-হাওড়া হুগলী এলাকার নির্জিত আধাবাঙালি মুসলমানের মন, মনন ও সংস্কৃতির প্রসূন। রোমান্স থেকে শরিয়ত-কথা অবধি সব বিষয়েই দোভাষী গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু এগুলো ভাষায়, ভাবে ও ভঙ্গিতে সাহিত্য হয়নি। তবু গত দেড়শ বছর ধরে বাঙলার অশিক্ষিত জনসাধারণের রস-পিপাসা ও জিজ্ঞাসা মিটিয়ে আসছে এ সাহিত্য। বিকল্প পাঠ্যপুস্তকের অভাবে সবাইকে পড়তে-শুনতে হয়েছে বলে একে জনপ্রিয় সাহিত্য বলে মনে করার হেতু নেই। অকালে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মানুষ যা খায়, তাকে পুষ্টিকর সুখাদ্য বলে না ওতে ধড়ে প্রাণ যদি-বা টিকে থাকে, কিন্তু স্বাস্থ্যরক্ষা হয় না। দোভাষী পুথিও মানস-আকালের সাহিত্য। যারা এ সাহিত্য রচনা করেছেন, তাদের বর্তমান ছিল অনিশ্চিত আর ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। তাই তাঁরা আশ্রয় খুঁজেছেন কল্পলোকে এবং অতীতের গৌরবময় ও আনন্দোচ্ছল জগতে একটু শ্রান্তিহর ও গ্লানিমুক্ত স্বস্তির ভরসায়। অতএব, জীবনবিমুখ কল্পনাশ্রয়ী এ সাহিত্যের সঙ্গে মন বা মাটির যোগ ছিল না, এ হল পরগাছা।

 দোভাষী পুথিতে কেউ কেউ মুসলমানদের গৌরবের সামগ্রী খুঁজে পান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গরীবুল্লাহর আবির্ভাব পলাশী যুদ্ধের পরে এবং তাঁর গ্রন্থগুলি রচিত হয় ১৭৬০-৮০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের এবং রাষ্ট্রীয় ও অর্থনীতিক ভাঙাগড়ার এ সময়টিতে জীবন-জীবিকায় যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, বগীর হাঙ্গামা ও কোম্পানির দেওয়ানী লাভের ফলে ধন-প্রাণের উপর আকস্মিক বিপদপাতের যে-শঙ্কা জেগেছিল তাতে কারো পক্ষেই রসচর্চা করা সম্ভব ছিল না। তবু মানুষ যেহেতু স্থবির নয় এবং নাড়ির ক্ষুধার মতো মানস ক্ষুধাও মিটাতে হয় সেহেতু নিতান্ত গরজে পড়ে কাজ চালানো গোছের রসচর্চা তাকে করতেই হয়েছে। সুখ-সৌভাগ্যে যেমন রাজধানীর লোকেরই অগ্রাধিকার, দুঃখ-নির্যাতনেরও তেমনি তারাই প্রথম শিকার। এ রাষ্ট্রিক, আর্থিক, তজ্জাত নৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পুরোনো শহর মুর্শিদাবাদ ও নতুন বন্দর কলকাতা ও তার উপকণ্ঠের লোক যখন দিশেহারা, তখনো দূরাঞ্চলে সে হাওয়া পৌঁছেনি। কলকাতায় তখন বুদ্ধিমান ও উদ্যোগী কিন্তু চরিত্রহীন, ঘরছাড়া, বেপরোয়া লোকের ভিড় জমেছে। কলকাতা তখন দালাল, বেনিয়া, জোচ্চোর ও ঠকের আড়া। এ বাজারে ইংরেজ-বাঙালি র চারিত্রিক ভেদ ছিল না। অযোগ্য ও দুশ্চরিত্র লোকের হাতে টাকা এলে যা হয়, তাই হল; এসব হঠাৎ-নবাবেরা ধরাকে সরা-জ্ঞানে উদ্দাম হয়ে উঠল। স্বল্প লোকের এ শ্ৰেণীটা ছাড়া বাকি লোকের জীবন তখন সর্বপ্রকার অনিশ্চয়তায় ম্লান। এমনি পরিবেশে কলকাতার হিন্দুসমাজে কবিওয়ালা আর মুসলমান সমাজে শায়ের-এর উদ্ভব। দুটো নামই তাচ্ছিল্য জ্ঞাপক। প্রশ্ন হতে পারে, কোম্পানির প্রত্যয়-পুষ্ট, কৃপা-জীবী হিন্দুরা যখন কোম্পানির অযাচিত অনুগ্রহে উদ্দাম হয়ে উঠছিল, তখন হিন্দুসমাজে কেন বন্ধ্যা যুগ এল? উত্তরে এটুকু বললেই চলে যে আপামরে বিলাবার মতো কৃপার পুঁজি তখনো কোম্পানির হাতে আসেনি; বিশেষত দেশের কোটি মানুষের জীবনে যখন দুর্যোগ-দুর্দিন নেমে এসেছে, তখন গুটিকয় সুখী মানুষের অন্তৰ্জীবনেও স্বস্তি থাকতে পারে না। দূষিত আবহ তাদের অবচেতন মনে নিশ্চিতই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলা যায় নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

দোভাষী পুথিতে যে ইসলামি আবহ সৃষ্টির তথাকথিত প্রয়াস আছে, তাও লজ্জাকর। নিন্দা বা প্রশংসা করবার জন্যেও যোগ্যতা চাই। অযোগ্য মুখে নিন্দা বা প্রশংসা দু-ই ব্যাজস্তুতি হয়ে পড়ে। ফকির গরীবুল্লাহ ছিলেন পীর-পূজারী, তাও লোক-শ্রুতির কাল্পনিক পীর দেবকল্প বড় খাঁ গাজী। তাঁর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। সত্যপীরও তাঁর অন্যতর জীবন-নিয়ন্তা। দোভাষী শায়েরেরা ইসলামের উন্মেষ যুগের নানা বীরের ও দেবকল্প নানা পীরের কাহিনী নিয়েই প্রধানত পুথিগুলি রচনা করেছেন। যে-কথা বিজাতিরা বললে মুসলমানেরা রুষ্ট হয়, সেই একহাতে কোরআন আর হাতে তরবারি নিয়ে রসুল, হযরত আলী, হামজা, হানিফা প্রমুখ দিগ্বিজয়ীরা পরাজিত রাজা ও অধিকৃত রাজ্যের মানুষকে বলপ্রয়োগে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে মুমিনের কর্তব্য করলেন বলে উল্লাস ও কৃতার্থ বোধ করেছেন, তাঁদের পুরনারীরা পরপুরুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও মল্লযুদ্ধে নেমেছেন। হিন্দুর দেব-কাহিনীর অনুকরণে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় আল্লাহ, রসুল ও ফেরেস্তার সমবায়ে দেবকল্প মুসলিম বীরের ও পীরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ যেন বাস্তবজীবনে গ্লানি ভুলবার জন্যে ইসলামের গৌরবদিনের স্বপ্নলোক সৃষ্টি করে পর-পীড়িত জাতির আত্মপ্রবোধ লাভের অপপ্রয়াস।

সূফীভাবের নানা কাহিনী রচনায়ও আদর্শচেতনা সর্বত্র দেখা যায় না। আবার শঙ্কা ও অনিশ্চয়তাবোধ থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার সহায় হিসেবে উপদেবতার উদ্ভব হয়েছে। কেবল সত্যপীর নয়; বনবিবি, ওলাবিবি, কালুগাজী, বড় খা গাজী, উদ্ধার বিবি, বাস্তুবিবি প্রভৃতির পূজা শিরনীও চালু হল একেশ্বরবাদী মুসলমান সমাজে। এঁদের সম্বন্ধে কাহিনী গড়ে উঠে ষোলো শতকে, কিন্তু এঁদের মাহাত্মকথা তথা পীর-পাঁচালি রচিত হয়েছে মুখ্যত উনিশ-বিশ শতকে। কাজেই এ সাহিত্য আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্যোগ-দুর্দিনের ঐতিহাসিক দলিল–গৌরবের কিংবা গর্বের সামগ্রী নয়। এ Predawn darkness নয়–অমাবস্যার তমিস্রা। রেনেসাঁসের নয়–পতনের ও গ্লানির প্রতিচ্ছবি। অতএব, এ আত্মবিকাশকল্পে আত্মবিস্তার-প্রয়াস নয়। এমনি দুর্দিনের সাক্ষ্য বাঙলার ইতিহাসে আরো রয়েছে, এমনি দুর্যোগের ঘনঘটা আগেও বাঙালি র ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে, তখনো অসহায় বিমূঢ় বাঙালি অনুরূপ দিশেহারা ভাব দেখিয়েছে।

॥ বাঙালি জীবন ও মননধারা ॥

যখনই সামাজিক ও আর্থিক জীবনে নিরাপত্তা ও স্বস্তির অভাব ঘটেছে, তখনই বাঙালি অধ্যাত্মজীবনের বৃহৎ ও মহৎ আদর্শ ত্যাগ করে জীবন-জীবিকার সহায় শক্তিদেবতার সন্ধান করেছে; আর দেবতার কৃপাজীবী হয়ে বাঁচতে চেয়েছে। তাই আমরা পালরাজাদের পতন যুগে নৈরাত্ম-নিরীশ্বরবাদী নির্বাণকামী বৌদ্ধসমাজকে অসংখ্য দেব-দেবীর স্তব-স্তুতিতে মুখর দেখতে পাই। মাটির মায়ামুগ্ধ জীবনবাদী বৌদ্ধেরা অমরত্বের ও চিরসুখের প্রত্যাশায় যোগতান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে দৈবশক্তিধর হয়ে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে জীবনোপভোগের প্রয়াসী হয়ে উঠল। তুকতাক দারু-টোনার শক্তি আয়ত্ত করে বৌদ্ধ ডাকিনী-যোগিনীরা কামাচার-সর্ব যে বীভৎস জীবনলীলা শুরু করল, তা রূপকথার আকারে আজো ভয়ঙ্কর, চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর হয়ে চালু আছে। রাঢ় অঞ্চলের সাধারণ বৌদ্ধের জীবন-জীবিকার সহায়ক দেবতা হিসেবে এক আদিম সূর্যদেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হতে থাকেন।

শঙ্করের প্রচারিত অদ্বৈতবাদ ও জ্ঞানবাদের প্রভাবে বাঙলাদেশেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-শাসনকালে তাদের প্রতিপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বাঙলার লোকধর্মে পরিণত হল, আর তাদের বিরূপতায় বৌদ্ধমত লোপ পেল। এই সেনদের মন্দার দিনে তুর্কী বিজয়ের কিছু আগে থেকেই সুমহৎ বেদান্ত দর্শনে আস্থা হারিয়ে বাঙালি জনসাধারণ আবার তাদের অনার্য সংস্কারানুসারী পার্থিব জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতার পূজায় ব্রতী হয় আত্মরক্ষার ও আত্মপ্রসারের গরজে। মনসা ও চণ্ডীই এঁদের মধ্যে প্রধান। অপরদিকে গীতগোবিন্দে ও শেখ শুভোদয়ায় বাঙালি র চারিত্রিক শৈথিল্য ও কাঙাল মনের পরিচয় পাচ্ছি।

তুর্কী পরাজয়ে পেলাম সত্যপীর, দক্ষিণরায়-বড় খা গাজী, কালুরায়-কালু গাজী, বনদেবী বনবিবি, শীতলা-ওলা-ষষ্ঠী-বাস্তুদেবী প্রভৃতি; আর মুঘলশক্তির পতনে পেলাম বিদ্যাসুন্দর ও পীর পাঁচালি আর কবিওয়ালা ও শায়ের।

বাঙলা দেশে তথা পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রথমত ও প্রধানত সূফী সাধকদের মাধ্যমে। দেশী প্রাকৃতজন ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নয়, দরবেশ প্রচারকদের কেরামতির আকর্ষণে ও প্রভাবেই ইসলাম বরণ করেছিল। কাজেই শরিয়তি ইসলামের সঙ্গে তাদের নিবিড় পরিচয় হয়নি। তবু গৌড় সুলতানদের আমলে ইসলাম জনমনে কিছুটা জাগ্রত ছিল। কিন্তু ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে বাঙলাদেশে নামত মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্তশক্তির মধ্যে বহুবর্ষব্যাপী যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল এবং তার ফলে যে শাসনতান্ত্রিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রিক অনিশ্চয়তা দেখা দিল আসলে শেরশাহর বঙ্গবিজয় (১৫৩৯ খ্রী) থেকেই এর শুরু। তাতে প্রাকৃতজনের ধন-প্রাণ নিরাপদ ছিল না। আকবর-জাহাঙ্গীরের আমল এভাবে কেটে যাওয়ার পর যদিও শাহজাহান-আওরঙ্গজীবের আমলে দেশে শক্তির দ্বন্দ্ব ছিল না, তবু সাত সমুদ্র না হোক, তেরো নদীর ওপারের দিল্লী শাসনে জনগণের আর্থিক দৈন্য ঘোচেনি। কেননা আর সব সাম্রাজ্যবাদীর মতো মুঘলেরাও ছিল কেবল শাসনে তৎপর ও শোষণে উৎসুক, প্রজার হিতসাধনের দায়িত্ব নেয়নি তারা। শাহজাহানের আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং মগ-হার্মাদ দৌরাত্ম্যে মানুষ ত্রাসের মধ্যে বাস করত আর আওরঙ্গজীবের আমলে বেনে স্বেচ্ছাচার বেড়ে গিয়ে নতুন উপসর্গ হয়ে চেপেছিল, এসবের সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হল বিদ্রোহ-বিগ্রহ, বগী বর্বরতা, সুবাদারের স্বেচ্ছাচার, সামন্ত স্বৈরাচার ও বেনে দৌরাত্ম। তারপর পলাশী-উত্তর অর্ধ-শতাব্দীর শাসনতান্ত্রিক অব্যবস্থা ও আর্থিক দুর্গতি মারাত্মক হয়ে দেখা দিল।

এমনি বিপর্যয়ের মুখে দেশজ মুসলমানেরা ও হিন্দুরা রাজশক্তির উপর আস্থা হারিয়ে অগত্যা জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্যে উপদেবতা সৃষ্টি করে পূজা-শিরনী, দিতে থাকে। এরূপে ষোলো শতকের শেষপাদ থেকে সত্যনারায়ণ-সত্যপীর, বনদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, দক্ষিণরায় বড় খ.গাজী, শীতলা-ওলা, ষষ্ঠী-উদ্ধার-বাস্তুদেবী হিন্দু-মুসলমানের পূজা পেতে থাকে। অন্যদিকে নিম্ন ও উত্তর-পশ্চিম বাঙলার কিছুসংখ্যক বাঞ্ছত লোক বাউল-বৈরাগী জীবনে আত্মপ্রসাদ খুঁজতে থাকে। অবশ্য রাজধানী থেকে দূরে এবং সুফলা বলে পূর্ববাঙলায় এসব উপদেবতার প্রভাব কমই পড়েছে এবং চট্টগ্রামে শরীয়ত-অনুগ ধর্মসাহিত্য ষোলো শতকের শেষপাদ থেকেই রচিত হতে থাকে। অবশ্য ১৬৬৬ সন অবধি উত্তর চট্টগ্রাম এবং ১৭৫৬ সন অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রাম রোসাঙ্গ রাজ্যভুক্তই ছিল, কাজেই সেদিক দিয়ে চট্টগ্রাম বাঙলার বাইরে এবং সে কারণে উপদ্রুত অঞ্চলও নয়।

ষোলো শতক থেকে বাঙালি র প্রধান দেবতা সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর। হিন্দু যে-কিছুকে নারায়ণ ভাবতে পারে, কিন্তু একেশ্বরবাদী মুসলমানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই মুসলমান নারায়ণকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে। একে অবলম্বন করেই মুঘল আমলে দুঃখী ও বিমূঢ় হিন্দু মুসলমান জীবনের ও জীবিকার দুর্দিনে এক মিলন-ময়দানে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। তাদের এ। মিলন-রাখী হল সত্য (Truth) এবং প্রমূর্ত সত্যই যুগপৎ সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর নামে পূজা শিরনী পেতে থাকেন দুঃখীর দেবতারূপে। ষোলো শতক থেকে আজ অবধি ষাট-সত্তর জন সত্যনারায়ণ পাঁচালিকারই এঁর অপ্রতিহত প্রভাবের সাক্ষ্যদান করছেন। অল্লোপনিষদের মতো। সত্যপীরও হিন্দুর মানস-প্রসূত। শাসক-শাসিতের মধ্যেকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই শাসিত হিন্দু কর্তৃক এ মুসলিম-দেবতা পরিকল্পিত। এমনি সমন্বয় প্রয়াস বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউলদের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। চৈতন্যাবতার মুসলিম ফকির আউলচাঁদ ও মদিনার মাধব বিবিই তাদের সাধন-পন্থার প্রবর্তক ও প্রচারক বলে পরিকীর্তিত। নিত্যানন্দ তাঁর পুত্র। বীরদ্রকে বলেছেন :

শীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা সহরে……
 তথা যাই শিক্ষা লহ মাধব বিবির সনে,
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।
—(বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা)

 ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আপোস ও ঐক্যের এ প্রয়াস নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনেকাংশে সফল হয়েছিল। দেশজ মুসলমানেরাও ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সহজপন্থা হিসেবে হিন্দুর দেবতার গুণসম্পন্ন কিন্তু প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড় করাল কয়েকজন কাল্পনিক পীর ও কয়েকজন ঐতিহাসিক বীরযোদ্ধাকে, যারা দেবকল্প পীরের মর্যাদায় তাদের জাতীয় বীর ও ধর্মীয় নেতারূপে পরিকল্পিত। জাফর খা গাজী (দরাফ খা), মোবারক গাজী, ইসমাইল গাজী, খানজাহাঁ খাঁ গাজী, সফীউদ্দিন গাজী প্রভৃতি সেননী-শাসক এবং গোরাচাঁদ, বাবা আদম, পীর বদর প্রমুখ দরবেশ আর বড়খা গাজী, কালুগাজী, মানিক পীর, মছলন্দ পীর, বনবিবি, প্রভৃতি কাল্পনিক পীরের সঙ্গে হিন্দু রাজার ও দেবতার দ্বন্দ্ব-মিলনের উপাখ্যান মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতা ও মিলন সম্ভব হয়েছিল। দরাফ খার মহাত্মকথা, মানিকপীরের কেচ্ছা, গাজীকালু চম্পাবতী উপাখ্যান কিংবা দক্ষিণ রায়, বনবিবি, সত্যপীর প্রভৃতির কাহিনী তার সাক্ষ্য।

কিন্তু স্বার্থসচেতন, জাত্যভিমানী, বিত্তবানেরা স্বাতন্ত্রের মধ্যেই খুঁজেছেন স্বস্তি ও প্রতিষ্ঠা। যেহেতু এঁরাই দেশের ধন-জনের মালিক, জয় হল তাদেরই। সত্যনারায়ণ মুসলমান পীর, তাই শিরনীই তাঁর ভোগ। বাঙলার বাইরেও এঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। লালমনের কিসসায় গৌড় সুলতান হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯) উল্লেখ রয়েছে। কেউ কেউ সত্যপীরকে হোসেন শাহর রক্ষিতা গর্ভজাত বাস্তবপুরুষ বলে বিশ্বাস করে। সতেরো শতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে ধর্মকে করেছেন আদর্শপীর আর নিজে হয়েছেন ফকির। হিন্দুদের ফকির চাঁদ, ফকির দাস, ফকির রায় প্রভৃতি নাম থেকেও হিন্দুসমাজে মুসলমান ফকিরের প্রভাব অনুমান করা যায়। সত্যপীর রচয়িতা উত্তরবঙ্গের কবি কৃষ্ণ হরিদাসের গুরু ছিলেন মুসলমান কবি তাহের মুহম্মদ। ইনিও সত্যপীর পাঁচালির রচয়িতা :

তাহের মামুদ গুরু শমস নন্দন
তাহার সেবক হয়ে কৃষ্ণ হরি গান।

এভাবে দক্ষিণ রায়, কালুরায়, সত্যপীর, বড় খা গাজী প্রভৃতি হিন্দু-মুসলিম দেবতা-পীরের বিরোধ-মিলনের মধ্যদিয়ে বাঙলার হিন্দু ও মুসলমান সামাজিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের রফা খুঁজেছে–বিষ্ণু আর বিসমিল্লাহ কিছু ভিন্ন নয়। কর্মকুণ্ঠ, পরনির্ভরশীল, ভীরু ও ভোগবাদী বাঙালি চিরকালই শক্তির উপাসক। যেখানে ইষ্ট বা অরি শক্তির প্রকাশ দেখেছে সেখানেই সে পূজায় তৎপর রয়েছে। অপ্রত্যক্ষ দেবতার সঙ্গে তাই অসামান্য শক্তিধর মানুষকেও সে পূজা করেছে। ঐতিহাসিক যুগে এর আরম্ভ জৈন-বৌদ্ধ ভিক্ষু-সাধু সেবায় এবং সমাপ্তি বীর-পূজায়। এদেশে ইসমাইল গাজী, খানজাহান খান, জাফরখান প্রভৃতি সেনানী-শাসক পর্যন্ত দেবকল্প হয়ে পূজা শিরনী পাচ্ছেন।

কেবল ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি-সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে-শিল্পে-স্থাপত্যে সঙ্গীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মেলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কী রূপ নিত কল্পনা করা সম্ভব কিন্তু নিরর্থক। কারণ ইংরেজ আমলে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারত ও বেদান্তের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যবাদমুখী করে দিল, আর ওহাবী-ফারায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানেরাও শরীয়ত-অনুগ জীবনাদর্শ গ্রহণে প্রয়াসী হল এবং আরব-ইরানি তমদুনের প্রতি অনুরাগ তাদের রক্ষণশীল করে তুলল। অথচ এখানেই একদা মানবতার মহত্তম বাণী উচ্চারিত হয়েছিল :

নানাবরণ গাভীরে ভাই
 একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
একই মায়ের পুত।

নিম্নবিত্তের এ মিলনমুখী প্রাকৃত মননধারা প্রবল হলেও অভিজাতদের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র এবং স্বধর্ম রক্ষার একটি সদা সচেতন প্রয়াস ছিল। উনিশ শতকে খ্রীস্টধর্ম প্রচার প্রতিরোধে ব্রাহ্মমতের যে ভূমিকা ছিল, পনেরো শতকে স্মার্ত রঘুনন্দনাদি প্রবর্তিত নবস্মৃতি তজ্জাত নবশাখ ব্রাহ্মণ্যমতও ইসলামের মোকাবেলায় সে-ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মুসলমান বিতাড়নও নাকি তাদের লক্ষ্য ছিল, যথাসময়ে গৌড়-সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তা টের পেয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিলেন। এ ব্যর্থতা থেকেই হিন্দুর ধর্ম ও সমাজ রক্ষার নতুন উপায় উদ্ভাবন করলেন শ্রীচৈতন্য। যদিও হিন্দুসমাজে বাহ্যত বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি হবে বলে সুলতান খুশি হয়ে শ্রীচৈতন্যকে প্রশ্রয় ও সর্বপ্রকার সহায়তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তবু ইসলামের প্রসার-প্রতিরোধই লক্ষ্য ছিল বলে চৈতন্যদেব মুসলিম অধিকারে থেকে তার মত প্রচারে সাহসী হননি। তাই উড়িষ্যার হিন্দুরাজ্যে (নীলাচলে) বসেই তিনি তাঁর মত প্রচার করেন। এজন্যে বাঙলাদেশে বৈষ্ণব সাহিত্য যত প্রসার লাভ করেছে, বৈষ্ণব মত তত গৃহীত হয়নি। তবু চৈতন্যদেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল; ইসলাম সত্য সত্যই আর প্রসার লাভ করেনি বরং কিছুসংখ্যক মুসলমান বৈষ্ণবমত গ্রহণ করে। বৈষ্ণবমত মুসলমান সমাজ-মানসকেও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আগেই বলেছি সূফীমতের অনুকরণেই বৈষ্ণব মতের উদ্ভব; সে সাদৃশ্যের ছিদ্রপথেই মুসলিম-মানসে রাধাকৃষ্ণ সূফীতত্ত্বের দেশী রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এদিকে শিক্ষিত মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি মুসলমানের আনুগত্য দৃঢ়মূল করবার উদ্দেশ্যে, ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করবার প্রয়াস পায়। তাই নবী বংশ, রসুল চরিত, ও নানা মসলা-মসায়েল গ্রন্থ রচিত ও প্রচারিত হয়েছে। এ সঙ্গে তাদের ধর্মের ও সংস্কৃতির উৎসভূমি আরব-ইরানপ্রীতি জাগানোর চেষ্টাও ছিল। হয়তো এভাবে মুসলমানদেরকে বহির্মুখী করে রেখে তাদের ধর্মানুরাগ ও আরব-ইরান প্রীতির সুযোগে শাসকরা নির্বিঘ্ন শাসন কায়েম রাখার প্রয়াসী ছিল। এর আভাস মেলে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষার প্রতি বিরূপতায় এবং সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রভৃতির মাতৃভাষার প্রতি প্রীতিজাত বিদ্রোহে এবং মাতৃভাষা ও উর্দু নিয়ে উনিশ-বিশ শতকের শিক্ষিত মুসলমানের মানসদ্বন্দ্বে ও বাহ্যাচরণে°২। পুরুষানুক্রমে তাদের মুখের বুলি বাঙলা। তারা উর্দু জানত না, দু-চারজন উর্দুভাষী বিত্তবানের নেতৃত্বে তারা স্বপ্ন দেখত উর্দুর। এবং সভা ডেকে এই বাঙালি রাই বাঙলা বক্তৃতার মাধ্যমে ঘোষণা করত–উর্দুই তাদের মাতৃভাষা ও জাতীয় জবান। কেবল বিজাতির ষড়যন্ত্রেই তাদের এ সাময়িক বিস্মৃতি ঘটেছে। শেষ অবধি এই অভিজাত দলেরই জয় হল। কেননা আজো হিন্দু ও মুসলমান স্ব স্ব স্বাতন্ত্রে সমুন্নত রয়েছে।

কিন্তু উচ্চবিত্তের মুসলমানের এ প্রয়াস বাঙালি মুসলমানের মানস ও সাংস্কৃতিক জীবন আটশ বছর ধরে পঙ্গু করে রেখেছে। তারা আজো স্বদেশে প্রায় প্রবাসী হয়েই আছে। অজ্ঞতা-অশিক্ষার জন্যে আরব-ইরানি সংস্কৃতিও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি, মানস-বিরূপতা বশত দেশী সংস্কৃতিও স্বাভাবিক বিকাশ পায়নি তাদের জীবনে। তাই কোনো মৌলিক চিন্তা, মননের কোনো ঐশ্বর্য তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাদের ভাব-ভাবনা কোথাও কোনো স্পষ্টরেখায় ফুটে উঠেনি। এজন্যে তারা আজো না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় রয়েছে, আজাদী-উত্তর এ বিশ বছরেও তাদের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘোচেনি এবং যদিবা মাতৃভাষা সম্পর্কে দ্বিধামুক্ত হয়েছে, তবু তার রূপ সম্পর্কে নির্ঘ হয়নি। তাই রব উঠেছে : হরফ বদলাও, শব্দ বদলাও, নাম বদলাও, বদলাও ভাব, বদলাও ভঙ্গি, বদলাও বিষয়। তারা বাঙলার মানুষ, কিন্তু দৃষ্টি তাদের আরব-ইরানে। অস্বীকৃত বাস্তব ও অসফল স্বপ্নের টানাপড়েনে তারা আজো দিশেহারা। এ বিশ বছরেও তারা দেশ ও ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মননের ক্ষেত্রে পথ ও পাথেয় খুঁজে পেল না। এমন মানস-বিপর্যয় পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমানের জীবনে দেখা যায়নি।

কেউ কেউ মুসলমানের রচনায় সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দু পুরাণের প্রভাব লক্ষ্য করে থাকেন। এ-কথা মোটামুটি স্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলমানের রচনায় আঙ্গিক ও ভাষাগত প্রভেদ ছিল না। এর কারণ, অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান বাঙালি অবিশেষের জন্যে বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে যেয়ে মুসলমান লেখকেরা ভারতের classic ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। জনগণের অপরিচিত আরবি-ফারসি শব্দ, অলঙ্কার ও প্রতাঁকের শরণাপন্ন হয়নি। যাদের জন্যে। লেখা, তাদের অজ্ঞাত অলঙ্কার ও রূপ-প্রতীক প্রয়োগে রচনা ব্যর্থ হত। এজন্যেই আমরা আজো পারত পক্ষে ইংরেজি সাহিত্যের রূপ-প্রতীক বাঙলায় ব্যবহার করিনে। এক কথায় খ্রীস্টান য়ুরোপ যে-গরজে ও যে-মনোভাব নিয়ে সাহিত্যে Pagan Greek ও Latin উপাদান গ্রহণ করেছে, মুসলমান লেখকগণও অনুরূপ কারণে অতিপরিচিত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উপাদান নিয়ে বাঙলায় সাহিত্য-সৌধ গড়ে তুলেছেন। একে হিন্দুয়ানী প্রভাব বলা অসমীচীন। এ হিন্দু-সংস্কৃতির প্রভাব নয়, দেশী উপাদান গ্রহণ–যাতে এঁদেরও উত্তরাধিকার ছিল। বাঙলা ভাষা তার পুষ্টির জন্যে জ্ঞাতি সংস্কৃতের থেকে ঋণ নেবে, এ-ই তো স্বাভাবিক। তা চর্যাপদের কাল থেকে চলেও আসছে। আজকের দিনে পরিভাষা নির্মাণের কাজেও লাগছে সংস্কৃতই।

সাহিত্য ব্যবহারিক জীবনের চিত্র না হোক, চিরকালই মানস-জীবনের আলেখ্য। এ অর্থেই সাহিত্য জীবন-মুকুর। এক এক দেশ, কাল ও মানুষের বিচিত্র জীবনের রূপ ফুটে উঠে সাহিত্যে। সে সে দেশ, কাল ও মানুষের পটভূমিকায় বিবর্তনশীল জীবনপ্রবাহে সমাজ ও সংস্কৃতি যেখানে যখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সাহিত্যের আঙ্গিকে, বিষয় নির্বাচনে, ভাবকল্পে আর ভঙ্গিতে অনুরূপ পরিবর্তন আসছে। আগের যুগের মানুষ ভূত-প্রেত-দেও-দানুতে বিশ্বাস রাখত, ঝাড়-ফুক-তুক তাক-দারু-টোনাতে ভরসা পেত; তাই তাদের রচনায় এ সবের ভয়, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধানিষ্ঠ চিত্র পাই। যেহেতু মানুষের কোনো আচরণ কিংবা মানস-অভিব্যক্তিই স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক প্রভাবমুক্ত নয়, সেহেতু আগের কালের মানুষের রচনায় তাদের বিশ্বাস-ভরসা-ভয়-ভাবনা-আশা আরজু, ভাব-কল্পনার আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে। সেদিক দিয়ে তাঁদের সাহিত্যও বাস্তব আর জীবনানুগ। বিশ্বাস-সংস্কার ভেদে আজ আমাদের কাছে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক। আজ আমরা তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, অনেক ব্যাপারেই তাদের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছি জ্ঞাতিত্ব, যোগসূত্র হয়ে এসেছে ক্ষীণ ও স্বাজাত্যবোধও হয়ে উঠেছে আবছা; তাই তাঁদের রচনা আজ আমাদের নিকট আজগুবি। মাটির মায়ামুগ্ধ, বস্তুনিষ্ঠ, মনস্তত্ত্ব প্রিয় ও জীবনরসিক আজকের পাঠক তাই সেকালের অলৌকিক-অবাস্তব জগতের বিবরণ পড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। সেকালের বিস্ময়বোধ আমাদের উপহাসের সামগ্রী, সেকালের রোমান্টিক ভাব-কল্পনা আমাদের চোখে অজ্ঞ অপরিণত শিশুমনের হাস্যকর বিলাসমাত্র। তাঁদের স্থূলতা পীড়াদায়ক এবং তাঁদের আন্তরিকতায় উজ্জ্বল বর্ণনভঙ্গিও বাল-ভাষণের মতো তুচ্ছ মনে হয়। এছাড়াও আজকের পাঠকের কাছে মধ্যযুগের সাহিত্য পরানুকরণ আর পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে ক্লান্তিকর। তবু কালিক ব্যবধান মনে রেখে যদি শ্রদ্ধা নিয়ে মধ্যযুগের বৈচিত্র্যহীন সাহিত্য পাঠ করি, তাহলে সেকালের কবি ও কাব্যের প্রতি পুরো না হোক, কিছুটা সুবিচার করা সম্ভব হবে। তখন দেখা যাবে এ পুচ্ছগ্রাহিতার মধ্যেও কোনো কোনো কবি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং আন্তরিকতায় স্নিগ্ধ।

সবচেয়ে বড় কথা–বাঙালি র চরিত্র, মানস ও জীবনধারার অন্তরঙ্গ ঐতিহাসিক ক্ৰম বিধৃত রয়েছে এ সাহিত্যে। কাজেই নিজেদের জানবার-বুঝবার জন্যেই এ সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় প্রয়োজন।

বাঙালি র জীবনের ও স্বভাবের পটে আমরা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য পরিক্রমা শেষ করলাম। অবশ্য একই সঙ্গে এ সাহিত্যের মুকুরে বাঙালি কে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগও পেলাম। কেননা ফল দিয়ে কর্মের এবং কর্ম দেখে কর্তার ধারণা পাওয়া সম্ভব। পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনো জাতিকে তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমেই জানতে হয়। কেননা মানুষের যথার্থ প্রকাশ ও পরিচয় থাকে তার মানস-অভিব্যক্তির মধ্যেই। দূরের ও অতীতের মানুষকে জানবার এছাড়া অন্য উপায় নেই। আমরা দেখলাম–বাঙালি র চেতনা-চঞ্চল জীবন, বুদ্ধির চমক, অনুভবের বৈচিত্র্য, মননের দ্যুতি, তরঙ্গিত জীবন-ভাবনার অভিনবত্ব, সৃজনশীলতা ও গীতোচ্ছাস এ সাহিত্যের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তা কখনো সার্থক ফলপ্রসূ হয়ে তাদের জীবনে ও সমাজে সুষ্ঠু অগ্রগতির সহায়ক হয়নি। তার কারণ, যারা দেশের নেতা ও সমাজের প্রতিভূ, তাদের জাত্যভিমান তাদের দেশাত্মবোধকে ছাপিয়ে উঠেছিল। বৰ্ণহিন্দু ছিল উত্তর ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুধ্যানে নিরত, আর বিত্তবান মুসলমান ছিল আরব-ইরানির জ্ঞাতিত্ব স্বপ্নে বিভোর আর হয়তো তুর্কী-মুঘল গৌরবগর্বেও স্ফীত। দেশগত জীবন ও পরিবেষ্টনীগত প্রয়োজন সম্পর্কে কেউ তেমন সচেতন ছিল না। ফলে স্বাদেশিকবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহা কখনো জাগেনি তাদের মনে। কাজেই আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা তথা দেশ-নির্ভর স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্যে তাদের আকাক্ষা ও কর্ম কখনো নিয়ন্ত্রিত হয়নি। তারা সুস্থ ছিল না, কাজেই সুস্থ চিন্তা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। এর ফলে পরিণামে পূর্ববঙ্গ হয়েছে পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ হয়েছে উত্তর-ভারতের কাছে বিক্রিত।

তবু বাঙলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তারই যে বাঙালি র মনোরাজ্যে নবচেতনা এনে দিয়েছিল এবং এতে যে তাদের মানস-জগৎ বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ ইসলাম ও তুর্কী মুসলমানের সান্নিধ্য যে এ চেতনার ও প্রেরণার উৎস তা অস্বীকার করা যাবে না। এ ছিল অনেকটা এ যুগের প্রতীচ্য প্রভাবের মতো।

প্রতীচ্য প্রভাবে ও প্রতিভার পরিচর্যায় মাত্র চৌত্রিশ বছরে–১৮৪৭ সনে বিদ্যাসাগরের হাতে শুরু হয়ে ১৮৮০ সনে রবীন্দ্রনাথে উত্তরণে–আধুনিক বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের যে-বিস্ময়কর বিকাশ সম্ভব হয়েছে, সেরূপ প্রতিভার স্পর্শ পায়নি বলে আটশ বছরেও মধ্যযুগের বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের তেমন দ্রুত ও বিচিত্র বিকাশ হতে পারেনি। তবু এ ভাষা ও সাহিত্যকে হিন্দু মুসলমানের মানস-ফসলরূপে গ্রহণ করব।

মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বাঙালি মুসলমানের বিশেষ গর্বের অবলম্বন হতে পারে। কেননা, এ ভাষা ও সাহিত্যের চর্যায় বাঙালি কে প্রবর্তনা দেন সুলতান-সুবাদার। এর অন্যতম আদিকবি ও প্রণয়োপখ্যানের আদি-লেখক শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.)। রোমান্সের সর্বশ্রেষ্ট রচক ও মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী দৌলত। বাঙলার প্রথম মৌলিক ও রূপক কাব্য সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ-এর (১৬৩৫ খ্রী.) রচয়িতা মুহম্মদ খান। বাস্তব প্রতিবেশে মাটির মানুষের জীবনচিত্র ও প্রণয় কাহিনী রচনা করেছেন লায়লীমজনুর কবি দৌলত উজির বাহরাম খান ও পূর্ব-বাঙলার গাথাকারগণ। বাঙলাকাব্যের ভাষাকে পরিশ্রুত ও নাগরিক লাবণ্যদান করেন। শাবারিদ খান ও আলাউল। মুসলমান কবিও সংখ্যায় হয়তো অমুসলমান কবির চেয়ে কম ছিলেন না। এভাবে বাঙলা সাহিত্যের সৃষ্টি, পুষ্টি ও বৈচিত্র্যের মূলে রয়েছে মুসলমানের বিশেষ সাধনা ও দান।