স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য

স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য

আমরা প্রায় সবাই বাঙালি-মুসলমান অর্থাৎ দেশজ মুসলমান– এ-কথা অস্বীকার করবার জো নেই। আমাদের স্বভাবে, সামাজিক সংস্কারে, জীবনবোধে সর্বোপরি আমাদের নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনে আমাদের এই বাঙালিয়ানার ছাপ রয়েছে পুরোপুরি। আবার আমরা ধর্মাদর্শে আরবের অনুসারী। কৃষ্টি-সংস্কৃতির চর্চায় এককালে আমরা ছিলাম ইরানের অনুকারী, এখন হয়েছি য়ুরোপীয় সভ্যতার সাধক!

বিগত হাজার বছর ধরে চলেছে আমাদের সমন্বয় সাধনা–তিনটে দেশ থেকে পাওয়া তিন ধারার স্বভাব, আদর্শ ও সংস্কৃতির সমন্বয়-সাধনা।

আদর্শ যত মহই হোক, জাতীয় জীবনে তা স্বভাবধর্মকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না কখনো। স্বভাবের সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়া-প্রতিবেশের সম্পর্ক, আর আদর্শবাদ হচ্ছে একান্তভাবে বুদ্ধিপ্রসূত। বৃত্তি-প্রবৃত্তির অভিব্যক্তিই স্বভাব; আর মন-মননজাত কল্যাণ বুদ্ধিই হচ্ছে আদর্শবাদ। স্বভাবের স্বপ্রকাশ প্রায় অপ্রতিরোধ্য আর জীবনে আদর্শের রূপায়ণ ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও সাধনাসাপেক্ষ। তাই হাজার বছরেও সার্থক বা সফল হয়ে ওঠেনি আমাদের সমন্বয়-সাধনা। গড়ার পরিমাণ হয়তো তবু বেশি, কিন্তু নগণ্য নয় ভাঙার পরিমাণও। কোরআন-হাদিস আমাদের নিত্যসঙ্গী, তবু লৌকিক সংস্কার থেকে আমরা মুক্ত ছিলাম না কখনো। আজ লৌকিক সংস্কার ছেড়েছি আমরা, আমাদের কৃতিত্ব নেই এতে–নেই কোনো সিদ্ধির আত্মপ্রসাদ। কেননা তার বদলে ধর্মাদর্শকে দৃঢ় করে ধরিনি আমরা। আসলে ভোগেচ্ছা ছাড়া এ-যুগে সবকিছুই ছাড়ছি আমরা, তাই ত্যাগ করেছি। কুসংস্কারও।

হয়তো আমাদের আরো বহু কল্যাণবুদ্ধি লোপ পাবে যুগ-প্রভাবে। কিন্তু স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বজাতির প্রতি মমতা ছাড়তে পারব না কখনো। স্বদেশ তথা আবাস হচ্ছে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত নিবাস। একে বলা চলে জীবনবৃন্ত। আর ভাষা হচ্ছে জীবন-রস। যে-ভাষার মাধ্যমে বোল ফোটে শিশুর, যে-ভাষায় অনুভূতি পায় অপরূপ অভিব্যক্তি, সে ভাষা বলতে গেলে–জুড়ে থাকে জীবনের সবখানিই। এ তথ্যটি ভালোভাবেই জানতেন আগের যুগের বাঙালি মুসলমান। তাই তারা স্বধর্ম ত্যাগ করলেও আঁকড়ে ধরে ছিলেন স্বভাষা। তাঁরা জানতেন ভাষা ও সাহিত্য শুধু মহৎ প্রেরণার সহায়কই নয়, জীবনানুভূতির ভিত্তি বা জীবনরসের উৎসও। তারা বুঝতেন শব্দের নিজস্ব কোনো স্বরূপ নেই। মানুষের রস-কল্পনাই শব্দকে দেয় মূর্তি ও দান করে প্রাণ। শব্দের ব্যঞ্জনা, ভাব বা চিত্র-প্রতীকতা আর সামগ্রিক অভিধা বক্তার রস-চেতনা, বুদ্ধি, বোধি ও অভিপ্রায় নির্ভর। বক্তার ভাবকল্পের দ্বারাই শব্দার্থ হয় নিয়ন্ত্রিত, শব্দার্থের দ্বারা পরিচালিত হয় না ভাব। তাই যেখানেই অনুভূতির কথা, যেখানেই বোধির প্রকাশ, সেখানেই বক্তার অভিপ্রায় শব্দকে–

অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যায় কিছু দূর।
ভাবের স্বাধীন লোকে পক্ষবান অশ্বরাজ সম।

এজন্যেই ঈশ্বর, খোদা, নিরঞ্জন বা ভগবান মুসলমানের মুখে এক অপরূপ আল্লাই নির্দেশ করে। তাদের কাছে নামাজ নমস্কার নয়– সালাতই। রোজাও দৈনিক উপবাস মাত্র নয়–সিয়াম। অতএব প্রতিশব্দ ভাবের প্রতিরূপ যে বদলায় না, এ বোধ ছিল সেকালের স্থিতধী বাঙালি মুসলমানের। তাই ইসলাম বরণ করে তারা ছেড়েছিল হিন্দুয়ানী, অবজ্ঞা করেছিল–ভুলতে চেষ্টা করেছিল হিন্দু-ঐতিহ্যকে, কিন্তু ছাড়েনি স্বভাষা ও সাহিত্যের চর্চা। তাই আমরা আদিকাল থেকেই। পাচ্ছি হিন্দুর রচনার পাশে মুসলমানের রচনার সাক্ষাৎ। শাহ্ মুহম্মদ সগীর চণ্ডীদাসেরই। সমসাময়িক। মালাধর বসুর সাথে পাচ্ছি জায়নুদ্দিনকে। বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্ৰীকরনন্দী, দ্বিজ শ্রীধর, মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম প্রভৃতির পাশে পাচ্ছি সৈয়দ সুলতান, চাঁদকাজী, শেখ কবির, শা বারিদখা, শেখ ফয়জুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খা, মুহম্মদ কবীর, দোনাগাজী প্রভৃতিকে। শুধু কী তাই? মুসলমান কবিরাই বিষয় ও রস-বৈচিত্র্যে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন বিচিত্র ধারায়। আর বিদেশাগত আমীর-ওমরাই শুধু বাঙলা ভাষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি, বহিরাগত অভিজাত মুসলমান-সন্ততিগণও করেছেন স্বকীয় অবদানে বাঙলা সাহিত্যের বিকাশে প্রচুর সহায়তা। বাহরাম খাঁ, শা বারিদ খা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মুর্তজা, সৈয়দ আইনুদ্দিন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মুহম্মদ খাঁ প্রভৃতির নাম ও আত্মপরিচয়ে রয়েছে আমাদের উক্তির সমর্থন। এঁদের কেউ কেউ আবার আমীর-ওমরাহর বংশধর বা স্বয়ং আমীর।

ধর্মান্তরে জাত্যন্তর হয়, কিন্তু দেশান্তর বা ভাষান্তর হয় না। য়ুরোপ খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু হিব্রু ভাষা ঠাঁই পায়নি সেখানে। বৌদ্ধধর্ম দেশদেশান্তরে গেছে, কিন্তু কারো জাতীয় ভাষা হয়নি পালি। কাফিরের ভাষা বলে আরবি ত্যাগ করেনি মুসলমান আরব। কোরআন তো নাযেল হল সে ভাষাতেই! বাঙালি মুসলমানের চিরকালের মুখের বুলি, প্রাণের ভাষা, স্বপ্নের বোল কী করে হয় হিন্দুয়ানী ভাষা? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ছাপ কম হবে না হিন্দুয়ানীর চেয়ে। আমাদের মধ্যযুগীয় অবদানের সম্যক উদ্ধার ও আলোচনা হয়নি আজো। আমাদের রিথের দলিল নেই আমাদের হাতে, মুছে গেছে স্মৃতি থেকেও, তাই নিজের সম্পদের দাবী জানাতে সঙ্কোচ বোধ করি আমরা। হীনমন্যতায় আমাদের রুচি-বুদ্ধি বিকৃত। আমরা বিভ্রান্ত, বিমূঢ়! ইতিহাসও আজ আমাদের কাছে যোবা। অথবা আমরা কালা ইতিহাসের বাণী আমাদের মর্মে দূরে থাক–কানেও পৌঁছে না। আরবি একদিন জবর-দখল বসাতে চেয়েছিল ইরানি ভাষায়; আত্মসচেতন ফেরদৌসীর নেতৃত্বে তা হয়েছে অস্বীকৃত ও বিচ্যুত। তবু মুসলিম ধর্ম-দর্শনে ইরানের দানই সবচেয়ে বেশি। আমরাও থাকব মুসলমান; আমাদের ভাষাও থাকবে বাঙলা। এ ভাষাই আমাদের মন-মননের অভিপ্রায় অনুসারে ইসলামি ভাবের জারকরসে অভিষিক্ত হতে বাধা নেই। এটুকুই আমাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক-কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক কল্যাণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে জেগে উঠে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সাবধান বাণী–মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো বাঁচতে দাওLive and let others live-এ যুগের চরম দাবী এ-ই। এ পথেই পরম স্বস্তি তথা শান্তি। এ যুগদাবী জেগে উঠুক আমাদের হৃদয়ে। এ-ই কামনা করি।