নজরুলের কাব্যসাধনার লক্ষ্য
নজরুল ইসলামই মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র কবি–যার অনন্য প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা ছিল। প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। নজরুল ইসলামের মধ্যেও আমরা এসব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটাজাতিকে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সভ্যতায়, আচারে, আদর্শে যেন কোথাও গ্লানি না থাকে, মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে– এ-ই ছিল তার অভিলাষ। এইজন্যেই তিনি বিপ্লবী কবি।
এইরকম আর একজন মাত্র প্রতিভা বাঙলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁরও সাধনা ছিল বাঙালি হিন্দুকে উন্নত সমাজাদর্শ, ধর্মাদর্শ, রাষ্ট্রাদর্শ ও জাতীয়তাবোধ দান করা। সমাজাদর্শে দেবী চৌধুরাণী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল এবং রাষ্ট্র ও জাতীয়তার প্রতীক তাঁর সীতারাম, আনন্দমঠ, রাজসিংহ প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুশীলন, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র প্রভৃতির দ্বারা তিনি ধর্ম-সংস্কারের প্রয়াসী হন। নজরুল ইসলামও অগ্নিবীণা, সন্ধ্যা, সর্বাহারা, সাম্যবাদী, বিষের বাঁশী, জিঞ্জির, ভাঙ্গার গান প্রভৃতি কাব্য; আমপারা, মরুভাস্কর প্রভৃতি গ্রন্থ এবং কোরবানী, মোহররম, ফাতেহা দোয়াজদহম আর আমানুল্লাহ, জগলুলপাশা, খালেদ, কামালপাশা প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের প্রশস্তি দ্বারা একাধারে মুসলমান ও বাঙালি জাতির উন্নতি কামনা করে গেছেন। একদিক দিয়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বড়। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু হিন্দুর কথা ভেবেছেন, প্রতিবেশী মুসলমানকে তিনি আপনজন ভাবতে পারেননি। স্বামী বিবেকানন্দও মুচি, মেথর, চণ্ডাল ভারতবাসীকে ভাই বলেছেন, কিন্তু মুসলমানকে ভাই বলে বরণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রও এ ত্রুটি থেকে মুক্ত নন। নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখেননি কখনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময়েও নয়। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে বাঙলার যমজ সন্তান বলেই জানতেন। বস্তুত সমগ্র বাঙলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই একমাত্র লেখক–যিনি ভুলেও কখনো বিধর্মীকে বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ করেননি। পক্ষান্তরে বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সব হিন্দু-লেখকের লেখায় অল্প-বিস্তর মুসলমান-বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ প্রকাশ পেয়েছে।
নজরুল-প্রতিভার পরম বিস্ময়কর দিক হচ্ছে সমকালীন জীবনবোধ। রাশিয়ার সাম্যবাদের বুলি যখন এদেশে পৌঁছেনি, তখন তারা ভারতবর্ষে–হয়তো গোটা এশিয়ায় তিনিই প্রথম জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ফরিয়াদ নিয়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং উদাত্তকণ্ঠে প্রতিকারের দাবী জানালেন। এমন অকৃত্রিম দরদী বাঙলাদেশে কমই জন্মেছেন। এইজন্যেই তাকে এককথায় জীবনধর্মী মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা হয়েছে।
কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তিনি প্রচার-সাহিত্যের কবি, তাঁর সাহিত্যে সাহিত্যের চিরন্তন উপাদান নেই। এসব মতবাদ একটু সেকেলে। কেননা যে-সাহিত্য মানুষের রসপিপাসা মিটাতে সমর্থ, তা পুরোনো হবার নয়। ধরতে গেলে সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, কবি সাহিত্যিকের প্রতিভার স্পর্শেই নগণ্য বিষয়বস্তুও শিল্পায়ত্ত হয়ে চিরন্তন রসের উৎস হয়ে থাকে। যেমন একটি দুর্ভিক্ষ বা একটি বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের কাহিনী শিল্পীর সক্ষম তুলিকায় চিরন্তন বাণীমূর্তি লাভ করে সর্বকালের পাঠকের কাছে কারুণ্যের নিঝর হয়ে থাকতে পারে। অথচ দুর্ভিক্ষ বা বন্যা এমন কিছু চিরন্তন সাহিত্যের উপাদান নয়। সুতরাং ভাব বা বিষয়বস্তু সাহিত্যের তেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, রূপায়ণশক্তিই সাহিত্যের চাবিকাঠি অন্য কথায় সাহিত্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে কঙ্কালস্বরূপ, ভাব হচ্ছে রক্তমাংস স্বরূপ এবং প্রাণ হচ্ছে প্রকাশভঙ্গি। এই প্রকাশ-প্রতিভা (style) না থাকলে রচনা সাহিত্য হয় না। সুতরাং নজরুল ইসলাম তার যে-কাব্য দিয়ে সমাজে সাহিত্যে-ভাষায় ছন্দে-সুরে যুগপ্রবর্তক কবি বলে অভিনন্দিত হলেন, সে-কাব্যের আবেদন অনাগতকালে থাকবে না এমন ধারণায় সত্য নেই বিশেষ। কেননা যা সাহিত্য তা রসোত্তীর্ণ কাজেই নজরুলের কাব্যের যে অংশ সাহিত্যরসময় সে-অংশ কখনো বিলুপ্ত হবে না। তা পুরোনো সাহিত্যরূপে উত্তরকালেও কদর পাবে। যদি সমালোচকদের যুক্তি মেনে নিয়ে বলি যেহেতু ইহা প্রচার সাহিত্য–এ-যুগের প্রয়োজনেই রচিত, সেহেতু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী যুগে এর কদর হবার কথা নয়, তাহলেও আমরা ভুল ধারণাই পোষণ করব, কেননা সেদিন এই সাহিত্য ইতিহাসের বাণীর ন্যায় সে-অনাগত দিনের জনগণকে আদর্শচ্যুতি বা পথবিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। কারণ নির্বিশেষ মানুষ কোনোদিন দুষ্পবৃত্তির ও সংকীর্ণতার উপরে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং আজকের মতো সেদিনও পাঠকচিত্তে নজরুলের কাব্য রস ও প্রেরণা যোগাবে।
নজরুল ইসলাম স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক কবি। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি নির্যাতিত মানবতার কবি। স্বদেশের দুঃখী জনসাধারণের দুঃখ-বেদনা-নিপীড়নের ফরিয়াদ ও প্রতিকার প্রচেষ্টায় তিনি কলম ধরেছিলেন। সর্বপ্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অত্যাচারমুক্ত করে মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর ব্রত : যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেশ-জাতি ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে মানুষের যেখানে নির্বিশেষ পরিচয়, সেই পরিচয়ের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত এবং নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করে তোলাতেই তাঁর সাধনা নিবদ্ধ ছিল। বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ মানুষের যে–ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তির আত্মিক মর্যাদা আছে– সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করাই ছিল তাঁর কাব্যসাধনার লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন মনুষ্যত্বের অবাধ স্ফুরণ ও বিকাশের অধিকার। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মানুষ নির্বিশেষের অবাধ ও সহজ মিলনের; যে-মিলনে বিত্ত-বৃত্তি-বেশাত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, যে-মিলন সম্ভব হয় পরস্পরের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদার স্বীকৃতির উপর। তিনি চেয়েছেন এমন মিলন ময়দান যেখানে মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যাত্মা লাঞ্ছিত হয় না এবং যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই।