ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা

ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা

মানুষের জ্ঞান সীমিত কিন্তু অজ্ঞতা অসীম। অজ্ঞতা থেকেই ভয়, বিস্ময় ও কল্পনার উদ্ভব। যা জানিনে, যা বুঝিনে তা জানবার-বুঝবার আগ্রহ থেকেই কল্পনার প্রসার। আদিম অজ্ঞ মানুষের জীবন ছিল ভয়, বিস্ময় ও কল্পনাশ্রিত। ফল ও মৃগয়াজীবী মানুষের সংখ্যাধিক্যে খাদ্যবস্তু যখন দুর্লভ হতে থাকে, তখন বাঞ্ছসিদ্ধির আত্যন্তিক কামনা মানব-মনে এক অদৃশ্য তৃতীয় শক্তির জন্ম দেয়। এর নাম জাদুবিশ্বাস। অভাব ও অতৃপ্তি বোধ থেকে উদ্ভূত হয় পাওয়ার বোধ। এর নাম কামনা বা আকাঙ্ক্ষা। অভাব-অতৃপ্তি মিটানোর জন্যে জাগে প্রাপ্তির ইচ্ছা। এই ইচ্ছার অভিব্যক্তি প্রচেষ্টারূপে শারীরক্রিয়ায় পরিণত হয়। এর নাম কর্ম। কিন্তু কর্ম মাত্রই সফল হয় না। তাই মানুষের অভাব মিটে না–সব প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না। ব্যর্থতায় বিক্ষুব্ধ অসহায় মানুষ তাই কল্পনা করেছে অরিশক্তি ও মিত্রশক্তি-ইষ্টদেবতা ও অপদেবতা। জাদুবিশ্বাসে তাই দেখতে পাই ইষ্ট ও অরি দেবতার উপস্থিতি, তাদের দ্বন্দ্ব, তাদের হার-জিৎ। জীবনধারণের পক্ষে যা-কিছু প্রতিকূল তা-ই মন্দ আর যা কিছু অনুকূল তা-ই-ভালো। ভালো-মন্দ ধারণার ভিত্তি এ-ই। তাই ভালো-মন্দের সর্বজনীন চিরন্তন কোনো রূপ নেই। সত্যবোধও হচ্ছে ভালোমন্দ প্রসূত। তাই সত্যেরও কোনো একক রূপ স্বীকৃত নয়। কেননা ভালো, মন্দ ও সত্য আপেক্ষিক ধারণা– অনপেক্ষ নয় (relative, absolute নয়)। উপযোগই ভালো, মন্দ ও সত্যের মাপকাঠি। তাই কলা পাকলে হয় খাদ্য, বেগুন পাকলে হয় অখাদ্য। রাজায় বা রাজাদেশে কাড়লে-কাটলে দোষ নেই, পাপ নেই। কিন্তু ব্যক্তিক জীবনে তাই যুগপৎ vice, crime ও sin–সমাজে অন্যায়, রাষ্ট্রে অপরাধ, ধর্মে পাপ।

জাদুবিশ্বাস-অনুগ আচার-আচরণই মানুষের আদিম ধর্ম। যেহেতু বুনো ফল-মূল ও মৃগজীবী মানুষের বাঞ্ছাসিদ্ধিই এর লক্ষ্য, সেজন্যে এ-ধর্ম মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ, বিদ্বেষ ও দ্বন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। কেননা তখন প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে করে টিকে থাকাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। যেখানে আত্মশক্তির তথা বাহুবলের শেষ, সেখানেই জাদুবিশ্বাসের উদ্ভব, সেখান থেকেই জাদুনির্ভরতার শুরু। মিত্রশক্তির আবাহনে অরিশক্তির বিতাড়নই ব্রত। আদিম মানবের অবোধ বাসনা চরিতার্থ করবার অক্ষম প্রয়াসে সৃষ্ট হয় প্রাকৃত শক্তির কাল্পনিক অনুকৃতিজাত তুকতাক-দারু-টোনা-মন্ত্র-তন্ত্র। ভাগ্য বা অদৃষ্টতত্ত্ব এ স্তরের বোধের দান।

কল্পিত তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রবর্তনা দেয় নিষ্ক্রিয় নিরীক্ষায় ও সক্রিয় পরীক্ষায়। এর থেকে অর্জিত হয় অভিজ্ঞতা। একের দেখে-জানা অভিজ্ঞতাই হয় অপরের শুনে-পাওয়া জ্ঞান। ক্রমে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাড়তে থাকে। কালে জ্ঞানে-বিশ্বাসে সংস্কার হতে থাকে জটিল ও বহুধা। কালের চাকা ঘুরছে অনবরত আর মানুষের জ্ঞান-বিশ্বাস-সংস্কারও হচ্ছে জটিলতর। বিশ্বাসের পরে এল জ্ঞান। তবু বিশ্বাসও রইল, জ্ঞানেরও ঠাই হল। জ্ঞান যুক্তির জনক। যুক্তি সংস্কার ভাঙে। বিশ্বাস সংস্কারকে প্রবল করে। যুক্তির আশ্রয় জ্ঞান বুদ্ধি, বিশ্বাসের প্রশ্রয় ভীরু মানুষের দুর্বলতায়, লোভী মানুষের অক্ষমতায়। যদিও বোধের থেকে বোধি, তা থেকে বুদ্ধির উন্মেষ, আর জ্ঞান বোধির যোগে আসে প্রজ্ঞা, তবু এর মধ্যে একটি প্রত্যয়স্বল্প অস্থির মানস-স্তর রয়েছে, যার ফলে জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশ্রণে গড়ে উঠে অধ্যাত্মবুদ্ধি, যা সুবিধেমতো কখনো জ্ঞানবাদী, কখনো বিশ্বাসপন্থী। এ বুদ্ধি এক অপার্থিব রহস্যলোক সৃষ্টি করে। ইহলোকে এ আলো-আঁধারির অস্পষ্টতা কখনো ঘুচবার নয়। কারণ অজ্ঞতা অসীম এবং জ্ঞানে অজেয়। তাই ইবনে রুশদ যখন বলেন– শাস্ত্র হচ্ছে সাধারণের জন্যে, আর জ্ঞানীর জন্যে প্রয়োজন দর্শনের, তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। কারণ ফল ও প্রভাব অভিন্ন থেকে যায়। কেননা দুটোই কল্পনাপ্রসূত এবং পরিণামে সংস্কার-রূপেই স্থায়িত্ব পায়।

জ্ঞান-বুদ্ধি ও নৈপুণ্যের বৃদ্ধিতে ক্রমে বুনো-মানুষ উৎপাদনে ও পশু-লালনে জীবিকার ব্যবস্থা করল। তখন মানুষ কৃষিনির্ভর আর পশুজীবী। তখন প্রকৃতি ও পরিবেশই কেবল তার প্রতিপক্ষ নয়, উৎপাদন ক্ষেত্রের ও চারণভূমির সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যের পরিমিতি মানুষকেও করে তুলল মানুষের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তখন ঈর্ষা-দ্বেষ কাড়াকাড়ি-হানাহানি হয়ে উঠল পারস্পরিক। তখন মানুষের সংগ্রাম দ্বিমুখী হলেও মানুষই প্রথম নম্বরের শত্রু বলে বিবেচিত হল। ফলে জাদুবিশ্বাস তো রইলই, তার উপর জগতে ও জীবনে নতুনতর তত্ত্বও হল আরোপিত। দুর্বলের নিরাপত্তা ও সান্ত্বনার জন্যে এবং সবলকে সংযত ও শৃঙ্খলিত রাখবার প্রয়োজনে কল্পিত হল ইহ-পরলোকে। প্রসারিত জীবন ও আত্মার অমরত্ব। রচিত হল অপৌরুষের শাস্ত্র। এই অভিনব উপায় উদ্ভাবিত হল গোত্র ও সমাজ শাসনের প্রয়োজনে। উদ্ভাবন করলেন যাঁরা, তাঁরা একাধারে জ্ঞানী এবং অধ্যাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন। এ এক অদ্ভুত ফাঁদ যা জানবার বুঝবার কিংবা এড়াবার সাধ্য নেই কারো। কেননা বিশ্বাসে এর দিশা মেলে না, আবার বুদ্ধি ও জ্ঞানে এর ওর পাওয়া ভার।

এ শাস্ত্র জাগাল ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং তজ্জাত পাপ-পুণ্যের ধারণা। এ পাপ-পুণ্যের ফল পরলোকে তো বটেই, ইহজীবনেও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে। আবার এ ন্যায়-অন্যায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিচিত্র। সবল ও দুর্বলের ন্যায়-অন্যায় অভিন্ন নয়! তিন টাকা দিয়ে কেনা গোলাম তার ত্রিশপুরুষ অবধি দেহ-মন ও মনুষ্যত্ব দিয়ে মালিকবংশের সেবা করলেও তিন টাকার ঋণ শোধ হয় না কেন, কিংবা ত্রিশ টাকা দিয়ে কেনা জমিতে তিনশ বছর গতর খাঁটিয়েও কৃষকের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে না, অথচ ত্রিশ টাকায় পাওয়া স্বত্ব অক্ষয় হয়ে থাকবে কেন–এ প্রশ্ন সে বোধের অন্তর্গত নয়। আবার রাজায় কেড়ে নেওয়াতে দোষ নেই, সামান্য লোকের কেড়ে খাওয়াতে বা চুরিতে পাপ কেন–সে-জিজ্ঞাসা হয়েছে অবান্তর বিবেচিত। সবলের পরিপূর্ণ সুবিধা-সুযোগের জন্যেই এ শাস্ত্র সবলপক্ষের তৈরি।

এই শাস্ত্র গোত্র-শাসন উদ্দেশ্যেই মূলত রচিত। সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তা সমস্যা হয়ে দেখা দিল পরে, যখন নিঃসম্পর্কীয় গোত্রগুলো জীবন-ধারণের প্রয়োজনে সহযোগিতার নামে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এল এবং একক দেবতা বা স্রষ্টার নামে ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে তথা গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা লোপ করার প্রয়াসে অভিন্ন আদর্শভিত্তিক সমাজ গড়ার চেষ্টা হল। কেননা ইতিমধ্যে স্ব স্ব আচার-সংস্কার, নিয়মনীতি ও শাস্ত্রজবোধ গোত্রীয় ঐতিহ্যে ও মানস-সম্পদে পরিণত হয়েছে। পার্থিব আর আর ধন-জন-সম্পদের মতো এও প্রিয় ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এভাবে এটি যখন গোত্রীয় মর্যাদার ও গৌরবের প্রতীক হয়ে দেখা দিল, তখন দলে টেনে দল ভারী করার লোভে এর উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের মানবপ্রবণতাও পষ্ট ও সক্রিয় হয়ে উঠল। একের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে হলে অপরের অপকর্ষ প্রমাণ করতে হয়। নিন্দা থেকে দ্বন্দ্বের শুরু; বিরোধের পরিণামে বাধল সংগ্রাম। ধর্মীয় সে-কোন্দলের আজো ইতি ঘটেনি। একে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতি। বিলুপ্ত হয়েছে গোত্রবোধ। আজো সমাজে-ধর্মে-জাতে রাষ্ট্রে ধর্মই নিয়ন্ত্ৰীশক্তি, বিদ্বেষ-বিরোধের উৎস, জীবন-প্রচেষ্টার নিয়ামক, প্রীতি-সম্ভাবনার অন্তরায়। এর সঙ্গে সামান্য-অর্থে তুলিত হতে পারে এ-যুগের অর্থনীতি। দ্রব্য বিনিময় রীতির অসুবিধে দূর করার জন্যে চালু হল মুদ্রা। সমস্যার সহজ-সরল-সুন্দর সমাধান! সে-ব্যবস্থার অলক্ষিত-অভাবিত জটিলতায় আজ মানুষের দেহ-মন-আত্মা জলাবদ্ধ। ধনী-নির্ধন সমভাবে পীড়িত তার অদৃশ্য পাশ-বেষ্টনে। এ এক মায়াফাঁদ–ছাড়া যেমন অসম্ভব, সহ্য করাও তেমনি আত্মপীড়নের নামান্তর।

কালে কালে মানুষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি-বুদ্ধির প্রয়োগে ও পরিচর্যায় তত্ত্বে ও তথ্যে, চিন্তায় ও চিন্ময়তায়, উপলব্ধি ও অনুভূতির ঐশ্বর্যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণের ঔজ্জ্বল্যে, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতায় মানুষের শাস্ত্র বিপুল ও বক্র, বিচিত্র ও বর্ণালি হয়েছে। কিন্তু মৌল আদর্শে ও লক্ষ্যে কোনো বিবর্তন আসেনি। কেবল যখন জনচিত্তে স্বধর্মের গর্ব ও অনুভূতির উষ্ণতা মন্দা হয়েছে, তখন পুরোনো বুলির চমক-লাগানো নব-উচ্চারণে কেউ কেউ সমাজে সংসারে সহজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। অথবা কোনো বাকপটু ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে জনমন ধাধিয়ে পুরোনো ধর্মের প্রশাখা কিংবা উপশাখা সৃষ্টি করে দেশকালের নেতৃত্ব পেয়েছেন। ন্যায়-নীতি সত্য-সদাচারের নামে সবাই কেবল বিভেদ বিদ্বেষ-বিরোধের কারণ বাড়িয়েছেন, ব্যবধানের প্রাচীর তুলেছেন, ঐক্য ও অভিন্নতার বুলি আওড়িয়ে খণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। মিলন-ময়দান তৈরির নামে খাদই খনন করেছেন বেশি। অবস্থা এমন যে, সন্ধির শর্তালোচনার জন্যে দাঁড়াবার ঠাইটুকু যেন আর অবশিষ্ট নেই।

আগের দিনে জীবন-যাপনের উপকরণ ছিল স্বল্প ও বৈচিত্র-বিরল। ঋজু জীবনের একঘেঁয়েমির মধ্যে বিচিত্র অভিলাষ জাগিয়ে প্রাণের উত্তেজনা-উৎসাহ বাড়ানোর উপায় ছিল না। জীবনধারণের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য মান ছিল না জনগণের। ডাল-ভাত নয়, শাক-ভাত নয়–নুন ভাতেও তৃপ্তি মিলত। তাদের মনের দিগন্ত ছিল সংকীর্ণ, তাতে মন-বলাকা অভিলাষের পাখা মেলার কল্পনাও করেনি। গৃহাশ্রিত হাঁস-মুরগির মতো কেবল কুটিরের চারধারেই দেহ-মনের খাদ্য খুঁজত। তৃপ্তি পেত খণ্ড ও ক্ষুদ্রের তুচ্ছ সাধনায়। বিপুল পৃথিবী, মনুষ্যত্বের বিরাট সম্ভাবনা তাদের থাকত অজ্ঞাত। বহু বিচিত্রভাবে প্রসারিত-পরিব্যাপ্ত জীবনের প্রসাদ লাভের স্বপ্নও জাগেনি মনে। তা তারা রেখে দিয়েছিল রাজপুত্রের অধিকারে। তাই বেকার মনের অবলম্বন হয়েছিল সমাজ, সংস্কার, শাস্ত্র ও স্বার্থ। তুচ্ছকেই উচ্চ করে ধরে তারা জীবনে স্বস্তি ও উত্তেজনা খুঁজেছে। পরশ্রীকাতরতা আর পর-পীড়নের মধ্যেই পেয়েছে প্রাণের সাড়া। ভূত-প্রেত, দেও-দানব, জীন পরী-হুঁর কিংবা বিদ্যাধরী-অন্সরা রচনা করেছিল তাদের মনের কোণে প্রীতি-ভীতির অপরূপ জগৎ। সে-জগতের প্রভাব ছিল তাদের প্রাত্যহিক জীবনে। তাদের বাহ্য আচরণে ও মানস অভিব্যক্তির মধ্যে দেখা যেত সে-জগতের ছায়া।

কৌতূহলী মানুষের অনবরত অনুশীলনের ফলে জ্ঞানের পরিধি গেছে বেড়ে। বৈজ্ঞানিক অবিস্ক্রিয়ায় বিজ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে প্রবল। অজ্ঞতার অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে পড়েছে জ্ঞান ও যুক্তি-সূর্যের ঝলমলে আলো। অলৌকিকতার বিস্ময়জাত আকর্ষণ গেছে কমে। ভোগ্যসামগ্রী হয়েছে বহুবিচিত্র। পৃথিবী হয়েছে অনেক বড়। মনের দিগন্তের প্রসার হয়েছে অসীম। অভিলাষ হয়েছে গণনচুম্বী। বুভুক্ষু গরু যেমন চারণভূমির উন্নতশীর্ষ কচি-নধর ঘন ঘাস অনন্যচিত্তে অনবরত গিলতে থাকে, ভোগ্যবস্তুর আধিক্যে লুব্ধ এবং বৈচিত্র্যে মুগ্ধ আজকের মানুষও একান্তই ভোগকামী হয়ে উঠেছে। সেজন্যে একদিকে দেও-দানো-হুঁরপরী যেমন সে ছেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি পরিহার করেছে সংস্কার। অস্বীকার করেছে সমাজ ও শাস্ত্রবিধি। বৈরাগ্য ও ত্যাগের মহিমা হয়েছে ম্লান। আজকের পৃথিবীতে প্রাণ মেতে উঠবার, আবেগ উথলে উঠবার কারণ রয়েছে অনেক। এভাবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে বলে এ-যুগে ধর্ম আর প্রবর্তিত হয় না। ধর্মান্দোলন কিংবা ধর্মবিপ্লবের মাধ্যমে নেতৃত্বও মেলে না। তাই সে পথ হয়েছে পরিত্যক্ত। ভোগকামী মানুষের চিত্তহরণের নবতর পন্থাও হয়েছে আবিষ্কৃত। সে-পথেই জনচিত্ত জয় করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন সম্ভব। ধন-বণ্টন নীতি ও শাসন রীতি সম্পর্কিত নব নব পরিকল্পনা তৈরি করে, সম্পদ উপভোগ তত্ত্বের চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়ে, কিংবা দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার তত্ত্বের মানস অনুশীলন-লব্ধ যুক্তিবুদ্ধি-অনুগ বিশ্লেষণ-চাতুর্যে জনমন মুগ্ধ করে, দেশে কালে ও সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ অসাধ্য নয় আজও। আগে যা ধর্মের নামে পাওয়া যেত, আজ তা Ism-এর দোহাই দিলে মেলে। লক্ষ্য ও ফল অভিন্ন। কেবল পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন পদ্ধতি ঠাই নিয়েছে, কলাকৌশলের রূপান্তর ঘটেছে।

আসলে গোড়া থেকেই মানুষ এ জীবনকেই চরম বলে জেনেছে, এ পৃথিবীকেই ভালোবেসেছে। পার্থিক জীবনকে নির্ধ-নির্বিঘ্ন করবার জন্যেই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা-বাঞ্ছায় মানুষ জাদুতে বিশ্বাস রেখেছে, দেও-দানো-ভূত-প্রেত মেনেছে, দেবতা এবং অপদেবতার পূজা করেছে, গড়েছে সমাজ ও শাস্ত্র। কল্পনা করেছে ইহ ও পরলোকে প্রসারিত জীবন। স্বীকার করেছে আত্মার অস্তিত্ব ও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব। সৃষ্টি করেছে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য, নিয়ম-নীতি-সত্যের ধারণা। এই জীবনের প্রয়োজনই কর্মপ্রচেষ্টা ও ধর্ম-প্রেরণার ভিত্তি। এ কারণেই ভূতে ও ভগবানে মানুষের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের উৎস অভিন্ন। ক্ষতি স্বীকারে অনিচ্ছুক বাঞ্ছসিদ্ধিকামী অসমর্থ মানুষ কাকেও অবহেলা করতে পারে না। জানে না কিছুই তাচ্ছিল্য করতে। চিরন্তন সুখ-লোভী, দুঃখ ভীরু মানুষ তাই স্বর্গের স্থায়ী সুখের লোভে স্বল্পকালীন পার্থিব জীবনের বঞ্চনা-দুঃখকে সহজে বরণ করার নির্বোধ প্রয়াসেও তৃপ্ত। আবার অসংযত অপরিণামদর্শী মানুষ সমাজের নিন্দা, রাষ্ট্রের শাসন ও পাপের শাস্তি অবহেলা করে বিধি-বহির্ভূত কাজ করে এই সুখের লোভেই।

এজন্যেই আদিম জাদুবিশ্বাস থেকে আধুনিক বিজ্ঞানবুদ্ধি অবধি মানুষের সব বিস্ময়, কল্পনা, চিন্তা ও জ্ঞানের সম্পদ মানুষ সযত্নে লালন করেছে, কিছুই পরিহার করেনি। সীমিত শক্তির মানুষ কোনোটাই তুচ্ছ বলে হেলা করে না। তুকতাক-দারু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্ৰ-পূজা-অর্চনা প্রভৃতি থেকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অবধি তার কাছে সবকিছুর সমান মূল্য-মর্যাদা। সে গরজ বুঝে সবকিছু সমভাবে কাজে লাগায়, সমান আগ্রহে মেনে চলে। এজন্যেই জগৎ ও জীবন ব্যাপারে তার মননে ও সিদ্ধান্তে, ধ্যানে ও ধারণায় কোনো যৌক্তিক পারম্পর্য নেই কার্যকারণ বোধের অবিচ্ছিন্ন সূত্র নেই। এ কারণেই তার মুখের বুলি আর বুকের বিশ্বাসে ঐক্য নেই। উক্তিতে ও আচরণে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের প্রয়োজনেই সে সৃষ্টির মূলে– জগৎ ব্যাপারে দ্বৈততত্ত্ব মানে। ভালো-মন্দ (dualism-good & evil) শক্তির টানাপাড়নে যে জগদযন্ত্র বোনা, এর দ্বারা যে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত, তা সে জরথুস্ত্রীয়দের মতোই বিশ্বাস করে। যদিও তার উচ্চমার্গের মননশক্তির মহিমা ক্ষুণ্ণ হবে বলে, সূক্ষ্মচিন্তার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে আশঙ্কায়, তা সে উচ্চারণ করে না। তাই মানুষ মুখে বলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া বালিও নড়ে না, আবার অপকর্মের জন্যে ব্যক্তিবিশেষকে দায়ী করে। সে বলে–বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন। কিন্তু বিপদে ফেলেছিল কে?–সে-প্রশ্ন উচ্চারণ করতে সাহস পায় না। কেউ বলে–দুঃখ দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে, রোগ-শোক দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করছেন! কিন্তু সে-পরীক্ষা কেন, কিসের জন্যে, তাতে আল্লাহর লাভ ও উদ্দেশ্য কি, এ পরীক্ষার নিয়ম কি, মান কি? কশাইখানায় রোজ এত পশু অকালে প্রাণ হারায় কোনো অপরাধে? রোজ কোটি কোটি ডিম জ্বণ নিহত হয় কোনো পাপে? এ কার পরীক্ষা? এসবের উত্তর নেই। সবটা মিলে একটা মস্তবড় গোঁজামিল, এক বিরাট ফকির ফাঁদ, একটা সাজানো অপরূপ মিথ্যা, এক গোলকধাঁধা–দিশাহারা মানুষ কেবলই দিশা পাওয়ার জন্যে আলোর। কামনায় অন্ধকারে ছুটাছুটি করছে! এরই নাম অন্তর্জীবন লীলা। এ এক মায়ার খেলা। এর রূপ রস-জৌলুস মোহ জাগায়। এক আনন্দিত উন্মুখতায় জীবন কেটে যায়। এজন্যেই ধর্মবোধের মৃত্যু নেই।

বাসনা-আসক্ত মানুষের দুর্বলতায় এর জন্ম। প্রাপ্তি লোভী মানুষ এ দুর্বলতা থেকে কখনো মুক্তি পাবে না। কেননা সে বাঁচতে চায়, নিরাপত্তা চায়, চায় সুখ-স্বস্তি-আনন্দ– যা তার আয়ত্তের মধ্যে নয়, সামর্থ্যের ভেতরে নয়। তাই অলৌকিক উপায়ে সে তার বাঞ্ছসিদ্ধি কামনা করে। তার আত্মপ্রত্যয়হীন অসহায়তার মধ্যেই সৃষ্টি-পালন-সংহার কর্তার স্থিতি। অতএব পার্থিব জীবনের কল্যাণ কামনায় ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে তার বিকাশ আর দুর্বলের স্বস্তি-কামনায় তার চিরায়ু। বিপদে-আপদে রোগ-শোকে অপ্রাকৃত শক্তির অদৃশ্য হস্তের করুণা তার চাই-ই। তা যুক্তিগ্রাহ্য নাই বা হল, নাইবা হল বাস্তব। জ্ঞানের দ্বীপে দাঁড়িয়ে অসীম অজ্ঞতা সমুদ্রের কী ধারণা করা যায়!