সাময়িকপত্র

সাময়িকপত্র

পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও মফস্বল থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। পাঠকসংখ্যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম হলেও এদেশের পক্ষে যথেষ্টই বলতে হবে। কিন্তু এসব পত্রিকার বৈচিত্র্যহীনতা রসজ্ঞ সুরুচিসম্পন্ন পাঠকের পক্ষে পীড়াদায়ক–এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য।

প্রথমেই ধরা যাক, ধর্মসম্বন্ধীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর কথা। আমাদের বাঙলা ভাষায় ধর্মসম্বন্ধীয় যেসব পত্রিকা বের হয়, তার ভেতরকার লেখাগুলোতে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তিধারার অবতারণা করা হয় না। ভাবপ্রবণতা, একদেশদর্শিতা, মনোমতো সত্য ও অর্ধসত্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃতির কচকচি, যুক্তিহীন বিশ্বাসপ্রবণতা, অলৌকিকতা প্রভৃতির জাল-জঞ্জালে ওসব লেখা প্রায় সুরুচিসম্পন্ন লোকের অপাঠ্য। এ পর্যন্ত ইসলামিক রিভিয়ু ধরনের একটি পত্রিকাও বাঙলার মুসলমান সমাজে বের হয়নি, ফলে ধর্মকথা সম্বলিত যে-কোনো কাগজের প্রতিই ভদ্রলোক মাত্রই বিরূপ।

তারপর সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকাই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চলে। কিন্তু নিছক সাহিত্য-আলোচনায় সীমিত থাকে না এসব কাগজের লেখাগুলো। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও ইতিহাস প্রভৃতি হরেক রকমের বিষয়বস্তু এতে সন্নিবেশিত হয়, ফলে এসব পত্রিকা এমন একটা রূপ ধারণ করে যে, বিশেষ সূক্ষ্ম-দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া আর কারো চোখে এগুলোর বিকৃতি ধরা পড়ে না। প্রথমেই হয়তো প্রেম-সম্পর্কিত একটা কবিতা পড়লেন, পরপৃষ্ঠায় দেখলেন কোয়ান্টাম থিওরি সম্বন্ধে এক আলোচনা যেখানে আপনি সম্পূর্ণ অনধিকারী। এর পরেই হয়তো পড়লেন একটি রোমান্টিক গল্প; গল্পের রেশ হয়তো আপনার মনে লেগেই আছে; এমনি সময়েই পরপৃষ্ঠায় দেখলেন শাহজাহানের সিংহাসন লইয়া বিবাদ অথবা ইসলামে পর্দার বিধান গোছের কোনো আলোচনা। তারপর আবার গেলেন কবিতার সাক্ষাৎ যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সর্বহারার নিপীড়িত হৃদয়ের মর্মান্তিক বিক্ষোভ। কোনো কোনো পত্রে, শেষের দিকে রাজনীতিচর্চার কসরৎও দেখা যায়। এমনি করে আমাদের মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো এক বিচিত্র বস্তুতে পরিণত হয়!

এমন লোক আছেন, যাঁদের কেউ শুধু গল্প পড়েন, কেউ শুধু কবিতা পড়েন, কেউ বা শুধু প্রবন্ধ পড়েন আর কেউবা রাজনৈতিক আলোচনা পড়েন; অন্যকিছু পসন্দই করেন না। এতে অসুবিধাটা দেখুন। হয়তো আপনি গল্প পড়তে ভালোবাসেন, অথচ কাগজে গল্প আছে মাত্র দুটো। এখন দুটো গল্পের জন্যে আট আনা পয়সা খরচ করা উচিত কি-না, তা-ই আপনাকে পাঁচ মিনিট ভাবিয়ে তুলল। যদি কিনলেন হয়তো পরে পস্তালেন, না কিনেও হয়তো আপনার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। তেমনি যারা কবিতা পড়তে চান, তারা দেখেন মাত্র চারটে কি পাঁচটা কবিতা আছে, এর জন্যে আটআনা খরচ করলেও পোষায় না, আবার না-পড়েও উপায় নেই। ধরুন, বিজ্ঞান কি ইতিহাসের কোনো একটিমাত্র বিষয় আলোচিত হয়েছে, বিষয়টা আপনার প্রিয়, কিন্তু শুধু ঐ একটা বিষয়ের জন্যে ছা-পোষা গরিব লোক আপনার পক্ষে আট আনা ব্যয় করা সম্ভব হল না, ফিরেই গেলেন–কিন্তু মনে মনে আফসোস রয়ে গেল। সেদিন আট আনা দিলেন না, অথচ আর একদিন তিন-চার আনা বাসভাড়া দিয়ে কোনো Public Library-তে পড়ে এলেন। লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে দেখুন। সমস্যাটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। প্রকাশক ও পাঠক উভয়পক্ষেরই ক্ষতি, তলিয়ে দেখুন।

কোনো কোনো সাহিত্য-পত্রিকার প্রথমে একটা চিত্রও সন্নিবেশিত হয়। চিত্রকলার এমন কী সার্থকতা, বুঝা দুঃসাধ্য। যদি চিত্রটি ব্যাখ্যা করে দেবার ব্যবস্থা থাকত, তবু নাহয় চিত্রকলায় হাতেখড়ি দেবার প্রয়াস বলে ধরে নেয়া যেত।

শুধু বৈজ্ঞানিক আলোচনার জন্যে এদেশে কোনো কাগজ আগে বের হত না, এখন হয়, কিন্তু চলে না। দর্শন বা ইতিহাস সম্বন্ধেও তাই। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকা বের করার কথা চিন্তাও করা যায় না। তবে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার মতো প্রত্নতত্ত্বমূলক আলোচনার বিশেষ পত্রিকা আছে; কিন্তু দু-একটি মাত্র।

সম্প্রতি চলচ্চিত্র ও যৌনবিষয়ক বিশেষ পত্র বের হচ্ছে। রুচি ও আদর্শ সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে চাইনে, তবে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের আলোচনার জন্যে বিশেষ বিশেষ পত্রিকার প্রকাশ-রুচি ও রসবোধের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই শুভ লক্ষণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু গল্প বা শুধু কবিতার জন্যেও কাগজ বের হতে দেখা যায়, এ অবিমিশ্র একাগ্র সাধনা মার্জিত মনের পরিচায়ক।

তারপর আমাদের দেশে শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসও দুর্লক্ষ্য নয়; এজন্যে কয়েকখানা মাসিক বের হয়েছে, দৈনিক পত্রে সাপ্তাহিক আসরও রয়েছে। কিন্তু এদেশে শিশু-সাহিত্যের লেখক ও সম্পাদকের এত অভাব যে, শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা কোনো নির্দিষ্ট পথ করে নিতে পারেনি। দুই বঙ্গে মাত্র জনকয়েক লেখক অবশ্য কিছুটা সফলতা অর্জন করেছেন, কিন্তু বাঙলাভাষী বিশাল শিশুসমাজের পক্ষে তাঁদের দান নিতান্ত সামান্য। যে-প্রতিভা ও সাধনা এ ব্যাপারে প্রয়োজন, এ পর্যন্ত তা আমাদের দেশে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে যে-অভাবটা বেশি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে কাগজগুলো আকর্ষণীয় করে বের করার অসামর্থ্য। শিশু পত্রিকায় রঙ বেরঙ-এর কার্টুন, খবরের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রভৃতি না থাকলে গল্প (যা প্রায় চির–পুরাতন), কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, জ্ঞানের কথা বা উপদেশের মুরুব্বিয়ানা শিশুচিত্তে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হবে না। য়ুরোপ-আমেরিকার। কাগজগুলোতে চিত্র, কার্টুন ছাড়া একটা পৃষ্ঠাও নেই। আমাদের মনোভাবও এর অভাবের জন্যে দায়ী। আমরা বিজ্ঞতা দেখাতেই ব্যস্ত, বোকা সাজতে জানিনে। ফলে হালকা কথা, হালকা হাসি আমাদের মুখে ফোটেই না। জ্ঞানগর্ভ কথা ছাড়া অন্য কথা আমাদের মনোমতো হয় না। আমরা যা পসন্দ করি, তাই শিশুকে পরিবেশন করতে চাই। এজন্যে আমাদের দেশে উৎসাহী শিশুপাঠকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেকেই অভিভাবকের উপদেশ রক্ষার জন্যেই শিশু-পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করে।

ছোটদের কথা গেল, বড়দেরও চিত্র, কার্টুন ও ফটোর প্রতি আকর্ষণ কম নয়। আমাদের দেশে ইংলন্ড-আমেরিকা থেকে যে-সব কাগজ আসে, তাদের অধিকাংশই চিত্র, কার্টুন ও ফটোতে পূর্ণ। এজন্যে আমাদের দেশে Illustrated weekly-র এত কদর। অথচ আজ পর্যন্ত বাঙলাভাষায় এরূপ একটা কাগজের কথা কল্পনাও করতে পারি না। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!

আমরা আগেই বলেছি, রুচি আদর্শের কথা বলব না; কেননা সম্পাদকের যোগ্যতা, রুচি ও আদর্শ পাঠকের রুচি ও আদর্শকে মার্জিত, সুস্পষ্ট ও বিকশিত করে তুলবে। স্বদেশী-বিদেশীর অনুকরণ-স্বীকরণ প্রভৃতি সম্পাদকের প্রতিভা ও যোগ্যতার উপরই নির্ভরশীল এবং পাঠকগোষ্ঠীর রুচি ও আদর্শ গঠনও সম্পূর্ণ নির্ভর করে সম্পাদকের উপর।

আমাদের শেষ বক্তব্য হচ্ছে; আমাদের দেশেও বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতির জন্যে বাঙলাভাষায় পৃথক পৃথক সাময়িকপত্র বের হোক। সিনেমা, চিত্রশিল্প, যৌনবিজ্ঞান, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি সবকিছুরই আলোচনা হোক পাঠকের রুচি গরজ ও ঝোঁক অনুসারে। পাঠক এতে একান্তভাবে তার নিজের জ্ঞাতব্য নিয়ে বিশেষভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। সাহিত্য-পত্রিকাগুলোর পরিবেশিত খিচুড়ি গেলার দায় থেকে পাঠকসাধারণ মুক্ত হোক–আমরা এ-ই চাই।