গণসাহিত্য
গণসাহিত্য বা সাম্প্ৰত-সাহিত্য ও সাহিত্যাদর্শ সম্বন্ধে আজো অনেকেই বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। এমন লোকও আছেন, যাঁরা একে রসসাহিত্য বলতে কিছুতেই রাজি নন। এক কথায়, তারা সাহিত্যের অত্যাধুনিক আদর্শে আস্থাবান নন।
দোষ তাঁদের নয়। নতুনকে দ্বিধাহীনচিত্তে গ্রহণ করা কোনোকালেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। নবীন ও প্রবীণে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। প্রবীণের মনে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার গর্ব থাকে, তাতেই প্রবীণরা রক্ষণশীল। যাকে প্রবীণেরা প্রজ্ঞা মনে করেন, তা আসলে সংস্কার; আর যাকে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত ভাবেন, তা মূলত অভ্যস্ত সংস্কারের প্রতি অন্ধ মমতা। এজন্যেই প্রবীণমাত্রেই বিজ্ঞতার দাবী করেন। নবীনরা চলে প্রাণধর্মের প্রেরণায়। বয়োধর্মের গুণে সংস্কারবিমুক্ত একটি স্বচ্ছ অথচ উচ্ছ্বাসময় দৃষ্টি এদের স্বভাবজ। সে-দৃষ্টিতে জগৎ, জীবন, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক খুঁত–বহু ত্রুটি ধরা পড়ে যায়। তারুণ্যের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে বিসদৃশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আর শক্তির প্রয়োগ। আশ্চর্য এই যে, এককালে যারা নবীন-নতুনের দিশারী ও পূজারী, তারাই বয়োধর্মের বিধানে প্রবীণ–বিজ্ঞতাভিমানী, নতুনের বিদ্বেষী, রক্ষণশীল; তারা এমন গোঁড়া। রক্ষণশীল যে, নতুন তুলিতে আর বুলিতে ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠেন। সবল হলে সশস্ত্র রুখে দাঁড়ান, দুর্বল হলে কান্না জুড়ে বসেন। ধর্মে-দর্শনে-সমাজে-সাহিত্যে-রাষ্ট্রে চিরদিন এই দ্বন্দ্বই চলে আসছে।
অতএব, আমাদের আজকের দিনের সাহিত্যাদর্শও যদি পূর্বযুগের মনন-পুষ্ট কারো পছন্দসই না হয়, তবে দুঃখ করবার কিছুই নেই। তাদের কাছে স্বীকৃতি না পেলে ক্ষুব্ধ হওয়াও উচিত নয়।
তবে প্রথা আছে, প্রচারণা চালিয়ে স্বমতের প্রতিষ্ঠা করা–আর অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস আনয়ন করা। আমরাই বা নিয়মের ব্যতিক্রম করব কেন! তাই দু-চারটা কথা বলতে চাই।
সাম্প্ৰত-সাহিত্য সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে–এ সাহিত্য হৃদয় ও কল্পনাধর্মী নয়, নিছক ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ নিয়ে একপ্রকার মানসিক ব্যায়াম অথবা অশিক্ষিত মনের অসংযত উত্তেজনা। অর্থাৎ তাদের মতে, আজকের সাহিত্য রসসাহিত্য নয়–অভিযোগ অভিযানের বাণীবাহক প্রচারপত্র বিশেষ। তারা বলেন–সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগ, অত্যাচার-নিপীড়ন চিরদিন মনুষ্য-জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে এসবের প্রতিষ্ঠা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্যে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভটি তো রয়েছেই, এগুলো নিয়ে আবার সাহিত্য করা কেন? আর এগুলোতে সাহিত্যের উপাদানই বা কোথায়? সাহিত্য হবে। ব্যবহারিক জীবনের এক কল্পজগতের দিশারী, সে-জগৎ হবে সব পাওয়ার দেশ। জীবনে যা পাইনি, যা পারিনি–সেখানে থাকবে তারই সমাবেশ। সেখানে রাজা আর ভিখারি সমভাবে—‘আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’।–এ মতের সমর্থক একজন কবি বলেছেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ দীন দুর্বল সবি–
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সে-জন বটে কবি। (মোহিত মজুমদার)
অপর একজন বলেছেন :
জীবনে যে-সাধ হয়েছে বিফল
সে-সাধ ফুটিছে গানে। (রবীন্দ্রনাথ)।
সুতরাং তাদের সুদৃঢ় অভিমত হচ্ছে—আধুনিক সাহিত্য-প্রচেষ্টা কোনোমতেই কবিকৃতি বা শিল্পীর সৃষ্টি নয়। কারণ সাম্প্ৰত-সাহিত্যের আদর্শ বা বিষয়বস্তু কোনোটারই রচনাকে রসায়ত্ত করবার যোগ্যতা নেই। কেননা–এ আদর্শে ও বিষয়বস্তুতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অনুভূতি ও প্রেরণা নিহিত নেই।
বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ শোনা গেল, এখন আমাদের বক্তব্য পেশ করতে হয়।
প্রথমত, দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ সাহিত্য নেই–তা সেই সাহিত্যের আদর্শ art for arts sake ই হোক, আর সমাজ-রাষ্ট্র বা ব্যক্তিজীবন-বোধই হোক। হোমারের ইলিয়ড ওডেসিতে যে-ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেসব চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যে-নীতির তারিফ করা হয়েছে, তা এদেশের নয়, এ যুগের নয়, এ জাতিরও নয়। তবে তা আজো বিশ্বমানবের সম্পত্তি হয়ে রইল কী করে? ইরানের সেই বীর-বাদশা নেই, সে-কালও নেই, কিন্তু শাহনামা আজো আছে। জাঁ ভাজার দিনের সেই ফ্রান্স আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। আজকের ফরাসি-জাতিতে ও ফরাসি দেশে সে-ফ্রান্সের সমাজের, রাষ্ট্রের, মানুষের চিহ্নমাত্র নেই; তবে ল্য মিজারেবল আজো টিকে রইল কী করে? একদিন যা ছিল একান্তভাবে একটি বিশেষ দেশের, কালের ও মানুষের নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার, তা-ই আজ দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ বিশ্বমানবের সর্বজনীন হৃদয়ের ধন হয়ে উঠল কিরূপে? জানি, বিরুদ্ধবাদীরা বলবেন–এতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অভিব্যক্তি ছিল– যা সর্বকালের, সর্বদেশের ও সর্বমানবের। ল্য মিজারেবল-এর মতো আরো দুটো পরিচিত গ্রন্থের নাম করব–একটা হচ্ছে Uncle Toms Cabin অপরটা নীলদর্পণ। এ দুটোও প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। নীলদর্পণের আবেদন নীল-চাষ উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। এটি স্বদেশেও কালজয়ী হতে পারেনি। Uncle Toms Cabin-এর আবেদনও কী আজ আছে? কিন্তু ল্য মিজারেবল-এর গৌরব আজো অম্লান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, আদর্শও অনেক সময় নিতান্ত সাময়িক সমস্যা নির্ভর। তবু রসসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আসনে এদের অনধিকার নেই।
অতএব একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেল–তা হচ্ছে রসসাহিত্য বা চিরন্তন আবেদনের সাহিত্য সৃষ্টিতে বিষয়বস্তু বা আদর্শ বড়কিছু নয়, লেখকের শক্তিই আসল। ল মিজারেবল-এ যে-সার্জেন্ট টার চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র নয়–সে হচ্ছে আইনের মূর্তিমান প্রতীক (personification of the spirit of law)। জঁ ভাজাও নির্যাতিত মানবতার প্রতিমূর্তি একটি বিদ্রোহী আত্মাবিশেষ (a personified soul of the suffering humanity and its revolt against mankind)। ল্য মিজারেবল-এর তাই এত কদর এবং অমর-সৃষ্টি বলে গোটা দুনিয়ায় অভিনন্দিত। অথচ একটা দেশের একটা বিশেষ যুগের আর্থিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রীয় কুশাসনের চিত্র বই এ আর কিছু নয়।
ওথেলো নাটকের কথাই ধরা যাক্। বিষয়বস্তু হচ্ছে–এক তরুণ স্বামী তার স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করে। এমন ঘটনা হয়তো আজো দৈনন্দিন ঘটছে। নিতান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনা। কিন্তু শুধু কী তাই! ওথেলো ও ডেসডিমোেনায় কী প্রেমের দুটো দিক মূর্তি পরিগ্রহ করেনি, ইয়াগো কী সর্বধ্বংসী মন্দশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেনি? এখানেও প্রেম, প্রতিহিংসা ও ঘৃণা মূর্তি ধারণ করেছে (The sprit of love, malice and hatred is manifested)। এজন্যেই ওথেলোর কাহিনী ব্যক্তির হয়েও সমষ্টির হয়ে উঠতে পেরেছে। এখানেই কবিকৃতি–শিল্পীর গৌরব এবং সৃষ্টির স্থায়িত্বও নির্ভর করে সম্পূর্ণ শিল্পকৌশলের উপর বিষয়বস্তু বা আদর্শের উপর নয়।
দ্বিতীয়ত, আমরা আজকের দিনে যে-জীবন-সমস্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সমস্যা দুনিয়ায় কোনোদিন ছিল না। ব্যক্তিসত্তাবোধ ও. তীব্র গণচেতনা এ-যুগের পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারে আধুনিক যুগের মানুষ জগৎ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পর্ক নতুনভাবে যাচাই করে নিতে বদ্ধপরিকর। কেননা শিক্ষা ও সুরুচি মানুষকে দিয়েছে তীব্র মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। এদিকে পরিবেশও হয়ে উঠেছে প্রতিকূল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গোটা দুনিয়ায় জীবন-ধারণযোগ্য দ্রব্য-সামগ্রীর অভাব ঘটেছে একান্ত। ফলে লোভ আর কাড়াকাড়ি ও হানাহানি তীব্রতর হয়ে উঠেছে সর্বত্র। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, তাই দুর্বল জনসাধারণ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। এইরূপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধন-বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন জীবন করেছে পঙ্গু। অধিকাংশ লোকের ডাল ভাতের সংস্থান না-থাকায় তারা বুনিয়াদি শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর ক্ষোভে উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব বিকাশক সুন্দর, বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই অধিকারবাদের সগ্রাম শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। সে-সগ্রাম দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে আর শ্রেণীতে শ্রেণীতে অবিরাম চলছে।
ব্যক্তিসত্তায় সংগ্রামী বীজ অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গণচিত্ত করেছে বিক্ষুব্ধ, বিস্রস্ত; তাই আজকের দিনে বুনিয়াদি শিল্পকলায় ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আজকের সাহিত্য প্রচেষ্টায় তাই বস্তু-ভাব-ভাষা-ছন্দ ও আদর্শ একান্তই নিরাবরণ ও নিরাভরণ। কিন্তু তাই বলে কী আজকের দিনের সাহিত্য আগামী দিনের জনগণ-মনে রস পরিবেশনে অক্ষম হবে?
আমাদের এই সংঘাত-মুখর গ্লানিময় জীবনের, এ ক্লিন্ন দিনের কাহিনী কী তাদের মনে রেখাপাত করবে না? তারা কী বুঝবে না–সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থায় যে-আর্থিক বিপর্যয় আসে, তাতে বুভুক্ষাপীড়িত নিরন্ন রুগ্ণ-ক্লিষ্ট-পিষ্ট কোটি কোটি হতভাগ্য মানবসন্তান অপঘাত অপমৃত্যু থেকে বাঁচবার জন্যে আনচান করেছিল? তারা কী উপলব্ধি করবে না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই হতভাগ্যেরা বৃহৎ ও মহতের সাধনায়, সুন্দরের সাধনায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ-অবসর পায়নি? এ কলঙ্কিত যুগের মানুষের ও মনুষ্যত্বের অপমৃত্যুর ইতিহাস কী তাদের জানবার দরকার হবে
আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বেদনার কাহিনী, আমাদের সংগ্রামের বাণী যদি তাদের কাছে কদর না পায়, তবে তা বিষয়বস্তু ও আদর্শের অযোগ্যতার দরুণ নয়, বরং তা আমাদের বাচনভঙ্গির ত্রুটি ও চিত্রণশক্তির অপটুতার জন্যেই উপেক্ষিত হবে।
আগেই বলেছি, রচনাকে রসায়ত্ত শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে শক্তি ও শিল্পকুশলতা প্রয়োজন। অন্যথায় রচনা রচনাই থেকে যায়, সাহিত্য হয় না।
একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক্। আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম বলেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর কাহিনী আমাদের উত্তেজিত করত, প্রেরণা দিত। আজ আজাদী পেয়েছি। পলাশী যুদ্ধ বা নবাব সিরাজদ্দৌলার কাহিনী আমাদের মনে আর সাড়া জাগাবে না; ইতিহাসের অসংখ্য যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা-কাহিনীর মতো এও একটি কাহিনী হয়েই থাকবে। তার বিশেষ আবেদন, বিশেষ ব্যঞ্জনা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যদি জুলিয়াস সিজারের মতো নাটক রচনা করে এ কাহিনীকে ভিত্তি করে, তবে তার আবেদন থাকবে চিরস্থায়ী হয়ে। ফলে, পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজদ্দৌলার ঐতিহাসিক মূল্য শুধু ইতিহাসের ছাত্রের কাছেই থাকল, কিন্তু পলাশীযুদ্ধ বা সিরাজদ্দৌলা নাটকের আবেদন সর্বদেশের, সর্বকালের ও সর্বমানবের কাছে সমভাবে পৌঁছবে। একেই বলে শিল্প, এতেই হয় সাহিত্য।
সুতরাং আধুনিক গণসাহিত্যকে প্রচারপত্রিকা বলে উপহাস করবার কারণ নেই। এ আদর্শে রচিত কোনো রচনা যদি পাঠক-হৃদয়ে সাড়া না জাগাতে পারে, তবে বুঝতে হবে, লেখক অক্ষম প্রতিভাহীন। আদর্শ ছোট নয়–বিষয়বস্তুও সাহিত্যের উপাদান হবার অযোগ্য নয়।
আধুনিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে আর একটা নালিশ এই যে–এতে প্রাচীন বিশ্বাস, সংস্কার, রীতিনীতি প্রভৃতিকে অস্বীকার ও উপহাস করা হচ্ছে। নরনারীর সম্পর্ক, প্রেম-স্নেহ-মমতা প্রভৃতির আধুনিক-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রাচীন সংস্কার ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে, ফলে যা একসময় আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আবরণে বরণীয় ও সহনীয়রূপে পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হত, তাকেই একান্ত জৈব-ব্যবহারিক প্রয়োজনের সামগ্রী বলে মাহাত্ম্যহীন করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এর সাথে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে মানুষের আস্তিক্য বুদ্ধিকেও। শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রভৃতির মতো পবিত্র বৃত্তি ব্যঞ্জনাগুলোকেও যেন করা হচ্ছে উপহাস। সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তিসত্তার চিরন্তন সংস্কারকেও দলিত করে সমাজের ভিত জীর্ণ করে দিচ্ছে। এর ফলে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সামঞ্জস্য সৌষ্ঠব-শান্তি নষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে যে-সংসার–সে-সংসারে প্রয়োজনের ব্যবহারিক বন্ধনের উপর ধর্মীয়, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা আরোপ করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার মধ্যে যে একটা পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সংস্কার জাগিয়ে রাখা হয়েছিল, তা যদি নষ্ট হয়ে যায়; তবে সংসার, পারিবারিক বন্ধন টিকবে কোনো আদর্শের জোরে?–এ-ই হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসা।
অবশ্য এ-কথা সত্যি যে, আমরা যে-পরিমাণে কার্লমার্কস্ ও ফ্রয়েডের অনুরাগী হচ্ছি, ঠিক তার দ্বিগুণ পরিমাণে প্রাচীন বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে দূরে সরে আসছি, ফলে প্রাচীনরাও ঠিক সেই পরিমাণে মানুষ ও মনুষ্য-সমাজের পরিণাম চিন্তায় ভীত-ত্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু প্রাচীনদের ভুলে চলবে না যে, কালস্রোত নদীর স্রোতের চেয়ে কম বেগবান নয়। কিছু ধরে রাখতে চাইলেই রাখা যায় না; নতুন সূর্যের উদয়ে, নতুন মানুষের আবির্ভাবে নতুন দিন নতুন চিন্তা না এসে পারে না। প্রকৃতির রাজ্যে অহরহ পরিবর্তন চলছে-বীজে মূল, মূলে কাণ্ড, কাণ্ডে শাখা, শাখায় পাতা-কলি ফুল-ফল, ফলে আবার বীজ। স্রষ্টার কল চলছে অনবরত–সৃষ্টি আর ধ্বংস, ধ্বংস আর সৃষ্টি, এই তার কাজ। যা যাচ্ছে তা আর ফিরে আসে না এবং Old order changeth yeilding place to new.
কিন্তু তবু নতুন যা আসছে, তার সাথে পুরাতনের অনৈক্য নেই, যদিও নতুন ও পুরাতন দুটোর আলাদা রূপ। তেমনি মনুষ্য-সমাজেও নতুন ও পুরাতনে রূপগত, পথগত অনৈক্য থাকলেও মৌলিক ঐক্য সর্বত্র বিদ্যমান, উদ্দেশ্যগত বিরোধ নেই কোথাও। প্রাচীন বিধি-ব্যবস্থা, শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্য যেমন সুশৃঙ্খল; জীবন ও সমাজবোধ, আজকের বিচার-বিশ্লেষণ, গ্রহণ-বর্জন, বিশ্বাস-শ্রদ্ধা, উপহাস-উপেক্ষাও ঠিক একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সুতরাং প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কার পালটাতে পারে, কিন্তু মানুষ চিরদিন সামাজিক জীবই থাকবে–তাতে সন্দেহ নেই। অতএব বলা যেতে পারে, এ পথে মানুষের পরিণাম ভয়াবহ হবে না বরং সামাজিক ও পারিবারিক জীবন আরও সুন্দর, আরো সার্থক, আরো মধুর হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং প্রাচীনদের আশঙ্কা করার কিছুই নেই, বরং ভরসা করার রয়েছে অনেক কারণ। কেননা শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারের ফলে মানুষের উৎকৃষ্ট বৃত্তিগুলো অধিকতর বিকাশ লাভ করছে, বেহেস্ত-দোজখের শান্তি-শাস্তি নিরপেক্ষ সহজ মনুষ্যত্বের প্রেরণায় মানুষের মানবতাবোধ ও সুরুচি মানুষকে বিবেচক ও ন্যায়ানুরাগী করে তুলতে বাধ্য, যা আগের যুগে আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক শক্তির দোহাই কেড়েও সম্ভব হয়নি।