বিশ্বের নাগরিক

বিশ্বের নাগরিক

মানুষের রুচি-প্রবৃত্তির বৈচিত্র্যে এবং বিবর্তনবাদে বিশ্বাস না করলে আজকের দিনে মানবসমাজের কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। এমন একদিন ছিল যখন মানুষ ছিল সর্বব্যাপারে অজ্ঞ। অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির অভাব ছিল একান্ত। ফলে মনুষ্য- সাধারণের সর্বাত্মক জাগতিক ব্যাপারের বিধাতা ও নিয়ন্তা ছিল গোত্ৰাধিপতি নামের বিজ্ঞতর ব্যক্তি। সেকালে সে-অবস্থায় সর্বপ্রকার বিশ্বাসের এবং বিধান ও সমাধানের মূলে ছিল অপটু বুদ্ধি, অস্পষ্ট চিন্তা ও অন্ধ কল্পনা। সুতরাং সেকালে জনসাধারণের আচার-আচরণ ও বিশ্বাস-সংস্কারের উৎস ছিল বহিরারোপিত বিধি নির্দেশ–অন্তরাহৃত আস্থা নয়, বুদ্ধিলভ্য বোধিজাত উপলব্ধিও নয়। অতএব সেকালে মানুষ চালিত হত বহির্নির্দেশ জাত সংস্কারগত বিশ্বাসে– বিবেক লব্ধ বা নিরীক্ষিত প্রত্যয়ে নয়।

কালের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের বিবেকের বিকাশ হয়েছে, অভিজ্ঞতার পরিসর হয়েছে বিস্তৃততর, প্রত্যয় ক্রমে ক্রমে মন্থরগতিতে আঘাত হেনেছে সংস্কারলব্ধ বিশ্বাসের মূলে। কল্পনার অপরিসীম রাজ্য বাস্তববোধের প্রসারের সাথে সাথে সংকীর্ণতর হয়ে এসেছে। কিন্তু যেমনি করে বলছি, ঠিক তেমনি কিছু ঘটেনি। নতুন-পুরাতনের সংঘাত লেগেছে বারবার, বিপর্যেয় ঘটেছে মানুষের মনে, জীবনে ও আদর্শে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিস্তর, তবু লাভ হয়েছে প্রচুর, অগ্রগতি রয়েছে অব্যাহত–যদিও তা কখনো মন্থর, কখনো দ্রুত, কোথাও চরমে, আবার কোথাও বা পরমে, অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র ধারায় তা গতি নিয়েছে।

কিন্তু অশিক্ষার প্রতিকূলতায় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রবিশেষ প্রশস্ত হতে পারেনি আধুনিক-পূর্ব যুগে। কল্পনা-ঘুড়ির রঙিন সূতো তখনো আমাদের মনের মুঠোয়। বহিরারোপিত বিশ্বাস-সংস্কারের চশমার মাধ্যমে জগৎ ও জীবন তখনো পোশাকিরূপে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সত্য ও মায়া, বুদ্ধি ও কল্পনা, কায়া ও ছায়া, বাস্তবতা ও আদর্শবাদ, প্রবৃত্তি ও নীতিবোধ প্রভৃতির চিত্তবিভ্রান্তকারী সংমিশ্রণে মানুষের জীবন স্বপ্ন ও রহস্যময় হয়েছিল। জাগর ও স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা–আচ্ছন্ন মনের পক্ষে ছিল একান্ত দুঃসাধ্য। বাস্তবেতর বাস্তব, জগতের জগৎ, জীবনের জীবন, সুখ-দুঃখের সুখ-দুখ ধুলিমাটির দুনিয়াকে আর ভোগ-তৃষ্ণার দেহকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে দেয়নি মানুষকে। তাই এতকাল, মানুষ শুধু ধর্মনির্ভর ছিল অর্থাৎ বহিরারোপিত বিধিনিষেধের পরিসরে বিচরণশীল ছিল। বিবেকের আহ্বানে, জীবনের সহজ চাহিদায় দ্বিধাহীনচিত্তে অকুণ্ঠ ও নিঃসংকোচ সাড়া দিতে সাহস পায় নি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে সে-কাহিনী। বঞ্চনা, ছল-চাতুরী, নরহত্যা, যুদ্ধ, নিপীড়ন, শাসন-শোষণ, আচার-বিচার-বিতর্ক, দান-সাহায্য, সত্য-মিথ্যা, হিংসা-দ্বন্দ্ব, ন্যায়-নীতি, লাভ-ক্ষতি সবকিছুই ব্যাখ্যাত, প্রচারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মের নামে! এখানে আল্লাহ দণ্ডধারী মহাশাসক—-মানুষ ধর্মকলের প্রত্যঙ্গ (parts) বিশেষ। যা ঘটে আল্লাহই ঘটান, যা হয় এমনিতেই হয়। যুক্তি নেই, কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। তবে নিয়মও আছে, নিয়তিও আছে। কিন্তু নিয়মের চেয়ে নিয়তির শক্তিই প্রবল।–এই বিশ্বাস-সংস্কারের আওতায় গড়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম, সমাজ ও রাজ্য! এই ভিত্তিতেই পেয়েছি শিক্ষা, আদর্শবোধ এবং ন}য়-নীতি, পাপ-পুণ্য ও লাভ-ক্ষতির সংজ্ঞা। এখানে আছেন প্রভু আল্লাহ আর মানুষ বান্দা-~~ চালক আর চালিত, যন্ত্র আর যন্ত্রী। এখানে মানুষের আর কোনো পরিচয় নেই। আর একটুর আভাস আছে, তা হচ্ছে কলুর বলদের অবাধ্যতা–মানে প্রভুর নির্দেশে বাধা-চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে থেমে যাওয়া।

শিক্ষার প্রসারে অনুশীলনের প্রাচুর্যে মানুষের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে নানাদিকে। বহির্জীবনে এবং মননে নব নব আবিক্রিয়া মানুষের মন ও মননকে একান্তভাবে বিজ্ঞানমুখী, যুক্তিনির্ভর ও বিবেকানুগত করে তুলেছে। বর্বর যুগে যে রঙিন চশমা মানুষ ও জগৎ জীবনের মধ্যে ব্যবধান বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা হঠাৎ ঘুচে গেছে। জগৎ ও জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করছে আপন সত্তা, প্রত্যক্ষ করেছে ধূলামাটির দুনিয়াকে, চিনে নিয়েছে প্রবৃত্তি সমন্বিত জীবনের যথার্থরূপ। কল্পনা-ঘুড়ির সূতা ছিঁড়ে গেছে, ধসে গেছে সংস্কারের অন্ধকার গৃহের প্রাচীর। বহিরারোপিত বিশ্বাসকে বিতাড়িত করে তার জায়গা দখল করেছে যুক্তি ও যাচাই-নির্ভর প্রত্যয়। মানুষের মনুষ্যত্ব স্বীকৃতি পেল। আল্লাহ মানুষকে শক্তিও দিয়েছেন, সামর্থ্যও দিয়েছেন। ধর্ম-কলের প্রত্যঙ্গ নয়, মানুষ একটি সত্তা–আল্লাহ্র প্রতিনিধি-আল্লাহর প্রতিভূ স্রষ্টা! নিয়তি নেই, শুধু নিয়ম আছে। আর কারণ, নিরপেক্ষ কার্য অসম্ভব।

আল্লাহ শুধু দুনিয়ার অন্য যাবতীয় বস্তুর মালিক নয়, মানুষেরও মালিক। গোটা দুনিয়া সৃষ্টিরই (জড়-জীব) বিহার, বিলাস ও ভোগ ক্ষেত্র–শুধু মানুষের একার নয় এবং জড়-জীব পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব, আদর্শ হোক–Live and let live (বেঁচে থাক এবং বাঁচতে দাও)। ধর্ম হোক–বিবেকের নির্দেশ ও যুক্তিবোধ।–আজকের মানুষের প্রাণের কথা এ-ই। অর্থাৎ এতদিন আমরা বহিরারোপিত ধর্মে চালিত হয়েছি। কিন্তু সমাজে সম্পদে আদর্শে বিশ্বাসে সংঘাত এড়াতে পারিনি। শান্তি দিইওনি, পাইওনি। এবার অন্তরাহৃত ধর্মের নির্দেশে চলা যাক! এবার সিদ্ধি সুনিশ্চিত, কেননা বিবেক প্রতারিত করে না। সুতরাং বহিরারোপিত ধর্মচালিত পূর্বযুগের মানুষের আচার-সংস্কার-আদর্শ-ঐতিহ্য প্রভৃতির প্রতি মোহ শুধু মানুষের মনের তমিস্রাকে গাঢ়তরই করবে। সেই অন্ধকারে মানুষের সহজ মনুষ্যত্ব শুধু পথ হাতড়িয়ে ব্যর্থ হবে, মুক্তি পাবে না। পূর্বযুগের গোত্রীয়, ধর্মীয় ও জাতীয় কারার বন্ধন থেকে মানুষকে আজাদ করে নীল আকাশের নিচে নরম মাটির উপর মহামিলনের মহায়োজন করাই হচ্ছে আজকের মানুষের একমাত্র উদ্যাপনযোগ্য ব্রত। মানুষের সংস্কৃতির, সাহিত্যের, সঙ্গীতের ও আদর্শের রূপ হবে একটি–তা মানবতা। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। আজো যারা সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে, ধর্মে-আদর্শে, সমাজে-সম্পদে স্বাতন্ত্রের কামনা-সাধনা করে তারা মানবতার শত্রু! কারণ– ধর্ম, সমাজ আর সংস্কৃতি মানুষের মনুষ্যত্ব সাধনার উপায় ও পন্থাস্বরূপ। এগুলো উপলক্ষ মাত্র–সিদ্ধি নয়, সুতরাং ব্যক্তির পরম ও চরম পরিচয় সে মানুষ। তার অবশ্য দেশ আছে, কাল আছে কিন্তু সে-সব তার পরিচয়বাহী নয়। যারা লক্ষ্য হারিয়ে উপলক্ষ নিয়ে লাঠালাঠি, মারামারি করে তারা শুধু হিন্দু, শুধু মুসলমান অথবা শুধু খ্রীস্টান- কিন্তু মানুষ নয়। মনুষ্যত্বের সাধনা তাদের নয় মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই।