মহাকবি কায়কোবাদ

মহাকবি কায়কোবাদ

আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম ধারার অন্যতম উদ্গাতা মহাকবি কায়কোবাদের এন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আশ্রয় নিল।

 কায়কোবাদ যে- যুগে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, সে-যুগে মধুসূদন, সুরেন্দ্রনাথ, হেমচন্দ্র, বিহারীলাল, নবীন সেন প্রমুখ ছিলেন প্রতিষ্ঠাবান কবি। তাঁদের প্রবর্তিত রাজপথে ও তাঁদের আদর্শের অনুসরণে কায়কোবাদের সৃষ্টি রূপ লাভ করে। অতএব কায়কোবাদের সমসাময়িক কবি রবীন্দ্রনাথ বাঙলা সাহিত্যে যে-নতুন কাব্যাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করলেন, গীতিকবিতার যে-উচ্ছল বন্যা বাঙলা দেশ ও বাঙালির মন প্লাবিত করেছিল, তার সঙ্গে কায়কোবাদের যোগ ছিল না। তিনি এ ধারাকে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি উনিশ শ তেত্রিশ সালেও কাহিনীকাব্য রচনা করেছেন। অতএব তাঁকে আমরা আধুনিক যুগে পেলেও তিনি ছিলেন বিগতযুগের শেষ প্রদীপ–সে প্রদীপ বিচিত্র অলঙ্কারে ও রূপসম্ভারে ঝড়ের ন্যায় মনোহারী আর ঔজ্জ্বল্যে সমৃদ্ধ।

সুতরাং তাঁর অবদানের মূল্য যাচাই করতে হলে উপরোক্ত কবিদের রচনার পাশে রেখেই যাচাই করতে হবে। কিন্তু বিস্তৃত আলোচনার সময় আজ নয়। আমরা আজ শুধু যুগ ও পরিবেশের নিরিখে তার সাধনার গুরুত্বটি উপলব্ধি করতে প্রয়াস পাব।

পলাশীর ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে বাঙলার মুসলিম-জীবনে নৈরাশ্যের যে সুচিভেদ্য অন্ধকার। নেমে এল, তাতে নিতান্ত জীবনধারণ প্রচেষ্টা ব্যতীত আর কোনোরূপ জীবন-স্পন্দনের সন্ধান মেলে না। এমনি যখন অবস্থা, তখন জীবনবোধ বা শিল্পপ্রচেষ্টা বা সৃষ্টিপ্রয়াস পঙ্গু অথবা স্তব্ধ হয়ে থাকারই কথা। ফলে মুসলমানরা নৈরাশ্যের পঙ্কেই কেবল মজল না, ঐতিহ্যবোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল।

এদিকে ইংরেজ শাসকমণ্ডলী স্বার্থপ্ররোচণায় সদ্যরাজ্যহারা স্বাধীনচেতা অসহযোগী মুসলমান–শোষণ ও হিন্দু-তোষণনীতি গ্রহণ করে এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ফন্দি আঁটল। ফল এই দাঁড়াল যে, নতুন ভূমিব্যবস্থায় বাঙালি মুসলমান ভূঁইয়ারা রাতারাতি ফতুর হয়ে গেল।

এরপরে অভাবে, অশিক্ষায় জড় মুসলমান আভিজাত্যের গর্ব ও অসহযোগের দৃঢ়তা ভুলে ইংরেজি শেখা আরম্ভ করল নতুন সমাজব্যবস্থায় মর্যাদা ও সম্পদ লাভের প্রত্যাশায়। প্রথম যুগের এমনি ইংরেজিশিক্ষিতদের মধ্যে কায়কোবাদ একজন, যদিও তিনি প্রবেশিকা মানের স্তরেও উঠতে পারেননি। মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে তাঁদের বিরাট ও বিচিত্র অবদানের ঐতিহ্যবোধের ক্ষীণ রশ্মিটুকুও মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। তাই মীর মশাররফ হোসেন ও কায়কোবাদ যখন বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে সক্ষম পদক্ষেপ করলেন, তখন সেদিনকার সাহিত্যের আসরে তারা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে সবিস্ময় অভিনন্দন পেলেন এবং সমালোচককে সবিস্ময়ে বলতে শোনা গেল–মুসলমান হইয়া এমন বিশুদ্ধ বাঙলা লিখিতে পারেন, তাহা আমাদের জানা ছিল না।

মুসলমানদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যবিস্মৃতি ও হিন্দুদের অবজ্ঞার সাক্ষ্য হয়ে চিরকাল ইত্যাকার কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনের বেদনাদায়ক দুঃসময় স্মরণ করিয়ে দেবে।

কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ব্যতীত কেউ তখনো প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি। সুতরাং বলা চলে কায়কোবাদের মাধ্যমেই মুসলমানদের আধুনিক বাঙলা কাব্য সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়। আশ্চর্য, প্রথম প্রচেষ্টাতেই অক্ষমতার তেমন কোনো স্বাক্ষর নেই। কায়কোবাদের অশ্রুমালা মহাশ্মশান ও অমিয়ধারা সেদিনকার বাঙলা-সাহিত্য-ইমারতে তিনটে সুদৃশ্য ও সুদৃঢ় স্তম্ভরূপে শোভা পেয়েছিল। বিস্তৃত আলোচনা করলে দেখা যাবে, মধুসূদন ও বিহারীলাল ব্যতীত সে-যুগের প্রথিতযশা কবি হেমচন্দ্র, কামিনীরায় ও নবীন সেন প্রভৃতির চেয়ে কায়কোবাদ কি মহাকাব্য রচনায়, কি খণ্ড-কবিতা সৃষ্টিতে তেমন ন্যূন ছিলেন না, বরং অসূয়াহীন ঔদার্যে তিনি পূর্বসূরীদের হার মানিয়েছেন।

কাব্যকলা সম্বন্ধে তাঁর ধারণাও ছিল অনন্য। মহৎ আদর্শ ব্যতীত উদ্দেশ্যবিহীন নিছক রসসৃষ্টির আদর্শকে তিনি ঘৃণা করতেন। এ কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথের এবং তৎপরবর্তী সাহিত্য প্রয়াসকে সুনজরে দেখতেন না।

কায়কোবাদের নিজস্ব মহৎ আদর্শ ছিল। সে-আদর্শ রূপায়ণ লক্ষ্যে তিনি মহাকাব্য রচনায় হাত দেন। তাঁর কাব্যসাধনার গুরু ছিলেন নবীন সেন। তাঁরও সাধনা ছিল মহান আদর্শ ও নীতির কাব্যে রূপায়ণ। ফলে মহাভারতের নতুন ভাষ্য-রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস নামক কাব্যত্রয়ীর সৃষ্টি ও অমিতাভ, অমৃতাভ, খ্রীস্ট প্রভৃতি মহাপুরুষের জীবনী ও শিক্ষাকে কাব্যে কথন-প্রচেষ্টাতেই সীমিত ছিল তাঁর সাধনা।

কায়কোবাদের জীবনাদর্শের তিনটে সুস্পষ্ট ধারা ছিল। সে-তিন ধারা-স্বাজাত্য ও ঐতিহ্যবোধ, জগৎ ও জীবন-জিজ্ঞাসা এবং জীবন ও প্রেম।

স্বাজাত্য ও ঐতিহ্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মহাশ্মশান, মহররম শরীফ ও অমিয়ধারায়।– জাতিবৈর-এর কবি হেমচন্দ্র বা পলাশীর যুদ্ধের কবি নবীন সেন অথবা পদ্মিনী কাব্যের কবি রঙ্গলালকে পাশাপাশি রেখে বিচার করলে, কায়কোবাদের শক্তি, আবেগ ও তেজস্বিতার প্রমাণ মিলবে। স্বদেশপ্রেমে ও স্বাজাত্যবোধে এবং প্রকাশ-প্রতিভায় কায়কোবাদ এঁদের চেয়ে কম ছিলেন না।

কবির আদর্শের আর একটি দিক হচ্ছে–মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের আপোসহীন সংগ্রাম। সর্বপ্রকার অন্যায়-অনাচার এড়িয়ে জীবনযাপন করার মধ্যেই আত্মার মুক্তি। জীবনের পথ বড় বন্ধুর; নানা মায়া-মমাহের জালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তদুপরি আছে অতৃপ্তির বেদনা ও জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের ক্ষোভ। একটানা মায়া-বন্ধন, অতৃপ্তি, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ-নৈরাশ্যের কান্নায় অশ্রুমালা গ্রথিত।

জীবন ক্ষণস্থায়ী সত্য, কিন্তু এ জীবনও সুন্দর এবং আরামদায়ক করে গড়া যায়, যদি প্রেমের সাধনা একান্তভাবে করা সম্ভব হয়। প্রেমের বীজ উপ্ত হয় ব্যক্তিকে অবলম্বন করে, কিন্তু পরিণতি বিশ্বপ্রেমে। তাই কবি তাঁর কাব্যে সর্বত্র প্রেমের মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছেন। বলা চলে–তিনি . প্রেমকেই মানবজীবনের দিশারী বলে আন্তরিকভাবে স্বীকার করেছেন। প্রেমিক অন্যায়-অসত্য অসুন্দরকে বাইরে না হলেও অন্তরে জয় করতে সক্ষম হয়। শিবমন্দির বা শ্মশানভস্ম প্রভৃতি কাব্য এ আদর্শেরই রূপায়ণ। তাঁর কাব্যগুলোর ভূমিকা পাঠে আমাদের উক্তি আরো স্পষ্ট উপলব্ধ হবে। কবির নিজের কথায়– অধোপতিত ও নিদ্রিত জাতিকে জাগাইবার প্রকৃষ্ট উপায়ই সৎসাহিত্যের আলোচনা। নিপুণ কবি তাহার কাব্যে যেসব পুণ্যময় চিত্র অঙ্কিত করিয়া থাকেন, তাদের মধ্যে ধর্মালোকে উদ্ভাসিত পুণ্যের জীবন্ত ছবি থাকিলে সমাজ তাহারই আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া উন্নতির দিকে শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইয়া থাকে। (ভূমিকা–শিবমন্দির)। কবি এ আদর্শেই সাহিত্য-সাধনা করেছেন।

বাঙলা সাহিত্যের তিন ক্ষেত্রে যে- তিনজন শক্তিমান পুরুষ আত্মবিস্মৃত দিশেহারা জাতিকে পথের দিশা দিয়েছিলেন, তারা হচ্ছেন–মীর মশাররফ হোসেন, মহাকবি কায়কোবাদ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। অবশ্য এঁদের সহযোগী ছিলেন আরো কয়েকজন। কিন্তু এঁরাই ছিলেন পুরোভাগে। মীর মশাররফ হোসেন গদ্য-সাহিত্যে, কায়কোবাদ কাব্যে এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের বাঙলা-সাহিত্যে মুসলিম অবদান ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় ঘটিয়ে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম প্রভাব ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এভাবে নতুন করে মুসলমানেরা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারক, বাহক ও সাধক হয়ে ওঠেন। সাহিত্য জাতির প্রাণ। এইজন্যে বাঙালি মুসলমান তাঁদের মরা দেহে প্রাণসঞ্চারকারী বলে এই তিন মহাসাধকের কাছে চিরদিন ঋণী থাকবেন।

সুতরাং কবি কায়কোবাদ আধুনিক বাঙলা-সাহিত্যের মুসলিম ধারার অন্যতম প্রবর্তক, বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় জাগরণ ও জাতীয়তাবোধের উদ্বোধক এবং আধুনিক মহাকাব্য রচনায় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান।

 এককথায়, আমরা তাঁর কাছে আধুনিক সাহিত্যে হাতে-খড়ি, জাতীয়তাবোধের এসম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রেরণা লাভ করি–এ-ই তাঁর গৌরব, এখানেই তাঁর সাধনার সার্থকতা, এ কারণেই তিনি আমাদের স্মরণীয় ও বরণীয়। আজকের দৃষ্টিতে সাধারণভাবে বলতে গেলে উনিশ শতকী মুসলিম সাহিত্যিকদের সৃষ্টি প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু তাদের প্রয়াস শ্রদ্ধেয়। তারা গন্তব্যে পৌঁছেননি বটে, কিন্তু পথের দিশা পেয়েছিলেন। তাঁদের অসাফল্যের জন্যে তাঁরা নন–তাঁদের অসম্পূর্ণ প্রতীচ্য-শিক্ষাই দায়ী। তারা পথিকৃৎ, তাঁরা দিশারী–এজন্যে তাঁরা আমাদের আদর্শ নন–অবলম্বন। তাঁরাই বটতলার মজলিশের মোহ কাটিয়ে লালদীঘির প্রভাব স্বীকার করে মুসলিম সমাজে বাসন্তী হাওয়া ছড়ালেন। তাঁদের কৃতিত্ব এখানেই। আমাদের কৃতজ্ঞতাও এজন্যেই।