সংস্কৃতি
এক কথায় Culture-এর কোনো সংজ্ঞা দেয়া চলে না। বলতে গেলে সবার গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞাই দেওয়া সম্ভব হয়নি আজ অবধি। Culture-এর পরিভাষারূপে সংস্কৃতি কথাটা চালু হয়ে গেছে আমাদের ভাষায় এবং আমাদের আটপৌরে ব্যবহারে তা ঘরোয়া ও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি সংস্কৃতির স্বরূপ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণায় কোনো গলদ কিংবা অস্পষ্টতা নেই। তার কারণ সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয় বটে, কিন্তু লোকের সংস্কৃতিবানতা অনুভব করতে পারি। এ অনেকটা গঁড় দেখে হাতির ধারণা করার মতো। এজন্যে ব্যক্তিভেদে সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিভিন্ন।
আমাদের ভাষায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, তমদুন, তাহজীব, তমিজ, তরবিয়ৎ, সুরুচি, সৌজন্য, ভদ্রতা প্রভৃতি culture-এর পরিভাষা কিংবা স্বরূপ-লক্ষণ প্রকাশক প্রতিশব্দ প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এদের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ culture-এর প্রতিরূপ নয়, culture-এর খণ্ডাংশ মাত্র। অর্থাৎ এগুলোর প্রত্যেকটিই culture-এর অঙ্গীভূত, কিন্তু প্রতীক নয়, যেমন চোখ-কান-শুড়-লেজ-পা হাতির প্রত্যঙ্গ বটে, হাতি নয়। কেননা কোনো প্রত্যঙ্গেরই পূর্ণাবয়বের তথা হাতির স্বরূপের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা নেই। কাজেই সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অন্ধ-হস্তী-ন্যায়-এর মতো সত্য বটে, কিন্তু সঠিক নয়। ফলে খণ্ডকে পূর্ণের মর্যাদা দানের বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি ঘোচে না। এতেই আমরা সবাই নিজ নিজ ধারণায় অটল-অবিচল থাকবার যুক্তি ও সুযোগ পাই।
Culture বা সংস্কৃতি একটি পরিষ্ক্রত জীবন-চেতনা। ব্যক্তিচিত্তেই এর উদ্ভব ও বিকাশ। এ কখনো সামগ্রিক বা সমবায় সৃষ্টি হতে পারে না। এজন্যে দেশে কালে জাতে এর প্রসার আছে, কিন্তু বিকাশ নেই। অর্থাৎ এ জাতীয় কিংবা দেশীয় সম্পদ হতে পারে, কিন্তু ফসল হবে ব্যক্তিমনের। কেননা সংস্কৃতিও কাব্য, চিত্র ও বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার মতো স্রষ্টার সৃষ্টি। কৃতিত্ব স্রষ্টার বা উদ্ভাবকের। তা অনুকৃত বা অনুশীলিত হয়ে দেশে পরিব্যাপ্ত ও জাতে সংক্রমিত হতে পারে এবং হয়ও। তখন culture হয় সাধারণের সম্পদ ও ঐতিহ্য এবং পরিচিত হয় দেশীয় বা জাতীয় সংস্কৃতি নামে। যেমন হযরত মুহম্মদের জীবনে ও বাণীতে যে-সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে, তা ই ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি নামে পরিচিত।
কাজেই একের পক্ষে যা real, অন্যদের কাছে তা ideal; একের পক্ষে যা স্বাভাবিক, অনুকারীদের কাছে তা-ই অনুশীলন-সাপেক্ষ ও কৃত্রিম। যেমন আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ সৈন্যদের স্বােপলব্ধ নয়, তারা চাকরির শর্ত হিসেবে যান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী মাত্র। কিন্তু যিনি বা যারা উপযোগ ও প্রয়োজন অনুভব করে নিয়ম-নিগড় উদ্ভাবন করেছেন, কৃতিত্ব তাঁদেরই। গাঁয়ের নিরন্ন, অজ্ঞ, অশিক্ষিত মজুরের তেমন লক্ষণীয় কোনো রুচিবোধ নেই। কিন্তু রুচিবান ধনীগৃহে বয়-বাবুর্চির কাজ নিয়ে মনিবের প্রয়োজনে তারা যে আদব-কায়দা, রান্না ও পরিবেশন পদ্ধতি শেখে তা তাদের মনিবের সংস্কৃতিরই অনুকৃতি। তেমনি দরজি, ওস্তাগার, সুতার, তাঁতি প্রভৃতি দেশের রুচিবান ধনী-বিলাসীদের পরিকল্পনা ও প্রয়োজনই রূপায়িত করে তাদের কাজে। তাজমহলের গৌরব তাই শাহজাহানের শ্রমিক ও শিল্পীদের নয়।
তাই যার মনে চেতনার উদ্ভব, কৃতিত্ব ও মৌলিকতার গৌরব তারই–অনুকারকদের নয়। নতুনতর কিছু কোনো ব্যক্তিমনে উদ্ভূত না-হওয়া পর্যন্ত অনুকারকদের মধ্যে পুরোনোটাই অনুবর্তিত হতে থাকে এবং সে-কারণেই তা জাতীয় বা দেশীয় সংস্কৃতি- রূপে পরিচিত হয়, কাজেই যে কোনো সৃষ্টিমূলে রয়েছে ব্যক্তিগত চেতনা। নতুন ভাব, চিন্তা কিংবা বন্ধুমাত্রই ব্যক্তিমনের দান। এককথায়, যে-কোনো উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি ও প্রয়াসের প্রসূন।
জীবনযাপনটাকে যদি শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে জীবন রচনা ও চালিত করার জন্যে শিল্পীর মতো চেতনা, সৃজনশীলতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন। তেমন লোকের সামাজিক ভূমিকা বিদ্রোহীর ও বিপ্লবীর। কেননা পুরাতনে আকর্ষণ না হারালে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা মেলে না। সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে, আচারে, আচরণে ও কর্মে রীতি-নীতি ও আদর্শে যারা কিছু নতুন করেছেন, তারা সবাই পিতৃপুরুষের সমাজ ও ধর্মদ্রোহী।
সাংস্কৃতিক প্রেরণার মূলে রয়েছে সৌন্দর্য-অন্বেষা। কেউ কেউ বলেন পশু-প্রায় মানুষ যেদিন ফুলের সৌন্দর্যে ও সুরের মাধুর্যে আকৃষ্ট হল–মুগ্ধ হল, সেদিনই হল মনুষ্যত্বের উন্মেষ। সে থেকেই মানুষ্যত্বের ও সংস্কৃতি-সভ্যতার শুরু, কেননা সেদিনই মানুষ অনুভব করে তার মন বলে একটা আশ্চর্য বৃত্তি রয়েছে যার শক্তির ও সম্ভাবনার সীমা নেই।
অতএব মনুষ্যত্বের পরিচয় সৌন্দর্য-চেতনায় ও পিপাসায়। সংস্কৃতিরও অন্য নাম সৌন্দর্য চেতনা ও সৌন্দর্য-অন্বেষা। যা দেখতে শুনতে বলতে কুৎসিত, যা ঘৃণ্য, যা অকল্যাণকর তা-ই অসুন্দর–কাজেই পরিহার্য। যা-কিছু কাম্য, আকর্ষণীয়, চিত্তবিনোদক, তা-ই সুন্দর ও কল্যাণকর। সংস্কৃতিবান এই সুন্দর ও কল্যাণের সাধক। সংস্কৃতিবান জীবনের রূপদক্ষ শিল্পী। উপযোগের চেয়েও প্রয়োজনীয় এ সৌন্দর্য মানুষের জীবনে। তাই মানুষ কেবল উপযোগ সৃষ্টিতেই তুষ্ট থাকে না, সৌন্দর্য সৃষ্টিতেও তৎপর হয়। যেখানে প্রয়োজনের শেষ, সৌন্দর্যের শুরু সেখান থেকেই। তার কাজে ও কথায় এই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যেই ভাষায় সে উদ্ভাবন করেছে সুরের, ছন্দের, নানা ভঙ্গির ও অলঙ্কারের; আর কাজে এনেছে শৃঙ্খলা, সুষমা ও সামঞ্জস্য। .
স্থূল প্রয়োজন সহজেই মেটে। কিন্তু সৌন্দর্য-পিপাসার শেষ নেই। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সমাজে ধর্মে-রাষ্ট্রে মানুষের এই বিচিত্র বিকাশের মূলে রয়েছে এ সৌন্দর্যবুদ্ধি। এই পিপাসাই মানুষকে এগিয়ে নিচ্ছে নব নব বিকাশের পথে–শ্রেয়সের সন্ধানে। পুরাতনে অস্বস্তি ও অবজ্ঞা না জাগলে নতুনের আকাক্ষা ও প্রয়াস জাগে না। মানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এই পিপাসা, অন্বেষা ও প্রয়াসের ফল।
সচেতনভাবে না হোক, অবচেতন প্রেরণায় কিংবা সহজাত বৃত্তিবশে সব মানুষই এই সৌন্দর্য সাধনায় নিরত। কেননা সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে এতে তার বিশেষ প্রয়োজন। কারণ সমাজে তার Personal life আছে, কিন্তু Private life নেই। তার গায়ে যদি সুগন্ধ থাকে তা অপরের চিত্ত প্রসন্নতার কারণ হয়, তার দেহে রূপ থাকলে তা অন্যের আকর্ষণ জাগায়। তেমনি তার শরীরে ঘা কিংবা দুর্গন্ধ থাকলে তা অপরের অস্বস্তি জন্মায়। এমনি করে তার হাসি-কাশি সবকিছুরই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে অপরের জীবনে। অতএব চিন্তায়, কর্মে ও ব্যবহারে লাবণ্য সৃষ্টি করে অপরের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা মানুষের জীবনের সামাজিক দায়িত্ব ও প্রয়োজন। অবচেতনভাবে তাই আমরা সবাই নিজেদের সুন্দর ও শোভন করে অপরের কাছে তুলে ধরবার প্রয়াসে নিরত। তা আমাদের দৈহিক লাবণ্য সাধন চেষ্টায়, পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতায় ও সুবিন্যাসে এবং অপকর্ম ও মিথ্যা গোপনের প্রয়াসে প্রকট। তফাৎ এই–যাঁরা সূক্ষ্ম চেতনা ও মনীষাসম্পন্ন এবং সৃজনশীল, তারা নতুন নতুন উদ্ভাবনে নিজেদের ঋদ্ধ করেন। তারা যুগোত্তর মনীষী ও যুগস্রষ্টা। আর সাধারণেরা থাকে গতানুগতিক, অনুকারক ও অনুসারক।
অতএব মৌলিক সংস্কৃতি মাত্রই সৃজনধর্মী ও গতিশীল। এজন্যে সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না। অনুকারক অনুসারকের গতানুগতিক ধারার সংস্কৃতি আসলে সংস্কৃতি নয়,– আচার। কেননা স্থিতিশীল সংস্কৃতি প্রাণের প্রেরণাহীন ও তাৎপর্য-বর্জিত আচারে কিংবা সংস্কারে অবসিত হয়। যেমন জাকাত দানের মূলে দুঃস্থ মানবপ্রীতি, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবুদ্ধি এবং সংবেদনশীল ব্যাকুল হৃদয়ের যে মানবিক প্রেরণা ছিল, তা আজ অবলুপ্ত। ফলে তা আজ একটি অনভিপ্রেত ধর্মীয় কর্তব্য–একটি যান্ত্রিক আচার মাত্র।
চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর ও শোভন অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। মৌলিক চেতনা ও চিন্তা যার আছে, সে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে রচনা করে চলে। সে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে নতুনভাবে অনুভব করে– সে-অনুভবে সে তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টি করে নিত্যনব পরিবেশ। তার কাছের মানুষকে চমক লাগানোর ও আকৃষ্ট করার মতো ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে তার। সংস্কৃতিবান কখনো অসুন্দরের সঙ্গে আপোস করতে জানে না। তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণ অন্যায় ও অকল্যাণপ্রসূ নয়। আত্মসম্মানবোধ, সহিষ্ণুতা, যুক্তিনিষ্ঠা, উদারতা ও কল্যাণবুদ্ধি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
সংস্কৃতিবান জীবনযাত্রী তার চলার পথ দীপ্ত করে, পথের দু-ধারে দ্যুতি ছড়িয়ে, অপরকে দি গা দিয়ে, অন্তরের মাধুরী বিলিয়ে ও জীবনের প্রসাদ পেয়ে ধন্য হয়– ধন্য করে অন্যদের।
তাই সংস্কৃতিই জীবনযাত্রীর পাথেয়। তার কথায় কাজে চলায় স্কুল প্রয়োজনাতিরিক্ত যে লাবণ্য থাকবে, তা-ই হবে সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র। হৃদয়ের প্রীতিকামী আবেগই বিভিন্ন আত্মার মিলন-ডোের। তার বোধে ও দৃষ্টিতে বসুধৈব কুটুম্বকম। তাই সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজে বিশিষ্ট কিন্তু স্বতন্ত্র নয়।
সাধারণ মানুষ সৃজনশীল নয়, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি নেই। তারা গ্রহণশীল হয়েই হয় সংস্কৃতিবান। তাছাড়া কোনো দেশে বা জাতে মানুষের ব্যবহারিক ও মানসজীবনের সব চাহিদা মেটাতে পারে, সর্বপ্রকার অভাব ঘুচাতে সমর্থ তেমন প্রতিভাবান বা ততগুলো প্রতিভাধরের আবির্ভাব হয় না, অন্তত আজো হয়নি। কাজেই সৃজনশীলতার সাথে গ্রহণশীলতাও থাকা চাই, নইলে সংস্কৃতি চালু রাখা যায় না। এজন্যে কোনো দেশের বা জাতির সংস্কৃতি কখনো অমিশ্র বা মৌলিক থাকে না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাঙ্গীকরণ বা আত্মস্থ করাই হচ্ছে সাধ্য। যারা সৃজনে সমর্থ নয়, অথচ গ্রহণবিমুখ–যেমন পার্বত্য ও আরণ্যক মানুষেরা তাদের মন-মনন ও সমাজ স্থাণু।
কেননা সংস্কৃতিপরায়ণতার অন্য নাম গতিশীলতা। ক্রমোকর্ষ ও উন্নয়নই এর ধর্ম। আমরা বাঙালিরা সংস্কৃতিবান হয়েছি, এগিয়ে চলেছিসৃজন করে নয়, গ্রহণ করেই। আমাদের ধর্ম এসেছে- উত্তরভারত ও আরব থেকে, ভাষাটাও উত্তরভারতের। প্রশাসনিক ঐতিহ্যও উত্তর ভারত, উত্তর এশিয়া ও য়ুরোপ থেকে পাওয়া। আজকের ব্যবহারিক জীবনের সব উপকরণ এবং মানসজীবনের সব প্রেরণা আসছে য়ুরোপ থেকেই। অতএব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা গ্রহণশীল ও অনুকারক।