সাহিত্যের স্বরূপ

সাহিত্যের স্বরূপ

সাহিত্যের রূপ ও আদর্শ সম্বন্ধে আজকালকার লোকের প্রশ্ন ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু চিরকাল এমনটি ছিল না। পড়তে শুনতে বা ভাবতে ভালো লাগলেই আগেরকার দিনে যে-কোনো রচনাকেই নির্বিচারে সাহিত্য বলে গ্রহণ করা হত। আজকের যুগে মানুষ বড় সচেতন, অত্যন্ত হিসেবী। তারা লাভ-ক্ষতির তৌলে সবকিছুর মূল্য ও সারবত্তা যাচাই করতে চান। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে যা-কিছু মানুষের ব্যবহারিক জীবনে অপ্রয়োজনীয় বোধ হয়, তা-ই সাহিত্য থেকে নির্বাসিত করাই বিধেয় বলে ফতোয়া জারি হচ্ছে। মনোজীবন বলে ব্যবহারিক জীবন-নিরপেক্ষ কোনো জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করা তাদের যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমুখী মন ও মননে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তার কারণও রয়েছে যথেষ্ট। আজকের দিনে ব্যবহারিক জীবন-সমস্যা এমন উকটভাবে দেখা দিয়েছে যে নিতান্ত বেঁচে থাকার সাধনা অন্য সর্বপ্রকার জৈব-সাধনাকে ছাপিয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া, কলকারখানার স্থাপন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং যন্ত্রশক্তির বদৌলত বিশাল পৃথিবীর বিশালতা ও বৈচিত্র্য ঘুচে গিয়ে পৃথিবী হয়ে গিয়েছে ক্ষুদ্র ও একাকার। জীবন ধারণের প্রয়োজনানুরূপ সামগ্রীর অভাবে পারস্পরিক হানাহানি কাড়াকাড়ি লেগেই আছে। মূলত সবদেশের সবলোকের সংগ্রামের রূপ একই–তা হচ্ছে জীবন-সংগ্রাম, বেঁচে থাকবার আকুল আগ্রহে-ই তাঁদের চিত্ত হয়ে উঠছে বিদ্বিষ্ট ও হিংস্র। এই সমস্যা-বিমূঢ় সমাধান-কাতর জগতে তাই জাগতিক ও জৈবিক সর্বব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে নানা মত ও পথ। এমনি অবস্থায় কারো দৃষ্টি স্বচ্ছ থাকার কথা নয়। নির্লিপ্ত আর অনাচ্ছন্ন। বিবেক ও চিন্তাপ্রসূত নয় বলেই বিভিন্ন মত ও পথগুলো দেখা দিয়েছে পরস্পরের মারাত্মক। প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। স্বার্থপ্রসূত এই বিভিন্ন আদর্শগুলোর সমন্বয় সাধন তাই একরূপ অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না।

সাহিত্যেও তাই প্রধানত দুটো আপোষহীন নীতি ও আদর্শের সংঘাত দেখা দিয়েছে। একটা হচ্ছে বাস্তবতা, অপরটা কল্পনা সর্বস্বতা; একটা প্রয়োজনানুগ অপরটা রসবিলাস, একটা গণসাহিত্য অপরটা বুর্জোয়া সাহিত্য; একটি প্রগতিকামী অপরটি রস-লীলাপরায়ণ; একটা ধর্ম ও স্থানীয় বা জাতীয় সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রচারক অপরটা নৈর্ব্যক্তিক সংস্কৃতির ধূরক।

আমরা এই আলোচনার বিষয়টা খোলাসা করে বুঝে নেবার চেষ্টা করব মাত্র কোনো সমাধান পাবার আশা না রেখেই।

প্রথমত, সাহিত্য হচ্ছে অনুভূতির অভিব্যক্তি মাত্র। তা কাব্য হোক, নাটক হোক বা প্রবন্ধ হোক। অনভূতিসঞ্জাত যে-ভাব আমাদের মনে ও মাথায় (তথা হৃদয়ে) আলোড়ন জাগায়, তা-ই বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। অবশ্য আমাদের সবকথার মূলে ভাব থাকে এবং তার পশ্চাতে থাকে অনুভূতি অর্থাৎ সব প্রকারের ভাবের মূলে থাকে Cognition, Volition ও emotion বা feeling. তথাপি সব বাণীই আমরা যথাযথ সচেতনতা ও যত্নের সাথে প্রকাশ করিনে। সুতরাং যা-কিছু সযত্নে ও স্বচৈতন্যে প্রকাশ করি তা-ই আমাদের সাহিত্য। কারণ তখন আমাদের বাণী অন্য হৃদয়ে সঞ্চারিত হবার যোগ্যতাসম্পন্ন হয় অর্থাৎ তা বিশেষ অর্থে রসাত্মক হয়ে ওঠে। যত্ন ও প্রয়াসের সাথে শক্তি যোগ না হলে তা অপর হৃদয়ে অনুরূপ ভাব বা অনুভূতি সঞ্চারের সামর্থ্য পায় না, তাই সব রচনা সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্য হয় না। এখানে এ-কথা স্বীকার করা ভালো যে সব রচনাই পাঠকের উদ্দেশ্যে রচিত হয়।

দ্বিতীয়ত, অনুভূতি মাত্রেই ভাবের সত্য অর্থাৎ বিশেষ মনের বিশেষ অবস্থার সত্য। সে-সত্যের সাথে বহির্জীবনের সত্যের সামঞ্জস্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। যেমন আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, প্রাণ-সখা বন্ধু-হে আমার অথবা পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে। এসব হচ্ছে অনুভূতিজাত ভাবের সত্য–বাস্তবের সত্য নয়। তেমনি শরৎচন্দ্রের মহেশ বা রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পদ্বয়ে বর্ণিত অবস্থাও ভাবের সত্য। বাস্তবে কত গফুর, কত রতনকার খবর কে রাখে? কিন্তু লেখকের হৃদে-মনে-মাথায় এমনি অবস্থার অনুভূতি যে-ভাব-আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, তা-ই প্রকাশিত হয়েছে রচনায় এবং সে-রচনা সযত্নে ও স্বচৈতন্যে সম্ভব হয়েছে। শুধু বাস্তব নয়, শুধু কল্পনাও নয়; বাস্তবে-অবাস্তবে, সম্ভব-অসম্ভবে, জ্ঞান প্রজ্ঞা, বুদ্ধি-বোধি সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছে এ সৃষ্টি। দার্শনিক তত্ত্বগুলো যেমন বাস্তব-নির্ভর হয়েও বাস্তব নয়–অনুভূতি ও প্রজ্ঞার সত্য; সাহিত্যও তেমনি অনুভূতি-উপলব্ধির সত্য, বাস্তব থেকে পাওয়া কিন্তু বাস্তব-সত্য নয়।

অতএব অনুভূতি বাস্তবাহৃত, বাস্তব-নির্ভর ও বাস্তবানুগ হয়েও তা বাস্তবাতিরিক্ত এবং কল্পনা নির্ভর হয়েও কল্পনা-সর্বস্ব নয়। মূলত তা জীবন-চেতনা-প্রসূত–প্রত্যক্ষভাবে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচেতনা জাত নয়। কারণ, তা অনুভূতির জারক রসে রসায়িত হয়েই অভিব্যক্তি লাভ করে, তার আগে নয়।

তৃতীয়ত, মানুষের মন স্বভাবত ভাবগ্রাহী, বৃহত্তর অর্থে মানবজীবন ভাবসর্বস্ব। মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, লাভ-ক্ষতি–সবকিছুই অনুভূতি মাত্র। অনুভব করি তো কোনো ঘটনা পর্বত প্রমাণ মনে হবে, আর অনুভব না করি তো তৃণবৎ তুচ্ছই থেকে যাবে। যেমন, শিশুটি উঠানে একপাত্র প্রয়োজনীয় পানি ফেলে দিলে আমার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি নেই, তাই আমি নির্বিকার; কিন্তু যদি একপাত্র সদ্যকেনা দুধ ফেলে দেয় তখন? একটি বাঘ নিহত হলে মানুষ খুশি হয়, একজন মানুষের অপমৃত্যু হলে তখন? তখন যে-দুঃখ যে-ক্ষোভ আমি অনুভব করছি তা তো স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তা হচ্ছে বিবেচনাপ্রসূত। মানুষের মনন ও অভিজ্ঞতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই অনুভূতির জীবন বিস্তৃত হয়েছে। তাই বলে কোনো অনুভূতি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়, বস্তুত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকেই সব অনুভূতি আসে। কারণ যা স্কুল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার কল্পনাও সম্ভব নয়।

সুতরাং মানুষের সব কর্ম-চিন্তা ও কামনা-বাসনার মধ্যে জীবন-চৈতন্য রয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করে বললে কথাটা এই দাঁড়ায় : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক দ্বারা আমরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ লাভ করি। এর ফলে আমাদের মনে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি হরেক রকম বোধ জন্মে। বস্তুত এইসব বোধ বা ভাব কিন্তু অনুভূতি বা ভাবরাশির সঙ্গে আমাদের জীবন-চৈতন্যের কোনো মূলগত পার্থক্য নেই। অন্য কথায় জীবন-চৈতন্য মানে দাঁড়ায় বাহ্যপরিবেশের সঙ্গে মনের গভীরতর যোগ চৈতন্য। এই ব্যাখা যদি মেনে নিই, তবে আমরা দেখতে পাই জীবনচৈতন্য ও সমাজচৈতন্য বলে আলাদা কিছুই নেই। ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ, বাধাবিঘ্ন মানসলোকে অর্থাৎ আমাদের অনুভূতির জগতে কিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার বিশিষ্ট রূপ যদি সাহিত্যে বিধৃত না হয়, তবে তা রসগ্রাহী তথা ভাবসর্বস্ব মনে ভাব বা অনুভূতি সঞ্চার করতে সমর্থ হবে না; এক কথায় বহিরোখিত ঘটনার সংঘাতে আমাদের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রক্রিয়া কী বিচিত্র রূপ ধারণ করে, তা কার্যকারণপরম্পরায় চিত্রিত না হলে, সব সৃষ্টি-প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য।

এই ব্যাখ্যার আলোকে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাই সাহিত্যে বাস্তব-অবাস্তব, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বা গণ-বুর্জোয়া বলে কোনো বিশিষ্ট ধারা নেই। তবে বস্তুভেদে অনুভূতিভেদ আছে। তা হচ্ছে নিতান্ত স্তরভেদ সুতরাং রূপগত নয় রসগত। শাকের স্বাদ মাছে নেই, আবার মাছের স্বাদ মাংসে অসম্ভব। তাই বলে শাক ও মাছে স্বাদ আছে, মাংসে নেই; অথবা মাছে বা মাংসে স্বাদ আছে, শাকে নেই–এমন কথা কোনোক্রমেই বলা চলে না। প্রত্যেকটাই বিশিষ্টরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবু এদের মধ্যে স্তরভেদ আছে। তেমনি সাহিত্যেও বিষয়বস্তু অনুসারে স্তরভেদ আছে। আমি দেশী সাহিত্য থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিচ্ছি। যেমন জসীমউদ্দীনের কাব্যে রস আছে, তা পাঠকচিত্ত আকৃষ্ট করে। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের বলাকার সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তেমনি নজরুলের সাম্যবাদী আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু এর সঙ্গে নক্সীকাঁথার মাঠের কোনো বিষয়গত ও ভাবগত ঐক্য নেই। তবু আমরা এই তিন প্রকারের কাব্যকেই স্বীকার করে নিয়েছি এবং এই তিন প্রকার রচনায় তিনটি স্তরও স্বীকার করেছি, কিন্তু রসহীন বলিনি। রসের তারতম্য দিয়ে উৎকর্ষ–অপকর্ষ বিচার চলে, কিন্তু অন্য নামে সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে চিহ্নিত করা চলে না।

আগেই বলেছি সৃষ্টি মাত্রেই কল্পনাধর্মী। কুলি-মজুরের কথাই লিখি, বা রাজপুত্র-রাক্ষসের গল্পই বলি, বসন্তের জয়গানই করি বা বর্ষার চিত্ৰই আঁকি–সবকিছুই মূলত অনুভূতিজাত ভাবেরই অভিব্যক্তি; বাস্তবের প্রতিকৃতি নয়। তবে অনুকৃতি বটে; তা রাক্ষসের গল্পও বাস্তবের অনুকৃতি বই তো নয়; কারণ পূর্বেই বলেছি-ইন্দ্রিয় বহির্ভূত কল্পনা অসম্ভব। এই অর্থে সাহিত্যে বাস্তবতা বলে কিছুই নেই এবং এই অর্থেই সাহিত্য মাত্রেই কল্পনা বা ভাব বা অনুভূতি আশ্রয়ী। এই কল্পনা, ভাব বা অনুভূতির বৈচিত্র্যানুসারে সাহিত্যে রসবৈচিত্র্য ঘটে। এই বৈচিত্র্য আসে স্রষ্টার জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বোধ-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির পার্থক্য থেকে। একই পরিবেশ বা প্রকৃতি থেকেও বিভিন্ন। মনোভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। তাই মন ও মননের পার্থক্যবশত সাহিত্যেও রসবৈচিত্র ঘটে, আদর্শ বৈচিত্র্যও এর আনুষঙ্গিক ফল। সুতরাং সৃষ্টি পরিকল্পনায় কোনো সচেতন প্রয়াস বিশেষ কার্যকর হয় না–মগ্নচৈতন্যের উপলব্ধি–যা অন্য অর্থে লেখকের জীবন-বোধ বা জীবন-চৈতন্য তা-ই রচনায় ব্যক্ত হয়ে পড়ে। অতএব গণসাহিত্য বা বুর্জোয়া সাহিত্য বলে আসলে কিছুই নেই। লেখক বিশেষের স্বকীয় মনোভঙ্গিরই অর্থাৎ রুচি-সংস্কারের রূপ-বৈচিত্র্য বিশেষ। লেখকের কলমের ডগায় যে বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত, পথ বা ধর্মীয় আদর্শ প্রকাশিত হয়, তা নিতান্ত আকস্মিক নয়। আকস্মিক নয় এইজন্যে যে, সেটা লেখকের উপরি পাওয়া জিনিস নয়–মর্মমূল নিঃসৃত সত্য বিশেষ। তথাপি তা সর্বজনগ্রাহ্য নাও হতে পারে, কারণ লেখক ও পাঠক নির্বিশেষের শিক্ষা, রুচি, সংস্কার ও পরিবেশ এক রকমের হয় না। যেমন আবর্জনা দেখলে আমাদের গা ঘিনঘিন করে, কিন্তু একজন মেথরের তেমন হয় না। একজন মুসলিম তরুণীর কাছে বৈধব্য তেমন বড় সমস্যা নয়, কিন্তু হিন্দু তরুণীর বৈধব্য মানে নিজেরও অপমৃত্যু। অতএব উপরোক্ত অবস্থায় উদ্ভূত দুই অনুভূতিতে রসবৈচিত্র্য অবশ্যম্ভাবী।

তারপর কোনো সাহিত্য বা অনুভূতি সর্বজনগ্রাহ্য হতে হলে তা জীবনের তথা হৃদয়ের গভীরতর বৃত্তি-প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন অর্থাৎ তা দেশ, কাল ও পাত্রের ছাপবিহীন একটি সর্বজনীন রূপ লাভ করবে। যতক্ষণ তা সম্ভব না হচ্ছে, ততক্ষণ তা দেশ-কালের গণ্ডীর মধ্যেই থাকবে আবদ্ধ। যেমন পানি বলতে জগতে যেখানে যত পানি আছে সবগুলোকে বুঝায়। কিন্তু তবু ডোবর পানি, নদীর পানি, দীঘির পানি, পুষ্কণীর পানি বা সমুদ্রের পানি এক নয়। এদের কারো সব-পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতা নেই, কারণ এগুলো আধারের ছাপ-মুক্ত নয়! কিন্তু distilled water-এর সঙ্গে সব পানির ঐক্য আছে। অর্থাৎ ঐ পানি নির্বিশেষ পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতাসম্পন্ন–কারণ তা বিশেষ আধারের ছাপমুক্ত। সাহিত্য সম্পর্কেও এই নিয়ম। দেশ-কাল জাতি ও ধর্মের ছাপমুক্ত সর্বজনীন অনুভূতি বা ভাব যে-সাহিত্যে প্রকাশ পাবে তা হবে চির-মানবের সাহিত্য। অন্য প্রকারের সাহিত্য হবে বিশেষ দেশের, জাতির, কালের বা ধর্মসম্প্রদায়ের। আধুনিক সাহিত্যে Yeats, রবীন্দ্রনাথ, T.S. Elliot ও ইকবাল–এই চারজনই অধ্যাত্মবাদী। কিন্তু Yeats ও রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ জীবন-রহস্য উদঘাটনের প্রয়াসপ্রসূত। পক্ষান্তরে T.S. Elliot ও ইকবালের সাহিত্য বিশিষ্ট আদর্শের ছাপযুক্ত সেজন্যে তা নির্বিশেষ পাঠকের গ্রাহ্য নয়। সুতরাং T.S. Elliot ও ইকবাল বিশেষ দেশ-কাল ও জাতি-ধর্মের কবি ও শিক্ষক; আর Yeats ও রবীন্দ্রনাথ দেশ-জাত নিরপেক্ষ আস্তিক মানুষের কবি।

তারপর আসে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা। এক হিসেবে সাহিত্য-মাত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অবান্তর। কারণ সাহিত্য হচ্ছে মূলত মানুষের ভাবলব্ধ সত্য-অনুভূতি ব্যতিরেকে বাস্তবে তার প্রতিচ্ছবি পাওয়া অসম্ভব এবং সাহিত্য কোনো বাস্তব-প্রয়োজন প্রত্যক্ষভাবে সিদ্ধ করে না। আর এক হিসেবে সাহিত্য–মনুষ্য জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। যে-প্রেরণায়, যে-অব্যক্ত-প্রয়োজনে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, সে-প্রয়োজন পরিহার করে চলা মানুষের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। আমরা যে হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, ব্যাস, বাল্মীকি, ফেরদৌসী-রুমী-জামীকে স্মরণে রেখেছি, তাঁদের রচনা পড়ে চলেছি–তা-ই আমাদের প্রয়োজনের যথেষ্ট প্রমাণ নয় কী? পক্ষান্তরে অগ্নি যিনি আবিষ্কার করলেন, কয়লা যিনি যোগালেন, রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন টেলিভিশন যারা দান করলেন তাঁদের কেন আমরা স্মরণে রাখার গরজ বোধ করিনে! এতেই প্রমাণিত হয় এসবের ব্যবহারিক প্রয়োজন যেমনই হোক, তার সঙ্গে আমাদের অন্তর্জীবনের সম্পর্ক অকিঞ্চিৎকর; পক্ষান্তরে অন্তৰ্জীবন তথা আমাদের অনুভূতির জীবন যতই অবাস্তব মনে হোক, তা ই আমাদের জীবনসর্বস্ব। তবু তা শিল্প মাত্র! অন্য দশ শিল্পকর্মের মতো এ-ও আমাদের প্রয়াসপ্রসূত সুতরাং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সাহিত্যে বাস্তবতা ও কল্পরসবিলাস সম্বন্ধেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। কোনো বিষয়বস্তুই সাহিত্যে নিরর্থক নয়, কারণ যে-কোনো ব্যাপারে মানুষের অন্তর্নিহিত বৃত্তি-প্রবৃত্তির স্ফুরণ হয়। হৃদয়-সংযুক্ত বহির্জীবনের সমস্যার সমাধান-চিত্র যেমন মানুষকে জীবন পথে প্রেরণা দান করে, তেমনি রাক্ষস-রাজপুত্রের কাহিনীতেও মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তি রূপায়িত হয়দুটোরই প্রয়োজন আছে। ফলত বুর্জোয়া ও গণসাহিত্য বলে সাহিত্যকে দ্বিধা- বিভক্ত করা নিরর্থক। কারণ আমরা বলেছি, মূলত মানুষের জীবন ভাবসর্বস্ব বা অনুভূতি-সমষ্টি মাত্র। কাজেই অনুভূতির জগতে স্ব স্ব স্বাভাবিক প্রবণতানুসারেই সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং মনোভঙ্গির পার্থক্যবশতই আমরা সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে ও রসে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় এবং বাস্তব ও অবাস্তবের সীমারেখা টানতে প্রয়াসী হই। আমাদের সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা ও মতগত অনৈক্যের মূলও এখানে। সাহিত্যে রস-সর্বস্বতা, জীবন-সর্বস্বতা, সমাজ-সর্বস্বতা, রাষ্ট্র-সর্বস্বতা বা প্রয়োজন-সর্বস্বতা বলে কিছুই নেই–যা আছে তা অনুভূতি ও উপলব্ধির সর্বস্বতা। এর প্রকারভেদেই আদর্শ, নীতি, রস ও বিষয় ভেদ ঘটে।

এ পর্যন্ত আমরা যা বলেছি, তা সংক্ষেপে এই-সাহিত্য হচ্ছে ভাবের অভিব্যক্তি মাত্র! সাহিত্যে রসভেদ আছে কিন্তু রূপভেদ নেই! কারণ মানুষের জীবন হচ্ছে অনুভূতির সমষ্টিমাত্র অর্থাৎ ভাবসর্বস্ব সুতরাং সাহিত্যে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, বাস্তব-অবাস্তব, গণ-বুর্জোয়া বলে কোনো সীমারেখা টেনে দেওয়া নিরর্থক। তারপর বলেছি, মানুষের মানস-সংস্কৃতি যখন দেশ, কাল, ধর্ম ও জাতীয়তার ছাপ মুক্ত হয়; তখন সাহিত্যে যে-অনুভূতি বিধৃত হয়, তা হয় সর্বকালের, দেশের ও চিরমানবের সম্পদ। অতএব সাহিত্যে একমাত্র কাম্যবস্তু হচ্ছে বহির্ঘটনার সঙ্গে হৃদয়ের গভীরতর সংযোগ সন্ধান। বাস্তবের ঘটনা সংঘাতে মনে দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ-উল্লাসের যে-আবেগ সৃষ্টি হয়, তা যতক্ষণ যথার্থরূপে বাণী লাভ না করবে, ততক্ষণ তা মনান্তরে বা হৃদয়ান্তরে সহানুভূতি সঞ্চারে সমর্থ হবে না। এইজন্যে সৃষ্টিমাত্রই নিরর্থক–সাথে হৃদয় নহিলে। অনুভূতি বা ভাবের যথার্থ প্রকাশ মানেই হৃদয়ের বৃত্তি-প্রবৃত্তির বাণী-চিত্র দান করা। এক কথায়, বাহ্যবস্তু বা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের অন্তর্নিহিত রূপ সাহিত্যে বিধৃত হওয়া চাই। একমাত্র এরই নাম সাহিত্য।