মানুষের সাধনা

মানুষের সাধনা

দূর অতীতে মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন দুজন দার্শনিক। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে একজন বলেন–মানুষ হাস্যময় জীব। অপরজন সংজ্ঞা দিলেন–মানুষ মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। এতকাল পরে আজ উপলব্ধি করছি, কেন এত শব্দ থাকতে তাঁরা হাস্যকর উক্ত শব্দদ্বয় বেছে নিয়েছিলেন মানুষকে চিহ্নিত করবার জন্যে! আমাদের মনে হয়, উক্ত দু-সংজ্ঞার সমন্বয় ঘটালে সম্ভব হয় মানুষ সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ ধারণা করা। যেমন, মানুষ হাস্য ও মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। বোধ করি, এর থেকে মানুষের যথার্থ পরিচয় আর কিছু হতে পারে না। আরো একজন নৈয়ায়িক মানুষকে আখ্যাত করেছেন পালকবিহীন পাখি বলে। সে-কথা এখন থাক।

আমরা জানি–মানুষ কান্না এড়িয়ে বুকে-মুখে-নয়নে হাস্য ফুটিয়ে রাখবার জন্যেই চিন্তা করে আসছে চিরকাল। মানব-প্রচেষ্টার চিরন্তন ইতিহাসের সারমর্ম বা সংক্ষিপ্ত সার এই-ই। মানুষের মনে নির্ঘ নিঃশঙ্ক হাসি ফোঁটাবার জন্যে কালে কালে কত ধর্ম, কত ব্যবস্থা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা নীতিকথার প্রচার হয়েছে, ইয়ত্তা নেই তার। মানুষ যতই হাসবার চেষ্টা করেছে, ততই বেড়ে চলেছে মনন-চিন্তনের ক্ষেত্র, কিন্তু ফল স্থায়ী হয়নি কোথাও। মহামানবের মহৎ সাধনা যুগে যুগে বুদ্ধিমান ও স্বার্থলোভীদের ষড়যন্ত্রে হয়েছে পণ্ড।

হজরত মুসা এলেন আল্লাহর সুসমাচার নিয়ে; কিন্তু মানুষের মুখে হাসি ফুটতে-না- ফুটতে জগৎ-সংসার আচ্ছন্ন হয়ে গেল কান্নায়। হজরত ঈসা এলেন চোখের পানি মুছিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করবার জন্যে! কিন্তু মানুষ আশ্বস্ত হতে-না-হতেই চারদিকে আচ্ছন্ন করে দিল নৈরাশ্যের অন্ধকার। হজরত মুহম্মদ এলেন আল্লাহর শেষ বাণী নিয়ে। সে-বাণীর লাঞ্ছনা তো প্রত্যক্ষ করছি রোজ। তত্ত্ব ও তথ্যবিকৃত বলে নিন্দিত বাইবেলের অনুসারীদের মধ্যে যত মত-পথের সৃষ্টি হয়নি, অবিকৃত কোরআনের ধারকদের মধ্যে উদ্ভব হয়েছে তার শতগুণ বেশি ফেরকার।

শ্রীকৃষ্ণ চলার পথের নির্দেশ দিয়ে গেলেন গীতায়! চিন্তাশীলেরা পথ হারালেন বেঘোরে। বুদ্ধদেব এলেন, আশ্বস্ত হল মানুষ; কিন্তু কয়দিন? আচার্য শঙ্কর এসে আবার দিশা দিলেন শ্রেয়সের। কিন্তু কিছুতেই হবার নয় কিছু। এই হাসির জন্যে জগৎ জুড়ে কান্নার সে কি রোল! সুখের জন্যে দুঃখের দাহনে কী বীভৎস আত্মাহুতি। দুনিয়াব্যাপী সে কী নৃশংস হানাহানি, মারামারি আর গালাগালি। হাসি ফোঁটাবার অবকাশ এল না আর। সুদূর অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। আরো আধুনিক নজিরও গ্লানিকর। সাম্য-ভ্রাতৃত্ব স্বাধীনতার-সন্তান নেপোলিয়ন সেদিন রক্তের বন্যা ডেকে এনেছিলেন য়ুরোপে। মানবতার পূজারী আব্রাহাম লিঙ্কন সেদিন নিহত হয়েছিলেন মনুষ্যত্বের ধ্বজাবাহীদের হাতেই। মানবাধিকারের এজেন্ট–সভ্যতাভিমানী আমেরিকায় নিগ্রো-নিগ্রহের অবসান হয়নি আজো। চোখের সামনে যা দেখছি আজ, তার খতিয়ানও যুগযুগান্তরের মনুষ্যসাধনার সকরুণ ব্যর্থতার মর্মান্তিক চিত্র বই তো নয়? Fraternity-র উদগাতা ফরাসিরা ইন্দোচীন ও আলজিরিয়ায় দেখিয়েছে অমানুষকিতার তাণ্ডবলীলা। তীব্র মানবতাবোধের অভিমানী ব্রিটিশের জ্ঞাতিগোত্র বর্বরতার প্রদর্শনী খুলেছে রোডেশিয়ায়, দক্ষিণ-আফ্রিকায়। ব্যক্তিসত্তায় বিশ্বাসী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার প্রচারক যে য়ুরোপ, সেখানে ফ্রয়েড, আইনস্টাইন আর রোমা রোলা হয়েছেন নির্যাতিত। বিশ্বশান্তির অছিলায় আমেরিকার কোরিয়া যুদ্ধ পরিচালনা, কোজে দ্বীপের কেলেঙ্কারি, ভিয়েতনামে বর্বর অভিযান প্রভৃতি হাজারো ব্যাপারে প্রমাণিত হচ্ছে মানুষ। চিন্তাবৃত্তিসম্পন্ন জীব, কিন্তু হৃদয়বান মানুষ নয়। এই মননশক্তি মানুষকে যুক্তির আশ্রয়ে শুধু হিংস্র লোভাতুর জীবে পরিণত করে রাখছে, দরদ ও বিবেক-নির্ভর মানুষে উন্নীত করছে না।

আরো দেখা যাক, মানবতার উপাসক ইংরেজের নৃশংসতা কী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিনি আমরা? সর্বপ্রকার শোষণ-অত্যাচার থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করবার জন্যে এতকাল সাহিত্যে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আন্দোলন করে আসছে যে প্রবুদ্ধ বাঙালি হিন্দু, আযাদী লাভের পর সে বাঙালি শাইকরাই গুলি চালায় ভুখ-মিছিলে। বহুনিন্দিত জমিদারি প্রথা কায়েম রাখার জন্যে তারাই। খুঁজছে আজ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয়। পুঁজিবাদকে গালাগাল দেয় আর নিজেরাই পুঁজিপতি হবার সাধনায় করেছে আত্মনিয়োগ। উদার জাতীয়তাবাদের উদগাতা গান্ধী আর চিত্তরঞ্জনের স্বজাতি আজ ভিন্নধর্মাবলম্বীদের রক্তপাগল। মহাত্মা বলে পরিকীর্তিত ও পূজিত গান্ধী বেঁচে থাকবার অধিকার পেলেন না এই স্বজাতি ভক্তের দেশেই। মানবতা ও সাম্যবাদের ধ্বজাধারী রাশিয়া ও চীন অস্ত্রাঘাতে ধরাশায়ী করে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী! কোরআনের অনুসারীরা আজ আচরণ, বিবর্জিত ইসলামি ধ্বজার বাহক হতেই উৎসুক। সুনীতির প্রবক্তারা চিরকালই কী এমন দুর্নীতির আশ্রয়েই পুষ্ট হতে থাকবে? তবু মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি আমরা। কেননা আমরা জানি, জনসাধারণের আসলের প্রতি আসক্তি আছে বলেই চিন্তাবিদ-বুদ্ধিমান প্রতারকেরা তাদের নাজেহাল করে নকল দিয়ে। ঠকে ঠকেও কী আসলে-নকলে পরখ করতে শিখবে না মানুষ? হাসির আশায়। আশায় শুধু কী কান্না নিয়েই থাকবে? চিন্তাশীল মানুষ কী সত্যিই পালকহীন পাখি? পাখির মতো বড় বড় বুলি মানুষ শুধু চিরকাল আওড়িয়েই চলবে হৃদয়ে তাদের মর্মার্থ ধারণ করবে না? তাদের স্বরূপ কী চেনা যাবে না? মানুষ কী চিরকাল হাস্য-সক্ষম ও মনন-সম্পন্ন জীবই থাকবে-হৃদয়বান। সহানুভূতিশীল মানুষ হয়ে উঠবে না? হাস্য-কাতর মানুষ কী হাসতে পারবে না? হাসির মরীচিকা দেখিয়ে দেখিয়ে সরল মানুষকে প্রতারিত করা হবে আর কতকাল? মানুষ হাসির অভিলাষী, তাই বলেই কী তাদের প্রতারণা ও মিথ্যা দিয়ে অশ্রুর লোনা দরিয়ায় ডুবিয়ে মারতে হবে? মানুষের সুখের সাধনা, শান্তির কামনা, সুন্দরের বাসনা কী সফল হবার নয়!

মানুষ! হায়রে হৃদয়হীন মননশীল মানুষ! মানুষের দুনিয়াকে বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন করে রাখবে কতকাল, আর কতকাল! হায়–

এমন মানব-জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা!