স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর
০১.
ঘৃণা, হিংসা ও ঈর্ষা–এই তিনটে পরিবেশ ও পাত্রভেদে মানুষের একই বৃত্তির বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র। আমরা ছোটকে ঘৃণা করি, সমকক্ষকে হিংসা করি, আর বড়র প্রতি হই ঈর্ষ। ঘৃণার স্বাভাবিক প্রকাশ অবজ্ঞায় ও অবহেলায়, হিংসার শূর্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও পরশ্রীকাতরতায় আর ঈর্ষার প্রকাশ ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত জীবনের দোষ-সন্ধানে ও অসূয়ায়। দুর্বলের বিপর্যয়ে আমাদের অনুকম্পা জাগে, সমকক্ষের দুর্যোগে সুপ্ত জিগীষাপ্রসূত আহ্লাদ বোধ করি আর বড়র দুর্দিনে আত্মপ্রসাদ পাই। অবশ্য এদের সঙ্গে প্রীতির কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে এদের দুঃখ-বিপদে বিচলিত ও দরদে বিগলিত হওয়াই স্বাভাবিক।
আমরা ছোটর সঙ্গে মিশতে চাইনে প্রাণের আরাম নেই বলে, সমকক্ষকে এড়িয়ে চলি প্রীতির অভাবে ও আত্মপ্রতিষ্ঠার গরজে আর বড়কে ধরা দিইনে তার সামনে বিব্রত বোধ করি বলে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব স্ফুর্তি পায় না ভেবে। এসব অবশ্য আত্মপ্রত্যয়হীন সাধারণের আচরণ, যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ম্লান হল ভেবে সর্বক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত। এরা বাইরে ভীরু আর অন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী। এ নিষ্ক্রিয় দ্বন্দ্বভাব তাদের মনের বিকৃতি ঘটায়। মনুষ্যত্বের সহজ বিকাশ এর ফলেই রুদ্ধ হয়। এরা সঙ্কীর্ণমনা, ছিদ্রান্বেষী ও অপচিকীর্ষ। কিন্তু যারা প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, যাদের জীবন-জিজ্ঞাসা আছে, তাদেরকে এ বৃত্তি ভিন্নপথে চালিত করে। যে উচ্চতায় থেকে তারা দুর্বলকে ঘৃণা করবার মৌরসী অধিকার পায়, সে উচ্চতা বজায় রাখবার–পতন রোধ করবার সতর্কতাও তারা এ পথে লাভ করে এবং সমকক্ষের প্রতি হিংসার উত্তেজনা তাদের মনে জিগীষা জাগায় এবং শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনে তাদের প্রবুদ্ধ করে। আর বড়র সমকক্ষ হবার প্রেরণাও খুঁজে পায় তারা। এই প্রতিক্রিয়াকে ইংরেজিতে incentive বলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়–প্রতিযোগিতাই (competative spirit) হচ্ছে এদের স্বভাব। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও পাথেয় এরা সহজেই খুঁজে পায়।
.
০২.
আগের যুগে মানুষের শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ ছিল না। চিন্তা বলতে অন্নচিন্তা আর তত্ত্ব বলতে অধ্যাত্মতত্ত্বই তাদের পরিচিত ছিল। জীবনকে–জীবন-সমস্যাকে তলিয়ে দেখবার, মানুষের বৃত্তি প্রবৃত্তিকে যাচাই করে খুঁটিয়ে বুঝবার গরজ বোধ করত না সাধারণে, সে সাধ্য তাদের ছিল না। তারা ছিল মোটা কথা আর স্কুল প্রয়োজনের মানুষ। ভবলীলা বলত বটে, কিন্তু জীবনলীলা জানত না, বুঝত কেবল জীবনে নিয়তির লীলা। পাপ-পুণ্য চেতনা তীব্রতর ছিল সত্য, কিন্তু পাপ-পুণ্যের সূক্ষ্ম সীমারেখা চিনত না।
তাই তাদের জীবনে সারল্য ছিল, স্থূলতা ছিল, আদর্শবাদও ছিল–ছিল না কেবল সূক্ষ্ম জীবনচেতনা যা দিয়ে ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, লাভ-ক্ষতি যাচাইয়ের নতুনতর মাপকাঠি তৈরি করা যায়। তাদের জীবন ছিল অনুভূতি ও অনুসৃতি নির্ভর। তারা ছিল বাধা-পথের যাত্রী, নিয়মের পূজারী এবং পীর ছিল তাদের দিশারী। ডানে-বাঁয়ে পা ফসকে গেলেই মানুষ হারিয়ে যেত, নৈতিকমানে তলিয়েও যেত। আমরা সাধারণ মানুষের কথা বলছি; অসামান্য ব্যক্তি চিরকালই স্বতন্ত্র, কাজেই তাদের কথা আলাদা।
.
০৩.
সেকালে মানুষের চলনে-মননে-কথনে মত বলতে একটিই ছিল–ধর্মমত। মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যবহারিক ও আচারিক জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হত ধর্মমতের দ্বারা। কাজেই সে-যুগে মতান্তর ছিল মারাত্মক ব্যাপার। মতান্তর মাত্রই মনান্তর, ফলে তা ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত সঙ্কুল। মত প্রীতি এ-যুগেও কম নয়, কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষার ফলে পরমতসহিষ্ণুতা এসেছে অন্তত প্রচুর বেড়েছে। সে-যুগে এটিই ছিল প্রায় অজ্ঞাত। ফলে মতান্তর দ্বন্দ্বপ্রবণতায় ইন্ধন যোগাত। আর তাতেই স্বমতের হলে মেহেরবান আর ভিন্নমতের হলে দুশমন ঠাওরানো হত। এ যুগে এর কিছুটা উন্নতি হয়েছে, স্বমতের হলে মিত্র ভাবি বটে, কিন্তু ভিন্নমতের হলেই শত্রু মনে করিনে।
Animism-এর আমলের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যেই ঐক্যবদ্ধ সমাজসৃষ্টির প্রয়াসে অভিন্ন স্রষ্টা ও উপাস্যের নামে মতাদর্শের অভিন্নতার ভিত্তিতে মানবিক ঐক্য, সহযোগিতা ও প্রীতি স্থাপনের পন্থা হিসেবে চিন্তাশীল মানুষ উদ্ভাবন করলেন ধর্মের। কাজেই–ধর্ম এল মানুষের স্বস্তি-শান্তির জন্যে, সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার গরজে। সব মানুষ একমত হতে পারল না। তাই সৃষ্টি করে চলল তাদের পছন্দমতো নানা ধর্ম। বাধল সংঘাত। কারণ পরমতসহিষ্ণুতা ছিল না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মের নামে কত রক্তনদী বয়ে গেছে তার হিসেব নেই। বর স্বরূপ যা কামনা করা হয়েছিল, এভাবে তা শাপে পরিণত হল। এ যুগের আগে ধর্মমতই ছিল মানুষের শঙ্কা ও ত্রাসের কারণ। চোর-ডাকাতের ভয়ে ধনী যেমন সদা-শঙ্কিত, সংখ্যালঘু দুর্বলও তেমনি থাকত সতত সন্ত্রস্ত। ধর্মমতই ছিল জাতি নির্ণয়ের নিরিখ। এ কারণে শুধু-যে জাতীয় জীবনই বিপন্ন হত, তা নয়; ব্যক্তিজীবনও নিরঙ্কুশ ছিল না। কেবল কী তা-ই, একই ধর্মাবলম্বীর বিভিন্ন শাখায়ও লেগে থাকত হানাহানি। মানুষের চরম কাম্য হচ্ছে নির্ঘ-নির্বিঘ্ন জীবন অর্থাৎ শান্তি। তারই উপায়স্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র। আশ্চর্য, এ সবই হয়ে উঠল মানুষের কাল। এদের পেষণে মানুষ হারিয়েছে দিশা–জীবনের সহজ ও স্বাভাবিক স্ফূর্তির পথ।
স্থূলবুদ্ধির স্বধর্মের প্রতি আত্যন্তিক প্রীতি পরমত-অসহিষ্ণুতা তীব্র করে ও অর্থহীন অভিমান বাড়ায়। স্বাতন্ত্রবোধ তারই সন্তান। অন্ধ-অনুকৃতিকে সে স্বকীয়তা মনে করে, আর সে-স্বকীয়তার মহিমায় নিজেকে গরীয়ান ভাবতে তার ভালো লাগে। রক্ষণশীলতার জন্ম এখানেই। আর স্বাতন্ত্রকামী রক্ষণশীলের জাতিবৈর না থেকেই পারে না; কেননা আত্মরতি মাত্রই পরপ্রীতির পরিপন্থী। অতএব স্বাতন্ত্র্যবোধ জাতিবৈর জাগায়, আর জাতিবৈর স্বাতন্ত্র্যবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র করে। এর আর একটি আত্মধ্বংসী দোষ-এ মন গ্রহণ করতে পারে না; সত্য, শিব ও সুন্দরকে বরণ করতে জানে না। এ অবস্থায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন ও মন মোহগ্রস্ত থাকে। তাই পরমতের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হয় না। ভালো-মন্দ যাচাই করা চলে না, ফলে আত্মপ্রসার হয় না, আত্মক্ষয়ই তার পরিণতি। কল্যাণ-বুদ্ধিই তার জাগে না। আত্মসংকোচনে নিজেকে দুর্বল করে করে একসময়ে সে অপমৃত্যুই ডেকে আনে। ভয় আছে অথচ হিতবুদ্ধি নেই, তাই বর্জনই তার আদর্শ। নতুনকে– কল্যাণকে এভাবে বর্জন করেই সে হয় দেউলিয়া, জীবন-রসের ঘটে অভাব, ফলে সমাজ-দেহ যায়। ধসে, জাতীয় জীবন হয় বানচাল।
.
০৪.
অবস্থান্তরে এর আর একটি প্রতিক্রিয়া বা রূপও দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে একে উদার ও মহিমময় বলে মনে হয়। একই গোত্রের বা গোষ্ঠীর একটা অংশ যখন ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে, তখন তারা পরস্পর বিজাতি হয়। ফলে মন-মননের যোগসূত্র হয় ছিন্ন। পৈত্রিক-ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, জ্ঞাতিত্ব অস্বীকার এবং জাতীয় ঐক্য বিনষ্টি ধর্মান্তরের অনিবার্য ফল।
স্বধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকারের গরজ বোধ করে সে। সনাতনীর আভিজাত্যবোধ আর নতুনের উত্তম্মন্যতা পারস্পরিক অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অসহিষ্ণুতা ও দ্বন্দ্বপ্রবণতার ফলে সংঘাতও অনিবার্য হয়ে উঠে। এর আভাস পাই আর্য ইতিকথায়। পণ্ডিতের মুখে শোনা যায়, প্রাচীন ইরানে একসময়ে আর্যরা বাস করতে থাকে। ধর্ম ব্যাপারে একদা তাদের দ্বিমত দেখা দেয়। একদলের ইষ্ট দেব অপর দলের দুশমন দেও হয়ে উঠে। এ দলের শত্রু অসুর ও দলের দেবতা অহোররূপে পূজা পায়। তাই হয়তো শুরু হল লড়াই। পরাজিত দলই বাস উঠিয়ে দিয়ে নতুন বাস্তুর খোঁজে ভারতে আসে। এভাবে কিংবা ধর্মান্তরের ফলে যখন দেশ একধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত হয়, তখন নয়া ধর্মমতবাদীরা বিধর্মী পূর্বপুরুষের জ্ঞাতিত্ব কিংবা মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকার করে না, বরং সাদরে ও সাগ্রহে বরণ করে নেয়। এ কারণেই মুসলিম আরব হাতেমতাই, নৌফেল, ইমরুল কায়েস প্রভৃতির ঐতিহ্যগবী। ইরান শাহনামায় নিজেকে খুঁজে পায়। পারস্যের বাদশাহ আজ ইরানের শাহ, আরীয় মেহের ও পহলবী। আর ভারতের সনাতনীরা যে নয়াধর্মকে (বৌদ্ধধর্মকে) একদা গ্রাস করে, সেই ধর্মের দেব-দ্বিজ ও বেদ্বেষী অশোক ও তাঁর বৌদ্ধধর্মচক্রকে তারা জাতীয় মহিমা ও ঐতিহ্যের প্রতীক বলে সগর্বে বরণ করে নিয়েছে। অথচ আমরা জানি অশোক ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি সদয় ছিলেন না; তিনি বলিদান রহিত করে ধর্মাচরণে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বৌদ্ধ-রাজত্বে জীবহত্যা নিষিদ্ধ ছিল বলে ভারতবাসীরা আমিষ ভোজন প্রায় ভুলে গিয়েছিল। বাঙলার বাইরে বর্ণহিন্দুর নিরামিষপ্রীতি বৌদ্ধযুগের সেই ধকলের সাক্ষ্য বহন করছে। আর সে-যুগে বৌদ্ধে-ব্রাহ্মণ্যবাদীতে মারামারিও কিছু মাত্র কম ছিল না।
প্রতিপক্ষতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই হানাহানির উৎপত্তি। আর হানাহানি থাকলে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগবেই। (পাকিস্তান-পূর্ব যুগে হিন্দুদের বিলেতী পোশাক ও সংস্কৃতি বর্জন আর মুসলমানদের ধুতি বর্জন এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়)। এক্ষেত্রে যে-কোনো এক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের বিলুপ্তিতে বিদ্বেষ ও বিক্ষোভজাত চিত্ত-বিকৃতির উপশম হয়। সহজ কথায় বলা যায়, এ হচ্ছে প্রতিবেশী সুলভ হিংসা ও হানাহানি। প্রতীচ্য দেশীয়রা আমাদের প্রতিবেশী নয়, তাই তাদের সংস্কৃতি গ্রহণে আমাদের গ্লানিবোধ নেই। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর প্রতিবেশী, তাই এখানে গ্রহণ-বরণ চলে না, বর্জনাদর্শই বজায় রাখতে হয়। কল্পনা করা যাক পাক-ভারতের সবাই মুসলমান হয়ে গেছে, তখন রামায়ণ মহাভারত মুসলমানদের জাতীয় মহিমার প্রতীক হবে, প্রতাপ-শিবাজী হবেন জাতীয় বীর।
আমি একবার ইসলামে দীক্ষিত এক ব্যক্তির মুসলিম পৌত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলোম– মুঘলেরা হলেন বিদেশী, আর প্রতাপ-শিবাজী হলেন দেশী লোক; এঁরা যদি আজকের আমাদের ইংরেজ তাড়ানোর মতো মুঘলকে তাড়াবার সাধনা করে থাকেন, তবে আমাদের সহানুভূতি তাঁদের প্রতি থাকা উচিত নয় কি? সে এ-কথার দুটো উত্তর দিয়েছিল। প্রথমটা দিয়েছিল তর্কের খাতিরে, আর দ্বিতীয়টা ছিল তার মনের কথা। সে বলেছিল–প্রতাপ-শিবাজীও তো এককালের বিদেশীর বংশধর। আর প্রতিবেশী বা জ্ঞাতির চেয়ে বিদেশী আত্মীয় প্রিয়তর। মুঘলেরা ধর্মসূত্রে আমাদের আত্মীয়-আমাদের ভাই। এ-কথার উপর তর্ক চলতে পারে, কিন্তু এটি হচ্ছে জীবনে অনুভূত ও পরীক্ষিত সত্য। কাজেই হৃদয়ের স্পর্শহীন মগজপ্রসূত যুক্তিপ্রয়োগ নিরর্থক। সত্যেন দত্তের আমরা বাঙালি কবিতায় বাঙলার কোনো মুসলিম-ঐতিহ্যের উল্লেখ নেই দেখে, এক হিন্দুবন্ধুকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলাম-ঈসা খান তো হিন্দুর বংশধর, চাঁদ-প্রতাপের সঙ্গে তাঁর নামটি অন্তত উল্লেখ করা যেত। তিনি উত্তরে বলেছিলেন–মুসলমান হয়ে গেল যখন, তখন তো আর আপন ভাবা যায় না। আমরা জানি এর উপর আর কথা চলে না।
অতএব দেখা গেল, এই প্রীতিহীন অনাত্মীয়ভাব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতিবেশিকতারই ফল। তেমনি প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে তথা বিলুপ্তিতে বিধর্মী পূর্ব-পুরুষের মহিমামুগ্ধতা এবং ঐতিহ্যগর্বও অপর একধরনের সংকীর্ণচিত্ততা ও বিকৃতি প্রসূত। বাহ্যত একে শুভ ও শোভন মনে হলেও এও চিত্ত-প্রসারের অভাবজাত। কেননা এ ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার পশ্চাতে রয়েছে আদিম গোত্র-প্রীতি। মধ্যযুগে এ মনোভাব উদার-হৃদয় ও উন্নত মননের পরিচায়ক বলে অভিনন্দিত হতে পারত। কিন্তু এ-যুগে নয়। কারণ এ মনোভাবই এ-যুগের কাল–স্বস্তি-শান্তির শত্রু ও মানবতার দুশমন।
.
০৫.
এক হিসেবে বলতে গেলে আধুনিক যুগের সঙ্গে আগের কালের কোনো পারম্পর্য বা জ্ঞাতিত্ব নেই। এ যুগ শিক্ষিতের, যুক্তির ও বিজ্ঞানের। এ-যুগের জীবনের ভিত্তি বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞান–যুক্তি (Rationality) এর অস্ত্র, আর বিজ্ঞান এর বাহন। এ-যুগ গণতন্ত্রের। কাজেই আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা যৌক্তিক জীবনের (Rational life) অধিকারী–এই মৌলিক স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতন্ত্র চলতে পারে। এর আনুষঙ্গিক অঙ্গীকার রইল–আমাদের জীবনের ভিত্তি জ্ঞান, সম্বল যুক্তি আর বাহন বিজ্ঞান। নানা ধর্ম ও জাতি অধ্যুষিত এবং মতবাদ আকীর্ণ আজকের রাষ্ট্রে স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর গুরুতর অপরাধ। আজকের জাতীয়তা রাষ্ট্রভিত্তিক হতেই হবে। নইলে কল্যাণ নেই। নিজেদের এ বোধের অভাবেই জার্মানিতে ইহুদীরা নির্যাতিত হয়েছিল। আমরা জানি ক্ষতিস্বীকারের শক্তিতে মনুষ্যত্বের প্রকাশ এবং বরণ করার ক্ষমতাতেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আমাদের জীবনচেতনা অনায়াসলব্ধ নয়, সাধনা-সাধ্য। পরিচর্যা করেই জীবনবৃক্ষে ফুল ফোঁটাতে, ফল ফলাতে আর রূপ চড়াতে হয়। জীবনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সহিষ্ণুতার ও উদারতার, প্রীতির ও কল্যাণ বুদ্ধির।To know all is to pardon all. এই বোধ না জাগলে এ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুগে সমাজে স্বস্তিতে বাস করা যাবে না। এ-যুগ মতবাদ পেশ করবার বা placing-এর যুগ–চাপানোর বা প্রচারের (preaching) কাল নয়। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই তা বোঝা উচিত। শুধু কী তাই! এ যুগ মিলনের আর মিলানোর এবং দেওয়ার আর নেওয়ার যুগ। তাই স্বরাষ্ট্র ও স্বাজাত্যে সন্তুষ্ট থাকা যায় না– আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছাও জাগিয়ে তুলতে হয়। কেননা রাষ্ট্রিক স্বাজাত্যবোধই হচ্ছে আজকের মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক কল্যাণ সাধন করা প্রয়োজন হয়। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠে। আর রাষ্ট্রিক কল্যাণের গরজেই আন্তঃরাষ্ট্রিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে উঠে। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সতর্কবাণী-মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো, বাঁচতে দাও; ভালো হও, ভালো চাও–এ যুগের চরম দাবী এ-ই। কেননা এ-পথেই পরম স্বস্তি ও শান্তি। আমরা আশাবাদী। মানুষের স্বাভাবিক ও পরিশীলিত মহত্ত্বে আমরা আস্থাবান। সেদিন হয়তো দূরে নয়, যখন বিশ্বমানবিকতা-বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ এক বিশ্বে এক রাষ্ট্রের অর্থাৎ বিশ্ব-রাষ্ট্রের ধ্বনি তুলবে।