জীবনবোধ ও সংগ্রাম

জীবনবোধ ও সংগ্রাম

মানুষের যাযাবর বৃত্তি আমাদের কৌতূহল জাগায়, আকৃষ্ট করে, এমনকি বিস্মিত করে অনেক সময়। অথচ জীবের চলমানতা একটি স্বাভাবিক বৃত্তি। তবু যে এটি আমাদের আকৃষ্ট করে, তার কারণ হয়তো এই বাহ্য-পরিচয়ের গভীরে একটি প্রবল উদ্ভিদ-স্বভাব রয়েছে আমাদের যাকে ঠিক জড়তা বলা চলে না। উদ্ভিদ যেমন সজীব হওয়া সত্ত্বেও মাটি বা জল আঁকড়ে হতে চায় দৃঢ়মূল ও নিশ্চল, প্রাণীজগতেও আমরা তেমনি দেখতে পাই স্থায়ী নিবাসের তীব্র আগ্রহ। মানুষের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যও এই নিশ্চিন্ত স্থায়িত্বকামী মনের আকাক্ষাপ্রসূত। আমরা কেবল ধরে রাখতে চাই, ভরে তুলতে চাই, হারাতে চাইনে কিছুই, ফেলতে চাইনে ভালোলাগা কিছুকেই। আমাদের অমরত্ব কামনার উৎসও এখানেই। আত্মার চিরন্তনত্বের ধারণাও গড়ে উঠেছে এই আত্যন্তিক স্থায়িত্ব কামনা থেকেই। জীবের সন্তান কামনা এই স্থায়িত্ব-লোভ তথা অমরত্ব বাঞ্ছার বিকল্প রূপ।

এ কারণেই কোনো বস্তুর দীর্ঘস্থায়িত্বের সম্ভাবনা না থাকলে আমরা উৎকণ্ঠা কিংবা অশ্রদ্ধা পোষণ করি মনে মনে। ভারতীয় বৌদ্ধমত ও মায়াবাদ এই উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি ও অশ্রদ্ধারই অভিব্যক্তি। এজন্যেই জানা অতীত ও নিশ্চিত বর্তমানের প্রতি আমাদের এত আস্থা ও আকর্ষণ, আর অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতি শঙ্কিত দৃষ্টি। পুরোনো-প্রীতি ও নতুন-ভীতির মূল এখানেই। তাই আমাদের জীবন-সাধনা তথা জীবনে সাধ্য হচ্ছে স্থায়িত্ব, নিশ্চয়তা ও নির্ঘাকি নির্বিঘ্নতা। এ-ই হচ্ছে মানুষের তথা জীবের সচেতন জীবন-প্রচেষ্টা। আর অবচেতন আকাঙ্ক্ষা যার নাম দেয়া যায় ঔৎসুক্য হচ্ছে নতুনকে চাওয়া ও পাওয়া। যাযাবর বৃত্তির মধ্যে এই নতুন প্রীতি তথা adventure-প্রবণতাই ক্রিয়াশীল। আমাদের অবচেতন-লোলুপতা যাযাবর তথা বেপরওয়া জীবনের পরিপোষক। তাই জীবনের স্বরূপ–সুনিশ্চিত ও স্থির-লক্ষ্য জীবন-প্রচেষ্টায় রূপায়িত কিংবা অনিশ্চিত দ্বান্দ্বিক জীবন-জিজ্ঞাসায় প্রকটিত, তা এককথায় বলা যায় না নিঃসংশয়ে।

তবে বাহ্যত নিশ্চিত আশ্রয় সন্ধান জৈবধর্ম হলেও মানুষের অন্তরতম প্রদেশে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত-প্রীতি রয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। আমরা দেখছি, মানুষের মধ্যে যে সহজ প্রাণশক্তির অধিকারী ও যে আত্মপ্রত্যয়শীল, সে আত্মপ্রসারে উনুখ ও উদ্যোগী। আত্মপ্রসার করতে চাইলেই নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত জীবনে স্বেচ্ছায় বরণ করতে হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে, নিতে হয় বাঁচামরার ঝুঁকি। যেমন, রাজা সুখে রাজ্য করছেন হঠাৎ তার বুকে জাগল আত্মশক্তি সম্বন্ধে দৃঢ়প্রত্যয়, মাথায় চাপল সে-শক্তি প্রকাশের খেয়াল। তাকে ঘাড়ে ধরে চালিত করে পর নিপীড়নের ভূত। বাঁচা-মরার ঝুঁকি নিয়ে বিচিত্র উল্লাসে তিনি চালান অভিযান। আত্মশক্তিতে আস্থা এবং অপরের দুর্বলতার সন্ধানই তার কাছে আত্মবিস্তারের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। সে-সুযোগ তাকে নামায় দ্বন্দ্বে ও সংঘাতে! কাজেই সংগ্রামে সামর্থ্যই তাঁর মতে সুযোগ। সংগ্রামই তাঁর কাছে জীবন-প্রচেষ্টা, সংঘাত সৃষ্টিই জীবন-সাধনা; জয়েই জীবনের উল্লাস, বিকাশ ও বিস্তার; সাফল্যেই স্বপ্রতিষ্ঠা ও সার্থকতা। আর দ্বন্দ্ব-ভীরু সাধারণ মানুষের কাছে সুযোগ মানে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতি। সাধারণ মানুষের এ পরিচয়-যে জীবনের ও প্রাণধর্মের বিকৃতরূপ, তার প্রমাণ মেলে আমাদের খেলায় ও সাহিত্যে।

খেলা মানেই কৃত্রিম দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম। প্রিয়-পরিজন নিয়েই খেলি আমরা। তাদেরই প্রতিপক্ষ করে সংগ্রাম করি আত্মপ্রতিষ্ঠায়। তাই হার-জিতে উপভোগ করি আনন্দ-বেদনা। খেলা অবসর বিনোদনের উপায়রূপে উদ্ভাবিত। কাজেই এ একান্তভাবে আনন্দের উপকরণ। তেমন উপকরণের স্বরূপ হচ্ছে দ্বন্দ্ব তথা প্রতিপক্ষতা, সহজ কথায় বিরোধ সৃষ্টি। মানুষের অবসর বিনোদনের আর একটি অবলম্বন হচ্ছে সাহিত্য। খেলা ও সাহিত্য একই প্রয়োজনে দু-কোটির সৃষ্টি। রূপকথার দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। রাজপুত্তুর যদি অনায়াসে রাজকন্যে লাভ করে, তাহলে হতাশ হই আমরা। যেন রাজকুমারের যোগ্য হল না কাজটা। তাই তার পায়ে পায়ে বাধা, পথে পথে শুক্র। তাকে সাত সমুদ্দরে পাড়ি জমাতে হয়, তেরো নদী পার হতে হয়, আরো অতিক্রম করিতে হয় গিরি-মরু কান্তার। সে-পথে সাপ, বাঘ, দেও, জীন, যক্ষ-রক্ষঃ হয় বৈরী, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী হয় সহায়। তাই তো কুমারের সাফল্যে আমাদের এত উল্লাস, এত তৃপ্তি। এজন্যেই তো সার্থক ট্র্যাজেডির নায়ক আমাদের এত প্রিয়। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতমুখর সাহিত্যের এত কদর।

অতএব, সংগ্রামই জীবন। তাই দুর্বল মানুষ কৃত্রিম সগ্রামেই জীবনের চরিতার্থতা খোঁজে। ভীরুহৃদয়ের ভিখারী পিপাসা পর-পরাক্রমে মিটিয়ে নিয়ে সে লাভ করতে চায় আত্মপ্রসাদ। কাজেই নিশ্চয়তার প্রশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়প্রীতি মানুষের স্বভাব নয়– স্বভাবের বিকৃতি।

তাই অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম অথবা জীবনযুদ্ধ কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়। কেননা ব্যঙ্গ্যার্থে জীবনই সংগ্রাম, অন্যকথায় সংগ্রামের মধ্যেই জীবন-রস নিহিত। এজন্যেই জীবন-রস রসিকের সগ্রামী না হয়ে উপায় নেই। আটপৌরে ব্যবহারে কথাটি বাচ্যার্থে তুচ্ছ এবং শব্দটির ব্যঙ্গ্যার্থ প্রায় লোপ পেয়েছে বটে কিন্তু এ কথাটি যতদিন আমরা স্বরূপে ও সদর্থে উপলব্ধি না করব, ততদিন জীবনের সত্যকার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে আমাদের।

সাধারণভাবে চিন্তা করলেও দেখতে পাব, প্রতিকূল পরিবেশ ও শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হয়েই জীবন-পথে এগিয়ে চলি আমরা। মাথায় চুল বাড়ে, হাতে-পায়ে গজায় নখ, মুখে জন্মায় দাড়ি–এসব অস্বস্তিকর প্রতিকূলতা যেমন জয় করি সুকৌশলে ও সুপরিকল্পিতভাবে, তেমনি রোদ বৃষ্টি-শৈত্যেও করে নিতে হয় আত্মরক্ষার সুব্যবস্থা। এসব আজ তুচ্ছ বটে; কিন্তু একদিন এসব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ছিল মানুষের বহু চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টার কারণ। এমনি করে প্রতিকূলতার সঙ্গে সগ্রাম করে আজকের স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য, যোগ্যতা ও প্রভুত্ব অর্জন করেছে মানুষ।

কাজেই সম্মুখগতি মানেই প্রতিকূল পরিবেশে চলার পথ করে নেয়া। আর এগিয়ে যাওয়া মানেই নতুনকে পাওয়া, বরণ করা, কিংবা জয় করা। তাই নতুন-ভীতি মাত্রই জীবনবিমুখতা। কোনো পুরোনোই পারে না নতুন দিনের পুরো চাহিদা মেটাতে। নতুন যদিবা অশ্চিয়তার মরু হয়, তবে পুরোনো নিশ্চিতই মরীচিৎকার মায়া। তাহলে মরীচিৎকার পিছু ধাওয়া নয়, মরু-উত্তরণের সাধনাই হওয়া উচিত কাম্য। আসলে কোনো নতুন ভাব, চিন্তা বা বস্তু মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসেনি। নতুনই তো চিরকাল এগিয়ে দিয়েছে মানুষের মানস-সংস্কৃতি ও ব্যবহারিক সভ্যতা। অতএব আমরা যে কেবল নতুন ভাব, চিন্তা ও আদর্শ গ্রহণ করব, তা নয়; নতুন দিনে সাহস ভরে মাথা পেতে নেব অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি। নইলে জীবনের প্রসাদ থেকে, জীবনের উল্লাস-রস থেকে থাকব বঞ্চিত। এই জীবনচেতনা, এই জীবন-রস-রসিকতা, এই জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়েই নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে সাড়া দেব সর্বপ্রকার নতুনের ডাকে। সুস্থ ও স্বস্থ জীবন মাত্রই বহতা নদী।

পুরোনো দিনের অবসানে নতুন সূর্যের উদয়ে কেবল বিকৃতবুদ্ধি ও দুৰ্বলচিত্ত ব্যক্তিই মিয়মাণ হয় হারানোর বেদনায়, পাণ্ডুর হয়ে উঠে মৃত্যুর বিভীষিকায়। তারই পড়ে দীর্ঘশ্বাস; সে-ই কেবল বলে দিন গেল। আর যে প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, সে মনে জানে দিন এল। একটার পর একটা দিন আসে, আর সে ভাবে এ বুঝি নতুন জীবনের তোরণে উত্তরণ।