মারণাস্ত্র – ৯

নয়

মে নয়-দশ।

ঝোপ থেকে হেনরি লিনফোর্ডকে সাবধানে সরিয়ে নিল রানা। ওকে শোয়াল সমতল মাটিতে। আঘাত খুব বেশি লাগেনি। ফলে, সামান্য পরেই চোখ মেলল লিনফোর্ড।

ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল রানা, ‘কথা বলবেন না, ওরা শুনে ফেলতে পারে। আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। তারপর না হয় রওনা দেয়া যাবে।’

আধ ঘণ্টা পরে পাহাড়ের ওপরে উঠে এল রানা আর লিনফোর্ড। লিনফোর্ড খানিকটা খোঁড়াচ্ছে। রানা হাঁটতে সাহায্য করছে তাঁকে। একটা নদী পড়ল পথে। মাথা ধুয়ে নিল লিনফোর্ড। পকেট থেকে দোমড়ানো ক’টা সিগারেট বার করে একটা অফার করল রানাকে। রানা নিল না।

‘ডক্টর,’ বলল লিনফোর্ড। ‘ব্যাপারটা বোধহয় খোলসা করা উচিত।’

মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘হ্যাঁ। এবার বলুন তো আমার ওপর হামলা করলেন কেন?’

‘ভেবেছিলাম আপনি ওখানে কাজ করেন। কর্মচারী। আমাকে দেখে ফেলেছেন। তাই মার খাওয়ার আগেই মার দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম।’

‘আমারও একই কেস,’ স্বীকার করল রানা।

‘ডক্টর, ওখানে হচ্ছেটা কী জানেন?’

এক মুহূর্ত ভাবল রানা।

‘পরে আলাপ করব।’

‘ঠিক আছে, চলুন।’

শহরের প্রান্তে যখন পৌছল ওরা তখন অন্ধকার ঘনিয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা একটা রেস্তোরাঁয় চলে গেল ওরা। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে দু’জনেরই। খাওয়া সারার আগ পর্যন্ত মুখ খুলল না কেউ। তারপর সিগারেট ধরাল লিনফোর্ড। হেলান দিল চেয়ারে।

‘ডক্টর, আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন।’

‘বলুন, মিস্টার লিনফোর্ড,’ বলল রানা।

‘গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের স্বার্থ আর আপনার স্বার্থ নিশ্চয়ই এক নয়?’

‘ঠিকই ধরেছেন।

‘ফাইন।’

পকেট হাতড়ে পাসপোর্ট আর ট্রিবিউন প্রেস কার্ড বার করল লিনফোর্ড।

‘এগুলো দেখার পর আর কোন দ্বিধা থাকবে না আশা করি। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। এবার বলছি শুনুন। সপ্তাহ তিনেক আগে আমাদের বুখারেস্ট প্রতিনিধি রিপোর্ট করেছে। জানিয়েছে, এ দেশে নাকি অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। গোটা দুয়েক বিশাল বিস্ফোরণ হয়েছে। এতই প্রচণ্ড সেগুলো যে সলিড পাথরেও প্রায় দুশো মিটারের মত গর্ত তৈরি হয়েছে। আর বিস্ফোরণগুলো ঘটেছে লোকালয়ের বাইরে। তা ছাড়া ইদানীং হঠাৎ করেই মিলিটারি এক্সারসাইজ শুরু হয়েছে; সেনাবাহিনীর বেতনও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

‘তো, আমাদের পত্রিকার ধারণা এখানে একটা কিছু ঘটবে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, ধারাবাহিক একটা আর্টিকেল লেখার জন্যে।

‘প্রথম যেটা খটকা লেগেছে আমার সেটা হচ্ছে মিনস্কির মৃত্যু। কাউন্টেস ক্যারেনিনা এখানকার গভর্নমেন্ট, তারই তো বন্ধু ছিল মিনস্কি। ওকে কেন খুন করা হলো? লেকের পাশে নতুন যে ফ্যাক্টরিটা হয়েছে সেটার দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিল তার। কেউ অবশ্য জানে না কী তৈরি করা হবে ওখানে। আমার ধারণা, আর্মস। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের আগ্রহও আমার ধারণাকে সমর্থন করে। গানস অ্যাণ্ড রিস কি ইক্সানিয়ায় আর্মস বিক্রি করছে? ঘুষ দিয়ে জানতে পেরেছি, করছে না।

‘আরও জানতে পেরেছি ‘রেড শিল্ড সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন আছে, আর্মি অফিসারদের। মিনস্কি এবং আরও অনেককেই নাকি খুন করেছে তারা। তা ছাড়া, উপত্যকার গুপ্ত ল্যাবোরেটরির খোঁজও পেয়ে গেছি। আজ ওখানে গিয়েছিলাম আড়ি পাততে, তা আপনি তো তার আগেই শুইয়ে দিলেন মাটিতে।’

‘আপনার কথার মাঝখানে একটু বাধা দিচ্ছি, মিস্টার লিনফোর্ড, বলল রানা, ‘এতসব কথা আপনি জানলেন কীভাবে?’

‘কপালের জোরে। ইয়াং ওয়ার্কার্স পার্টির নাম শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘পার্টিটা চালায় আলেন্দে নামে এক নেতা। রয়্যালিস্ট সরকারের আমলে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয় তাকে। সে চলে গিয়েছিল নিউ ইয়র্কে। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। আলেন্দে সোশ্যালিস্ট। শ্রমিকদের দুরবস্থায় খেপে গিয়েছিল সে, আন্দোলন শুরু করেছিল। ফলে, নির্বাসন। দেশকে রিপাবলিক ঘোষণার পরে ফিরে আসে আবার। তবে তার মতে এখানকার অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ। এখানে পৌছেই দেখা করেছিলাম তার সঙ্গে। প্রচুর সাহায্য করেছে সে। বিশেষ করে মিনস্কির ব্যাপারে অনেক কিছু জানিয়েছে।’

আরেকটা সিগারেট ধরাল লিনফোর্ড।

‘আপনি বোধহয় ভাবছেন ইক্সানিয়ার নিজস্ব ব্যাপারে ট্রিবিউন এত আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন।’

‘ঠিক।’

‘আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে ইক্সানিয়া।’

‘ওদের টাকার খুব দরকার,’ সায় জানাল রানা।

‘জানি। কিন্তু কেন?

‘ফুড ফ্যাক্টরি বানাবে।’

লিনফোর্ডকে দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। সামনে ঝুঁকল রানা।

‘খাবার,’ ধীরে বলল ও। ‘মিষ্টি তৈরি করবে, মিস্টার লিনফোর্ড। এমন মিষ্টি বানাবে ওরা যাতে শক্ত পাথরে দু’শো মিটার গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়। ওদের বানানো মিষ্টি লাখে-লাখে মানুষকে মারবে।’

ভ্রূ কুঁচকাল লিনফোর্ড।

‘আপনি বোধহয় আমার চেয়ে অনেক বেশিই জানেন, ডক্টর। আমাকে বলতে আপত্তি আছে?’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল রানা। তারপর মনস্থির করে নিল।

‘বলতে পারি, তবে আপনি যদি সাহায্য করবেন বলে কথা দেন।’

ভ্রূ কুঁচকে কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভাবল লিনফোর্ড। তারপর বলল, ‘যদ্দূর সম্ভব আমরা দু’জন একই লাইনে চিন্তা করছি। ঠেকাতে হবে ওদের। ঠিক আছে, ডক্টর, আছি আপনার সঙ্গে।’

‘প্রথম কথা হচ্ছে, আমি ডক্টর পাশা নই।’

‘বলেন কী!’ অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল লিনফোর্ড।

‘ঠিকই বলছি।’ সব কথা খুলে বলল রানা। জানাল, আসলে সে বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এজেণ্ট। তার নাম মাসুদ রানা। কীভাবে ডক্টর পাশা তাকে খুঁজে বার করে এ কাজের দায়িত্ব চাপালেন; নিজের পাসপোর্ট, জামাকাপড় ধার দিয়ে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার প্রস্তাব দিলেন-একে-একে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল।

পাথরের মূর্তির মত বসে রয়েছে লিনফোর্ড। দু’চোখে অবিশ্বাস। ‘প্রমাণ দিতে পারবেন?’

‘এই যে, ডক্টরের পাসপোর্ট আমার কাছে,’ দেখাল রানা। পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল লিনফোর্ড।

‘কোন সন্দেহ নেই, এটা ডক্টর পাশার পাসপোর্ট। কিন্তু এতে কি প্রমাণ হলো আপনি ডক্টর পাশা নন?’

‘কী প্রমাণ পেলে আপনি বিশ্বাস করবেন?’

‘তাঁর লেখা কোন চিঠি বা কিছু।’

‘হাতের লেখা চিনবেন?’

‘একশোবার। তাঁর নিজ হাতে লেখা আর্টিকেলটা তো আমিই প্রেসে দিয়েছিলাম।

ক’সেকেণ্ড ভাবল রানা। লিনফোর্ডের সাহায্য তার দরকার, যেভাবেই হোক। হাসল ও। ‘অপেক্ষা করুন। আমি তাঁর লেখা চিঠি নিয়ে আসছি। একটু হোটেলে যেতে হবে।

বেরিয়ে গেল রানা। খানিকটা হেঁটে গিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানে ঢুকে পড়ল। এক টুকরো কাগজ কিনে নিয়ে লিখল:

‘প্রিয় মাসুদ রানা,

আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি যে করে হোক ইক্সানিয়ার সুপার নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর পরিকল্পনা বানচাল করুন। এজন্য আমি আপনাকে আমার পাসপোর্ট এবং আমার ছদ্মবেশ গ্রহণ করার সমস্ত উপকরণ দেব এবং আপনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গা ঢাক দিয়ে থাকব। আশা করি, বন্ধুর এই একান্ত অনুরোধ মানবতার খাতিরে রক্ষা করবেন।

ডক্টর পাশ
২০/৪/৮৮  

দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল রানা। চিঠিটা বাড়িয়ে দি লিনফোর্ডের দিকে। চিঠিটা আগাগোড়া পাঁচবার পড়ল সাংবাদিক তারপর ফিরল রানার দিকে। ‘অবিশ্বাস্য! আশ্চর্য মিল আপনাদের দু’জনের চেহারায়!’

‘তা হলে আমার কথা বিশ্বাস করছেন?

‘হ্যাঁ, তার কারণ আছে,’ বলল লিনফোর্ড। পকেট থেকে একট টেলিগ্রাম বার করে দেখাল। ‘আমার অফিস থেকে এসেছে এটা।’

টেলিগ্রামটা পড়ল রানা। ওটায় লেখা:

পাশা উধাও। রহস্যজনকভাবে। বেশ ক’সপ্তাহ যাবৎ। সম্ভবত মৃত।

‘তো এবার আপনার সাহায্য আশা করতে পারি নিশ্চয়ই?’ জানতে চাইল রানা।

‘অবশ্যই,’ বলল লিনফোর্ড। বাড়িয়ে দিল হাত।