ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ৭

সাত

‘আপনি!’ নেলি খালা চিৎকার ছাড়লেন আবারও, আঙুল তাক করলেন ড. মন্টগোমারির দিকে। ‘আপনি নিজেকে আর্ট এক্সপার্ট দাবি করেন অথচ আপনার জাদুঘরে একটা ছবি উল্টো হয়ে ঝুলছে।’

এসময় আরেক মহিলা উদয় হলেন দোরগোড়ায়। ইনি ড. মণ্টগোমারির সহকারী।

‘আমি দুঃখিত, ডক্টর, ইনি জোর করে ঢুকে পড়েছেন, আমার বাধা মানেননি,’ বললেন তিনি।

‘কে আপনি?’ ড. মন্টগোমারি প্রশ্ন করলেন নেলি খালাকে।

‘আমি আর্ট ভালবাসি, আপনার মত নই! আমি কখনওই কোন মণ্ডিয়ান উল্টো করে ঝোলাব না!’

‘কী বলছেন আপনি? আমাদের এখানে তো কোন মণ্ডিয়ানই নেই!’

অন্য কেউ হলে থমকে যেতেন, কিন্তু নেলি খালা অন্য ধাতুতে গড়া।

‘তারমানে আপনি স্বীকার করছেন মণ্ডিয়ান চেনেন না!’ খেঁকিয়ে উঠলেন।

এসব যখন চলছে, আমার ইচ্ছে হলো গুড়ি মেরে ডেস্কের নীচে লুকোই। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নেলি খালা আমাকে দেখে ফেলেছেন।

‘মুসা, তুই এখানে কী করছিস?’

‘তুমি এই পাগল মহিলাকে চেনো?’ কিউরেটর প্রশ্ন করলেন।

‘জি,’ বললাম। ‘আমি ওঁকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ, ডক্টর মন্টগোমারি। নেলি খালা, চলো যাই।’

আমার জানতেও ইচ্ছে করল না কোন্ ছবিটাকে নেলি খালা উল্টো করে ঝোলানো মন্ত্রিয়ান মনে করেছেন। এমনকী মণ্ডিয়ান কে তাও জানতে চাই না আমি। স্রেফ এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। বাস স্টপে অপেক্ষা করছি, এসময় সাহস জড় করে বললাম, নেলি খালা, তুমি ওভাবে ধেয়ে গিয়ে অফিসে ঢোকাতে লজ্জায় পড়ে গেছিলাম আমি। ডক্টর মন্টগোমারির সাথে ইন্টারেস্টিং আলোচনা করছিলাম।’

‘মুসা, যে লোক আর্টের কদর করে না তার কাছ থেকে তুই কিছুই শিখতে পারবি না।’

কিন্তু নেলি খালা ভুল বলেছেন। ডক্টরের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি আমি এবং তা রবিনকে জানানোর জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছি। বাসায় পৌঁছেই ওকে ফোন করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম শুধু অ্যানসারিং মেশিনের জবাব। মনে হচ্ছে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, পার্কে যখন দেখা হবে দু’জনের।

ডিনারের পর (নেলি খালার স্বাস্থ্যকর রেসিপি সত্ত্বেও বড়, রসাল বীফবার্গার আর বাসায় তৈরি ফ্রাই ছিল), আমার সাবেক কামরায় আলগোছে ঢুকে ক্যামকর্ডারটা নিয়ে নিলাম। এক মুঠো কেবল আর প্যাচ কর্ডও রাখলাম, যদি লাগে। সব কিছু শার্টের নীচে লুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, তারপর একলাফে বাইকে চেপে রওনা দিলাম।

রবিন ইতোমধ্যে পার্কে পৌঁছে গেছে, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর পাশে বাইক নিয়ে যেতেই ভক্ করে একটা দুর্গন্ধ নাকে ঝাপ্টা মারল।

‘গোসল কর না কয়দিন?’ বলে নাক চেপে ধরলাম।

‘গন্ধটা আসছে এখান থেকে,’ বলল ও। ব্যাকপ্যাকটা তুলে ধরল, ‘কিছু সাপ্লাই নিয়ে এসেছি।’

‘খাইছে, ওটা মাটিতে না পোঁতা পর্যন্ত সরিয়ে রাখো।’

আজকের সন্ধেয় কুয়াশা এখনও জমাট বাঁধেনি। সূর্য ঝলসাচ্ছে, তবে ডুবতে বেশি দেরি নেই। অপেক্ষার ফাঁকে রবিনকে জানালাম বিকেলে ক্রিস্টোফার পাইক সম্পর্কে যা যা জেনেছি। ও ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে গা ছমছম করছিল আমার। রবিনকে শিউরে উঠতে দেখলাম যখন বললাম ছবির চোখজোড়া আমাকে মেঝে অবধি অনুসরণ করছিল। একটু পরেই, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ল সূর্য। গোলাপি-কমলা রং ধরল আকাশ। সময় হলো।

‘চলো,’ বলল রবিন। স্টোরেজ বিল্ডিঙের দিকে রওনা হলাম আমরা। এক ব্লক মত গিয়েছি কি যাইনি এসময় অনুভব করলাম কীসে যেন আমার চুল চেপে ধরেছে। ব্রেক দাবিয়ে হড়কে থেমে পড়লাম। রবিনও থেমেছে।

‘কী হলো?’

‘কী যেন আমার চুলে বাউন্স করে গেল,’ বললাম ওকে।

‘আমি তো কিছুই দেখলাম না,’ বলল রবিন, কিন্তু মুহূর্ত পরে, দু’জনেই দেখতে পেলাম। ‘মুসা, দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। সময় মত মাটিতে আছড়ে পড়ায় আমার দেখা সবচাইতে বড় বাদুড়টার ঠোকর খাওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।

বাদুড়টা শোঁ করে বাতাসে ভেসে উঠে, চক্কর কেটে নেমে আসতে লাগল। এবার রবিনের দিকে।

‘মাথা ঢাকো!’ চেঁচালাম আমি। মাথায় ব্যাকপ্যাক চাপা দিল ও। ব্যাকপ্যাকে বাড়ি খেয়ে আবারও শূন্যে ভেসে উঠল বাদুড়টা। নির্দিষ্ট এক জায়গায় থেমে গিয়ে ভাসতে লাগল বাতাসে।

‘মুসা, ওটার চোখ দুটো দেখো!’ গর্জাল নথি, কিন্তু আমি আগেই লক্ষ করেছি। রক্তলাল। ঠিক ভ্যাম্পায়ারটার মত!

‘খাইছে, এটা ও-ই!’ চিৎকার ছেড়ে দৌড় দিতে গেলাম। কী মনে করে পিছু চেয়ে দেখি রবিন ঠায় দাঁড়িয়ে, গলা ছেড়ে বকাবাজি করছে বাদুড়টাকে।

‘রবিন, কী করছ?’ চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘টেপটা চালু করো!’ পাল্টা চেঁচাল ও।

বাবার ক্যামকর্ডারটা ঘনঘোর আঁধারেও ছবি নিতে পারে। কাজেই ভিউফাইণ্ডার ভেদ করে যখন চাইলাম, দেখতে পেলাম বাদুড়টা সরাসরি রবিনের মাথার উপরে ভাসছে।

‘রক্ত খেয়ে এসেছিস নাকি? পচা রক্ত?’ রবিন চেঁচাচ্ছে, বাদুড়টা নেমে আসতে লাগল ওর উদ্দেশে। ‘আমার রক্ত খাবি? আয়।’

এখন কী করব আমি? ভাবলাম। রবিনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!

এসময় ব্যাকপ্যাকে হাত ভরে দিল ও। ভিউফাইণ্ডারে মনে হলো পিংপং বলের মত এক মুঠো কী জিনিস যেন বের করে আনল। বাদুড়টার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে লাগল ওগুলো। সহসাই উপলব্ধি করলাম কী নিয়ে এসেছে ও। রসুন! এজন্যই ওর ব্যাকপ্যাক থেকে দুর্গন্ধ আসছিল! ভ্যাম্পায়াররা যেহেতু রসুন ঘৃণা করে, এতেই হয়তো জীবন বাঁচবে আমাদের!

‘ছবি তুলছ?’ চেঁচাল রবিন, বাদুড়টাকে লক্ষ্য করে রসুন ছুঁড়ে যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ, চালিয়ে যাও!’

বাদুড়টা রসুনগুলো এড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু রবিনের নিশানা লক্ষ্যভেদী। যতবারই রসুন আঘাত করছে বাদুড়টা খানিকটা করে পড়ে যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে যাচ্ছে যেন। বেশিক্ষণ লাগল না, রবিন ওটাকে মাটিতে নামিয়ে আনল। রসুন ছুঁড়ে যেতে লাগল যতক্ষণ না স্টক শেষ হলো।

ঘাসে পড়ে থাকা বাদুড়টার ক্লোজ-আপ নেয়ার জন্য দৌড়ে গেলাম।

‘মরে গেছে?’ প্রশ্ন করলাম।

‘জানি না,’ বলল রবিন। ‘রসুনে মরে কিনা জানি না, তাড়িয়ে দেয় সেটা জানি।’

‘দেখে তো মনে হচ্ছে মরে গেছে,’ বললাম। রক্তচোষা বাদুড় সম্পর্কে আমি কতটা অজ্ঞ পরমুহূর্তেই তার প্রমাণ পেলাম। কারণ বাদুড়টা বাতাসে লাফিয়ে উঠে ক্রিস্টোফার পাইকের রূপ ধরল। রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে! এবার ক্যামেরা লেন্সের দিকে চেয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল। ইচ্ছে করল ক্যামেরা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গা ছেড়ে নড়ব না সঙ্কল্প করলাম।

লেন্স ভেদ করে আমার দিকে তখনও জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রয়েছে, ভ্যাম্পায়ারটা এবার গর্জানো থামিয়ে আরও ভয়ঙ্কর একটা কাজ করল। হাসতে শুরু করল ওটা। নিচু, কর্কশ, বীভৎস হাসিটা শুনে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।

এবার আবার রূপ পাল্টাল ওটা। বিশাল, ধূসর এক হিংস্র কুকুরের চেহারা নিল। কিংবা নেকড়েও হতে পারে। আমি বুঝে ওঠার আগেই রাস্তা ধরে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্টপ বাটন টিপে ক্যামকর্ডারটা নিচু করলাম।

‘টেপে সব উঠেছে?’ প্রশ্ন করল রবিন। হাঁফাচ্ছে ও। কাঁপছে।

‘রবিন, আমরা আমেরিকা’স স্কেয়ারিয়েস্ট হোম ভিডিওর গ্র্যাণ্ড প্রাইয জিতব।’

‘আগে দেখে নিই কেমন উঠল।’

রেস দিয়ে রবিনের বাসায় গেলাম আমরা, কিন্তু দু’জনের কেউই জিততে পারলাম না। টাই হলো।

‘আস্তে, আস্তে!’ আণ্টি বললেন। আমরা বাইক থেকে নেমে এক দৌড়ে রবিনের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। রবিনের কামরায় যেহেতু টিভি আছে, টেপটা একান্তে দেখতে পারব আমরা। টেপটা যখন রিওয়াইও হচ্ছে আমার আনা কর্ডগুলো থেকে বেছে বের করলাম সঠিক কর্ডটা। ক্যামকর্ডারটা জুড়ে দিলাম টিভির সাথে।

প্লে বাটন টিপে কী টেপ করেছি দেখার যখন সময় এল, লক্ষ করলাম আমার হাত কাঁপছে। রবিন বাটনটা দাবিয়ে দিল এবং আমরা পিছিয়ে গেলাম ভিডিওটা দেখার জন্য।

ক’মুহূর্ত পর দেখতে পেলাম, রবিনের মুখ হাঁ হয়ে গেছে।

আমি মন শক্ত করলাম। যা উঠেছে দেখব।