মারণাস্ত্র – ১৪

চোদ্দ

মে এগারো-একুশ

ইতোমধ্যে দশ দিন পেরিয়ে গেছে। রানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

তবে বরিস নামে পার্টির এক বিশ্বস্ত লোক প্রতিদিনই টেলিফোন করে আমাকে; বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন টেলিফোন বক্স থেকে। ওর কথাতেই জেনেছি সবই পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছে। আরও জেনেছি রানার পরিকল্পনা মনঃপূত হয়েছে কোমাচিনের। সেই মোতাবেকই কাজ করে চলেছে ওরা।

বরিসের সঙ্গে ক্যাফেতে দেখা করলাম একদিন। জিজ্ঞেস করলাম ডক্টর পাশার কথা। চোখ চকচক করে উঠল ওর। ডক্টরের প্রশস্তি গাইল ও, কিন্তু কাউণ্টেসের প্রতি ডক্টরের আকর্ষণের কথা বলার সময় কেমন যেন হয়ে গেল ওর মুখের ভাব। কাউণ্টেসের একটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবির দিকে চেয়ে থেকে নাকি প্রচুর সময় নষ্ট করে ডক্টর।

বরিস অবশ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এসেছে আমার জন্যে। শীঘ্রিই নাকি অ্যাকশনে নেমে পড়ছে ওরা।

তেরো তারিখে যথারীতি কুড়বেকে মর্নিং ওয়াক করতে গেছি। হোটেল ছাড়তেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। রাস্তায় জটলা পাকাচ্ছে লোকজন, উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাদেরকে। ক্যাফেতেও আজ ভিন্ন দৃশ্য। নিচু স্বরে, গোপন কোন ব্যাপার নিয়ে যেন আলোচনা করছে ক্রেতারা। রাস্তায় প্রচুর পুলিশ। নার্ভাস দেখাচ্ছে তাদেরকে। খবরের কাগজ কিনলাম। জানতে পারলাম না বিশেষ কিছুই। ক্যাফের বেয়ারাকে প্রশ্ন করেও কোন লাভ হলো না। ব্যাটা এমন ভান করল যেন আমার কথা বোঝেইনি। হোটেলে ফিরে এলাম। অপেক্ষা করছি বরিসের ফোনের জন্যে। হঠাৎ মনে পড়ল মাইকেলের কথা। বেল বাজালাম। অন্য এক বেয়ারা এল। মাইকেলের কথা জিজ্ঞেস করাতে চুপ করে রইল। শেষে চাপাচাপির ফলে মুখ খুলতে বাধ্য হলো। মাইকেল নাকি অসুস্থ, কাজে আসেনি। ওর কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না।

অপেক্ষা করতে-করতে যখন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি ঠিক তখনই এল বরিসের ফোন।

‘কিছু মনে করবেন না,’ দ্রুত বলল ও। ‘সিগারেট।’

‘সিগারেট’ একটা সাঙ্কেতিক শব্দ। এর অর্থ ‘জলদি আসুন’। হ্যাট আর কোট খামচে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তক্ষুণি। বড় রাস্তা এড়িয়ে অলিগলি ধরে প্রায় সারাটা পথই একরকম ছুটলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বরিস। আমাকে ওপরে নিয়ে গেল।

কোমাচিনের ঘরটা দেখে আর্মি হেডকোয়ার্টার মনে হচ্ছে। ঘরে গুরুত্বপূর্ণ কোন যুদ্ধের ঠিক আগের পরিবেশ। রানা আর কোমাচিন টেবিলের ওপর ঝুঁকে বড় একটা ম্যাপ দেখছে। ঘরে জনা ছয়েক ইক্সানিয়ানও রয়েছে। নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে তারা। আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল কোমাচিন, রানার যেন কোনদিকে খেয়াল নেই। একমনে ম্যাপ দেখছে। অন্যদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল বরিস। কোমাচিন খানিক বাদে আমাকে টেবিলে ডেকে নিয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।

তারপর ঝানু রাজনীতিকের মত সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাল আমাকে। ওদের প্ল্যান হচ্ছে সেনাবাহিনীর মনোযোগ জোভোগোরোড থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া। সেই ফাঁকে ওরা শহরে ওদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করবে। ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আর উত্তরের দুটো শহরে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছে। সরকার ও-দুটো জায়গায় ন’হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। জোভোগোরোডে এখন মাত্র হাজারখানেক সৈন্য আছে। ওদিকে ইয়াং ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মীরা ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে জোভোগোরোড শহরের দিকে এগোচ্ছে। আগামীকাল রাত একটার দিকে শহরে ছড়িয়ে পড়বে তারা। সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে সরকারকে উৎখাত করবে।

‘তারপর, মঁসিয়ে লিনফোর্ড,’ বলে চলল কোমাচিন, ‘আবার যোগাযোগ স্থাপনের পর আপনার সাহায্য খুবই প্রয়োজন। প্রথমেই বুখারেস্টের স্বীকৃতি চাই। তারপর প্যারিস, লণ্ডন আর ওয়াশিংটন। আমরা জানি এসব দেশে আপনার কীরকম প্রভাব।’

‘কিন্তু…’ বলতে চাইলাম আমি।

‘আপনি যা-যা চান মিস্টার লিনফোর্ড সবই করবেন,’ বাধা দিয়ে বলল রানা।

প্রতিবাদ করার সময় পেলাম না। কোমাচিন আর তার লোকেরা এরমধ্যেই একদফা আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে দিয়েছে।

পরে রানাকে রবিন্সের কথা জিজ্ঞেস করলাম।

‘ও কী মতলব আঁটছে জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে আজ রাতের মধ্যে যদি চলে না যায় তবে আর বাঁচবে কিনা সন্দেহ।’

হঠাৎ ঘরের ভেতরের বেলটা বেজে উঠল। কারও মুখে রা নেই। জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিল বরিস। তারপর এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে। যখন ফিরল তখন তার দৃষ্টি কোমাচিনের দিকে, কিন্তু রানাকে উদ্দেশ্য করে বলল:

‘প্ল্যাট,’ হাঁফাচ্ছে ও, ‘গুলি খেয়েছে। তবে বহু কষ্টে পৌঁছেছে এখানে। রবিন্স তার দলবল নিয়ে গাড়িতে করে ভিজিলের ল্যাবোরেটরির দিকে গেছে। আধ ঘণ্টা আগে।’