নেকড়েমানুষ – ৩

তিন

মুসা আর রাফি কাঠের বেড়াটার পাশে দাঁড়াল। করালের ভিতরে দুটো ঘোড়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এক কাউবয় বেড়ার এক খুঁটিতে উঠে দাঁড়িয়েছে। মাথার উপরে বিশাল এক ল্যাসো ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল করালের ভিতরে। একটা ঘোড়ার উপর আছড়ে পড়ল ওটা।

‘দেখলি, রাফি? প্রশ্ন করল মুসা। ‘বসে থাকা জিনাকে ফাঁস পরানোর চাইতে ছুটন্ত ঘোড়াকে ফাঁস পরানো অনেক কঠিন কাজ। একবার চেষ্টা করে দেখি, কি বলিস?’

রাফি ঘেউ-ঘেউ করে সায় জানাল।

মাটিতে পড়ে থাকা একটা রশি তুলে নিল মুসা। তারপর উঠে পড়ল এক খুঁটিতে। করাল ঘিরে তখনও ছুটে বেড়াচ্ছে একটা ঘোড়া। মুসা মাথার উপরে ল্যাসোটা ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল করালের ভিতরে। বাতাসে ভেসে গিয়ে কিছু একটার উপর পড়ল ওটা।

‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা।

ও খুঁটি থেকে নেমে দড়িটা ধরে টানতে লাগল। কিন্তু ঘোড়াটাকে দেখার বদলে মুখোমুখি পড়ে গেল খেপা এক ষাঁড়ের।

‘খোঁত!’ ফেন্সের ওপাশ থেকে মুসার উদ্দেশে গর্জে উঠল ষাঁড়টা। এবার মাথা নুইয়ে সামনের ক্ষুর দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগল।

‘খাইছে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘সাবধান, রাফি, ষাঁড়টা তাড়া করতে যাচ্ছে!’

ষাঁড়টা মুসাকে ধাওয়া করতে যাবে, এসময় বিশালদেহী এক লোক ওটার সামনে এসে দাঁড়াল। জানোয়ারটার ক্রুদ্ধ চোখজোড়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল সে। ষাঁড়টা খোঁতখোঁতানি থামিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

লোকটি উল্টো ঘুরে মুসা আর রাফির দিকে চাইল। ধূসর একজোড়া চোখ তার। হাতে হাতুড়ি।

রাফি ভয়ে কেঁউ করে উঠে মুসার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘খাইছে, রাস্তার সেই ভুতুড়ে লোকটা!’ বলে উঠল মুসা। ঘুরেই দৌড় দিল বাঙ্কহাউসের দিকে। রাফি অনুসরণ করল।

বাঙ্কহাউসের সামনের বারান্দায় তখন কিশোর, জিনা আর রবিন কথা বলছিল এক বৃদ্ধা আর এক যুবকের সঙ্গে।

‘তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল, গ্লেন,’ যুবকটিকে বলল কিশোর। ‘তোমার সাথেও, মার্থা। তোমার রান্না ভীষণ মিস করেছি আমি।’

‘অনেক ধন্যবাদ, কিশোর,’ মহিলা বলল। লম্বায় খাট মানুষটির মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। কাপড়ের উপরে বড়সড় এক ডেনিম অ্যাপ্রন পরা। তাতে নানা ধরনের খাবারের দাগ লেগে রয়েছে।

‘কারা এরা?’ গ্লেন প্রশ্ন করল।

‘এরা হচ্ছে রবিন আর জিনা, কিশোর বলল। ‘মুসা আর রাফি আশপাশেই আছে।’

‘এদিকে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ও আর রাফি ছুটে আসছে বাঙ্কহাউসের দিকে। বারান্দায় দৌড়ে উঠে পড়ে হাঁফাতে লাগল মুসা। আর রাফি ছেলে-মেয়েদের পিছনে আড়াল নিল।

‘কী হয়েছে তোমাদের?’ জিজ্ঞেস করল জিনা।

রবিনের পিছন থেকে উঁকি মারল রাফির লেজ। বারান্দার দিকে হেঁটে-আসা লোকটির দিকে নির্দেশ করল ওটা।

‘ওটা তো কয়োটি পল,’ বলল গ্লেন। ‘রানশের একজন হায়ার্ড হ্যাণ্ড। অনেক বছর ধরে আছে।’

‘কয়োটি পল?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ‘চেনাই যায় না। এত পরিবর্তন?’

‘তার কারণ ওকে নেকড়েমানব কামড়েছিল,’ গ্লেন ঠাট্টা করে বলল।

‘চুপ কর তো, গ্লেন,’ বলল মার্থা।

কয়োটি পল ধীর পায়ে হেঁটে বাঙ্কহাউসের বারান্দায় উঠল। বড় হাতুড়িটা তার ড্যাংগারি থেকে ফাঁসে ঝুলছে। ডেনিম শার্টের পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে কপাল মুছে নিল সে। ছেলে- মেয়েদের উপর থেকে মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাল না।

‘তোমাদেরকে বলেছিলাম চলে যেতে,’ বলল। ‘অচেনা মানুষরা এখানে ওয়েলকাম নয়। অন্তত আজকের রাতে।’

‘পল,’ বলল মার্থা। তুমি ওকে চিনতে পারনি? ও তো আমাদের কিশোর। সামারে গ্লেনের সাথে খেলা করত।’

পল চোখ পিটপিট করে কিশোরের দিকে দৃষ্টি স্থির করল।

‘তুমি যখন বলছ তখন ওর ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই,’ বলল পল। ‘কিন্তু এখানে যা ঘটছে তাতে আজ রাতে এত মানুষের উপস্থিতি ঠিক নয়।

‘এখানে কী ঘটছে? পার্টির প্রস্তুতি?’ প্রশ্ন করল নথি।

‘ও বোঝাতে চাইছে সোনার হর্সশুগুলো দেখার প্রস্তুতি চলছে,’ বলল গ্লেন।

‘ও পার্টির কথাই বলছে,’ বলল মার্থা। ‘আমি কয়েকদিন ধরে রান্নার আয়োজন করছি কি না।’

‘আমি পার্টির কথা বোঝাইনি,’ বলল পল। ‘বোঝাতে চেয়েছি গত ক’রাতের নেকড়ের গর্জনের কথা।

‘পলের ধারণা আজ রাতে লোন উলফের অভিশাপ ফলবে,’ বলল গ্লেন। মুসা আর রাফির দিকে চেয়ে অশুভ হাসল। ‘পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে, চাঁদের আলোয় লোন উলফের মূর্তিটা ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। ফলে মুক্তি পাবে নেকড়েটার আত্মা। নেকড়েমানব ফিরে আসবে! আআআ উউউহ!’

মুসার মুখের চেহারা ফ্যাকাসে। রাফি গা ঢাকা দিল রবিনের পিছনে। গ্লেন হেসে উঠল।

‘অ্যাই,’ মার্থা বকা দিল ওকে।

‘হেসো না, গ্লেন,’ বলল পল। ‘চাঁদ উঠলেই হাজির হবে নেকড়েমানব। তখন বোলো না আমি সাবধান করিনি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে।

‘পলের কথায় কান দিয়ো না,’ বলল মার্থা। ‘ওর এত রাগের কারণ ও এখনও রানশ হ্যাণ্ডই রয়ে গেছে। স্যাম আর র‍্যামকে সারাক্ষণ উপদেশ দিতে থাকে কীভাবে রানশটা চালাতে হবে। কিন্তু ওরা পাত্তা দেয় না ওর কথায়। নেকড়েমানবের অভিশাপের কথাও বিশ্বাস করে না।’

‘অভিশাপের কথা যখন উঠলই,’ বলল মুসা, ‘রাফি আর আমার উপরও অভিশাপ আছে।’

‘কীসের অভিশাপ?’ জিনার প্রশ্ন।

‘খিদের অভিশাপ,’ জবাব দিল মুসা। ‘আমাদের খিদে পেয়েছে।’

‘বেশ তো, ভেতরে এসো,’ বলল মার্থা। ‘আমার বিখ্যাত পিচ কবলারের একটা টুকরো চেখে দেখো। ওটা খেলে রাতের বার্বিকিউয়ের আগে আর খিদে পাবে না। আর ওটা খাওয়ার জন্যে তোমাদেরকে পূর্ণিমার চাঁদের অপেক্ষায়ও থাকতে হবে না!’

সবাই হেসে উঠল। তারপর মার্থা আর গ্লেনকে অনুসরণ করে বাঙ্কহাউসের ভিতরে প্রবেশ করল।