মারণাস্ত্র – ৪

চার

এপ্রিল বিশ

রানার মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না।

‘আপনাকেই খুঁজছিলাম, মিস্টার রবিন্স। দেখতেই পাচ্ছেন মত বদলেছি।’

নিষ্পলক চেয়ে রইল রবিন্স। তারপর হাতের ইশারায় বসতে বলে চুরুট ধরাল।

‘ডক্টর পাশা,’ মৃদু হেসে বলল রবিন্স, ‘আমাকে একেবারে অবাক করে দিয়েছেন। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হতে চাইছে না। হঠাৎ আপনার সুবুদ্ধির উদয় হলো দেখছি। কী ব্যাপার বলুন তো?’

এমনটিই আশা করেছিল রানা।

‘খোলাখুলিই বলছি। আমার দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন আসলে হয়নি। ব্যাপারটা অন্যখানে। রিসার্চের জন্যে যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন তা নেই আমার। সেজন্যেই আপনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়াটা সম্ভব হলো না।’

রানার কথা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো রবিন্সের। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল সে।

‘গুড। লাঞ্চের সময় আলাপ করা যাবে, কী বলেন?’

কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে পরে আলাপ হলো ওদের। রবিন্স স্মরণ করিয়ে দিল, গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের পক্ষে ডক্টর যে কাজই করুন না কেন সেটা শুধুমাত্র কোম্পানির এখতিয়ারভুক্ত। কোম্পানির কাছে তাঁকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। ছয় মাসের জন্যে কন্ট্রাক্ট করতে চায় রবিন্স। তবে ভিজিলের ফর্মুলা যেদিন কোম্পানির হস্তগত হবে ডক্টরের চুক্তি শেষ হয়ে যাবে সেদিনই। সেই বিশেষ দিনটিতে ডক্টর পুরো পাওনা অর্থাৎ চার লাখ পাউণ্ড পেয়ে যাবেন। অবশ্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিটি মাসেই তিনি আরও আশি হাজার পাউণ্ড করে পেতে থাকবেন।

রানা ভেবেছিল আরও অনেক শর্ত জুড়ে দেবে রবিন্স। কিন্তু তেমন কিছুই বলল না ও। খুব কাছ থেকে রানাকে জরিপ করছে রবিন্স। হাসল রানা, খানিকটা বিস্মিত। দ্রুত চিন্তা চলছে মনে, ফর্মুলা হাতিয়ে তারপর বোমা বানিয়ে দেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করবে না তো রবিন্স?

‘অফারটা লোভনীয়। এখন আপনাকে খুশি করতে পারলে হয়। পারব আশা করি।’

‘তবে কথা পাকা হয়ে গেল,’ বলল রবিন্স। ‘বেল-এ ঘণ্টাখানেকের জন্যে থামবে ট্রেন। আমাদের অফিস রয়েছে ওখানে। কন্ট্রাক্টটা ওখানেই সেরে ফেলব।’

চওড়া হেসে হাতের গেলাসটা তুলে ধরল রবিন্স।

‘আমাদের সাক্সেস কামনা করে…’ বাক্যটা সম্পূর্ণ করল না ও। রানার কাঁধের ওপর দিয়ে চেয়ে রয়েছে। চোখজোড়া সরু। চমকে গেছে মনে হলো।

রেস্টুরেন্ট কারে দু’জন আগন্তুক ঢুকেছে। ওরা না বসা অবধি জরিপ করল রবিন্স। এদের চেনে রানা। লে হাভরে-প্যারিস ট্রেনের সেই দুই যাত্রী।

‘কিছু মনে করবেন না, ডক্টর,’ হাতের গেলাসটা উঁচিয়ে বলল রবিন্স। ‘ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলাম।’

কম্পার্টমেন্টে ফিরে এল ওরা। একটা রিপোর্ট নিয়ে বসেছে রবিন্স। আর কোন কথা হলো না ওদের মধ্যে। তাতে বরং খুশিই হলো রানা। ডক্টর পাশা হিসেবে ওর বেশি কথাবার্তা না বলাই ভাল। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তা ছাড়া এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চায় ও, ভাবতে হবে।

প্যারিস ট্রেনের যাত্রী দু’জনকে দেখে রবিন্সের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করবার মত। অবশ্য সেরকম আভাস রবিন্স নিজেও দিয়েছে।

কারা ওরা? রবিন্স বলবে না, এটা নিশ্চিত। জানতে হবে রানাকেই।

করিডরে চলে এল ও। কোচের শেষ প্রান্তে হেঁটে গেল, ধীর পায়ে। প্রতিটি কম্পার্টমেন্টের লোকজনের ওপর একবার করে নজর বুলিয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখা পেল ওদের। লোকটিকে দেখে মনে হলো ঘুমাচ্ছে, মেয়েটি পড়ছে কী যেন। আরও খানিক দূর হাঁটল রানা। তারপর থেমে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। ভাবছে, কী করা উচিত।

কেমন যেন একটা ধোঁয়ার পর্দা মনের ওপর। আবছাভাবে ভেসে উঠছে কয়েকটা মুখ। সোহানার অনিন্দ্যসুন্দর চেহারা, মেজর জেনারেল রাহাত খানের কাঁচাপাকা ভ্রূ। ওদেরকে আরও স্পষ্টভাবে কল্পনা করার চেষ্টা করল রানা। পারল না। হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এল

লম্বা একটা টানেলে ঢুকেছে এখন ট্রেন। আচমকা গতি কমে গেল। রেলের সঙ্গে চাকার ঘর্ষণের জোরাল শব্দ কানে এল। ঝাঁকি মেরে থামল ট্রেনটা। মুহূর্তে একাধিক জানালা খুলে গেল। উঁকি দিচ্ছে অনেকগুলো মাথা। ক’জন অফিসার নেমে পড়ল লাইনের ওপর। একটা কোচের ব্রেক পরীক্ষা করছে। সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় সমস্ত যাত্রী, এমনকী ড্রাইভারকেও দেখা গেল লাইনে। প্রত্যেকেই উপদেশ দিচ্ছে। কৌতুক অনুভব করছে রানা। চেয়ে রয়েছে সে। হঠাৎ কাছেই দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠল।

‘এক্সকিউজ মি, মঁসিয়ে, কী ব্যাপার বলতে পারেন?’ সেই যুবতীর কণ্ঠস্বর। পরিষ্কার ইংরেজিতে প্রশ্নটা করেছে।

‘ব্রেকের প্রব্লেম,’ জবাব দিল রানা।

লাইনে ভিড় করা জনতার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইল যুবতী। ‘আপনার কি মনে হয়, অনেক দেরি হবে?’

‘মনে হয় না, ম্যাডাম। ব্রেকটা বোধহয় কাজ করতে শুরু করেছে।’

মহিলার চেহারায় স্বস্তি ফুটল। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে এ মুহূর্তে। হঠাৎ হুইসেলের শব্দ। প্যাসেঞ্জাররা তড়িঘড়ি করে উঠতে লাগল ট্রেনে।

‘আমি আপনার ভক্ত, ডক্টর,’ হঠাৎ বলল মেয়েটি। ‘আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করি আমি।’

‘ও, আচ্ছা,’ খানিকটা থতমত খেয়ে গেছে রানা। কিন্তু আমাকে চিনলেন কীভাবে?’

‘কে না চেনে আপনাকে বলুন?’

মুচকি হাসল রানা।

‘আপনিও কি বুখারেস্ট যাচ্ছেন?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল মহিলা। ‘তবে থাকব না ওখানে।’ মৃদু হাসল সে।

‘আমিও বুখারেস্ট ক্রস করব,’ বলল রানা। ‘জোভোগোরোড যাচ্ছি।’

মহিলার মুখের সূক্ষ্ম পরিবর্তনটা দৃষ্টি এড়াল না রানার।

নরম গলায় বলল মহিলা, ‘ও, তাই নাকি?’

‘জোভোগোরোড জায়গাটা কেমন? গেছেন আগে কখনও?’

‘গেছি।’ মহিলার চোখ এখন সোজাসুজি রানার চোখে। ‘গবেষণার কাজে যাচ্ছেন?’

‘উঁহুঁ। বলতে পারেন শখের জন্যে-ফটোগ্রাফি। শুনেছি জোভোগোরোডের কাছে নাকি দারুণ কয়েকটা স্পট আছে।’

রানা অনুভব করছে, মহিলা সন্দেহ করতে শুরু করেছে তাকে।

‘ঠিকই শুনেছেন,’ বলল মহিলা। ‘তবে আপনাকে একটা সাজেশন দিই। প্ল্যান চেঞ্জ করুন। ইক্সানিয়ায় আরও কিছুদিন পরে আসুন, আমরা আপনাকে ভিআইপি অভ্যর্থনা জানাব। তা ছাড়া বসন্ত কালটায় ওখানে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে।’

মহিলার চোখ দুটো আচমকাই শীতল হয়ে গেছে। রানা স্পষ্ট বুঝল, ভদ্র ভাষায় সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে তাকে। এ-ও বুঝল মহিলা ইক্সানিয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ।

কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতেই বাধা পেল রানা। তীক্ষ্ণ স্বরে কথা বলে উঠেছে মহিলা।

‘মঁসিয়ে, বেল-এ কখন পৌঁছব বলতে পারেন?’

‘সাড়ে আটটায়, ম্যাডাম।

‘ধন্যবাদ, মঁসিয়ে।’

ভুবনমোহিনী হেসে উল্টো দিকে ঘুরল মহিলা। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। চোখের কোণে কারণটা ধরা পড়ল রানার।

করিডরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে হ্যামণ্ড রবিন্স। দৃষ্টি এদিকে।