মারণাস্ত্র – ১৫

পনেরো

মে একুশ-বাইশ

এক মুহূর্ত নিশ্চুপ সবাই। কোমাচিনের দিকে চাইল রানা। মাথা ঝাঁকাল কোমাচিন।

বরিসের পিছে-পিছে বেরিয়ে পড়লাম আমি আর রানা। অসংখ্য সরু প্যাসেজ পেরিয়ে ছোট্ট একটা উঠনে চলে এলাম। কোমাচিন আমাদের জন্যে গাড়ি আর ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

শহরের বাইরে চলে আসতে সময় লাগল না। খানিক বাদেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। রাস্তার জায়গায়-জায়গায় গর্ত, বৃষ্টির ফলে পিছলও হয়ে গেছে। ফলে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। আমার হাতে একটা পিস্তল ধরিয়ে দিল রানা। বলল, ‘রেখে দিন। কাজে আসতে পারে।’

উপত্যকার পাশের রাস্তা ধরে মিনিট বিশেক যাওয়ার পর হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিল রানা। আমরা তিনজন হেঁটে এগোলাম। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। রাস্তায় প্যাচপেচে কাদা, পা দেবে যায়। শেষ পর্যন্ত ডানে মোড় নিলাম আমরা। প্রায় এক কিলোমিটার চড়াইয়ের পর থামল রানা। ফিসফিসিয়ে আমাদের দু’জনকে অপেক্ষা করতে বলে মিশে গেল সামনের অন্ধকারে। ফিরল ক’সেকেণ্ড পরেই। খানিক দূরেই নাকি একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে, ভেতরে এক লোক বসা।

তার নির্দেশ মত বরিস আর আমি নেমে আসতে লাগলাম গাড়িটার দিকে। পঞ্চাশ, মিটারের মত নামার পর দেখতে পেলাম গাড়িটাকে। আমরা এগোতেই ড্রাইভারের দরজাটা খুলে গেল ধীরে- ধীরে। লোকটা বেরিয়ে এসেছে। আমাদের সঙ্গে ওর দূরত্ব এখন মাত্র দু’মিটার। আমাদের দেখে ফেলেছে ও। ঝট করে তার হাত চলে গেছে পিস্তলে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা ছায়ামূর্তি পেছন থেকে ভারী কিছু দিয়ে বাড়ি মেরেছে ওর মাথায়। হাঁটু মুড়ে ভূমিশয্যা নিল লোকটি।

ঝুঁকে লোকটিকে একবার দেখে নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল রানা।

লোকটাকে বেঁধে ফেললাম আমরা। মুখটা কষে বাঁধলাম স্কার্ফ দিয়ে। তারপর চ্যাংদোলা করে তার অচেতন দেহটা গাছের আড়ালে ফেলে দেয়া হলো। রানা গাড়ির এঞ্জিনের কী যেন একটা ছোট্ট যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে পকেটে পুরল। নামতে শুরু করলাম আবার, ল্যাবোরেটরির দিকে। ইলেকট্রিক তারের কাছে পৌঁছে দেখি গেট হাট করে খোলা। ঢুকে পড়লাম নিঃশব্দে। বাড়িটা প্রায় অন্ধকারই বলা চলে, কেবল দূর প্রান্তের একটা ঘরে আবছা আলোর আভাস।

‘কোনার দিকে ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার একটা রাস্তা আছে,’ বলল রানা। ‘আমি ওখান দিয়েই ঢুকব। শেষ প্রান্তে আরেকটা দরজা পাবেন। ওটা আপনাদের জন্যে। আমি ওদের ঘিরে ফেলতে চাই, তবে মনে রাখবেন আমি সিগন্যাল না দেয়া পর্যন্ত কিচ্ছু করবেন না। সিগন্যাল দিলে গুলি চালাবেন।

আমরা দু’জন রওনা দেব ঠিক এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার ভেসে এল ল্যাবোরেটরির দিক থেকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি দু’জনেই। তাড়া লাগাল রানা। দেয়ালের কাছে পৌঁছে শ্বাস নেয়ার জন্যে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম। তারপর পা বাড়ালাম ল্যাবোরেটরির উদ্দেশে।

পেট গুলাচ্ছে আমার, ভয়ে। চিৎকারটা রক্ত হিম করে দিয়েছে। রানার বলে দেয়া দরজাটা খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হলো না। ওটা আস্তে করে খুলল বরিস।

ল্যাবোরেটরির মধ্যখানে পাঁচজন লোক, অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়ানো। রবিন্স আর হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বেলানভকে চিনতে পারলাম। তবে চেয়ারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা লোকটির প্রতিই নজর চলে গেল আমার। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা মেকানিক। ওর মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকে, বোধহয় জ্ঞান নেই। রড হাতে এক লোক হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। হাঁটুতে মারার জন্যে তুলেছে রডটা। মুহূর্তে মাথা তুলল চেয়ারের লোকটা। প্রাণভয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠেছে। চোখজোড়া বিস্ফারিত, মুখ হাঁ।

রডওয়ালা মারেনি। আবার ভান দেখাল মারবে। এবার সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে মেকানিকটি। অন্য আরেকজন এগিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। প্রচণ্ড কয়েকটা ঘুসি বসিয়েছে অজ্ঞান লোকটার মুখে। ঘুসি খেয়ে যেন জ্ঞান ফিরল তার। বেলানভ এগিয়ে গিয়ে ইক্সানিয়ান ভাষায় কী যেন বলল তাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে রবিন্স, চুরুট ফুঁকছে। প্রশ্ন যা করার বেলানভই করছে। মেকানিক বেচারা হয় জানে না আর না হয় ইচ্ছে করেই উত্তর দেয়নি প্রশ্নের। ফলে রডওয়ালা হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কাছে এগোল। প্রাণপণে দড়িমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে লোকটি। চেঁচাচ্ছে। বরিসের দ্রুত শ্বাস নেয়ার শব্দ স্পষ্ট শুনছি আমি।

পকেটে রাখা পিস্তলে শক্ত হলো আমার হাত। রানার নির্দেশের তোয়াক্কা করলাম না। নিষ্ক্রিয় দর্শকের মত লোকটির দুর্দশা দেখা আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ধেয়ে গেলাম ল্যাবোরেটরির ভেতরে।

আমার প্রথম দুটো গুলি লাগল উল্টোদিকের দেয়ালে। পরের দুটো বিধল মেঝেতে। পরমুহূর্তে অবশ হয়ে এল আমার কবজি। মেঝেতে পড়ে গেছে পিস্তল। যে লোকটার গুলি খেয়েছি সে তাক করছে আবার। আচমকা আমার পেছন দিকে যেন প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হলো। কানে তালা লাগার উপক্রম। পিস্তলবাজ মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বরিস আবার গুলি করার আগেই সাইলেন্সড পিস্তলের ভোঁতা শব্দ শুনলাম; দরজার দিক থেকে এসেছে। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ, বাতিটাও গেছে।

আমার বাহু আঁকড়ে ধরেছে বরিস। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম, আড়াল নেয়ার জন্যে। রাস্তায় নেমে আসতেই পেছনে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলো। ল্যাবোরেটরির দিক থেকে গুলির শব্দ শুনলাম। আর্তনাদ করে উঠল কেউ, গুলি হলো আবার। ধাওয়া করছে না এখন কেউ। থেমে পড়ে কান পাতলাম আমরা। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ল্যাবোরেটরির উদ্দেশে পা বাড়াল বরিস।

বেশ ভালই রক্তপাত হচ্ছে আমার। রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা পেঁচিয়ে ধীর পায়ে ল্যাবোরেটরির দিকে এগোলাম। কয়েক মিটার যেতেই পৌঁছলাম বেড়ার কাছে। থামলাম। স্পষ্টই শুনলাম সামনের ঝোপে কেউ একজন নড়াচড়া করছে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। নিরস্ত্র, আহত অবস্থায় আর কীইবা করার আছে। ওদিকে ঝোপের মধ্যকার শব্দটা হচ্ছেই। গেটের দিকে এগোচ্ছে কেউ। হঠাৎ সার্চলাইটের উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার হয়ে গেল অন্ধকার। ছাদ থেকে আসছে আলো। নিশ্চয়ই রানা বা বরিস অপারেট করছে ওটা। নিচু হলো আলো। আস্তে-আস্তে ঝোপের দিকে এগোচ্ছে। এ সময় অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎই আলোর ঝলকানি এবং তার পর-পরই গুলি হলো। আলোটা লাফিয়ে উঠে থেমে গেল। দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলানভ। অভিনেতা স্টেজে যেভাবে আলোকিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক সেভাবে।

আলোয় ধরা পড়ে নিচু হয়ে এক পাশে সরে যেতে চাইল ও। ওকে অনুসরণ করল আলো। সামনে বেড়া। আচমকা দাঁড়িয়ে উঠেই বেড়ার দিকে ঝেড়ে দৌড় দিল ও। বেড়া যখন টপকাতে চেষ্টা করছে তখন পরিষ্কার দেখতে পেলাম তাকে। তবে বেড়া টপকানো হলো না তার। তারে হাত ছোঁয়াতেই শক্ত হয়ে গেছে সে, বেঁকে গেছে শরীর। পায়ের পাতা মাটির সামান্য ওপরে, হাঁটু ভাঁজ; দেখে মনে হলো প্রবল ভার চাপানো হয়েছে তার ওপর। বইতে পারছে না সে। আলতোভাবে খসে পড়ল ও। একটিবারের জন্যেও আর নড়তে দেখলাম না ওকে।

আলোটা একবার যেন পুরো জায়গাটাকে ঝাড়ু দিয়েই নিভে গেল। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডাকছে বরিস। উঠে দাঁড়ালাম।

‘আসুন, মঁসিয়ে। আর চিন্তা নেই, কারেন্ট অফ করা হয়েছে। বেড়ায় কারেন্ট দেয়ার আগেই রবিন্স তার এক স্যাঙাতকে নিয়ে পালিয়েছে। তবে ওদের গাড়িটা তো আগেই বিকল করে দেয়া হয়েছে। ফলে, লম্বা হাঁটা মারতে হবে ওদের।’

‘কিন্তু ওর দলের অন্যদের কী খবর?’

‘বেলানভের দশা তো দেখলেনই। আমি যাকে গুলি করেছিলাম সে ব্যাটা মরেছে। ডক্টরের গুলিতে আরেকটা গেছে।’ সামান্য থেমে বলল ও, ‘ডক্টর দারুণ ফাইটার।’

‘চেয়ারে বাঁধা লোকটার কোন খবর জানেন?’

‘মনে হয় মারা গেছে।’

বাইরেই থাকল বরিস। আমি ঢুকলাম ল্যাবোরেটরির ভেতরে। রানাকে দেখলাম এক রাশ কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ছোট একটা ডেস্কও হাতড়াল ও।

‘উঁহু,’ বলল ও, ‘কিচ্ছু পেলাম না। কোন জায়গা তো খুঁজতে বাদ রাখিনি।’

‘রানা,’ বললাম আমি, ‘কিছু মনে করবেন না। সব কিছুর জন্যে আসলে আমিই দায়ী। এ ধরনের কাজ করার কোন যোগ্যতা আমার নেই।’

হাসল ও।

‘বাদ দিন। আপনি তখন গুলি না করলে আমাকেই শুরু করতে হবে। ওদের এক্কেবারে বোকা বানিয়ে দিয়েছিলেন। যা হোক, আপনার কবজির কী অবস্থা?’

দেখালাম ওকে। পেশাদারি চোখে ও পরীক্ষা করল ব্যাণ্ডেজ।

‘চিন্তার কিছু নেই,’ মন্তব্য করল ও। ‘তবে ব্যাণ্ডেজটা ঠিকমত বাঁধতে হবে। দেখুন কোথাও ব্যাণ্ডেজ খুঁজে পান কিনা।’

সামনে একটা দরজা। ওটা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই হাতের ডানে একটা খাট দেখতে পেলাম। সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমও রয়েছে। দেয়ালের মেডিসিন বক্সে ব্যাণ্ডেজ পেয়ে গেলাম। পুরো বক্সটাই ল্যাবোরেটরিতে নিয়ে এলাম। রানা তখন মেঝেতে বসে ছড়ানো- ছিটানো কাগজগুলোয় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

‘যে কাগজগুলো আমরা চাই সেগুলো এখানে নেই,’ বলল ও। জ্বলন্ত কাগজগুলোর দিকে ভ্রূ নাচিয়ে দেখাল। ‘আমি কোন রিস্ক নিচ্ছি না। এখানে এমন কোন কাগজ থেকে থাকতে পারে যেটা ঝানু কারও হাতে পড়লে বিপদ হয়ে যাবে।’

‘কী করবেন তবে?’

‘পুরো জায়গাটাই উড়িয়ে দেব। উপত্যকার ওপরে আমাদের লোকজন বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছে। বরিস টেলিফোনে ওদের তৈরি হয়ে আসতে বলেছিল। ও-ও রয়েছে ওদের সঙ্গে।’

‘বলেন কী!’

‘হ্যাঁ, রিস্ক নেব না। আমি চাই না ভিজিলের ফর্মুলা কেউ হাত করুক।’

‘কিন্তু ভিজিলের কথা কিছু ভেবেছেন? তা ছাড়া কাউণ্টেসের কাছেও তো একটা কপি আছে।’

‘আছে, তবে থাকবে না। দু’জনের কেউই পার পাবে না। কোমাচিন ওদের দায়িত্বে আছে।’

আমার করজি ব্যাণ্ডেজ করার জন্যে হাত বাড়াল রানা। চিরকালই বাঁ হাতটা কম চালু আমার। ফলে দেয়ার সময় পড়ে গেল রোলটা। ওটা মেঝেতে পড়ামাত্র উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল রানা। পরমুহূর্তে দেখতে পেলাম হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়েছে ও, খুলছে রোলটা। কারণটাও বুঝতে পারলাম। ব্যাণ্ডেজের রোল খুলতেই একতাড়া কাগজ বেরিয়ে এল। ছোট হস্তাক্ষরে বিজবিজে লেখা।

উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে রানা, চোখে দীপ্তি।

‘পেয়েছি,’ চেঁচাল ও, কাগজগুলো নাড়ছে আমার চোখের সামনে। ‘ভিজিলের ফর্মুলার দ্বিতীয় কপি।’

পরমুহূর্তে আমার কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল ও। তবে ওর আনন্দ স্থায়ী হলো না। কাশল কে যেন। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে শুষ্ক কণ্ঠে বলল, ‘আপনার ফুর্তি দেখে বড় ভাল লাগছে। তবে একটু বিরক্ত করব; হাত দুটো যে মাথার ওপর তুলতে হয়।’

খাট, বড় মাথাওয়ালা এক লোক দরজায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। বাঁকা হাসি ঠোঁটে। তার পেছনে রিভলভার হাতে ইগর আর ইউনিফর্ম পরা দু’জন লোক। তাদের পেছনে অবশ্য আরও লোকজন দেখা যাচ্ছে।

আমাদের চুপ করে থাকা ছাড়া গতি নেই। খাট লোকটি ঢুকে এল ঘরে, বাউ করল রানাকে।

‘আপনিই বোধহয় ডক্টর পাশা। আমি ভিজিল। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

‘না শুনে উপায় আছে?’ মৃদু স্বরে বলল রানা।

আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ঘরের চারদিকটা জরিপ করল ভিজিল। পোড়া কাগজের স্তূপের দিকে স্বভাবতই দৃষ্টি গেছে ওর।

‘ও, বাবা, অনেক কাজ করেছেন তো,’ শান্ত কণ্ঠে রানাকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। ব্যাণ্ডেজের খোলা রোলের দিকে এ মুহূর্তে নজর ওর। ‘বহুত আচ্ছা।’ ব্যাণ্ডেজের ভেতর থেকে বেরনো কাগজগুলো মেঝে থেকে সযত্নে কুড়িয়ে নিল ও। তারপর ওগুলো পকেটে পুরে চলে গেল হাই ভোল্টেজ ল্যাবোরেটরিতে। ইগরের নিষ্প্রাণ চোখজোড়া আমাদের ওপর স্থির। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল ভিজিল। ধক্‌ধক্ করে জ্বলছে দু’চোখ। ইগরকে কী একটা বলে এগিয়ে গেল রানার দিকে। কষে এক চড় বসাল ওর গালে। নড়ল না রানা।

‘এতবড় সাহস!’ গর্জে উঠেছে ভিজিল। ‘আমার কাগজপত্রগুলো তো পুড়িয়েছই, আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকেও ছাড়োনি।’

‘না, মঁসিয়ে,’ শান্ত স্বরে বলল রানা। ‘ও কাজটা আমাদের নয়।’

ভিজিল ওর কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না।

বরিস এত দেরি করছে কেন? জানালার দিকে দৃষ্টি গেল আমার। আমার ভাবনাটা বোধহয় বুঝে ফেলেছে ভিজিল। বিদ্রূপের হাসি ফুটল ওর ঠোঁটের কোণে।

‘বাকি বদমাশগুলোর কথা ভাবছ তো? ও আশা ছেড়ে দাও। ওদের সঙ্গে ভাগ্যক্রমে রাস্তাতেই দেখা হয়ে গিয়েছিল আমাদের।’ ইগরের দিকে ফিরল ও। ওকে ভেতরে নিয়ে আসুন।’

চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল ইগর। দু’জন সৈন্য ঢুকল ঘরে। দু’পাশ থেকে বগলের দু’দিক ধরে এক লোককে নিয়ে এসেছে। এই লোকটাই পালাতে পেরেছিল রবিন্সের সঙ্গে।

‘ওকে সার্চ করুন,’ আদেশ করল ভিজিল।

লোহার রডটা পাওয়া গেল। ভিজিল ওটা ইগরের হাতে দিতে বলল।

উভয় সঙ্কটে পড়েছি আমরা। এ লোকটার অপকীর্তির দায়ও কি আমাদের ওপর বর্তাবে নাকি? বরিস যেহেতু ধরা পড়েনি সেহেতু সামান্য হলেও রক্ষা পাওয়ার একটা আশা আছে। এ লোকটা যে আমাদের দলের নয় সেকথা মুখ ফুটে বললাম না আমরা। কিন্তু এ ব্যাটা ফস করে কিছু বলে বসবে না তো?

আমাদের তিনজনকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলল ওরা। কবজিতে দড়ির ঘষা খেয়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে সইতে লাগলাম।

‘রডওয়ালা সবার আগে,’ বলল ভিজিল।

আমার পাশের চেয়ারে বসা লোকটার দিকে এগোল ইগর। চেঁচাচ্ছে ও,

বিকট স্বরে। রডটা তুলে সজোরে ওর কাঁধে বসিয়ে দিল ইগর। হাড় ভাঙার শব্দ। আর্তচিৎকার। ইগর আবার রড তুলেও ভিজিলের নির্দেশে নামিয়ে নিল।

‘প্লিজ, কর্নেল,’ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলল ভিজিল। ‘অতখানি নিষ্ঠুর হবেন না। আমার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এসেছে।’

ভিজিলের নির্দেশে হাই ভোল্টেজ ল্যাবোরেটরিতে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয়া হলো আমাদের। মৃত অ্যাসিস্ট্যান্টটি মেঝেতে আমাদের পাশেই পড়ে রয়েছে। ল্যাবোরেটরির অন্য প্রান্তে তখন ভিজিল, বড় একটা চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। চেয়ে দেখি দুটো তামার বল ছাদ থেকে ধীরে-ধীরে নেমে আসছে।

‘আপনার জন্যে পরিচিত পরিবেশ, ডক্টর,’ সহজ গলায় বলল ভিজিল। ‘সময় নেই, নইলে আমার লেটেস্ট কাজ সম্পর্কে খানিক আলাপ করা যেত। তবে সে আনন্দ অন্যভাবে পুষিয়ে নেব আমি। বুঝবেন, বাঘের খাঁচায় ঢুকে কী ভুলটাই করেছেন। আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, কান দেননি। কাজেই বুদ্ধ বন্ধুগুলোকে নিয়ে মরা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আপনার। বলে রাখি, মরবেন কিন্তু হঠাৎই। এক মিলিয়ন ভোল্ট শরীরগুলো ছুঁয়ে দেবে কেবল। তখন বুঝবেন কোন পদ্ধতিতে মারা পড়লেন। হা-হা করে হাসল ভিজিল।

টান-টান দেখাচ্ছে রানাকে, তবে টু শব্দটিও করল না। আমিও ওর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলাম, যদিও ঘামে ভিজে যাচ্ছে সারা শরীর।

আমাদেরকে চেয়ারসুদ্ধ তুলে বসানো হয়েছে তামার বল দুটোর মধ্যখানে।

ভিজিল একটা সুইচের দিকে এগোল। হাত বাড়িয়েছে যেই অমনি বাইরে কীসের যেন শোরগোল শুরু হলো। ল্যাবোরেটরিতে ধেয়ে এল কাউণ্টেস।

এক ঝলকে আমাদের দেখে নিয়ে চাইল ভিজিলের দিকে।

‘শুনলাম সার্চলাইটটা নাকি ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাপার কী?’

‘ব্যাপার হচ্ছে এই তিন ভদ্রলোক, ম্যাডাম,’ জবাব দিল ভিজিল। ‘ইগর আর আমি ল্যাবোরেটরির ভেতরে পেয়েছি এদের। তল্লাশি করছিল। তা ছাড়া এরা আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকেও মেরে ফেলেছে। মিস্টার লিনফোর্ডের সম্মানে আমি এ তিনজনকে আমেরিকান আইন অর্থাৎ ইলেকট্রিসিটির মাধ্যমে মেরে ফেলব ঠিক করেছি।’

শীতল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চাইল কাউন্টেস। বুঝলাম, রাগে ফুঁসছে ভেতর-ভেতর।

‘আপনাদের দু’জনকে সাবধান করেছিলাম। আমার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করেননি, এখন প্রায়শ্চিত্ত করুন।’

রাগে কাঁপছে মহিলা। লক্ষ করলাম নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে নিজের ওপর। অতি কষ্টে সামলে নিয়ে ফিরল ভিজিলের দিকে।

‘কিছু হারিয়েছে?’

‘না,’ উত্তর এল। ‘তবে কিছু কাগজপত্র পুড়িয়েছে এরা।’

‘তবে এদের নিয়ে আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন।’

যাওয়ার জন্যে ফিরল সে। সুইচের কাছে আবার চলে গেছে ভিজিল। হঠাৎই ল্যাবোরেটরির ডান দিকের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। তারপর একটানা গুলির শব্দ। দেখলাম ভিজিল আর অন্য তিনজন লোক মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে।

কাউণ্টেসকে কভার দিয়ে দরজা দিয়ে পেছাচ্ছে ইগর। সেই সঙ্গে পাল্টা গুলি চালাচ্ছে। উল্টো দিক থেকেও অবিরাম গুলি বর্ষিত হচ্ছে। ঘরের বাকি লোক দু’জনও ঢলে পড়ল। ইগর অক্ষত অবস্থায় পালিয়েছে। এবার দৌড়ে ঘরে ঢুকে এল বরিস। তার পেছনে সশস্ত্র পাঁচজন বুনো চেহারার লোক। তাদের তিনজন ধাওয়া করল কাউন্টেস আর ইগরকে। বাকি দু’জন দরজায় পাহারায় রইল।

আমাদের দড়িমুক্ত করল বরিস। রানা দ্রুত ভিজিলের কাছে পৌছল। মারা গেছে বিজ্ঞানী। চেয়ারের লোকটিরও একই দশা। মাথা ছ্যাঁদা করে দিয়েছে বুলেট।

বরিসের লোক তিনজন ফিরল এ সময়। জানাল, কাউন্টেস আর ইগর গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছে।

বরিসের কাছ থেকে ম্যাচ চেয়ে নিল রানা। ভিজিলের পকেট হাতড়ে কাগজগুলো বার করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল ভিজিলের মহামূল্যবান ফর্মুলা।

ক’মিনিট পরে আমি আর রানা পাহাড় বেয়ে রবিন্সের গাড়ির কাছে নেমে এলাম। আমাদের বেঁধে রাখা লোকটাকে দেখতে পেলাম না। বলাই বাহুল্য, রবিন্স তাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে। খুলে নেয়া যন্ত্রাংশটা এঞ্জিনে আবার বসিয়ে দিল রানা। খুব সহজেই স্টার্ট নিল গাড়ি। উঠে বসলাম আমরা।

‘এক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে,’ বলল রানা।

বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ পরিষ্কার। বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। তবে কবজির ব্যথাটা ঘুম তাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করছে।

এখন বাজে পৌনে একটা। আর মাত্র পনেরো মিনিট। তারপরই শুরু হবে অভ্যুত্থান।

হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল আমাদের গাড়ি। ল্যাবোরেটরির দিক থেকে অতি উজ্জ্বল আলো উঠে যাচ্ছে আকাশে। ধ্বংস হয়ে গেছে ভিজিলের সাধের ল্যাবোরেটরি।

‘ভিজিল, তার ল্যাবোরেটরি আর ফর্মুলার একটা কপি খতম,’ বিড়বিড় করতে শুনলাম রানাকে। ‘এখন বাকি কেবল দ্বিতীয় কপিটা ধ্বংস করা।’