মারণাস্ত্র – ৩

তিন

এপ্রিল উনিশ-বিশ

মাসুদ রানা লে হাভরে থেকে ট্রেনে চাপল। গন্তব্য প্যারিস। নিজের মনেই বলল, ‘সাধ্যমত গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।’ ডক্টর পাশার পরিচয়ে ভ্রমণ করছে সে। ব্যাপারটা অনেকাংশে নিরাপদ। মাসুদ রানার পরিচয় লোকে জানলে সন্দেহ করতে পারে।

পাসপোর্ট বার করে দেখল ও। সবই ঠিক আছে। মনে-মনে হাসল রানা। নিরীহ ডক্টর ভালই খেল দেখালেন। আমোদ পাচ্ছে রানা। রবিন্স যখন জানবে ডক্টর পাশা মনে করে মাসুদ রানাকে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে, তখন ওর মুখের অবস্থাটা কেমন হবে? মুচকি হাসল রানা।

বেল বাজিয়ে ওয়েটারকে ডাকল ও। চায়ের অর্ডার দিল। রবিন্সের প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ওদের অ্যাডভাইজার হিসেবে এখন জোভোগোরোড থেকে গোপন ইনফর্মেশন সংগ্রহ করা সহজ হবে। একটা ব্যাপারে ওদের দু’জনেরই মিল রয়েছে: দু’জনই ভিজিলকে ঠেকাতে চায়। রুখতে চায় ইক্সানিয়ার নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির পরিকল্পনা। কদ্দূর সফল হবে সে পরের কথা। খোদার ওপর ভরসা রাখে ও।

চা খেয়ে রেস্টুরেন্ট বারের দিকে এগোল রানা, খাবারের অর্ডার দেয়ার জন্যে। তারপর বসে-বসে অন্যান্য যাত্রীদের দেখতে লাগল। দু’জন যাত্রী দৃষ্টি কেড়ে নিল ওর-একজোড়া নারী-পুরুষ। টেবিলে মুখোমুখি বসেছে তারা। মাথা দুটো ঝুঁকে পড়েছে সামনে। মাঝে মধ্যে দু’-একটা শব্দ কেবল কানে আসছে রানার। খুব সম্ভব রাশান ভাষায় কথাবার্তা হচ্ছে। মহিলা হঠাৎ মুখ তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল রানার সঙ্গে।

মাসুদ রানাকে টেনেছে অনেক মেয়েই, কিন্তু বাঁধনে জড়াতে পারেনি। মনটা বড় শক্ত ওর। মুক্ত পুরুষ। এ মুহূর্তে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো ওর। মেয়েটির সম্বন্ধে জানার জন্যে ভেতর-ভেতর তাড়না অনুভব করছে সে।

মেয়েটির একহারা গড়ন, ফর্সা গাল দুটোর হাড় সামান্য উঁচু। চোখজোড়া কালো, মায়াবী। কপালের ওপর ক’গাছা চুল পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছে। মুখের গড়নটা চমৎকার। একই সঙ্গে সেখানে কোমলতা আর দৃঢ়তার সংমিশ্রণ। পরনে দামি বাদামী পোশাক। সব মিলিয়ে সত্যিই আকর্ষণীয়! আত্মবিশ্বাসী চোখ দুটো জরিপ করছে অন্যান্য যাত্রীদের।

রানার চোখে আবারও চোখ পড়ল সুন্দরীর। মেয়েটি চকিতে দৃষ্টি ফেরাল সহযাত্রীর দিকে। সামান্য পরেই উঠে পড়ল ওরা, রেস্টুরেন্ট ছাড়ল।

রানাও ফিরে এল নিজের কম্পার্টমেন্টে। কৌতূহল অনুভব করছে। উত্তেজিত। দেখা হবে। সে জানে, কোথাও না কোথাও, কোনভাবে না কোনভাবে আবারও দেখা হবে মেয়েটির সঙ্গে।

প্যারিসে পৌঁছেই রানা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলো রিটজ হোটেলের দিকে। রবিন্সের সঙ্গে দেখা করবে। একটা ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। রবিন্সকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না সে কে। রবিন্স তাকে নিরীহ বিজ্ঞানী ভাবছে, ভাবুক। সে-ও ভান করে যাবে। সুবিধে হচ্ছে, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স সম্বন্ধে ওর নিজের জ্ঞান ডক্টর পাশার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এমনকী ইদানীং লক্ষ করছে, ডক্টর পাশার হাতের লেখা হুবহু বেরোচ্ছে ওর হাত দিয়ে। ও যে ডক্টর পাশা নয় তা বোঝে কার সাধ্য।

রিটজ হোটেলে ঢুকল গাড়ি। নেমে এল রানা। হোটেলটা বিলাসবহুল। এখানে এসে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে তার। কিন্তু রিসেপশনে গিয়ে জানল রবিন্স মিনিট দশেক আগে হোটেল ছেড়েছে, স্টেশনের উদ্দেশে।

রানা অনুমান করল, বুখারেস্টের ট্রেন ধরতে গেছে রবিন্স। ওখান থেকে হয়তো জোভোগোরোড যাবে। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল ও। ট্যাক্সি থামিয়ে উঠে পড়ল। পাঁচশো ফ্রাঁ ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। সময় মত স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারলে আরও পাঁচশো দেবে। হাওয়ায় ভেসে যেন স্টেশনে পৌঁছে গেল গাড়ি। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল রানা, ছুটছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। লাফিয়ে শেষ বগিটায় উঠতে পারল ও।

করিডর ধরে এগোল রানা। চলে এল ফাঁকা একটা কম্পার্টমেন্টে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই কাঁধে হাতের স্পর্শ পেল। পাঁই করে ঘুরল ও।

‘তো, শেষ পর্যন্ত মত পাল্টালেন, ডক্টর,’ বলল হ্যামণ্ড রবিন্স।