মারণাস্ত্র – ২

দুই

এপ্রিল সতেরো-আঠারো

উঠে পড়ল রবিন্স। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, তবে সরু চোখ দুটো জ্বলছে। ক্রুদ্ধ। মুখ খুলল ও। দূরাগত মনে হলো ওর কণ্ঠস্বর।

‘আমি হাল ছাড়ছি না, ডক্টর। আগামী দিন কয়েক প্যারিসের রিটজ হোটেলে থাকব। আজই রওনা হচ্ছি, প্লেনে। মত পাল্টালে…’

কর্ণপাত করলেন না ডক্টর। ক্লান্ত তিনি। কাজ করতে চাইছে না মাথা। খানিক পরে চোখ যখন তুললেন তখন নেই রবিন্স চলে গেছে।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন ডক্টর। হাত বাড়ালেন কফির কাপে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথা রাখলেন হাতে, বাইরের দিকে দৃষ্টি। আকাশে মেঘ করেছে। ঝিরঝির বৃষ্টি। আবারও মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন তিনি। নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন নিজের ওপর। ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে এলেন লাউঞ্জে।

আগুন জ্বালানো হয়েছে। ওটার কাছেই একটা চেয়ার পেতে বসলেন ডক্টর। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দু’চোখ। ভারী হয়ে আসছে চোখের পাতা। সব খাপছাড়া ব্যাপার দেখতে পাচ্ছেন যেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ধ্বংসের ছবি। পাক সেনাদের অত্যাচার-সুপার নিউক্লিয়ার বোমা।

আর্তচিৎকার করে জেগে উঠলেন তিনি। এক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন আগুনের দিকে। মাথা গুলিয়ে গেছে। চিন্তাভাবনাগুলোকে পর-পর সাজাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। রবিন্স। ওই উটকো লোকটাকে মনের পর্দা থেকে তাড়াতে পারছেন না কিছুতেই। লোকটার সাপের মত দৃষ্টি, আত্মবিশ্বাস-কোনটাকেই অস্বীকার করা যায় না। লোকটার কথা যদি সত্যি হয় তবে যে করে হোক ঠেকাতে হবে ভিজিলকে। কিন্তু কীভাবে? দরকার রানার মত একজন দুঃসাহসী লোক; যে একই সঙ্গে ভিজিল, ইক্সানিয়ার সরকার আর গানস অ্যাণ্ড রিসকে শায়েস্তা করতে পারবে।

কিন্তু বাস্তবে অমন লোক কোথায়? অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে মাসুদ রানা সিরিজের বইটা বার করলেন ডক্টর। ওটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল চল্লিশ নম্বর পৃষ্ঠা। পড়ছেন ডক্টর:

বিড়ালের ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে দেয়ালের ওপর দিকটা আঁকড়ে ধরল রানা। নীচে তাকাতেই দেখতে পেল লোহার মই বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে গুলজার। হাতে পিস্তল। একটা জানালার নীচে আশ্রয় নিল রানা। মুহূর্তের জন্যে নিরাপদ বোধ করল, তবে গুলজার দেখে ফেলেছে ওকে। পিস্তলে লোকটার আশ্চর্য হাত। নির্ভুল নিশানায় গুলি পাঠাতে পারে। বিপদে পড়ে গেছে রানা। ঢিবঢিব করছে হৃৎপিণ্ড। তবে মাথা ঠাণ্ডা রাখল ও। আলগোছে কোমর থেকে সিল্কের রশিটা খুলে নিল। জাপানের এক জেলে জিনিসটা দিয়েছিল ওকে, বন্ধুত্বের চিহ্ন। লোকটির জীবন বাঁচিয়েছিল রানা। দ্রুত হাতে রশিটা গোল করল ও, গিঁট দিল। সতর্ক চোখে চাইছে নীচের দিকে। গুলজার আর মাত্র ফুট কয়েক নীচে। ওঠানামা করছে ওর বুক। ঘর্মাক্ত মুখটা এখন আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে। তবে পিস্তল তৈরিই আছে শিকারের অপেক্ষায়। রশিটা ছুঁড়ে দিল রানা, নিঃশব্দে। পরমুহূর্তেই হাত থেকে অস্ত্রটা গায়েব হয়ে গেল গুলজারের। বিহ্বল দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে। দ্রুত নামতে চেষ্টা করছে।

‘একটু নড়াচড়া করলেই মরবে,’ কঠিন গলায় বলল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডক্টর পাশা। রানা পড়তে এখনও ভাল লাগে। কেমন যেন সাহস বেড়ে যায়। নিজেকে এখন আর বিজ্ঞানী বলে মনে হচ্ছে না তাঁর। আবারও মাথাচাড়া দিল পুরানো ইচ্ছেটা। রানাকে ঈর্ষা হচ্ছে। জমে গেছে বইটা পড়ে চললেন ডক্টর। পাতায় পাতায় শিহরণ। এ বইটিতে রানার ভূমিকা খুবই বলিষ্ঠ। গোপন মিশন নিয়ে ঢুকে পড়েছে সে ইজরায়েলে। চায়।

বা রবিন্সের কথা আপাতত বেমালুম ভুলে গেছেন ডক্টর। একটানা একশো বিয়াল্লিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে গেলেন বইটা। তারপর বন্ধ করে পকেটে ঢোকালেন। জানালায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে। রানা সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ হলে দুনিয়ার বিরাট উপকার হত। রবিন্স, ভিজিল আর তার বোমা সবই নস্যি হয়ে যেত তার সামনে। তা ছাড়া এখন কী করা উচিত তা-ও বুঝতে পারত রানা। চুপ করে চেয়ারে বসে ভাবছেন ডক্টর। পলকহীন চোখে বৃষ্টি দেখছেন। क

অবসাদগ্রস্ত ডক্টরের সর্বাঙ্গে আচমকা যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।

‘ঠিক মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে, বিড়বিড় করে বললেন ডক্টর। মুহূর্তের জন্যে শিথিল হলো মুখের পেশিগুলো, তারপর আবার দৃঢ় হয়ে গেল।

‘প্রথম কাজ হচ্ছে,’ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন তিনি, ‘গানস অ্যাণ্ড রিসকে ঠেকানো। আজ রাতেই জোভোগোরোড রওনা হব।’

হঠাৎ যেন চমক ভাঙল ডক্টরের। একথাগুলো কি তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়েছে? নাকি অন্য কেউ বলে গেছে কানের কাছে? হয়েছেটা কী তাঁর? ঘরে কেউ নেই। আপন মনেই কথা বলছেন তিনি।

অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন ডক্টর। ইচ্ছে করছে, এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে, বহুদিন যেন বুক ভরে তাজা বাতাস নেয়া হয়নি। ট্রুরোতে ছুটি কাটাতে যাবেন তিনি। যাবেনই। রবিন্স, ভিজিল আর দুনিয়ার মানুষ-কারও পরোয়া করেন না তিনি। তাঁর চাই শুধু বিশ্রাম, বিশ্রাম আর বিশ্রাম। অন্য মানুষদের নিয়ে কেন ভাববেন তিনি? তাঁর কী ঠেকা পড়েছে?

লন্সটন থেকে ট্রুরোর দিকে যাওয়ার পথটা নির্জন। ডক্টর ভাবলেন, টাটকা বাতাসে খানিকটা তরতাজা বোধ করবেন। কিন্তু এঞ্জিনের শব্দ আর বাতাসের গর্জন আরও বেশি কাহিল করে দিচ্ছে তাঁকে। ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইছে। গাড়ি চালানোর সময় আনমনে হঠাৎ একটু ঝিমিয়েও নিলেন তিনি। সেই ফাঁকে গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে চলে গেল পাশে। ভয় পেয়ে গেলেন ডক্টর। দ্রুত পালাতে হবে। মাথার ভেতর শুনতে পাচ্ছেন একটা কণ্ঠস্বর। অনবরত উপদেশ দিয়ে চলেছে। তারপর আরেকটা কণ্ঠ। রবিন্সের। বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে কথাগুলো।

‘মানবতার স্বার্থে মত আপনি পাল্টাবেনই, ডক্টর…মত আপনি পাল্টাবেনই, ডক্টর…মত আপনি পাল্টাবেনই, ডক্টর…’

এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়ল আরও। কিন্তু তারপরও তাড়ানো যাচ্ছে না শব্দগুলোকে। উপরন্তু তারাই তাড়া করে ফিরছে তাঁকে। শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরলেন ডক্টর। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে ঢুকে পড়েছে দু’চোখে।

‘মানবতার স্বার্থে মত আপনি পাল্টাবেনই…’ ক্রমান্বয়ে অন্য একটা বাক্য চলে এল প্রথমটার জায়গায়। জোরাল, জরুরি গলায়, নামতার মত করে একটা বাক্য বারবার বলে চলেছে কে একজন। মাসুদ রানার কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন এখন ডক্টর।

‘আজ রাতেই জোভোগোরোড রওনা হব… আজ রাতেই

হব…আজ জোভোগোরোড রওনা হব। আজ রাতেই জোভোগোরোড রওনা হব।’

চিৎকার করে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুললেন ডক্টর।

তীর গতিতে ছুটছে তখন গাড়ি। সোজা গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশের খাদে। মুহূর্তে জ্ঞান হারালেন ডক্টর।

.

রাত। চাঁদ উঠেছে। চোখ মেললেন ডক্টর। খাদে পড়ে রয়েছেন। উঠে বসলেন কোনমতে। উল্টে গেছে গাড়িটা। মাথায় খুব যন্ত্রণা বোধ করছেন তিনি। হাত দিতেই ভেজা-ভেজা ঠেকল। রক্ত চটচট করছে। দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর। চাঁদের আলো পানিতে পড়ে চকচক করছে। এগোলেন সেদিকে। ছোট একটা নদী। আঁজলা ভরে পানি তুলে নিয়ে ব্যথার জায়গায় লাগালেন। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি, ফলে সুবিধেই হলো। ধীরে-ধীরে গাড়ির দিকে হেঁটে গেলেন ডক্টর। অতিকষ্টে স্যুটকেসটা বার করতে পারলেন। উঠে এলেন রাস্তায়। থমকে দাঁড়াতে হলো, কোথায় যাবেন জানা নেই। হঠাৎই কথা বলে উঠলেন। ঝাড়া মুখস্থ করা কোন বিষয় আওড়াচ্ছেন যেন।

‘তো,’ শান্তস্বরে বললেন তিনি, ‘আমার কাজ হচ্ছে মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো।’ সামান্য বিরতি দিয়ে বলতে লাগলেন আবার। এবার আগের চেয়েও জোরাল কণ্ঠে।

‘প্রথম কাজ হচ্ছে গানস অ্যাণ্ড রিসকে ঠেকানো- আজ রাতেই জোভোগোরোড রওনা হব।’

কোটের কলার তুলে দিলেন ডক্টর। তারপর হাঁটা ধরলেন, দৃপ্ত পদক্ষেপে।

.

পরদিন বিকেল। স্যুটকেস হাতে এক ভদ্রলোককে প্লাইমাউথের ন্যাশনাল হোটেলে ঢুকতে দেখা গেল। রূম ভাড়া নেবেন। ভদ্রলোকটির দুটি ব্যাপার নজর কাড়ল রিসেপশন ক্লার্কের। একটি হচ্ছে তাঁর মাথার এক পাশের শুকনো রক্ত, আর অন্যটি তাঁর তীক্ষ্ণ, কঠিন চাহনি।

‘৪৫৬ নং, স্যর,’ বলল ক্লার্ক। ‘সই করুন।

বিনা দ্বিধায় সই করলেন চোট খাওয়া ভদ্রলোক। হল পোর্টারকে ইশারায় ডাকার আগে নামটার দিকে এক ঝলক চাইল ক্লার্ক।

‘মিস্টার মাসুদ রানার লাগেজ ৪৫৬ নম্বর রূমে পৌঁছে দাও,’ বলল সে।