ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ১

এক

শেষ পর্যন্ত তিনটের ঘণ্টা বাজল। আমরা সবাই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোলাম। বেরনোর সময় শুনতে পেলাম, জ্যামিতি স্যর মি. নেমারসন বলছেন, ‘ছুটির দিন দুটো তোমাদের ভাল কাটুক।’

হ্যাঁ, এবারের উইকএণ্ডটা দারুণ কাটবে, ভাবলাম। ভিড় ঠেলে লকারের দিকে এগিয়ে গেলাম। সোমবারের পরীক্ষাটার জন্য পড়াশোনার চেষ্টা করেই বেশিরভাগ সময় পার করতে হবে। ক্লাস শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে পরীক্ষার কথা জানিয়েছেন মি. নেমারসন। পড়াশোনার চেষ্টা বললাম কারণ জ্যামিতি মোটেই আমার প্রিয় বিষয় নয়।

কিন্তু তাই বলে এই টেস্টটাকে উড়িয়ে দিতে পারি না আমি, তাই নিশ্চিত হয়ে নিলাম লকার বন্ধ করার আগে জ্যামিতি নোটবইটা ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়েছি। রবিনকে বলতে পারি আমাকে সাহায্য করতে। ও শুধু অঙ্ক নয়, ইংরেজি, ইতিহাস, কিংবা অন্য যে কোন বিষয়ে পাকা। আর আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ট্র্যাক অ্যাণ্ড ফিল্ড।

বাইরে বেরনোর পর সামনের সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে তরতর করে নেমে এলাম। অন্তত দুই দিন আর স্কুলের পথ মাড়াতে হবে না। এসময় বাবাকে দেখতে পেলাম আমাদের মিনি-ভ্যানটার পাশে, আমার উদ্দেশে হাত নাড়ছে। ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক। ঝুম বৃষ্টি না হলে বাসা থেকে আমাকে নিতে গাড়ি আসে না।

কিছু একটা ব্যাপার আছে।

‘কীরে, মুসা, স্কুল আজ কেমন হলো?’ আমি পৌঁছনোর পর বলল বাবা। তার গলার অতি বন্ধুভাবাপন্ন সুরটা আমার কান এড়াল না। এর মানে খারাপ কোন খবর আছে।

‘তুমি এখানে কী করছ, বাবা? তোমার না অনেক কাজের চাপ?’ বললাম।

‘হ্যাঁ, কিন্তু কাজে বসার আগে কিছু কাজ সারতে হবে। স্টোরেজ থেকে কটা জিনিস বের করা দরকার।’

একথাগুলোও আমার কানে অদ্ভুত ঠেকল। স্টোরেজ থেকে মালপত্র বের করার এত তাড়া কীসের? টের পেলাম বাবা আমাকে কিছু একটা বলবে, এবং ব্যাপারটা যা-ই হোক না কেন সে নিজেও বিশেষ উৎসাহিত নয়। শেষমেশ সে বলল, ‘কটা বাড়তি জিনিসের দরকার পড়েছে, কারণ তোর নেলি খালা আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবে।’

নেলি খালা থাকতে আসছেন? এজন্যই বাবা কিছু বলতে চায়নি!

আমার মার খালাতো বোন নেলি খালা সম্পর্কে অল্প কথায় বলতে গেলে বলতে হয় তিনি খানিকটা অন্যরকম। পুনরায় দেহধারণ, এনার্জি ক্রিস্টাল এসব নিয়ে কারবার তাঁর। ব্যাপারটা বেশ বিদঘুটে। তবে নেলি খালার সঙ্গে আমার বনিবনা বেশ ভাল। ভিন্ন মানসিকতার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভাল মানুষ।

এবার আরেকটা চিন্তা ঘাই মারল আমার মাথায়। খাইছে, আমি অঙ্কের জাদুকর না হতে পারি, কিন্তু এটা গুণে বলে দিতে পারি আমাদের বাসায় মাত্র দুটো বেডরূম এবং তার একটা আমার।

‘নেলি খালা কোথায় ঘুমাবে?’ প্রশ্ন করলাম।

বাবা আমার কাঁধে একটা হাত রাখল।

‘তুই কী ভাবছিস জানি আমি, মুসা, এবং তুই ঠিকই ভাবছিস। তোর রূমটাই ওকে ছেড়ে দিতে হবে। এ ছাড়া আর জায়গা কোথায়?

খাইছে! ঢোক গিললাম আমি।

‘তাকে বেসমেন্টে রাখা যায় না?’ বাতলে দিলাম। ঠাট্টার ছলে বলেছি, কিন্তু বাবা চালকের আসনে বসার পর ব্যাপারটা নিয়ে যেন উল্টেপাল্টে ভেবে দেখল। তারপর মাথা ঝাঁকাল।

রওনা দেয়ার পর জানতে চাইলাম নেলি খালা আসছেন কেন।

‘ওর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে ভূমিকম্প জোরাল আঘাত হেনেছে, বলল বাবা। ‘তাই নিরাপত্তার খাতিরে ওকে সরে যেতে হচ্ছে। আমরা এ অবস্থায় ওকে ফিরিয়ে দিতে পারি না।

মনে পড়ল ক্যালিফোর্নিয়ায় সপ্তাহ দুয়েক আগে বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছিল।

‘নেলি খালা কতদিন থাকবে?’

বাবা শ্রাগ করল।

‘যদ্দিন না নিজের জন্যে নতুন একটা বাসা খুঁজে পায়,’ বলল।

‘তাতে কতদিন লাগতে পারে?’

‘জানি না। কয়েক মাস হয়তো।’

‘কয়েক মাস!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘তার বাড়ি ভেঙে গেছে বলে আমাকে নিজের সব ছেড়ে থাকতে হবে কয়েক মাস?’

‘দেখ, মুসা, কারও বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। কী করবি বল?’ আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল বাবা।

‘স্টোরেজ থেকে কী কী বের করতে হবে?’ পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানতে চাইলাম। আমি নিশ্চিত এই সপ্তাহান্তে ওখানে আমার বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করা হবে না।

‘তোর সাহায্য বেশি দরকার এক্সার-সাইকেলের জন্যে,’ বাবা বলল। ‘অন্যান্য জিনিস বের করা সহজ। জানিসই তো, এক্সট্রা বালিশ-বিছানা, তোয়ালে, এ ধরনের জিনিস।’

স্টোরেজ বিল্ডিঙের পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করানো হলো, বাবা লাফিয়ে নেমে পড়ল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে। ভিতরে ঢোকার আগে এটা জরুরি।

আমি এখানে আগেও বার দুয়েক এসেছি, এবং সত্যি কথাটা হচ্ছে এখানে আসতে ভাল লাগে না। এখানে এমন কিছু আছে আমার গা ছমছম করে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এটা স্রেফ একটা কুৎসিত বিল্ডিং, আর কিছু নয়। কিন্তু ভিতরটা বিশাল এক গোলকধাঁধার মত। সংযুক্ত হলওয়েগুলো যেন সবদিকে ছুটেছে। একবার হারিয়ে গেলে বেরনো শক্ত। আজীবনের জন্য যেন বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

এসব চিন্তা মাথায় ঘুরছে এসময় জোরাল এক শব্দে চমকে উঠলাম। বাবা মিনি-ভ্যানের সাইড ডোর হড়কে খুলেছে। ভিতরে মাথা গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আয়, মুসা।’

বাবাকে অনুসরণ করে স্টোরেজ বিল্ডিঙে ঢোকার পর নিজেকে বোকা মনে হলো। অচেনা, অন্ধকার জায়গায় যেতে ভয়-পাওয়া বাচ্চাদের মত করছি আমি। নিজেকে এসব কথা বলছি আর সরু হলওয়ে দিয়ে হাঁটছি, দরজার পর দরজা পেরোচ্ছি। শেষমেশ বাবা আমাদের স্টোরেজ লকার খুঁজে পেল।

কিন্তু আমার মন কুডাক ডাকছে। কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।