মারণাস্ত্র

মারণাস্ত্র – শামসুদ্দীন নওয়াব

[কাজী শাহনূর হোসেনের ‘প্রফেসর মাসুদ রানা’ বইটিকে তিন গোয়েন্দা সিরিজে রূপান্তর করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব।]

প্রথম প্রকাশ: ২০১৫

আমার কথা

ডক্টর হিরন পাশা
এফ. আর. এস., ডি. এস সি, ডি. এস সি., ফিজিসিস্ট
পার্কলেন, উইম্বলডন

যদ্দূর জেনেছি এ বইয়ের মুখ্য নায়ক আমি। গত বছরের এপ্রিল মাসের সতেরো তারিখ থেকে মে মাসের ছাব্বিশ তারিখের মধ্যকার ঘটনাগুলো নাকি আমিই ঘটিয়েছি।

চা ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না আমার, আবার হেসেও উড়িয়ে দিতে পারি না। আমাকে একটা ফটোগ্রাফ দেখানো হয়েছে। ইক্সানিয়ার জনৈক ফটোগ্রাফার (অবশ্যই খবরের কাগজের) তুলেছেন ছবিটি। পাঠানোও হয়েছে ইক্সানিয়া থেকেই। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ঠিক আমারই মত দেখতে এক লোক বড়সড় একটি গাড়ি থেকে নামছে। জায়গাটা জোভোগোরোড। এরপরও বিশ্বাস হতে চায় না। ওই শহরে কখনওই যাইনি আমি। তা ছাড়া ছবিটির ব্যাকগ্রাউণ্ডে মেশিনগান হাতে সৈন্য আর ব্যারিকেড দেখে ভড়কে গেছি আরও। কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র পছন্দ নয় আমার। আর গোলাগুলির শব্দ তো অসহ্য লাগে।

আমার নাম পড়ে পাঠকদের নিশ্চয়ই খটকা লেগেছে। সেটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, আমি বাঙালী। পড়তে এসেছিলাম ইংল্যাণ্ডে। ফিরে যাইনি আর। রয়ে গেছি এখানেই। এখন ইংল্যাণ্ডের নাগরিক। বাবা- মা মারা গেছেন, ভাই-বোনও নেই, ফলে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেই গেছে প্রায়। পাঁচ-সাত বছর পর-পর হয়তো যাওয়া হয় একবার, ব্যস। তবে দেশে গেলে একটা ব্যাপারে ভুল হয় না। বই কিনি প্রচুর। মাসুদ রানা সিরিজের বই। আমি মাসুদ রানার ভক্ত। বাঙালীদের গর্ব করার মত একজন চরিত্র বটে সে। এখানকার জেমস বণ্ডের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে রানার মত হয়ে যাই-স্পাই।

যা হোক, অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরছি। নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনে আমাকে নিয়ে রিপোর্ট বেরিয়েছে। লিখেছেন হেনরি লিনফোর্ড। প্রমাণ করেছেন, আমিই ছবির সেই মানুষটি। আমিই নাকি জোভোগোরোডে গিয়েছিলাম। হেনরি সাহেবও সেসময় ওখানে ছিলেন।

পাঠকদের জানিয়ে রাখছি, মার্কিন সাংবাদিকদের কোন বিশ্বাস নেই। ওরা তিলকে তাল আর তালকে তিল বানাতে ওস্তাদ। তবে মিস্টার হেনরি লিনফোর্ড যদি জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘ওই পাঁচ সপ্তাহ কোথায় ছিলেন আপনি, কী করেছিলেন?’ – সেক্ষেত্রে আমি লা জবাব। পুরো ঘটনাটিকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় থাকবে না আমার।

তবে কিছু ব্যাপার অবশ্যই জানা আছে আমার। সেগুলোর ক্ষেত্রে আমি সন্দেহমুক্ত। পাঠকদেরও তাই জানিয়ে দিচ্ছি।

আমার বয়স আটাশ। অবিবাহিত। পেশায় পদার্থবিদ। সতেরোই এপ্রিলের চার মাস আগে এক ইন্সট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে চাকরি নিই আমি। ওখানে জটিল এবং নতুন এক ধরনের অ্যাস্ট্রোনমিকাল যন্ত্র তৈরির কাজ করছিলাম। বলাই বাহুল্য, কাজটা কঠিন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ রাতদিন কাজ করেছি। প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। দিনকে দিন স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এপ্রিলের দশ তারিখে ডাক্তার দেখালাম। উনি বললেন: হয় লম্বা ছুটি, নয়তো শয্যা নেয়ার জন্যে তৈরি হতে হবে।

প্রথমে কোম্পানির কাজটা সারব ঠিক করলাম। ছুটি নেব ক’দিন পর। হাউসকিপারকে বলে দিলাম চিঠি এলে ফরওয়ার্ড করে দিতে। তারপর এল সেই সতেরোই এপ্রিল। ভোর সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। একা। কর্নওয়ালের ট্রুরোতে যাব। বেলা দেড়টায় পৌঁছলাম লন্সটনে। লাঞ্চ সারতে ঢুকলাম এক হোটেলে।

এরপর থেকে স্মৃতি আর ভাল কাজ করেনি। হোটেলে ঢোকার কথা মনে আছে। কিন্তু বেরিয়েছিলাম কিনা মনে পড়ে না। এক কাপ কফি পান করেছিলাম। আর কিছু খেয়েছিলাম কিনা জানি না। রহস্যময় আগন্তুক রবিন্সের কথা কিচ্ছু মনে নেই। আবছা মনে পড়ে, অসুস্থ বোধ করছিলাম। হোটেলের লাউঞ্জে চলে গিয়েছিলাম, খানিকক্ষণ বসে থাকার জন্যে। হিপ পকেট থেকে বার করেছিলাম মাসুদ রানার একটা কপি। ওটা নিয়ে এসেছিলাম সময় কাটানোর জন্যে। কভারে এক সুদর্শন যুবকের ছবি। হাতে ওয়ালথার পি. পি. কে। মনে হলো, বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করছি। তারপরই দেখলাম গাড়ি চালাচ্ছি। কেমন যেন ঘুম-ঘুম ভাব, আচ্ছন্নতা। নিজেকে আবিষ্কার করলাম বেল প্যারিস এক্সপ্রেসে। ট্রেনের গার্ড জোর করে হুইস্কি ঢালছে, আমার দাঁত ফাঁক করে। সেদিনটি ছিল মে মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই পাঁচ সপ্তাহের ভেতর কী যে ঘটে গেছে কিছুই জানা নেই আমার। মে-র ছাব্বিশ তারিখে বেরিয়েছিলাম এক কাপড়ে। সঙ্গে ছিল পাসপোর্ট। ছিল না বাক্স প্যাটরা বা অন্য কোন জিনিসপত্র। আমার বিশ্বাস, প্যান্টের পকেটে একটা ফটো ছিল-কার তা জানি না—তবে একজন মহিলার। পরে অবশ্য ফটো বা পাসপোর্ট কোনটাই পাইনি।

পরবর্তী ক’মাস খুব ভুগলাম। ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। খানিকটা সামলে ওঠার পরে যে গল্পটা তোমরা পড়বে সেটা শুনলাম। আমাকে নিয়ে গল্প অথচ আমি নিজেই জানি না। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর নয়? যা হোক, যে কাণ্ডটা আমি ঘটিয়েছি (!) সেটা তোমরাও শোনো–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *