মারণাস্ত্র – ৬

ছয়

এপ্রিল একুশ-তেইশ

পরবর্তী আটত্রিশ ঘণ্টা বিনা ঘটনায় কেটে গেল। বুখারেস্টে সন্ধের আগ দিয়ে পৌঁছল ওরা। এক ঘণ্টা পরে অন্য ট্রেন ধরে জোভোগোরোড রওনা হলো। কম্পার্টমেন্টটা নোংরা, তা ছাড়া আরামদায়কও নয়। যাত্রাটা সুখকর হবে না খুব একটা, বুঝল রানা।

কাউণ্টেস আর তার সঙ্গী অর্থাৎ মিনস্কিকে পরের বগিটায় পাওয়া গেল। আর্মির পোশাক পরা আরও দু’জন গুঁফো লোকও রয়েছে সেখানে। রানা লক্ষ করল, দু’জনের কারও সঙ্গেই লাগেজ নেই। এ ছাড়া কামরায় বেশ কিছু গ্রাম্য লোকজন দেখতে পেল ও। পরিবার- পরিজন নিয়ে চলেছে তারা।

রবিন্সকে খুব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। জানিয়েছে, ইক্সানিয়ায় কাজ সারতে দেরি হওয়ার কথা নয়। দু’-তিন দিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় তথ্য হাতে চলে আসবে বলে আশা তার।

রানা বুঝে পেল না, কেন তবে ছ’মাসের জন্যে কন্ট্রাক্ট করা হয়েছে তাকে।

রাত দুটোয় ইক্সানিয়ার সীমান্তে পৌঁছল ওরা। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল রানা। তীব্র শীত। গা গরম করার জন্যে পায়চারি শুরু করল ও। কিছুক্ষণ পরেই একজন সঙ্গী জুটে গেল। লম্বা মত এক আমেরিকান যুবক। উলোঝুলো অবস্থা।

‘কেমন আছেন, ডক্টর?’ জিজ্ঞেস করল যুবক।

অবাক হয়ে গেল রানা। কোনদিন দেখেনি একে।

‘অবাক হয়েছেন, না?’ প্রশ্ন করল যুবক, ‘আমি আমেরিকার ট্রিবিউন পত্রিকার সাংবাদিক। ক’দিন আগেই আপনার একটা আর্টিকেল ছেপেছি আমরা।’

উভয় সঙ্কটে পড়েছে রানা। স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করতে পারছে না। তা ছাড়া রবিন্স কাছেপিঠেই রয়েছে। সে রানার আসল পরিচয় জেনে ফেললে বিপদ। রানা আরেকবার বুঝল, ডক্টর ভদ্রলোক খুবই পরিচিত। রবিন্স এবং অন্যান্য যাত্রীরাও নেমে এল এ সময়। মৃদু হেসে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইল রানা। বড়সড় এক কুঁড়েতে শীত- কাতর মানুষগুলোকে নিয়ে যাওয়া হলো। মিনস্কিকে দেখতে পেল রানা। কিন্তু কাউন্টেস নেই। খানিকটা হতাশ হলো ও। হঠাৎ একটা মার্সিডিজে উঠতে দেখা গেল কাউণ্টেসকে। দ্রুত ছুটল গাড়িটা। বোধহয় তাড়া আছে মহিলার।

পাসপোর্ট পরীক্ষা করার পর কাস্টমস অফিসাররা যাত্রীদের লাগেজ হাতড়াতে শুরু করল।

রানার ক্যামেরাটা নিয়ে নিল তারা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পেছনের পকেটে রাখা পিস্তলটার খোঁজ পেল না।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই সশব্দে হেসে উঠল রবিন্স।

‘ডক্টর,’ আমুদে গলায় বলল ও, ‘কাউন্টেস ক্যারেনিনার ভাবসাব সুবিধের ঠেকছে না। আমার তো ধারণা ও আপনার প্রেমে পড়ে গেছে।’

মৃদু হাসল রানা।

‘ক্যামেরাটা ভাল জাতের ছিল,’ বলল ও,

ও, ‘ইচ্ছে ছিল জোভোগোরোডের কিছু ছবি তুলব। হলো না। আবার আরেকটা কিনতে হবে।

পকেট থেকে ঠিক আগেরটার মত দেখতে একটা ক্যামেরা বার করে দিল রবিন্স।

‘এটা রাখুন, কাজে দেবে। জানতাম আপনার ক্যামেরাটা কেড়ে নেবে, তাই আমিও একটা কিনে রেখেছিলাম। এখন যত খুশি ছবি তুলবেন।

ওভারকোটটা টেনে-টুনে আরাম করে বসল রবিন্স। ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগল না ওর।

রানারও চোখ বুজে এল। ঘুমাল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎই চমকে জেগে উঠল। কোথাও কোন গণ্ডগোল হয়েছে। ট্রেন তখন পক্ষীরাজের মত ছুটে চলেছে। পুবাকাশে একবার বিদ্যুৎ চমকাল। এ সময় করিডরের অন্য প্রান্ত থেকে শব্দ এল। গুলি, কোন সন্দেহ নেই। মুহূর্ত পরে আরও দু’বার।

সময় নষ্ট না করে করিডরে চলে এল রানা। অন্ধকার, ভাল করে ঠাহর করা যায় না। দুটো আবছা শরীরকে করিডর ধরে এগোতে দেখল ও। উত্তেজিত কণ্ঠের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। গুলির শব্দ অন্যরাও শুনেছে। আচমকা ব্রেক চাপার তীক্ষ্ণ শব্দ। সামনের দিকে হুমড়ি খেতে গিয়ে সামলে নিল রানা। থেমে গেছে ট্রেন। কে যেন অ্যালার্ম বাজিয়েছে। রানার সামনে তিনটে ফাঁকা কামরা। ট্রেন থামতেই একটার বাইরের দিকের দরজা খুলে গেল। চোখের পলকে পরবর্তী কামরায় পা রাখল রানা। ঝুঁকে পড়ল জানালা দিয়ে। দুটো ছায়ামূর্তি দ্রুত পায়ে মাঠ পেরোচ্ছে।

করিডরে ফিরে এল রানা। টর্চ হাতে এক গার্ড এদিকেই আসছে। রবিন্সও বেরিয়ে এসেছে। তাকে সব কথা খুলে বলল রানা।

গার্ড উঁকি দিচ্ছে প্রতিটা কামরাতে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। তার পেছনে জুটে গেল যাত্রীদের অনেকে, ঠেলে জায়গা করে নিয়ে এগোল রবিন্স। পৌঁছেছে গার্ডের কাছে। টর্চটা উঁচিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গার্ড। চোখ দুটো বিস্ফারিত, মুখ হাঁ।

একটা লোকের শরীর। অর্ধেকটা সীটে, বাকিটা মেঝেতে। কপালের ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে নামছে। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। আতঙ্কিত চাহনি, বিকৃত দেখাচ্ছে মুখ। তবে তাকে চেনা যাচ্ছে পরিষ্কার। মিনস্কি।

রবিন্সের সঙ্গে কম্পার্টমেন্টে ফিরে এল রানা। জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত রবিন্সের। মুখে কথা নেই। মনে-মনে লোকটির প্রশংসা করল রানা, নিজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছে। তাকে অস্ফুটে কী যেন একবার বলেই বসে পড়ল সীটে।

‘ডক্টর,’ তিক্ত শোনাচ্ছে রবিন্সের কণ্ঠ, ‘আমি ভুল বলেছিলাম। জোভোগোরোডে আসলে আমাদের বেশ কিছুদিন থাকতে হবে।’

ওভারকোটটা ভাল করে গায়ে জড়াল রবিন্স, তারপর আবার ঘুমের অতলে ডুব দিল। ট্রেনের অফিসাররা তখন প্রশ্ন করছে যাত্রীদের। রানা মুখ বন্ধ রাখল। জানাল, কিছুই দেখেনি সে। তবে, সৌভাগ্যক্রমে অন্য একজন যাত্রী পালাতে দেখেছে দুটো লোককে। ভাল করে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দুই গুঁফো মিলিটারি গায়েব।

এ ঘটনার ফলে বেশ কিছু ব্যাপার খোলসা হয়ে গেল রানার কাছে। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের সঙ্গে মিনস্কির যোগাযোগের খবর গোপন থাকেনি। কাউণ্টেস ক্যারেনিনা মিনস্কির সহযাত্রী হয়েছিল দুটো কারণে; সে চেয়েছিল রবিন্সের সঙ্গে যাতে মিনস্কির আর যোগাযোগ না হয়। তা ছাড়া মিনস্কির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য সেরা জায়গা নিঃসন্দেহে ইক্সানিয়া। মিনস্কির হত্যাকারীরা বুখারেস্টে উঠেছিল, ট্রেনে। খুনীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সীমান্তে নেমে গেছে কাউন্টেস।

‘বেশি জেনে ফেলেছিল বেচারা,’ পরে রানার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বলল রবিন্স।

রানার মৃত্যুও কি এমন আচমকাই আসবে?

রবিন্সের ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি। তবে চোখ দুটোয় তার লেশমাত্র নেই। অস্বস্তি বোধ করছে রানা।