ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ৬

ছয়

বলতে দ্বিধা নেই দরজা বন্ধ হয়ে বাস রওনা দিলে নার্ভাস বোধ করতে লাগলাম আমি। আমাকে বোধহয় নার্ভাস দেখাচ্ছিল, কেননা নেলি খালা আমার দিকে চেয়ে হাসতে শুরু করলেন।

‘আমি ঠাট্টা করেছি, মুসা!’ এবার ভাড়ার বাক্সে এক মুঠ কয়েন ফেললেন। ‘আমাকে তুই ভয় পাস?’

ঠিক করলাম জবাব দেব না, স্মিত হাসলাম শুধু।

প্রথম দুটো খালি সিট দখল করলাম আমরা, এবং বলে চললেন নেলি খালা, ‘মুসা, তুই তোর ঘরটা আমাকে ছেড়ে দেয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমিও তোর জন্যে কিছু করতে চাই, তাই তোকে স্পেশাল একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’

‘তার দরকার নেই,’ বললাম।

‘না, যেতে হবে। শেষ কবে তুই আর্ট মিউজিয়ামে গেছিস?’

‘খাইছে, আর্ট মিউজিয়াম?’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। ‘আমরা ওখানে যাচ্ছি?’

‘জানতাম তুই খুশি হবি!’ বলে আমার উদ্দেশে চওড়া হাসলেন তিনি।

হ্যাঁ, খুশিই বটে। আসলেই আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছেন নেলি খালা!

বাস রাস্তা দিয়ে চলেছে, প্রায় জনা পঞ্চাশ ছেলে-মেয়েকে কিক বল, সকার কিংবা হপস্কচ খেলতে দেখলাম। আরেক রাস্তার মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল এক দল স্কেটবোর্ডার পালা করে এক প্লাইউড র‍্যাম্প বেয়ে সাঁ করে উঠে যাচ্ছে। শহরের সবাই মজা করছে। আমি বাদে।

‘ওই বেচারীদের দেখ,’ স্কুলইয়ার্ডে কয়েকটা ছেলে হুপ শুট করছে দেখে বললেন নেলি খালা, ‘ওরা তোর মত লাকি নয়, বিখ্যাত সব মানুষ আর মাস্টারপিসের সাথে বিকেলটা কাটাতে পারছে না।’

‘আমি লাকি!’ গুঙিয়ে উঠলাম। মনে পড়ল কালো বিড়ালটার কথা। কী ধরনের দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল ওটা কে জানে।

কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম, আর্ট মিউজিয়ামটা মন্দ লাগছে না। সত্যি কথা বলতে, গোটা দুয়েক জিনিস, যেমন মিশরীয় মামি কেস, দারুণ লাগল।

নেলি খালা যখন একটা পেইন্টিং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছেন, যেটা দেখে আমার মনে হলো চার বছরের বাচ্চার আঁকা কোন স্ট্রীট ম্যাপ, আমি আলগোছে সরে পড়লাম। বিভিন্ন কামরা ভেদ করে হেঁটে গেলাম। ছবি আর ভাস্কর্যগুলো নিরীখ করলাম। কিন্তু কোনটাই আমাকে আকর্ষণ করতে পারল না। অন্তত যতক্ষণ না মেইন গ্যালারিতে গেলাম।

দূরের দেয়ালে এক লোকের পোর্ট্রেট। ওটার দিকে এক পলক চেয়েই সভয়ে শ্বাস চাপলাম। এবার চোখ পিটপিট করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম ভুল দেখছি না। ধীর পায়ে পেইন্টিংটার কাছে হেঁটে গেলাম, কাছে যেতে ভয়ই পাচ্ছি। পেইণ্টিঙের মুখটা জরিপ করলাম। কোন ভুল নেই।

এটা সেই ভ্যাম্পায়ারটার পোর্ট্রেট!

চুলের স্টাইল ভিন্ন এবং পরনের পোশাক প্রাচীন আমলের, গত শতাব্দীর মত। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে চোখজোড়া রক্তলাল নয়। কিন্তু মুখের চেহারায় কোন ভুল নেই। এটা সে-ই।

কাছিয়ে গিয়ে ফ্রেমের নীচের প্লাকটা পড়লাম: ক্রিস্টোফার পাইকের পোর্ট্রেট, সির্কা ১৮৪৩।

খাইছে, ১৮৪৩!

খানিকটা পিছিয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম পেইণ্টিঙের কালো চোখজোড়া যেন আমাকে অনুসরণ করছে, আমি যেখানেই দাঁড়াই না কেন। এমনকী আমি যখন হাঁটু গেড়ে বসে মুখ তুলে চাইলাম, পেইণ্টিঙের মুখখানা সরাসরি আমার দিকে চেয়ে ছিল! জানি না ওখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। শুধু এটুকু জানি যখন এক লোক আমার পিছনে এসে বলে ওঠে, ‘ইন্টারেস্টিং লোক, তাই না?’ রীতিমত আঁতকে উঠি আমি!

চরকির মতন ঘুরে দাঁড়াতেই ক’ইঞ্চি দূরে এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। চোখে পুরু কাঁচের চশমা। মুখে ধূসর দাড়ি।

‘চমকে গেলে মনে হচ্ছে,’ বলল লোকটা। এবার লক্ষ করলাম তাঁর পরনের ব্যাজ বলছে তিনি ডক্টর এম. মন্টগোমারি, মিউজিয়াম কিউরেটর। ‘তুমি এত মন দিয়ে পেইন্টিংটা দেখছিলে,’ বলে চললেন তিনি, ‘যে আমার মনে হলো তোমার হয়তো এটা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে।’

খাইছে, পেইণ্টিঙের ভয়ঙ্কর লোকটা সম্পর্কে আমার তো সত্যিই অনেক প্রশ্ন আছে!

‘জি, আমি এই লোকটা সম্পর্কে স্কুলে একটা রিপোর্ট লিখব ভাবছিলাম। আপনি হয়তো এ ব্যাপারে আমাকে হেল্প করতে পারবেন।’

আমার কথাগুলো নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য শুনিয়েছে, কারণ ডক্টর মণ্টগোমারি আমাকে তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন, ক্রিস্টোফার পাইক সম্পর্কে কথা বলার জন্য।

বাবা-মা আর কখনও যদি আমাকে অগোছাল ঘরের জন্য বকে, তা হলে আমি তাদেরকে ড. মন্টগোমারির অফিসে নিয়ে আসব। প্রতিটা দেয়ালে বুককেস, সব কটা ঠাসা বই, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজে। কামরার মাঝখানে বড় এক স্তূপ কাগজ এবং তার নীচে কোথাও ড. মন্টগোমারির ডেস্ক।

এক চেয়ার থেকে এক গাদা কাগজ সরিয়ে আমাকে বসতে বললেন তিনি।

‘তো, তুমি ক্রিস্টোফার পাইককে নিয়ে স্কুলে রিপোর্ট করছ?’ প্রশ্ন করে, পুরানো এক অফিস চেয়ারে বসলেন তিনি। চেয়ারটা ককিয়ে উঠে প্রতিবাদ জানাল।

‘জি, স্যর,’ আমি বললাম। আসলে তো করছি না, কিন্তু তাঁকে তো বলতে পারি না দেড়শো বছর আগে ছবি আঁকা লোকটার সঙ্গে গত রাতে দেখা হয়েছে আমার।

‘এতে বোঝা যায় আমরা গত শতাব্দীতে কতটা এগিয়ে গেছি। একশো বছর আগে, ক্রিস্টোফার পাইকের নাম উচ্চারণ করাটাও বিপজ্জনক ছিল।’

‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ক্রমেই আগ্রহ বোধ করছি।

‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত মানুষদের বোকামির কারণে। ক্রিস্টোফার পাইক উনিশ শতকে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সওদাগর ছিলেন। তাঁর জাহাজ বহর ছিল। ইউরোপ, আফ্রিকা, চীনসহ সারা দুনিয়া থেকে মালপত্র আমদানী করতেন। তিনি ছিলেন সে সময় লস এঞ্জেলেসের কয়েকজন বড়লোকের মধ্যে একজন। লোকে তাঁকে ভয়ানক ভয়ও পেত। ক্রিস্টোফার পাইককে নিয়ে অনেক ধরনের গুজব চালু ছিল।’

‘কী ধরনের গুজব?’

হাত বাড়িয়ে বুকশেলফ থেকে প্রাচীন এক বই নামালেন ড. মণ্টগোমারি এবং ফুঁ দিয়ে ধুলো ওড়ালেন।

‘এটা রকি বীচের টাউন হিস্ট্রি, শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রকাশিত হয়,’ বলে, পাতা উল্টালেন। ‘হ্যাঁ, এই যে, পড়ে শোনাচ্ছি। ‘গুজব ছিল ক্রিস্টোফার পাইক কোনভাবে অমরত্ব লাভ করেছেন। এলাকাবাসীদের মধ্যে যারা বয়স্ক তারা যখন ছোট ছিল তখন ক্রিস্টোফার পাইক পূর্ণবয়স্ক মানুষ, তারা দাবি করেছে সত্তর বছরে তাঁর বয়স একদিনও বাড়েনি।’ ড. মন্টগোমারি মুখ তুলে আমার দিকে চাইলেন। ‘আরও জানতে চাও?’ প্রশ্ন করলেন।

সাগ্রহে মাথা ঝাঁকালাম।

‘ক্রিস্টোফার পাইককে নিয়ে গুজব আরও ডালপালা মেলে ১৮৬৪ সালে, তাঁর মৃত্যুর পর। সরকারিভাবে বলা হয়, তিনি তাঁর জাহাজ দ্য গোস্ট হান্টার-এর সঙ্গে সলিল সমাধি লাভ করেন। মেক্সিকান উপকূলে এক ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল জাহাজটা। তবে রকি বীচের লোকজন এরপরও তাঁকে বছরের পর বছর দেখতে পেয়েছে, যদিও শুধু রাতের বেলা। পাইকের কুখ্যাতি আরও বাড়ে ১৮৯০ সালে, যখন এলাকায় রহস্যময় এক মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেদের ধারণা হয়, এটা প্রমাণ করে পাইক–’’

‘ভ্যাম্পায়ার হয়ে গেছেন!’ বলে উঠলাম।

‘হ্যাঁ,’ ড. মন্টগোমারি বললেন, ‘তবে আরও বেটার কিছু। পাইক সাধারণ কোন ভ্যাম্পায়ার ছিলেন না। লোকে মনে করত তিনি বহুরূপী।’

মেরুদণ্ড বেয়ে হিমস্রোত নেমে গেল আমার। স্টোরেজ বিল্ডিঙের সেই হিংস্র, রক্তচক্ষু বিড়ালটার কথা মনে করে।

‘বহুরূপী কী?’

‘এটা এসেছে নেটিভ আমেরিকান মিথলজি থেকে। বহুরূপী যে কোন জ্যান্ত প্রাণীর রূপ ধরতে পারে। সাধারণ ভ্যাম্পায়ার যেখানে শুধু বাদুড় বা নেকড়ে হতে পারে, বহুরূপীকে তুমি বলতে পারো আরও অনেক বেশি প্রতিভাবান ভ্যাম্পায়ার। খলখল করে হেসে উঠে ফট করে বইটা বন্ধ করলেন ড. মন্টগোমারি।

‘আপনি এসবে বিশ্বাস করেন?’ সাবধানে প্রশ্ন করলাম।

‘ভ্যাম্পায়ার? বহুরূপী? কী যে বলো না। আমরা আজকে জানি মহামারী হয় ভাইরাস থেকে, ভ্যাম্পায়ার থেকে নয়। আর রূপ বদলের ব্যাপারে বলা যায়, তুমি যদি গোয়ালের কোন গরুর দিকে তাকাও তা হলে মনে হতে পারে তুমি ঘৃণা কর এমন কেউ তোমার দিকে পাল্টা চেয়ে রয়েছে-এজন্য অবশ্য প্রচণ্ড চেষ্টা করতে হবে। না, ক্রিস্টোফার পাইক ছিলেন নিষ্ঠুর এক ব্যবসায়ী, যে কারণে মানুষ তাঁকে শয়তানের প্রতিমূর্তি ভেবে নিয়েছে-কিন্তু আমি মনে করি না তিনি ভ্যাম্পায়ার ছিলেন।’

বাজি ধরবেন? ভাবলাম। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম।

‘বয়স না বাড়ার ব্যাপারটার কী ব্যাখ্যা দেবেন?’

ড. মন্টগোমারি ডেস্কে দু’হাত ভাঁজ করে রেখে আমার উদ্দেশে মৃদু হাসলেন।

‘তুমি কি দেখতে তোমার বাবার মতন?’

‘খানিকটা।’

‘আমি শিয়োর ক্রিস্টোফার পাইক তাঁর বাবার মত দেখতে ছিলেন। বুড়োরা ছেলেকে বাবা মনে করেছে। ব্যাপারটা সিম্পল।’

‘তা হতে পারে,’ বলে হাসার ভান করলাম।

‘আমরা লাকি যে পূর্বপুরুষদের মত আমাদের জীবনে কুসংস্কারের সেই প্রভাব নেই। যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন কিছু এজগতে নেই।

ভদ্রলোক সম্ভবত তখনও ভাবনায় মশগুল ছিলেন, এসময় দড়াম করে খুলে গেল তাঁর অফিসের দরজা এবং একটা আর্তচিৎকারে ভরে উঠল কামরাটা।