ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ১০

দশ

লক্ষ করছি, আতঙ্কে স্থাণু হয়ে গেলাম। নেলি খালার দেহ রূপান্তরিত হলো ক্রিস্টোফার পাইকে এবং এগিয়ে আসতে লাগল আমার উদ্দেশে। ঝট করে রিসিভারটা তুলে নিলাম আমি। রবিনের নম্বরে টিপে দিলাম। ও জবাব দিতেই চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ও এখানে!’ তারপর রিসিভারটা আবার ফেলে দিলাম।

‘তোমার বন্ধুকে আমাদের সাথে যোগ দিতে বলো,’ বলল পাইক, এক সারি ঝকঝকে সাদা, ধারাল দাঁত দেখাল। এবার পেটে হাত বুলাল। ‘আমার পেটে ওর জন্যেও জায়গা হয়ে যাবে।’

মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু একটা বেরিয়ে এল। দৌড়াও!

সোজা বেসমেন্টের দিকে ছুটলাম। বাতির সুইচ টিপে দিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে নেমে যাচ্ছি, কিন্তু নীচে যা দেখলাম তাতে মনে হলো এখানে না এলেই ভাল হত। একটা কফিন। পাইকের কফিন। ও আমাদের বেসমেন্টে আস্তানা গেড়েছে!

আতঙ্কিত না হওয়ার চেষ্টা করলাম। সিঁড়ির দিকে ঘুরে দৌড় দিলাম, কিন্তু পাইক সিঁড়ির মাথায় দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। বেরনোর ওটাই একমাত্র পথ।

খাইছে!

‘আ-আপনি কী চান?’ তুতলে বললাম।

‘তুমি যা চাও ঠিক তাই,’ বলল পাইক। ধীরে-ধীরে নেমে আসছে সিঁড়ি ভেঙে। ‘তুমি আমাকে ধ্বংস করতে চাও। আমি দুই শতাব্দী ধরে এখানে রাজত্ব করে আসছি। দুটো ছেলের জন্যে তা নষ্ট হলে আমি মেনে নেব কেন?’

কফিনটার দিকে আঙুল তাক করলাম।

‘ওটা এখানে নিয়ে এলেন কেন?’

পাইককে আমোদিত মনে হলো।

‘কেন?’ বলল। এবার আমার কণ্ঠকে বলতে শুনলাম, ‘আমি একা কোথায়, তুমি তো-’ তবে কথাগুলো আমি বলছি না। পাইক আমার গলা নকল করছে!

ভ্যাম্পায়ারটা হেসে উঠল।

‘হ্যাঁ, আমি তোমার খালাকে ফোন করে বলেছি তুমি তোমার বন্ধুর বাসায় থাকবে। দেখতেই পাচ্ছ, আমি একবার তোমার হাত থেকে মুক্তি পেলে তোমার রূপ ধরতে পারব।’ কথাটা প্রমাণ করতেই যেন আমার যমজ ভাইয়ে রূপ নিল রক্তচোষাটা!

গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল আমার। শিউরে উঠলাম।

‘আমার চোখের দিকে তাকাও,’ বলল পাইক। যত চেষ্টাই করি না কেন তাকাব না, আবিষ্কার করলাম ওর রক্তচক্ষুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি আমি। মাথা তুলে রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। পাইক আবারও আমাকে সম্মোহিত করছে! ঠিক এসময় পরিচিত এক কণ্ঠস্বর শুনলাম।

‘মুসা, কোথায় তুমি?’

মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠলাম। কেটে গেল ঘোর।

কিশোর! নিশ্চয়ই রবিন ওকে নিয়ে এসেছে।

‘বেসমেণ্টে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ভ্যাম্পায়ারটা আমার কথাটা প্রতিধ্বনি করল। কিশোর আর রবিন ল্যাণ্ডিঙে এসে থমকে দাঁড়াল। মুখের চেহারায় বিস্ময়।

‘দু’জন মুসা কেন?’ বলে উঠল কিশোর।

‘আমি আসল!’ চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘না,’ আমার গলা নকল করে বলল পাইক, ‘আমি!’

‘মুসা, আমাদেরকে কোন ধরনের কু দাও,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল রবিন।

এসময় দেখতে পেলাম ভ্যাম্পায়ারটা হাত দিয়ে চোখ ঢাকছে। বুঝে গেলাম কেন।

‘ও চোখ লুকাচ্ছে, কারণ ধরা পড়ে যাবে। ওগুলো লাল! তোমরা আমার চোখের দিকে তাকাও!’

কিশোর আর রবিন চাইল। তীক্ষ্ণ চোখে। এবার গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘পালাও, মুসা!’

সিঁড়ির দিকে ছুটলাম। ধাওয়া করল পাইক, কিন্তু তৈরি হয়ে এসেছিল রবিন। ওর ব্যাকপ্যাকটা উল্টে দিল। রক্তচোষাটার শরীর লক্ষ্য করে ঝাঁকি দিয়ে ফেলতে লাগল অজস্র রসুন। গতি ধীর হয়ে এল পাইকের। আমি সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছনোর সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেটুকুই যথেষ্ট ছিল, কারণ মগজের মধ্যে আশার আলো জ্বলে উঠল। মুহূর্তে বুঝে গেলাম ক্রিস্টোফার পাইকের হাত থেকে বাঁচতে কী করতে হবে!

‘কিশোর, রবিন, জলদি আমার বেডরূমে যাও!’ চিৎকার ছাড়লাম।

‘কিন্তু ও তো আমাদের ফলো করবে,’ পাল্টা চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

‘জানি! এসো!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলাম।

বাড়ির ভিতর দিয়ে দৌড়ে বেডরূমে পৌঁছলাম পাইকের ক’মুহূর্ত আগে, ও ইতোমধ্যে নিজের ভয়ঙ্কর রূপ ধরেছে।

‘তোমরা বড্ড জ্বালাচ্ছ,’ ঘাউ করে উঠল সে।

‘ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? আমাকে ধরবে না?’ পাল্টা বলে, এক কোণে সরে গেলাম। ‘তোমরা হয়তো এটা দেখতে চাইবে না, কাজেই বাতি নেভাও।’

‘মুসা, কী বলছ তুমি!’ সভয়ে শ্বাস চাপল রবিন, জানে না আমার মনে কী চলছে।

‘নেভাও, রবিন। ও নিশ্চয়ই টের পেয়েছে আমার আস্তিনে কিছু লুকানো আছে, কারণ খুট করে লাইট সুইচ অফ করে দিল। গোটা ঘর ঢাকা পড়ল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।

‘এতে কাজ হবে না,’ ভ্যাম্পায়ারটা বলল। জ্বলজ্বল করছে লাল চোখজোড়া।

‘হ্যাঁ, কিন্তু এতে হবে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। নেলি খালার জন্য বাবা আর আমি যে সান ল্যাম্পটা বসিয়েছিলাম সেটার সুইচ টিপে দিলাম।

সূর্যের কৃত্রিম আলোয় আপাদমস্তক ভেসে গেল পাইক। যেন ফাঁদে আটকা পড়েছে, নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। আর্তনাদ ছাড়ল, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা গেল তাতে ক্রোধ নয় বরং যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটল। ক্রিস্টোফার পাইকের মরণদশা ঘনিয়েছে! ক’মুহূর্ত পরে, তার দেহ থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগল, এবং ও আর্তচিৎকার ছাড়ল, ‘নাআআআআ!’ এবার ফ্ল্যাশ এফেক্টের জন্য জাদুকররা যে বিশেষ ধরনের কাগজ ব্যবহার করে সেরকম কাগজের মত উজ্জ্বল অগ্নিশিখায় বিস্ফোরিত হলো ভ্যাম্পায়ারটা এবং কোন চিহ্ন না রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঠিক তার পরমুহূর্তে, বেসমেন্ট থেকে আরেকটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। দৌড়ে নীচে নেমে গেলাম আমরা। দেখতে পেলাম ভ্যাম্পায়ারটার কফিনটা ভেঙেচুরে এক গাদা জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। নেলি খালা বাড়ি ফিরে আসার আগেই জঞ্জাল এবং ছড়ানো- ছিটানো রসুনগুলো সাফ করে ফেললাম তিন বন্ধু।

‘মুসা, তুই ঠিক আছিস বল!’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন নেলি খালা। ‘আমি তোর জন্যে চিন্তা করছিলাম।’

‘আমি ভাল আছি, নেলি খালা,’ বলে তাঁকে পাল্টা জড়িয়ে ধরলাম। তারপর তাঁর বাহুতে জ্ঞান হারালাম। ওরা আরকী পরে তাই বলেছিল। আমার কিছুই মনে নেই।

পরদিন এতটাই ক্লান্তি আর অসুস্থ বোধ করলাম, স্কুলে গেলাম না। পরে জানলাম স্যর অসুস্থ থাকায় জ্যামিতি পরীক্ষাটা হয়নি। ভুতুড়ে ঘটনাটার মোটামুটি এখানেই সমাপ্তি, শুধু একটা অদ্ভুত ব্যাপার বাকি ছিল। ওটা কিশোরের কাছ থেকে জানতে পারলাম। ডিনারের ঠিক পরেই ফোন করেছিল ও।

‘সন্ধের কাগজ দেখেছ?’ প্রশ্ন করল। ‘সাত নম্বর পৃষ্ঠার নীচে। পড়ে দেখো।’

রিসিভার রেখে, আমি গিয়ে কাগজটা নিলাম এবং পৃষ্ঠাটা খুললাম। নীচের দিকে ছোট্ট এক আর্টিকল। হেডলাইন: জাদুঘরে রহস্যময় কাণ্ড।

গত রাতে শহরের জাদুঘরে রহস্যময়
এক বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে। ক্রিস্টোফার
পাইকের উনিশ শতকের এক পেইন্টিং
তার ফ্রেমে পুড়ে গেছে। পুলিস এবং
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ হতবাক, কেননা ক্যানভাসটা
পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও, ফ্রেমে এবং
জাদুঘরের দেয়ালে আগুনের কোন চিহ্ন নেই।

কাগজটা নামিয়ে রেখে কিশোরকে ফোন করলাম।

‘ওদেরকে আসল ঘটনা জানাব আমরা?’ জানতে চাইলাম।

‘দরকার নেই, ওরা নিজেরাই রহস্যের কিনারা করুক,’ জবাব দিল কিশোর। ‘ওরাও আমাদের মত থ্রিল পাক না।’