মারণাস্ত্র – ১৭

সতেরো

মে বাইশ

ঘুম যখন ভাঙল তখন দেশের শাসনভার কোমাচিনের হাতে। সে অবশ্য ঘোষণা দিয়েছে, ভোট হবে। জনগণ যাকে বেছে নেবে সে-ই চালাবে দেশ। মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার। ঘুমিয়ে এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো থেকে বঞ্চিত হলাম, সাক্ষী থাকতে পারলাম না।

বেল বাজাতেই হাজির হয়ে গেল মাইকেল। মুখে চওড়া হাসি, হাতে ট্রে।

খানিক বাদে এল রানা। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। গোসল করতে ঢুকল ও। গোসল আর শেভ সেরে যখন বেরোল তখন সামান্য সতেজ দেখাল ওকে।

পরে গভর্নমেন্ট হাউস-এ আমাদের স্বাগত জানাল কোমাচিন। আমাকে নতুন সরকারের অফিশিয়াল প্রেস অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হলো। আমেরিকার সরকার স্বীকৃতি জানিয়েছে। আর আমার কাগজ ছ’মাসের জন্যে ইক্সানিয়ার সরকারকে ধার দিয়েছে আমাকে।

কোমাচিনের প্রথম চিন্তা টাকার জোগাড় করা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই কেবল দ্রুত বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সম্ভব-যা এ মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন। সেজন্যেই আমার সাহায্য চায় ও।

পরের ক’দিন বেরোতে পারলাম না বড় একটা। গভর্নমেন্ট হাউসে জনা কয়েক সহকারীকে নিয়ে কাজ করে গেলাম। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোয় কোমাচিন সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি করলাম।

এরমধ্যে রানা একদিন এল আমার অফিসে। অসুস্থ দেখাচ্ছে, সেকথা তাকে বললামও। বিড়বিড় করে ওকে বলতে শুনলাম, ‘ভালই তো আছি।’ বুঝলাম, কিছু একটা নিয়ে দুশ্চিন্তামগ্ন সে। কথা বলার সময় আমার চোখে চাইছে না।

‘আজ রাতে প্যারিস যাচ্ছি।’

বিস্মিত হলেও চুপ করে রইলাম।

‘জানেনই তো,’ বলল ও, ‘আমার এখানকার কাজ খতম। আর কিছু করার নেই।’

উঠে দাঁড়াল ও, দেখে মনে হচ্ছে পা দুটো ওর শরীরের ভার বইতে পারছে না। ‘রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি।’

ওর কাঁধে হাত রাখলাম।

‘শুনুন, রানা,’ বললাম, ‘আপনি অসুস্থ। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করুন না, বিশ্রাম নিন। কোন তাড়া তো নেই। আপনি সরকারের লোক। তারা আপনাকে সব রকম সাহায্য করবে, খাতির যত্ন করবে।’

‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন,’ ক্লান্ত গলায় বলল ও, ‘আমি ডক্টর পাশা নই। আজ না হয় কাল ওরা জানবেই।’

‘জানুক, তাতে কী?’ বললাম, ‘কাল বরিস আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আপনার আসল পরিচয় কোনটা। ওদের ধারণা, আপনি রাশিয়ার চর।’

কিছু বলতে গিয়েও যেন সামলে নিল ও। বন্য চাহনি ওর চোখে। চাইছে না আমার দিকে।

ওকে থামানোর আগেই বেরিয়ে গেল।

সে রাতে ন’টার সময় আমি জোভোগোরোড স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। হর্ন দিচ্ছে, ট্রেন ছেড়ে দেবে। রানা এখনও পৌঁছেনি।

ট্রেন চলতে শুরু করল। একটু পরেই মিশে গেল অন্ধকারে।

হোটেলে ফিরে দেখি আমার জন্যে একটা নোট লিখে রেখে গেছে রানা। ওতে লেখা:

প্রিয় লিনফোর্ড,

বিদায়ের সময় দেখা করতে পারলাম না বলে কিছু মনে করবেন না। বুঝতে পারছি আপনি আমার ব্যাপারে খুব কৌতূহল বোধ করছেন। তা তো করবেনই, হাজার হলেও আপনি রিপোর্টার, সংবাদপত্রের লোক। বিকেলের ট্রেনে চলে যাচ্ছি। আমার জন্যে ভাববেন না। গুডবাই, বন্ধু, আর কোনদিন হয়তো দেখা না-ও হতে পারে। প্রয়োজনের সময় বন্ধু হিসেবে পেয়েছি আপনাকে, সেজন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

শুভেচ্ছা-
মাসুদ রানা।

মাসুদ রানা নামের মানুষটি সম্বন্ধে এরপর আর কোন কিছুই জানতে পারিনি। দু’দিন পরে জানলাম বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর পাশার ওপর বেল-প্যারিস এক্সপ্রেসে হামলা হয়েছে।