মারণাস্ত্র – ১৬

ষোলো

মে বাইশ

শহরে ঢোকার মুখে প্রথমবারের মত দেখতে পেলাম অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি। রাস্তায় ব্যারিকেড। ফলে থামতে হলো। ডিউটিরত সশস্ত্র লোকটিকে ছোট একটা কার্ড দেখাল রানা। উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সে, আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। গাড়ি চলল শহরের দিকে।

শহর শান্ত। কোথাও কোন গোলযোগের চিহ্নমাত্র নেই। তবে আরও ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল মেশিনগান হাতে ছোট-ছোট দল, রাস্তার কোণে ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কাউণ্টেস যেখানে থাকে সেই স্কয়্যারের কাছে গাড়ি থামালাম আমরা। নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়িটা আজও অন্ধকার, কেবল দোতলার একটিমাত্র ঘরে আলো জ্বলছে। কালো রঙের পেল্লায় এক গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়ানো।

কাজের লোকদের ঢোকার পথ দিয়ে ভেতরে চলে এলাম আমরা। দরজা খোলাই ছিল। রান্নাঘরে এসে ঢুকলাম। খাঁ-খাঁ করছে চারদিক। ম্যাচ জ্বালল রানা। বাড়ির পরিবেশ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় লোকজন সব তড়িঘড়ি কেটে পড়েছে। ওপরতলায় মৃদু নড়াচড়ার শব্দ।

‘মহিলা পালানোর জন্যে তৈরি হচ্ছে,’ ফিসফিস করে বলল রানা।

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলাম। ঠাণ্ডা বোধ করছি। কবজিটা টনটন করছে, খিদেও পেয়েছে। এ মুহূর্তে একটু ড্রিঙ্ক পেলে বড় ভাল হত। কিছুক্ষণের জন্যে সব চুপচাপ; তারপর হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল একটা দরজা। পায়ের শব্দ। সিঁড়ি বেয়ে নামছে কেউ। হলঘরের দরজাটা খুলেছে। চারদিক নিঃশব্দ।

হলঘরের দিকে এগোলাম আমরা। কোণের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। এগোচ্ছে রানা, ওর পেছনে আমি। দরজার বাইরে থামলাম। ভেতরে কাগজ ওল্টানোর খসখস শব্দ। রানার হাতে পিস্তল এসে গেছে। আলতো করে সে ঠেলা দিল দরজায়।

কাউণ্টেসের স্টাডিরূম এটা। তাকেও দেখতে পেলাম। ফারের কোট পরে সেফের পাশে দাঁড়ানো, হাতে এক গোছা কাগজ। ফায়ারপ্লেসে আরও একতাড়া কাগজ পুড়তে দেখে সে কী করছিল বুঝতে অসুবিধে হলো না। ঘাড় ফেরায়নি সে।

‘আসুন,’ অন্যমনস্কভাবে বলল।

ঢুকলাম আমরা। রানার পিস্তল ওঠানো। তৈরি সে।

‘আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, ডক্টর,’ বলল মহিলা। বাকি কাগজগুলো ফায়ারপ্লেসে ফেলে দিয়েছে।

‘এখানে কেন এসেছি জানেন নিশ্চয়ই?’ শান্ত শোনাল রানার কণ্ঠ।

আমাদের দিকে ফিরল কাউন্টেস। মুখে হাসি।

‘জানি, জানিই তো,’ জবাব দিল সে। ‘কিন্তু আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় যে।’

‘আমাদের মানে?’ ভ্রূ উঠে গেছে রানার।

‘কর্নেল ইগর আপনার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন।’

দমে গেলাম আমি। স্বেচ্ছায় ফাঁদে আটকা পড়েছি আমরা।

‘পিস্তলটা নামিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকুন, তা হলে হয়তো দু’এক সেকেণ্ড বেশি বাঁচবেন,’ ফরাসিতে বলল কাউণ্টেস।

পিস্তল নামাল রানা। কেড়ে নেয়া হলো ওটা। ঘরে ঢুকে পড়েছে ইগর।

‘পালানোর আগে আমার এক চাকর একটা মেসেজ রেখে গেছে,’ সহজ গলায় বলছে কাউন্টেস, ‘শহর বোধহয় এখন বিদ্রোহীদের আয়ত্তে।’

‘ঠিকই শুনেছেন,’ বলল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানার দিকে চাইল কাউন্টেস।

‘আপনার এমন সব গুণ আছে যা একজন ডক্টরের মধ্যে আশা করা যায় না। আপনাকে মাপতে ভুল হয়েছিল আমাদের। কর্নেল ইগর আপনার সম্পর্কে খুব আণ্ডার-এস্টিমেট করেছিলেন। যা হোক, একটা ব্যাপার আমার কাছে আজও রহস্যময়। কার হয়ে কাজ করছেন আপনি, ডক্টর?’

রানার দিকে চেয়ে দেখি শূন্য তার চোখের দৃষ্টি। জবাব শোনার জন্যে বৃথাই অপেক্ষা করল কাউন্টেস।

‘থাক, বলতে হবে না,’ শেষ পর্যন্ত বলল মহিলা। ‘আচ্ছা, ল্যাবোরেটরি থেকে কী কী নিয়েছেন আপনি?’

‘কিছুই না, ম্যাডাম। আর তা ছাড়া ল্যাবোরেটরিটা এখন আর নেইও।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল কাউণ্টেসের চেহারা।

‘কেউ মারা পড়েছে?’

‘বিস্ফোরণে কেউ বোধহয় মরেনি। কিন্তু কর্নেল ইগর যখন গুলি চালাচ্ছিলেন তখন ভিজিল নামে এক লোক পাল্টা গুলিতে মারা গেছে।’

দ্রুত শ্বাস টানতে শুনলাম কাউন্টেসকে। ইগরের চেহারায় কোন অভিব্যক্তি ফুটল না। তার পিস্তল ধরা হাতটা এক চুল নড়েনি। ঠাণ্ডা চোখজোড়া আমাদের ওপর স্থির।

‘তাই বলুন,’ খানিক বাদে বলল কাউন্টেস। জানালার কাছে হেঁটে গেল সে। বাইরে অন্ধকারে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিরল আমাদের দিকে।

‘আপনাদের মতলবটা কী ছিল?’ জানতে চাইল মহিলা।

‘ভিজিলের আবিষ্কারের ব্যবহার ঠেকানো এবং তার ফর্মুলা ধ্বংস করা। ব্যস।’

‘কেন?’

‘সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্যে।

অসহিষ্ণু কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল কাউন্টেস।

‘রাজনীতিবিদদের মত কথা বলছেন। ইক্সানিয়া ছোট দেশ। আমাদের টাকা নেই, সম্পদ নেই-কিছুই নেই। টিকে থাকার জন্যে চিরকাল কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। ডু অর ডাই। অন্য দেশ দখল করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের। সে সুযোগও এসেছিল। কিন্তু আপনার জন্যে কিছুই হলো না। এসব কিছুর জন্যে আপনিই দায়ী।

‘চাইলেই আপনারা দেশের উন্নতি করতে পারতেন,’ জবাবে বলল রানা। ‘কিন্তু করেননি। জনগণের সরকার অবশ্যই দেশের জন্যে কাজ করবে। ভুল হয়তো হবে তাদের। তবে তারা এটুকু জানে, যুদ্ধ কেবল মৃত্যুই ডেকে আনে; কোন সুফল তাতে আসে না।’

অধৈর্য কাউণ্টেস হাত ওঠাল।

‘অন্য পরিবেশে এ আলোচনায় হয়তো আগ্রহী হতাম আমি। কিন্তু এখন আমাদের হাতে সময় নেই। এখুনি চলে যেতে হবে। কর্নেল আপনাদের খুন করার জন্যে এক পায়ে খাড়া। আপনাদের ব্যাপারে আমারও আর কিছু বলবার নেই।’

আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় তাকে ঠেকাল রানা।

‘মরার আগে,’ শান্ত স্বরে বলল ও। ‘একটা অনুরোধ করছি।’

‘কী অনুরোধ, মঁসিয়ে?’ তাড়া আছে কাউণ্টেসের।

‘আমাদের সামনে ভিজিলের ফর্মুলার কপিটা পুড়িয়ে ফেলুন। প্লিজ, ম্যাডাম,’ জরুরি কণ্ঠে বলে চলেছে রানা, ‘আর্মড লোকজন বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। কোমাচিনের পারমিশন ছাড়া জোভোগোরোড ছেড়ে কেউই বেরোতে পারবে না, আগামী বারো ঘণ্টার জন্যে।

‘ইনফর্মেশনটার জন্যে ধন্যবাদ, মঁসিয়ে। কিন্তু একদল গর্দভ ওয়ার্কারের জন্যে তো আর প্ল্যান পাল্টাতে পারি না। আর ভিজিলের ফর্মুলা সঙ্গে নিয়ে তবেই যাব আমি, কেউ ঠেকাতে পারবে না। আপনারা জেসন ভিজিলকে খুন করেছেন। তাঁর মত গুণী লোক আর জন্মাবেন কিনা সন্দেহ। উনি নেই কিন্তু ওঁর কীর্তি চিরকাল রয়ে যাবে।’

কাউন্টেস যখন কথা বলছে তখন খুব আলগোছে বাঁয়ে সরে গেছে রানা। কাউন্টেস এখন ইগর আর রানার মধ্যখানে দাঁড়ানো। ইগর গুলি চালালে কাউণ্টেসের গায়ে লেগে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। দেখতে পাচ্ছি ইগরও আমাদের কভার করার জন্যে এক কোণে সামান্য সরে গেছে। রানা ভান করল কাউণ্টেসের কথার জবাব দিচ্ছে, হঠাৎই দেখলাম তড়িৎ গতিতে ঝুঁকে ইগরের পা লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়েছে সে।

ইগরের গুলি ছাদে গিয়ে বিধল। ওদিকে মাটিতে জড়াজড়ি করে পড়ে রয়েছে রানা আর ইগর। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। পেছনে নড়াচড়ার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি কাউণ্টেস। আমি তার দিকে এগোতেই সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। আমি দরজার হাতলে হাত রাখতেই ক্লিক করে শব্দ হলো। লক করে দিয়েছে। সুইচ খুঁজে পেয়ে বাতি জ্বাললাম। পরমুহূর্তেই পর-পর দুটো গুলির শব্দ। ইগরকে হঠাৎ দেখে পাথরের মূর্তির মত মনে হলো। কাশতে শুরু করল সে, দড়াম করে মেঝেতে পড়ে গেল।

দ্রুত শ্বাস টানছে রানা। ইগরের পিস্তলটা এখন ওর হাতে।

‘কাউণ্টেস কই গেল?’ কোনমতে প্রশ্ন করল ও।

‘পালিয়েছে, দরজা লক করে।’

পকেটে পিস্তল ঢুকিয়ে জানালার কাছে গেল রানা। খুলেছে।

‘আসুন,’ বলল ও, ‘কাউন্টেসকে কিছুতেই ওই কপি নিয়ে পালাতে দেব না।’

রবিন্সের গাড়ির কাছে যখন পৌঁছলাম তখন রীতিমত বেহাল আমি। রানার পাশের সীটে বসার পর জানে যেন পানি ফিরে পেলাম। খবর নেব বলে একটুক্ষণের জন্যে প্রথম ব্যারিকেডের সামনে থামতে হলো। কাউন্টেস ব্যারিকেড মানেনি। তার কালো মার্সিডিজ সোজা চালিয়ে দিয়েছে। ফলে দু’জন লোক আহত হয়েছে।

রানার অনুমান মহিলা সাউথ-ইস্ট রোড ধরে সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে। পাহাড়ী একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে রাস্তাটা।

‘বৃষ্টিতে বোধহয় জায়গায় জায়গায় ধস নেমেছে,’ বলল রানা।

‘তবে ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। এটাও ঠিক ও আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে রয়েছে। এখন আল্লাহ-আল্লাহ করে আমার আন্দাজটা ঠিক হলেই হয়।’

প্রচণ্ড গতিতে শহর পেরোলাম। গাড়িটা চমৎকার কণ্ডিশনে রয়েছে। রানা চালাচ্ছেও রেসিং ড্রাইভারদের মত। সাউথ-ইস্ট রোডের ব্যারিকেডের কাছাকাছি পৌঁছে হেডলাইটের আলোয় বুঝতে পারলাম ঠিক পথেই চলেছি। এখানেও ব্যারিকেড ভাঙা হয়েছে। লোকেরা আবার যথাস্থানে ব্যারিকেড বসাচ্ছে। রানা স্পীড কমিয়ে হেডলাইট বার পাঁচেক ফ্ল্যাশ করল। আমরা ব্যারিকেড পেরনোর সময় লোকজন উত্তেজিতভাবে সামনের দিকে আঙুল দেখাল। আবার স্পীড তুলল রানা।

রাস্তা এতক্ষণ মোটামুটি ভালই ছিল। কিন্তু ওপরে উঠতে শুরু করতেই ঝামেলা শুরু হলো। কাদাপানিতে চাকা পিছলে যায়, ঘুরতে থাকে। সামনে এগোনো খুবই মুশকিল, হেডলাইটের আলো যথেষ্ট নয়। তবে এ অবস্থা বেশিক্ষণ রইল না, বিজলী চমকাতে শুরু করেছে। কাউণ্টেসের টিকিটিও দেখতে পাচ্ছি না।

এবার কাদার জায়গা নিল পাথর। রানা স্পীড বাড়াতেই পাগলের মত ঝাঁকি খেতে শুরু করল গাড়ি। উঠছি আমরা। বিপজ্জনক বাঁক, দু’দিকে খাদ। পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে গেলাম শেষ পর্যন্ত। ঘন ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করছে গাড়ির এঞ্জিন। ঢাল বেয়ে অর্ধেক পথ নেমে আসার পর মার্সিডিজটার দেখা পেলাম। পরের পাহাড়টায় উঠছে।

‘এ হারে চালাতে পারলে ও ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই সীমান্ত ক্রস করবে,’ বলল রানা।

উঠছে আমাদের গাড়ি। মার্সিডিজের লাইটগুলো এ মুহূর্তে অদৃশ্য। পাগল হয়ে গেছে যেন রানা। এক্সিলারেটরে বাড়ছেই পায়ের চাপ। দরজার ভেতর দিককার হাতল শক্ত করে চেপে ধরে বসে রয়েছি আমি। অনুমানে বুঝলাম আমরা এখন মার্সিডিজের চেয়ে মিনিট তিনেকের পথ পিছিয়ে রয়েছি। রাস্তা এখানে ভালই, যদিও ছোট আকারের প্রচুর পাথর বিছিয়ে রয়েছে রাস্তাময়।

আকাশ গোমড়ামুখো। যে-কোন মুহূর্তে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। সামনের তুষার ঢাকা বিশাল চূড়া দুটোর মধ্যখান দিয়ে একটা গভীর গিরিপথ চলে গেছে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে নেমে গেছে রাস্তা, মার্সিডিজটা এখন অনেকখানি নীচে। নামতে শুরু করেছি আমরাও। ঢাল বেয়ে নামার সময় স্পীড কমাচ্ছে না রানা। কড়া ব্রেক কষছে প্রতিটা বাঁকে। একবার তো প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম খাদে। কোনমতে গাড়িটাকে রাস্তায় রাখতে সক্ষম হলো রানা। একটু পরেই কাউণ্টেসের দুটো বাঁক পেছনে চলে এলাম আমরা। মহিলা রানার চেয়ে কম ঝুঁকি নিচ্ছে, ফলে অ্যাডভান্টেজ ধরে রাখতে পারেনি। সামনের গাড়িটার এঞ্জিনের গর্জন এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

আমাদের দেখে অথবা গাড়ির আওয়াজ শুনে স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছে কাউন্টেস। রানাও একই কাজ করল। কাউণ্টেসের গাড়ি যদি সামনের শুকনো রাস্তায় একবার উঠতে পারে তবে তাকে ধরা আর আমাদের কম্ম নয়। মার্সিডিজের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা নেই রবিন্সের গাড়ির। প্রচণ্ড গতিতে যখন শেষ বাঁকটার উদ্দেশে ছু তখন দেখলাম রানার হাতে এসে গেছে ইগরের পিস্তল। লোকটার এলেম আছে বটে। মনে-মনে প্রশংসা না করে পারলাম না।

‘ও বাঁক ঘুরলেই,’ কঠিন শোনাল রানার গলা, ‘পেছনের টায়ার দুটো ফাটিয়ে দেব। ওকে মারার ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু কোন উপায় নেই বোধহয়।

শেষ বাঁকটার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে গাড়ি দুটো। প্রচণ্ড শব্দে ব্রেক কষল কাউন্টেস। রানাও শক্ত ব্রেক চেপেছে। বাঁকের অর্ধেকখানি ঘুরতেই গাড়ির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাল কাউন্টেস ক্যারেনিনা। পেছনের চাকা দুটো মুহূর্তে রাস্তার ওপাশে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ড পরেই সশব্দে পতিত হলো মার্সিডিজ।

বাঁক ঘোরার আগেই গাড়ি থামালাম আমরা। নীচে যখন নেমে এলাম তখন জ্বলছে মার্সিডিজ। প্রচণ্ড উত্তাপ চারপাশে। তবে গাড়ির ভেতরে কাউণ্টেসকে দেখতে পেলাম না। তাকে পাওয়া গেল খানিকটা দূরে।

হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসে পড়ে মাথাটা তুলে ধরল রানা।

জ্বলন্ত গাড়ির আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে কাউণ্টেসের সুন্দর মুখটা। খুব সম্ভব নীচে পড়া মাত্রই মৃত্যু হয়েছে তার।

কাউণ্টেসের কোটের পকেট থেকে এক গোছা কাগজ ধীরে-ধীরে বার করে আনল রানা। ওগুলো এগিয়ে দিল আমার দিকে।

‘এগুলো পুড়িয়ে ফেলুন, লিনফোর্ড, কাঁপা গলায় বলল ও।

কাগজগুলো নিয়ে জ্বলন্ত গাড়ির দিকে এগোলাম। হঠাৎ কী মনে হতে পেছন ফিরে চেয়ে দেখি ইগরের পিস্তলটা নিজের কপালে ঠেকাচ্ছে রানা। তখনও সে বসে রয়েছে হাঁটু গেড়ে। এক ছুটে ফিরে এলাম। পিস্তলটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম দূরে।

আমার দিকে এক ঝলক চাইল ও। গাল দুটো চিকচিক করছে পানিতে, ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। কাগজগুলো ওর হাতে দিলাম। শূন্য দৃষ্টিতে ধরে থাকা কাগজগুলোর দিকে সে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ।

‘আপনিই বরং পোড়ান,’ বললাম আমি।

অনিশ্চিত পদক্ষেপে গাড়িটার দিকে এগোল ও, ঝুলে পড়েছে কাঁধ। আগুনে নিক্ষিপ্ত হলো মহামূল্যবান কাগজ। ওগুলো পুড়ল কিনা দেখার জন্যে দাঁড়াল না ও। উঠে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। আগুনের শিখায় দেখে ওকে এই প্রথমবারের মত একজন ক্লান্ত মানুষ বলে মনে হলো আমার।

.

গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঘুম ভাঙতে দেখি জোভোগোরোডের ঠিক বাইরে ব্যারিকেডের সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়ানো। তখনও সূর্য ওঠেনি। ম্লান আলোয় রানাকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। শহরের ভেতর থেকে মেশিনগানের গুলির শব্দ আসছে।

অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। কোমাচিনের দল ক্ষমতা দখল করেছে। গুটি কয়েক সৈন্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে সফল হয়নি।

আমাদের গাড়ি শহরে প্রবেশ করল। হোটেলের কাছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল রানা। সোজা নিজের রূমে চলে এলাম আমি। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। পরবর্তী আট ঘণ্টা একটানা ঘুমালাম।