মারণাস্ত্র – ১০

দ্বিতীয় পৰ্ব – দশ

লিনফোর্ডের জবানী

মে দশ।

তথাকথিত মাসুদ রানার গল্প শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি আমার।

সেজন্যে অবশ্য দোষ দিতে পারেন না আমাকে। এখনও ব্যাপারটা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।

রানার সঙ্গে কাটানো সেই রোমাঞ্চকর দিন ক’টার কথা কীভাবে বর্ণনা করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

হ্যাঁ, ওকে আমি রানাই বলব। মাসুদ রানা। জোভোগোরোডে আসার আগে সে কে ছিল, এখনই বা কে, সে ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার কাছে সে মাসুদ রানা।

ওর ব্যক্তিত্ব আশ্চর্য রকমের পরিবর্তনশীল। সাধারণ কাজে-কর্মে সে সাধারণ মানুষ। কিন্তু কোন ধরনের সঙ্কটে পড়লেই হলো, সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ তখন সে। একাই একশো। ও প্রায়ই একটা কথা বলে, বাঙালি নাকি একাই একশো; আবার একশো বাঙালি কখনওই এক হতে পারে না। হবেও বা। তবে বাঙালি যে দুঃসাহসী জাতি তার প্রমাণ একাত্তরেই পেয়ে গেছে সারা দুনিয়া। কাজেই মাসুদ রানা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?

জোভোগোরোডে রানা যখন তার গল্প শেষ করল তখন রাত একটা। বেয়ারারা লাইট অফ করতে শুরু করেছে। আমি রবিন্স লোকটার প্রতি বিশেষ আগ্রহ অনুভব করছিলাম। ওকে ভালই চেনা আছে আমার। মানে, পরিচয় জানি আরকী। ও একজন আর্মস এজেন্ট, তবে আরও অনেক পরিচয়ে পরিচিত সে। গানস অ্যাণ্ড রিসের ডিরেক্টরদের লিস্টে মোট জনা বিশেকের নাম আছে। রবিন্স তাদের একজন হতেও পারে। হয়তো চীনে তারই নাম ডিন জোন্স, দক্ষিণ আমেরিকায় পল মেরিনার, আবার ইউরোপে রবিন্স। নিঃসন্দেহে ঘুঘু লোক।

রানা আবারও সবিশেষ অনুরোধ করেছে, যাতে এডিটরকে আমাদের আলোচনার কথা না জানাই।

‘ভয় পাবেন না,’ বলেছি আমি। ‘এসব কথা জানালে এডিটর আমাকে নির্ঘাত পাগল ভেবে বসবে। নট হয়ে যাবে আমার চাকরি।’

দেখে মনে হলো স্বস্তি পেয়েছে ও।

‘মিস্টার লিনফোর্ড,’ বলেছে ও, ‘আমরা দু’জনে কি একসঙ্গে কাজ করতে পারি?’

দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি।

‘আমি ইমোশনাল সাপোর্টের কথা বলছি না,’ বলেছে ও। ‘আমার ধারণা, আমাদের জুটি হলে দু’জনেরই লাভ। আপনি পাবেন স্টোরি; আর আমারও কাজ উদ্ধার হবে।’

হাত মেলালাম আমরা। ঠিক হলো, পরদিন সকালে আমার হোটেলে আসবে ও।

রানা যখন পৌঁছল তখনও আমি বিছানায়। গড়াগড়ি খাচ্ছি। ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে দেখলাম।

‘রবিন্স বলেছে কালকের মধ্যেই ভিজিলের ফর্মুলা পেয়ে যাচ্ছে ও।’

সিগারেট ধরালাম।

‘কিন্তু কাউন্টেস তো বলছিল রবিন্স মিছেই সময় নষ্ট করছে।

‘রবিন্স বুদ্ধিতে হয়তো টেক্কা মেরে দিয়েছে তাকে। ওকে খুব আত্মবিশ্বাসী দেখলাম। বলছে, পরশুর মধ্যেই জোভোগোরোড ছাড়বে।’

‘আপনি কী করবেন ভাবছেন? ও ফর্মুলা পেয়ে যাওয়ার পর কোনভাবে ওটা হাতিয়ে নেবেন?’

‘না,’ বলল ও। ‘কাজটা কঠিন। ফর্মুলার এখন আর মাত্র দুটো কপি আছে। একটা ভিজিল, আরেকটা কাউণ্টেসের কাছে। আমার বিশ্বাস রবিন্স কাউণ্টেসের কপিটাই চুরির চেষ্টা করবে। কারণ, ভিজিলের আস্তানা সুরক্ষিত। কাউন্টেস থাকে কোথায়?’

‘রয়্যাল প্যালেসের কাছেই, বিশাল বাড়ি।’

‘কপিটাও সম্ভবত ওখানেই রাখে। পাহারার ব্যবস্থা কেমন?’

‘কোন গার্ড তো দেখিনি।

‘তারমানে কড়া পাহারা রাখা হয়। এখন আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে রবিন্সের প্ল্যানটা জানা। তারপর ওকে ঠেকানো। আজ বিকেল চারটায় এজেন্টদের সঙ্গে ওর মীটিং।’

‘ভাল কথা। কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ? ওদের কথা শুনতে হলে কাবার্ডে লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর তো কোন উপায় দেখছি না।’

হাসল রানা।

‘সেজন্যেই তো আপনার সাহায্য চাইছি। আজ তিনটের দিকে আমার ঘরে একবার আসতে পারবেন? তার আগে অবশ্য আমার একটা উপকার করতে হবে। গোটা দুয়েক টেলিফোন বক্সে যাবেন, তার কাটার জন্যে। রিসিভার দুটো নিয়ে আসবেন, তার সহ। কাজটা খুব সাবধানে সারতে হবে। খুব জরুরী।’

‘দুটো রিসিভারের কী দরকার?’

রহস্যময় হাসল রানা।

‘বিকেলেই দেখতে পাবেন। আমার কিছু কাজ আছে। এখন চলি। বিকেলে দেখা হচ্ছে, মিস্টার লিনফোর্ড।’

যাওয়ার আগে বলল ও, ‘ওহহো, একটা কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনার বন্ধু আলেন্দের সঙ্গে দেখা করতে চাই। সম্ভব?’

বেলা এগারোটার দিকে হোটেল ছেড়ে বেরোলাম। কুডবেকের দিকে হাঁটছি। মনে আছে, ওখানকার পোস্ট অফিসে বেশ ক’টা টেলিফোন বক্স দেখেছি।

তার খুব শক্ত। এতটা যে শক্ত হবে ভাবিনি। ছুরিটাও ভোঁতা। ফলে, কাজটা সহজ হলো না। ভয়ে ঘেমে উঠলাম আমি। তবে শেষ পর্যন্ত সফলও হলাম। রিসিভার দুটো ওভারকোটের পকেটে চালান করে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

ফিরতি পথে একটা ক্যাফেতে ঢুকলাম। মনটা ড্রিঙ্ক দাবি করছে। ক্যাফের ভেতরটা জনাকীর্ণ, তবে একটা সাদা মাথা দৃষ্টি কাড়ল আমার। আলেন্দে। তার পাশে বসে রয়েছে মাঝবয়সী এক লোক। ঠোঁটের ওপর কালো গোঁফ, চোখজোড়া ধূসর নীল। টেবিলটার দিকে ভিড় ঠেলে এগোলাম। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল আলেন্দে।

‘মিস্টার লিনফোর্ড,’ মৃদু হেসে বলল আলেন্দে, ‘কোমাচিনের সঙ্গে পরিচয় আছে?’

ঘাড় নাড়লাম আমি।

কোমাচিনের সঙ্গে ইক্সানিয়ান ভাষায় কীসব যেন বলল আলেন্দে। কোমাচিন বাউ করল আমাকে। পরবর্তী ক’মিনিট ওদের দু’জনের মধ্যে দ্রুত কথোপকথন হলো। আলেন্দের মুখে কোমাচিনের কথা আগেই শুনেছিলাম। কথা মানে প্রশংসা। কোমাচিনের প্রশংসায় আলেন্দে পঞ্চমুখ। বোঝা গেল, আলেন্দের প্রতিও সমান সম্মান পোষণ করে কোমাচিন।

যা হোক, কথা শেষ হলো ওদের। কোমাচিন উঠে পড়েছে। আমাকে আবারও বাউ করে বেরিয়ে গেল।

আলেন্দেকে জানালাম এক বাঙালি ভদ্রলোক দেখা করতে চান ওর সঙ্গে।

‘জানি,’ স্মিত হাসল আলেন্দে। ‘আমার এক লোক আপনাদের হোটেলের বেয়ারা। মাইকেল নাম। এ-ও জানি বাঙালি ভদ্রলোকটির নাম পাশা। রবিন্সের বন্ধু।’

পাশার সঙ্গে বৈঠকে রাজি হলো না ও।

‘এই পাশা লোকটা,’ ব্যাখ্যা করে বলল আলেন্দে, ‘খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ও সেটা জানে কিনা জানি না। তবে ওকে ঘিরে একটা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা দানা বাঁধছে। সেজন্যেই দেখা করব না ওর সঙ্গে। খামোকা রিস্ক নিতে চাই না আমি। আপনি আমার বন্ধু, আপনাকে বলছি লোকটাকে এড়িয়ে চলবেন।

এরপর প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল আলেন্দে। খানিক বাদে বিদায় নিয়ে চলে গেল ও। ওর বলিষ্ঠ শরীর আর সাদা চুলগুলো চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত চেয়ে রইলাম আমি। এখন ভিড়ে মিশে গেছে ও।

ওকে আর কোনদিন দেখিনি।