ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ৮

আট

টেপে বাদুড়টার কোন চিহ্ন নেই। না ডানা ঝাপ্টানো, না লাল চোখ, না ক্রিস্টোফার পাইক, না নেকড়ে, কিচ্ছুই না। আছে শুধু শূন্য আকাশে রবিনের রসুন ছোঁড়ার কাঁপা-কাঁপা কিছু ছবি, এবং আমাদের আলোচনা-ছবিতে যেটার অস্তিত্ব নেই সেটা জীবিত নাকি মৃত। ভিডিওর একমাত্র অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কিছু রসুন মাঝ-বাতাসে থমকে গিয়ে মাটিতে ঝরে পড়ছে। যেগুলো অদৃশ্য রক্তচোষা বাদুড়টাকে আঘাত করেছিল আরকী।

‘হায়, খোদা, কিচ্ছু ওঠেনি,’ হতাশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল নথি। ‘অথচ জিনিসটা ওখানে ছিল!’

‘জানি,’ বললাম। ‘মনে হয় ভ্যাম্পায়াররা ভিডিওতে ধরা পড়ে না, যেমন আয়নায় ওদের দেখা যায় না।’

‘এখন কী করা?’

‘জানি না। ভেবে দেখতে হবে।’

‘বেশি সময় নিয়ো না। কারণ আমাদের সামনে এখন মস্ত বিপদ।’

‘তারমানে?’ প্রশ্ন করলাম।

রবিন আমার দিকে চাইল। চোখজোড়া বিস্ফারিত।

‘ও জানে আমরা ওর পিছে লেগেছি।

রবিন কথাটা না বললেই খুশি হতাম। ক্যামকর্ডারটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। সারা রাস্তা মাথায় ঘুরপাক খেল বিষয়টা। ক্লান্তি লাগছিল, তাই শাওয়ার নিতে ঢুকলাম। বেরিয়ে এসে পাজামা পরে টিভিতে মুভি দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। মাথায় ঘুরছে কেবল রবিনের কথাগুলো: ও জানে আমরা ওর পিছে লেগেছি।

কাউচে বিছানা পাতছি এসময় সদর দরজায় টোকার শব্দ।

‘কে এল এত রাতে?’ বলে বাবা সাড়া দিতে গেল। ফিরে যখন এল হাতে বড়সড় এক বাদামি খাম। ‘আজব ব্যাপার। কেউ ছিল না, শুধু এটা পড়ে ছিল সিঁড়ির ওপর। তোর নাম লেখা।’

‘আমার?’ বললাম। মনে হলো রবিন পাঠিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ও ভিতরে এল না কেন? খামটা নিলাম। সুন্দর হাতের লেখায় আমার নাম লেখা। ছিঁড়ে ফেললাম। ভিতরে কী আছে দেখার পরে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

‘আমার জ্যামিতি নোটবই!’ বলে উঠলাম। এত সব উত্তেজনার মধ্যে সোমবারের টেস্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! ধারণা করলাম স্টোরেজ বিল্ডিঙে ফেলে আসিনি এটা। হয়তো স্কুলের মাঠের কোনওখানে পড়ে-টড়ে গিয়েছিল, কেউ খুঁজে পেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন পড়াশোনা করার সময় নেই, কিন্তু পরীক্ষাটায় পাস করার একটা সুযোগ অন্তত পেলাম আমি।

কিন্তু নোটবইটার প্রথম পৃষ্ঠাটা উল্টে সভয়ে শ্বাস চাপলাম। রক্তের অক্ষরে লেখা: আমি তোমাকে ছাড়ব না!

গলা শুকিয়ে গেল। চিৎকার করতে চেয়ে পারলাম না। এমনকী বাবাও বুঝল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

‘মুসা, তুই ঠিক আছিস?’ প্রশ্ন করল।

‘বাবা,’ ককিয়ে উঠলাম, ‘এটা দেখো।’ নোটবইটা তার হাতে দিলাম। ওটা খুঁটিয়ে পরখ করল বাবা।

‘জ্যামিতি আমি ভাল বুঝি না। তোর মা হয়তো হেল্প করতে পারবে।’ বাবা নোটবইটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিল।

ব্যাপারটা কী? রক্ত দিয়ে লেখা শব্দগুলো সম্পর্কে বাবা কিছু বলল না কেন? এবার পৃষ্ঠাটার দিকে চাইতেই কারণটা বুঝতে পারলাম।

শব্দগুলো নেই!

ও জানে আমরা ওর পিছে লেগেছি, রবিনের কথাগুলো কানে বাজছে এখনও। ব্যাপারটা খারাপ, কিন্তু হুমকি দিয়ে লেখা মেসেজসহ নোটবই ফেরত পাওয়া আরও খারাপ। ক্রিস্টোফার পাইক জানে আমি কোথায় থাকি!

সারা রাত কাউচে শুয়ে ছায়া দেখলাম, এই বুঝি কোনও একটা ছায়া কালো দেহ, রক্তচক্ষুতে রূপ নেবে। ভোরে সূর্য ওঠার পর নিরাপদ বোধ করলাম। কিন্তু এতটাই ক্লান্তি বোধ করছি, কাউচ থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না।

ক’ঘণ্টা পর। হাতুড়ি পেটা বীফবার্গারের মত অনুভূতি হচ্ছে এসময় রবিন উদয় হলো।

আমার চেহারাতেও নিশ্চয়ই তার ছাপ পড়েছে, কারণ রবিন আমাকে দেখামাত্র হাসতে লাগল। ওকে নোটবই আর রক্তে লেখা শব্দগুলোর কথা বলতেই হাসি থেমে গেল ওর।

‘এখন শোডাউনের পালা,’ বলল ও। ‘হয় আমরা ওকে ঘায়েল করব আর নয়তো ও আমাদেরকে ঘায়েল করবে।’

‘কীভাবে?’

‘ওকে দিনের বেলা কাবু করতে হবে, ওর যখন কোন ক্ষমতা থাকে না। এক কাজ করলে কেমন হয়? আমরা স্টোরেজ বিল্ডিঙে গিয়ে, ওর ইউনিটের দরজার তালা কেটে, ওর কফিন খুলে দিনের আলোকে যদি তার কাজ করতে দিই?’

‘খাইছে, ম্যানেজার যদি ধরে ফেলে?’

চোখ ঘুরাল নথি।

‘কী বলবে সে? ‘তোমরা ভ্যাম্পায়ারটাকে ডিস্টার্ব কোরো না। ও আমার সেরা কাস্টোমার?’’

‘আচ্ছা, মানলাম তোমার কথা। কাজটা কখন করতে চাও?’

রবিন পকেট থেকে একটা হ্যাক-স ব্লেড বের করে হাসল।

‘তুমি যখন রেডি হবে,’ বলল।

রেডি শব্দটা আমি ঠিক ব্যবহার করতে চাই না। ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে লড়ার জন্য কীভাবে তৈরি হবে তুমি? আমি স্রেফ মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটে দিলাম, স্টোরেজ বিল্ডিঙে যাওয়ার পথে বাইকে যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি।

যদিও কড়া রোদ, কিন্তু স্টোরেজ বিল্ডিংটার খোলা দরজা দেখামাত্র পুরানো গা ছমছমে ভাবটা ফিরে এল। চারপাশে চেয়ে দেখে নিলাম কেউ লক্ষ করছে না। এবার সাঁত করে রবিন আর আমি ঢুকে পড়লাম ভিতরে। দিনের বেলা পথ খুঁজে নেয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হলো। শীঘ্রি আমরা পৌঁছে গেলাম ভ্যাম্পায়ারটার লকারের সামনে।

‘আমাকে আড়াল দাও,’ বলল রবিন। আমি পাহারা দিচ্ছি, ও প্যাডলকটায় স চালাতে লাগল। তালাটা শীঘ্রি খুলে গেল, কিন্তু দরজা খুলবে কে?

‘একসাথে টানি এসো, বলল নথি। তিন পর্যন্ত গুণে দরজাটা টেনে খুলে ফেললাম আমরা। উঁকি দিলাম ভিতরে। মুহূর্তে পেটের ভিতরটা যেন বরফ হয়ে গেল।

‘আমরা স্বপ্ন দেখছি নাকি, মুসা?’ ফিসফিস করে বলল রবিন।

গায়ে চিমটি কাটলাম। না, স্বপ্ন নয়।