মারণাস্ত্র – ৮

আট

দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠেও অপেরা হাউসের ঘটনাটা মন থেকে তাড়াতে পারল না রানা। বাতিগুলো নিভে যাওয়ার আগে কাঁপল কেন? রহস্যজনক! ইলেকট্রিকের বাতি নিভলে সাধারণত একবারেই নেভে, কেঁপে ওঠে না।

ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল রানা, মাস দুয়েক আগে ঠিক এমনই একটি লোডশেডিং-এ পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।

অদ্ভুত একটা চিন্তা এল রানার মাথায়। হ্যাঁ, অদ্ভুতই, তবে অসত্য নয়। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ও। মুখ ধুয়ে বাথরূম সারল। তারপর নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল ট্যাক্সি নিয়ে। গন্তব্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ইউনিভার্সেলিয়া’-র কপি চাইল ও। আর ইংরেজি সংস্করণই পেয়ে গেল।

কোথায় খুঁজতে হবে জানে রানা। গতকাল লিনফোর্ডই __ দিয়েছিল সেটা। ‘স্ট্রাকচার অভ নিউক্লিয়ারস’-এর চ্যাপ্টারটা খুলল ও। ডক্টর পাশার লেখা আর্টিকেল থেকে জেনে নিল প্রয়োজনীয় তথ্য। তারপর সশব্দে বইটা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ল।

জোভোগোরোড আর এর আশপাশের অঞ্চলগুলোর একটা __ কিনতে হবে। কিনল ও। তারপর ওটা বগলদাবা করে পাব__ গার্ডেনে চলে এল। এক কোণে খালি একটা বেঞ্চি দেখে বসে পড়ল। দেখতে পেল কালকের এক বডিগার্ড বসে রয়েছে কাছেই। খুব করে একে বলা হয়েছে একাই যাতে সে রানাকে নজরবন্দি রাখে। লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। তারমানে গত দু’সপ্তাহ ধরেই নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর। ব্যাপারটা আজ পরিষ্কার হলো ওর কাছে।

ম্যাপটা খুলল রানা। জোভোগোরোডের ইলেকট্রিক সাপ্লাই গেছে শহরের উত্তর-পুব কোণে। হেলান দিয়ে বসে ডক্টর __ আর্টিকেলটার কথা ভাবল ও। পুরো জোভোগোরোডেই লোড হয়েছে। তারমানে, আালো বেড়ে ওঠার ব্যাপারটা ঘটেছে __ স্টেশন আর উপত্যকার ওপরকার পাওয়ার স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গা থেকে। উৎসটার সঠিক অবস্থান জানতে পারলেই __ পড়বে ভিজিলের ল্যাবোরেটরি।

পরিকল্পনা তৈরি করে নিল রানা। জোভোগোরোডে বিদ্যুৎ __ ওভারহেড লাইন দিয়ে। সেগুলোর সঙ্গে কোথাও নিশ্চয়ই একটা কেবল রয়েছে, যেটা চলে গেছে ল্যাবোরেটরিতে। লাইনগুলো ধরে সেখানে পৌঁছে যাবে রানা। কাজ শুরু করতে হবে সাপ্লাই স্টেশন থেকে।

এ মুহূর্তে প্রথম কাজ হচ্ছে টিকটিকিটাকে খসানো। সেজন্যে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হলো না, কুডবেকের কাছে অলিগলির অন্ত নেই।

ওখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সাপ্লাই স্টেশনের দিকে রওনা দিল ও। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা পাহাড়ের ওপর স্টেশনটা। চারপাশে তারের বেড়া। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ওপর দিকে কিছুটা উঠে এল রানা। ওভারহেড লাইনগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে অনুসরণ করতে হবে।

সঙ্গে খাবার নিয়ে নেয়া দরকার। নেমে এল রানা। শহর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট আর পানির বোতল নিয়ে যাত্রা শুরু করল আবার।

পাহাড়ে উঠতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। মাটি আলগা, খসে খসে পড়ছে। তা ছাড়া খাবার আর পানীয়ের ব্যাগটাও কঠিন করে দিচ্ছে কাজটা। ঘণ্টাখানেক বাদে বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থামল ও। খেয়েও নিল সেই ফাঁকে। তারপর পূর্ণোদ্যমে যাত্রা শুরু করল। লাইনগুলোর ওপর দৃষ্টি রেখেছে ও। একটা পরিত্যক্ত খনি চোখে পড়ল। ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। গাছপালার ভেতর দিয়ে চাইল রানা। বুঝল, অভিযান শেষ। পাওয়ার স্টেশনের লাইনগুলো থেকে দুটো ভারী কেবল চলে গেছে পাহাড়ের ঢালে। জায়গাটা গাছপালা দিয়ে ছাওয়া। উঁচু একটা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে নীচে।

বিল্ডিংটার এক প্রান্তে চৌকো একটা টাওয়ার। কেবল দুটো ওখানেই পৌঁছেছে। এরকম বিল্ডিং আগেও দেখেছে রানা। ফলে অনুমানে বুঝতে পারল ওটা একটা হাই ভোল্টেজ ল্যাবোরেটরি। কাছ থেকে দেখা দরকার। কিন্তু প্রতিবন্ধক হচ্ছে তারের বেড়া। একটা মরা পাখিকে তারে লটকে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল রানা। বেড়াটা ইলেকট্রিফায়েড। এখন বিদ্যুৎ চালু আছে কিনা জানার জন্যে হাত থেকে ঘড়িটা খুলল ও। সামান্য দূরে পড়ে থাকা একটা ডাল কুড়িয়ে নিল। ওটার মাথাটা গুলতির মত। ওখানটাতে ঘড়িটা আটকে তারে ছোঁয়াল ও। কিছুই ঘটল না। কারেন্ট অফ। পরমুহূর্তে বেড়ার ওপাশে পৌঁছে গেল রানা।

গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তা। বিল্ডিংটার নীচের দিকে সহজেই চলে এল রানা, কেউ দেখতে পায়নি। দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে একটা জানালার নীচে চলে এল ও। চাইল ভেতরে। নানা রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রয়েছে ঘরটিতে। ল্যাবোরেটরির ভেতরে ঢোকার পথ যখন খুঁজছে তখন নীচে উপত্যকার কাছে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল রানা। গাড়িটা থেমেছে। এবার দেয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিল ও। অপেক্ষা করছে।

খানিকক্ষণ পরেই ইলেকট্রিক বেল বেজে উঠতে শুনল। মাথাটা সাবধানে তুলল রানা। এক লোক ঘরে ঢুকে দরজাটা ধরে রেখেছে। আরেকজনও ঢুকল এবার। তার আগেই মাথা নামিয়েছে রানা, তবে আন্দাজ করতে পেরেছে দ্বিতীয়জন কে হতে পারে। কাউণ্টেস ক্যারেনিনা।

লোকটা কথা বলছে, তার কণ্ঠের মাধুর্যে ইক্সানিয়ার ভজকট ভাষাও চমৎকার শোনাচ্ছে। মাথাটা সামান্য তুলল রানা, লোকটিকে দেখার জন্যে।

খাট, সরু কাঁধের লোকটির বড়সড় মাথাটায় পাতলা কালো চুল। চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি। পরনে সাদা ডাস্ট কোট। এ লোকই খুব সম্ভব ভিজিল।

কাউন্টেস এ মুহূর্তে ফরাসি ভাষায় কথা বলছে। কারণ, একজন শ্রমিক ঢুকেছে ঘরে, রানার সুবিধেই হলো তাতে।

‘আরও সতর্ক থাকবেন,’ বলছে কাউণ্টেস। অপেরা চলার সময় লাইট চলে গেলে কেলেঙ্কারী হয়ে যেত। প্রেসিডেন্ট অবশ্য বলেছে তদন্ত কমিটি করবে।’

‘ওই গর্দভটার কথা ছাড়ুন,’ হেসে বলল ভিজিল, ‘কিন্তু আমার কী করার আছে? কাজের সুযোগ পাচ্ছি মাত্র চার ঘণ্টা; রাত একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। তাতে কিছু হয় নাকি? প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে-দেরি হচ্ছে।’

‘উপায় নেই। ধৈর্য থাকতে চাইছে না আমাদেরও, কিন্তু কী করবেন বলুন। আপনি সাধ্যমত চেষ্টা করে যান। শুনুন, রাত একটার আগে আপনি পাওয়ার ব্যবহার করতে পারবেন না। এটা আমার অর্ডার। গত রাতে পৌনে বারোটায় কাজ শুরু করেছিলেন। দেখলেনই তো কী ফল হলো।’

‘আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি, ম্যাডাম? আমি অত সময় বেঁধে কাজ করতে পারব না।’

কাউণ্টেস খানিকটা নরম হলো।

‘রাগ করছেন কেন? ফ্যাক্টরির সঙ্গে কথাবার্তা সব পাকা। ইংল্যাণ্ড থেকে শীঘ্রিই মেশিনারি চলে আসছে। এবার আপনার খবর বলুন।’

‘প্রগ্রেস হচ্ছে। শীঘ্রিই ইউরোপকে উড়িয়ে দেয়ার মত প্রয়োজনীয় মার্শানাইট তৈরি হয়ে যাবে।’

‘মার্শানাইট মানে?’

হাসল ভিজিল।

‘মার্শানাইট আমার গোপন অস্ত্রের নাম। আমার স্ত্রীর নাম থেকে নিয়েছি। সারা দুনিয়ার লোক আমাদের দু’জনের নাম জানবে। শক্তি আর সৌন্দর্য হাতে হাত রেখে দুনিয়া জয় করবে।’

‘ভাল।’ প্রসঙ্গ পাল্টাল কাউন্টেস, ‘মিস্টার ভিজিল, ডক্টর পাশা আর গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের লোকটা একসঙ্গে জুটেছে। ওদের ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না। ‘

‘কেন, ক্ষতির সম্ভাবনা আছে নাকি?’ ভিজিলের কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘মনে হয় না। ওদেরকে নজরে রাখা হচ্ছে। তা ছাড়া মিনস্কির সাহায্য এখন পাবে কোথায়? ওকে ছাড়া এক পা-ও আগে বাড়তে পারবে না। আপনি আর আমি ছাড়া ওদের ইনফর্মেশন জোগাড় করার আর কোন পথ নেই।’

‘পাশাটা গর্দভ। তবে আমার লাইনে কাজ করে যাচ্ছে সে-ও। ম্যানুফ্যাকচারিং ইনস্ট্রাকশন ওর হাতে পড়লে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আপনি ঠিক জানেন তো, মিনস্কির কপিটা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে?’

‘আমি নিশ্চিত।’

‘তবে ওরা এখনও এখানে রয়েছে কেন?’

‘রবিন্স লোকটা সহজে হাল ছাড়ে না। জোভোগোরোডে ওর বেশ ক’জন এজেন্ট আছে। প্রতিদিনই রিপোর্ট করে তারা। প্রেসিডেন্টের এক কর্মচারীকে ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করছে ও।

‘কে সে?’

‘চেঙ্কো। একসময় আমার সেক্রেটারি ছিল। ও অবশ্য কিছুই জানে না। আমি বাধা দিচ্ছি না রবিন্সকে। ও ভুল লোকের পিছে ছুটে সময় নষ্ট করলে আমাদেরই সুবিধা। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। নিশ্চিন্তে কাজ করে যান।

আবার ইক্সানিয়ান ভাষায় ফিরে গেছে ওরা। রানা বুঝল আর অপেক্ষা করা বৃথা। জানার আর তেমন কিছু নেই। নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের আড়াল নিতে এগোল ও।

রানার মনের ধোঁয়াটে ভাবটা কেটে গেছে। অনুভব করছে, কাজ শুরু করতে পারবে।

বেড়ার কাছে চলে এল ও। সহজেই টপকে নেমে এসে ফিরতি পথ ধরল। কয়েক গজ এগিয়েছে এমন সময় সামনে কীসের যেন শব্দ শুনতে পেল। পাখি হতে পারে, তবে সাবধানের মার নেই।

হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে রানা। সতর্ক। ঝরা পাতা বা আলগা নুড়িতে যাতে পা না পড়ে সেজন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। পেছনে হঠাৎ পায়ের শব্দ। চরকির মত ঘুরল রানা। আক্রমণকারী ঘুসি ছুঁড়েছে। কিন্তু লাগাতে না পারায় টলে গেছে। সে সুযোগটাই নিল রানা। প্রচণ্ড ঘুসিতে ছিটকে পড়ল লোকটা, ঝোপের ওপর। তারপর স্থির। পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে।

দৌড়বে কিনা ভাবল রানা। কিন্তু দৌড়লে আলগা নুড়িতে শব্দ হবে। তাতে ল্যাবোরেটরির লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। তা ছাড়া, আক্রমণকারীর চেহারাটাও দেখা দরকার। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল রানা। ল্যাবোরেটরিতে কোন সাড়াশব্দ নেই। ঝোপের ডাল-পাতা সরিয়ে ভাল করে চাইল রানা।

লোকটার গাল আর কপাল কেটে রক্তের সরু একটা ধারা সৃষ্টি হয়েছে। আহত লোকটা হেনরি লিনফোর্ড, ট্রিবিউন পত্রিকার প্রতিনিধি।