মারণাস্ত্র – ৭

সাত

এপ্ৰিল তেইশ-মে আট

তিনটে উপত্যকার মাঝখানে জোভোগোরোড শহরটা। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ঠাণ্ডা কমই এখানে। ইক্সানিয়া মোটামুটি সচ্ছল দেশ।

হোটেল কণ্টিনেন্টালে উঠেছে রানারা। খাওয়ার সময় কথা হয় রবিন্সের সঙ্গে, অন্য সময় তার দেখা পাওয়া ভার। এ হোটেলটা রবিন্সের বেছে নেয়ার কারণ রয়েছে। শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে এটার অবস্থান। সেরা ঘরগুলো নিয়ে রাজার হালে নিজেকে রেখেছে রবিন্স। রানা অবশ্য সাধারণ মানের একটা বেডরূম পেয়েছে, করিডরের উল্টো দিকটাতে।

পৌঁছেই রানাকে জানিয়ে দিয়েছে রবিন্স, চট করে তাকে দরকার পড়বে না। ফলে রানা এখন ঝাড়া হাত-পা।

রবিন্সের সীটিং রূমে ইতোমধ্যেই সন্দেহজনক বেশ কিছু লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। রানার ধারণা, এরা গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের স্থানীয় এজেণ্ট।

রানার হাতে এখন সময় আছে। ফলে ক্যামেরা নিয়ে শহর ঘুরে বেড়ায় সে। ইচ্ছে হলে ছবি তোলে দু’একটা। আসলে পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে জেনে নেয়ার চেষ্টা করছে। বেশির ভাগ সময় কাটে তার কুডবেকের একটা ক্যাফেতে। একটা ইক্সানিয়ান-ফ্রেঞ্চ ডিকশনারির সাহায্যে জোভোগোরোডের নামকরা দৈনিকগুলো পড়ার চেষ্টা করে ও।

জোভোগোরোডে পৌঁছনোর দু’সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ‘ইয়াং ওয়ার্কার্স পার্টি’ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল। তবে পুলিশী তৎপরতার কারণে তাদের কর্মসূচী সফল হয়নি।

পনেরোতম দিনে ক্যাফেতে বসে-বসে বিরক্ত বোধ করছিল রানা। এখন পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেনি সে, পারবে এমন আশাও করতে পারছে না। ভিজিলের ল্যাবোরেটরি কোথায় জানা সম্ভব হয়নি এখনও।

ঠিক এ সময় কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাকল। ঘাড় ফিরিয়ে ট্রেনের সেই আমেরিকানটিকে দেখতে পেল ও।

‘চিনেছেন? আমি লিনফোর্ড-হেনরি লিনফোর্ড। ট্রিবিউন পত্রিকার রিপোর্টার,’ চেয়ারে বসে পড়ে বলল ও।

‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল লিনফোর্ড।

‘মিনস্কির ব্যাপারে খুব কৌতূহল বোধ করছি,’ বলল লিনফোর্ড। ‘চেনেন তাকে?’

মাথা নাড়ল রানা। লিনফোর্ড সিগারেট রোল করল।

ড্রিঙ্ক চলে এল। রানার জন্যে কফি।

‘কাউণ্টেস ক্যারেনিনাকে চেনেন নাকি?’ প্রশ্ন ছুঁড়ল লিনফোর্ড।

কফিতে চুমুক দিল রানা। ‘চেনা তো দূরের কথা, নামও শুনিনি।’

‘প্যারিস পেরনোর পর কথা বলতে দেখেছি আপনাদের।’

‘তাই নাকি? ট্রেনে তো কত মানুষের সঙ্গেই পরিচয় হয়, হয় না?’

হাসল লিনফোর্ড।

তা হয়, ডক্টর। এখানে ছুটি কাটাতে এসেছেন বোধহয়?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী কাণ্ড দেখুন দেখি,’ অসহিষ্ণু গলায় বলল সাংবাদিক। ‘এখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই খবর। মারা পড়ল মিনস্কি। সরকার খুনীদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন নিতে পারল না। আরও একটা খবর আছে। আর্মস কোম্পানির এক বস্-হ্যামণ্ড রবিন্স নাম, লোকাল বন্দুকবাজদের সঙ্গে হোটেলে মীটিং করছে। আর সেই রবিন্সকে সহায়তা করছেন বিখ্যাত এক বিজ্ঞানী। কিন্তু কেন?’

‘আর কী জানেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘এর বেশি কিছু না,’ দ্রুত জবাব এল।

নিজের অবস্থানটা একবার ভেবে নিল রানা। ইনফর্মেশন আছে লিনফোর্ডের কাছে, কাজে লাগবে ওকে। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না।

‘আরেকটা ড্রিঙ্ক নেবেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। সায় জানাল লিনফোর্ড।

‘এখন বলুন,’ ভারী গলায় বলল রানা। ‘কী জানতে চান?’

ঝুঁকে পড়ল লিনফোর্ড।

‘প্রথম কথা হচ্ছে,’ ফস করে বলে ফেলল লিনফোর্ড। ‘মিনস্কিকে মারা হলো কেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন: গানস অ্যাণ্ড ব্লিস জোভোগোরোডে কী চায়?’

‘প্রথমটার উত্তর দিতে পারব না। কারণ, উত্তরটা আমি নিজেও জানি না। দ্বিতীয়টার জবাব দিচ্ছি। তবে কথাটা গোপন রাখতে হবে কিন্তু। গানস অ্যাণ্ড ব্লিস ইক্সানিয়ার গভর্নমেন্টের কাছে আর্মি গান বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে আমি ওদের উপদেষ্টা।’

কঠিন হলো লিনফোর্ডের দৃষ্টি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক তাড়া কাগজ বার করল সে। বেছে নিল একটি।

‘আপনার রেকর্ড, ডক্টর,’ ছোট্ট করে বলল লিনফোর্ড। ‘সপ্তাহখানেক আগে নিউ ইয়র্ক থেকে আনিয়েছি।’

ডক্টর পাশার কাজ এবং লেখালেখির রেকর্ড দেখিয়ে দিল সে।

‘নিউক্লিয়ার, ডক্টর, নিউক্লিয়ার।’

হেসে ফেলল রানা। ‘আপনি নাছোড়বান্দা লোক দেখছি।’

‘ঠিকই বলেছেন। নাছোড়বান্দা না হলে রিপোর্টারদের ভাত নেই। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের আর্মি গান উপদেষ্টা হচ্ছেন মেজর জেনারেল কেনেথ রবসন-আপনি নন।’

‘আপনি আসলে ভুল করছেন…’

উঠে পড়ল লিনফোর্ড। কণ্ঠে রাগ।

‘সত্য গোপন থাকে না, ডক্টর। আমাকে বোকা বানানো অত সহজ নয়। আবার দেখা হবে। আসি।’

ঘুরে হেঁটে চলে গেল সে।

রানা যখন ফিরল তখন ডিনার সারছে রবিন্স। খোশ মেজাজে রয়েছে সে। জানাল, শীঘ্রিই রানার সাহায্য দরকার পড়বে।

‘বেশ কিছু লোকের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে,’ বলল রবিন্স। ‘কাজের লোক। দু’তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে; তারপরই বোঝা যাবে কাজ কদ্দূর এগিয়েছে।’

সে-সন্ধ্যায় রানাকে অপেরায় আমন্ত্রণ জানাল রবিন্স। ট্যাক্সিতে করে অপেরায় রওনা হওয়ার মুহূর্তে ড্রাইভারকে স্টার্ট বন্ধ করতে বলল রবিন্স। রানার দিকে ফিরল।

‘বডিগার্ড’-রাও আসুক আমাদের সঙ্গে, কী বলেন?’

মৃদু হেসে ফুটপাতের দিকে ইশারা করল ও। দু’জন লোক মরিয়া হয়ে একটা ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করছে।

‘কাউণ্টেস কোন ঝুঁকি নিতে রাজি না। ফেউ লাগিয়ে দিয়েছে পেছনে।’

বডিগার্ড দু’জন ট্যাক্সিতে চাপলে ড্রাইভারের উদ্দেশে মাথা নাড়ল রবিন্স। চালু হলো গাড়ি।

ওরা পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই প্রথম অঙ্ক শেষ হলো। বিরতির সময় কাউণ্টেস ক্যারেনিনার দিকে ভ্রূ উঁচিয়ে দেখাল রবিন্স। আবারও মুগ্ধ হলো রানা। অনেকে কাউণ্টেসের বক্সে গিয়ে দেখা করছে, কথা বলে আসছে। মিনস্কির খুনের সঙ্গে এই সুন্দরী মহিলাকে মন থেকে কিছুতেই জড়াতে পারছে না রানা।

অপেরা শেষে গায়ক-গায়িকারা মঞ্চে এল। তাদেরকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে দর্শকরা। হাততালির শব্দ মিলিয়ে গেলে হাত তুলল কণ্ডাকটর। ড্রামে বাড়ি পড়ল। দাঁড়িয়ে গেল দর্শকবৃন্দ। __নিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে শোনানো হচ্ছে। ঠিক সে মুহূর্তে অপেরা হাউসের প্রতিটা বাতি দু’এক সেকেণ্ডের জন্যে কেঁপে উঠল। আলো বেড়ে গেছে। তারপর গাঢ় অন্ধকার। লোডশেডিং।